অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৩৩.
গোধূলি লগ্ন। উত্তর থেকে ভেসে আসছে ঠান্ডা শীতল হাওয়া। লালচে রঙে সেজে উঠেছে চারপাশ। গুলশান লেকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। বরাবরের মতোই কালো হুডিটা দিয়ে মুখের অর্ধেকটা ঢাকা তার। হাতে একটা ছু-রি। র-ক্তের দাগ শুকিয়ে বেশ বিভৎস দেখাচ্ছে সেটা। একহাত দিয়ে ছু-রির বাট ধরে অপর হাতে ধা-রাল অংশটা রাখল সে। দেখল খুব মনোযোগ দিয়ে। এই ছু-রিটা দিয়েই গতরাতে পলাশ মীর্জাকে নিষ্ঠুরভাবে খু-ন করেছিল সে। পলাশের শরীরের প্রতিটা অঙ্গে প্রবেশ করেছে এই ছু-রির ধার। তারই র-ক্ত লেগে আছে এখানে। শুধুই কী তার? কথাটা ভাবতেই ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি ফুটল যুবকের। হিংস্রতা, ক্ষোভ, কষ্ট, আফসোস সব মিলেমিশে অদ্ভুত হাসি।
যুবত আলতো করে হাত বুলালো ছু-রিটায়। লেকের পানির দিকে আলতো করে বাড়িয়ে দিল নিজের ছুরিধরা হাতটা। খুব সযত্নে লেকের পানিতে বিসর্জন দিল মাঝারি গড়নের র-ক্তা-ক্ত অস্ত্রটা। পানিতে পরে নিজস্ব গতিতে তলিয়ে গেল সেই ধাতব বস্তু। পানিতে যতক্ষণ আলোড়ন চলল, ঠিক ততক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল যুবক। আনমনেই বলল, ‘বলেছিলাম না, র-ক্তের প্রতিটা ফোটার দাম নেব।’
হঠাৎই যেন ফিরে এলো অন্য জগত থেকে। পকেট থেকে বের করল একটা সেলফোন। ডায়াল করল এক নাম্বারে। কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই বলল, ‘মীর্জার ছেলের ঠিকানা চাই আমার। তুহিন আহমেদের আগে।’
বাড়তি আর কিছু বলল না যুবক। কেটে দিল কলটা। পলাশকে খু-ন করে বের হওয়া সহজ ছিল না। একবার সুইপার আরেকবার বৃদ্ধলোকের ছদ্মবেশে সিঁড়ির মাঝের জায়গাটায় অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ওকে। চাবি তৈরীর ব্যপারটা আরেক রহস্য। তুহিন আহমেদ গোটা ব্যপারটা মেলাতে মেলাতে নিজের পরবর্তী টার্গেটের কাছে পৌঁছে যাবে সে।
–
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। এখনো ওভাবেই বসে আছে তুহিন। সেই একইকথা ভেবে চলেছে নিরন্তর। সবরকমভাবে, সবরকম সম্ভাবনা দিয়ে চিন্তা করে দেখেছে বিষয়গুলো। কিন্তু সব মিলে ঐ একটাই জিনিস হচ্ছে। জগাখিচুড়ি।
হঠাৎ ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল তুহিনের। যথেষ্ট হয়েছে। আপাতত ও খু-নিকে নিয়ে ভাববেই না। গিরগিটির চেয়েও দ্রুত গতিতে চেহারা বদলাচ্ছে সে। আদোও খু-নি একজন লোক কি-না; হলেও সে কোথায় আছে কিছুই জানেনা। সৌভাগ্যক্রমে খুনের প্যাটার্ন আর ভিকটিম দেখে পরবর্তী টার্গেট কে হবে সেটা বুঝে গেছে। সুতরাং এখন অন্য রাস্তায় এগোতে হবে ওকে। ডালপালা একটু বেশিই ছড়িয়ে যাওয়ার পর কেসটা এসছে তুহিনের হাতে। তাই একসঙ্গে বাগে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। কিন্তু শেকড়? শেকড় বাবাজির যাওয়ার জায়গার বড় অভাব। সুতরাং শেকড় ধরে তুলতে হবে ওকে এখন। সকলের কাছে নিশ্চয়ই অনর্থক সময় বলে মনে হবে ব্যপারটা। কিন্তু আর কোনো রাস্তা নেই।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল তুহিন। চমকে উঠল তমাল। একটু আগে এসেছিল নতুন খবর নিয়ে। হোটেলের সেই নকল লোকটা এতো নিখুঁত জাল ইনফরমেশনগুলো কোথা থেকে তৈরী হয়েছে; সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে লাগিয়ে দিয়েছে কিছু গোপন লোক। ঢাকা আর চট্টগ্রামে কারা এধরণের জিনিস বানায় তার একটা লিস্ট আছে ওদের কাছে। প্রত্যেককে ধরে খোঁজ করা হবে। কিন্তু এ সম্পর্কে তুহিনের কাছ থেকে কোনরকম উত্তর বা মতামত না পেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ওখানেই।
তুহিন মিনিট দুই পায়চারি করে আবার ফিরে এলো চেয়ারের কাছে। গা ছেড়ে বেশ আরাম করে বসল। আঙ্গুলের ইশারায় বসতে বলল তমালকে। খানিকটা ইতস্তত করে বসে পড়ল তমাল। তুহিন তমালের দিকে না তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে বলল, ‘প্রায় দুই বছর আগে রাশেদ আমের একটা প্রজেক্টে হাত দিয়েছিল। সেই প্রজেক্টটা হতে পারে ড্রা-গসের, মানি লন্ড্রিংয়ের কিংবা বৈদেশিক অ-স্ত্রশস্ত্রের। তাইতো?’
‘ জি স্যার।’
‘ কিন্তু সেই প্রজেক্ট শুরু হওয়ার আগে ভারত থেকে আসছিল একটা পেনড্রাইভ। বর্ডার ক্রস করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিনিয়ে নেওয়া হল ওটা। কারা নিল?’
তমালের উত্তরে অপেক্ষা করল না তুহিন। নিজেই বলে চলল, ‘ব্লাক হোল বা ডার্ক নাইট। পথেও সম্ভবত অপর এক দল অ্যাটাক করেছিল রুদ্রর ওপর। অর্থাৎ দুটো দলই ভীষণভাবে চাইছিল প্রজেক্টটা বন্ধ করতে কিংবা হাতাতে। আর তারজন্যে তারা এতোটাই ডেসপারেট ছিল যে পেনড্রাইভটা কখন, কীভাবে কোথা থেকে আসছে সেসব তথ্য জোগাড়ের জন্যে কিনে নিয়েছিল বা বলা যায় পাঠিয়েছিল সোলার সিস্টেমের কিছু লোক। যেমন সবুজ, খোকন, স্বপন এবং তপু। ভয়ানক রিস্ক নিয়েছিল ব্লাক হোল। কিন্তু কেন? কী এমন করতে চাইছিলেন রাশেদ আমের?’
প্রশ্নটা করে নিজের মনেই চমকে উঠল তুহিন। রাশেদ আমের আসলে করতো কী? আমের ফাউন্ডেশনের ফাইল ঘেটে কিংবা আমের ভিলার বৈঠক ঘরেও এমন কিছুই পেলোনা যার দ্বারা ব্যপারটা পরিস্কার বোঝা যায়। মানি লন্ড্রিং, ড্রা-গস ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসার বড়বড় র্যাকেট ছিল তার। এমনটাই সন্দেহ ছিল পুলিশ, প্রশাসনের। কিন্তু কোন প্রমাণ ছিলোনা। এমনটাও অভিযোগ আছে ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একপ্রকার জুলুম করে টাকা আদায় করতো সে। কিন্তু কেন? কী হতো সেসব দিয়ে। এতো ডোনেশনের যা কাগজ দেখল। ওগুলো সব অরিজিনাল? ডার্ক নাইট বা ব্লাক হোলের সাথে শত্রুতার মূল কারণ কী ছিল। চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অসৎ ব্যবসা ইত্যাদির জন্যে কুখ্যাত দুটি দল হলো ডার্ক নাইট আর ব্লাক হোল। সেখানে সোলার সিস্টেম কী এমন করতো যা উভয়ের পক্ষে ভারী হয়ে পরেছিল? প্রশ্নগুলো মনেই রাখল তুহিন। এদিকে তমাল কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘আর ব্লাক হোল আর ডার্ক নাইটওতো পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল। হঠাৎ এক হলো কীকরে?’
হাসল তুহিন। বলল, ‘সহজ ব্যপার। শত্রুর শত্রু, পরম মিত্র। যখন দুটো দলের লক্ষ্যই এক ও অভিন্ন ছিল এবং একা রাশেদ আমেরকে টলানো অসম্ভব ছিল, তখন একসঙ্গে কাজ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে ঐ চারজনকে রুদ্র আর রাশেদ আমের শেষ করে দিয়েছিল। তাহলে পেনড্রাইভটা আনার পরে ওদের দলের গোপন খবরগুলো বের হচ্ছিল কীকরে? যেমন, রুদ্র কখন চট্টগ্রাম যাচ্ছে, কীভাবে যাচ্ছে, কোথায় উঠছে। আর এই প্রজেক্টটা সম্পূর্ণ না হওয়ার কারণ এটাই। অভ্যন্তরীণ সব খবর বেরিয়ে যাচ্ছিল। সোলার সিস্টেমের প্রতিটা পদক্ষেপ আগেই জেনে যাচ্ছিল বাকি দুই দল। শেষদিকে ওদের সব পরিকল্পনাই জানা থাকতো বাকি দু দলের। সুতরাং একশনের আগেই তৈরী থাকতো রিঅ্যাকশন। সুতরাং গোড়া থেকে উপরে ফেলতে বেশি কষ্ট হয়নি।’
বিস্মিত দৃষ্টিতে তুহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তমাল। ঘোর লাগা কন্ঠে বলল, ‘রাশেদ আমের আর রুদ্র থাকতেও এটা সম্ভব হল?’
‘ হয়েছে। ওরাও মানুষ ছিল তমাল। আর ভুল মানুষ করবেই। মারাত্মক কিছু একটা হয়েছিল; কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছেনা। কেউ বুঝতেই পারছেনা।’
তমাল আবার কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ভাবতে বসল। হঠাৎই বিস্ফোরিত চোখে তাকাল তুহিনের দিকে। প্রায় আটকে যাওয়া গলায় বলল, ‘ বিশ্বাসঘাতকতা!’
‘ নিঃসন্দেহে।’ নির্বিকারভাবে বলল তুহিন। ‘এটাই একমাত্র কারণ। আর এবার আমার লক্ষ্য এটা খুঁজে বের করা যে কাজটা কে করেছে।’
ভ্রু কুঁচকে ফেলল তমাল। হঠাৎ এমন কথা শুনবে বলে আশা করেনি। অবাক কন্ঠে বলল, ‘ কিন্তু স্যার, এটাতো আপনার কেইস না।’
‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটাই আমার কেইস। একমাত্র এই রাস্তায় হেঁটেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।’
‘ কাকে সন্দেহ হচ্ছে আপনার?’
‘ সবাইকে।’ নির্বিকারভাবে বলল তুহিন। ‘এমন অবস্থায় কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখা যায়না। তবে সে এমন কেউ যে দলের প্রত্যেকটা গোপন মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতো, সব কথা শুনতো, সব প্লান জানতো। অর্থাৎ গ্রুপের প্রধান এবং বিশ্বস্ত লোকের মধ্যেই কেউ।’
‘এমনতো অনেকেই আছে?’
‘ না। অনেকে নেই। রাশেদ আমের ছাড়া আমের ফাউন্ডেশনের উল্লেখযোগ্য নাম ছিল রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর আমের, ইকবাল। বাকিদের কাজ ভাগ করে দেওয়া থাকলেও এই পাঁচজন দলের সবকিছু জানতো। এ টু জেট। এই পাঁচজনের কোন একজন অনুপস্থিত থাকলে কোন মিটিং বা প্লান করা হতোনা। আমার সংগ্রহ করা তথ্য সেটাই বলছে। অর্থাৎ ঘাপলা ঐ পাঁচজনের মধ্যেই ছিল। রুদ্রকে সন্দেহের বাইরে রেখে দেওয়া যায়। কারণ রাশেদের পর সবকিছু ওরই হতো। এমনিতেও সোলার সিস্টেমের লিডার রাশেদ আমের হলেও রুদ্রর দাপট কোন অংশে কম ছিল না।
তমাল এবার নিজে একটু ভাবল। চিবুক চুলকে বলল, ‘আমার তাহলে মনে হচ্ছে জাফর নয়তো ইকবাল।’
এতক্ষণে চোখ খুলে তাকাল তুহিন। তমালের দিকে তাকিয়ে ডান পাশের ভ্রুটা উঁচু করে বলল, ‘ উচ্ছ্বাস কেন নয়?’
হকচকিয়ে গেল তমাল। একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল, ‘আসলে যতটা শুনেছি ওর পক্ষে রাশেদ বা রুদ্রর ক্ষতি করা সম্ভব? ছেলেটাকে তো ভালো_’
তমালকে থামিয়ে দিল তুহিন। নিষ্ঠুর কন্ঠে বলল, ‘মানুষের সাথে বছরের পর বছর কাটানোর পরেও আসল চেহারা চেনা যায়না তমাল। আর তুমি কিছু রিপোর্ট আর ইন্সপেক্টরের আবেগমাখা কয়েকটা লাইন শুনেই ধরে নিলে ও বিট্রে করতে পারেনা! ভুলে যেওনা ও রাশেদ আমেরের রাস্তা থেকে তুলে আনা একটা গুটি মাত্র। পেছন থেকে ছু-রি মারলে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
তমাল ভাবল কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। যা কিছু হতে পারে। ‘কিন্তু কারণটা কী হতে পারে, স্যার?’
আবার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল তুহিন বলল, ‘কাউকে বিট্রে করার জন্যে অনেক কারণ থাকতে পারে। ক্ষমতা, সম্পত্তি, প্রতিশোধ, লোভ। উচ্ছ্বাস, জাফর বা ইকবাল তিনজনের কাছে এই কারণগুলো থাকা অসম্ভব কিছু না। জাফরের নিজের বড় ভাইয়ের ক্ষমতা আর সম্পত্তি দখলের বাসনা জাগতেই পারে। ইকবালের মনে দলীয় কোন কারণে একপাক্ষিক বিদ্বেষ জন্মাতেই পারে, তারসাথে পকেটে পরতে পারে অন্য দলের দেওয়া মোটা অঙ্কের কিছু টাকা। উচ্ছ্বাসের মনে হতেই পারে সে দলের প্রয়োজনে ব্যবহার করা একটা সামান্য গুটি মাত্র। রাজা, রাজপুত্র, মন্ত্রীদের মধ্যে সে কেবলই এক অনুগত সেনপতি। এগুলোর মধ্যে কোনটা অসম্ভব তমাল?’
খুব মনোযোগ দিয়ে তুহিনের কথাগুলো শুনছিল তমাল। তুহিনের প্রশ্ন শুনে মাথা ঝাকিয়ে বলল, ‘সবই সম্ভব স্যার।’
ফোন বেজে উঠল তুহিনের। ইরা ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে নিজের কন্ঠস্বর যথাসম্ভব ক্লান্ত করার চেষ্টা করে তুহিন বলল, ‘হ্যালো?’
‘ কোথায় আছো?’ ইরার মিষ্টি কন্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
‘ অফিসে এখনো।’
‘ লাঞ্চ করেছিলে?’
‘ হুম। তুমি?
‘ করেছি। সাথে কে কে আছে?’
ইরার কন্ঠে হালকা ঝাঝ টের পেয়ে হেসে ফেলল তুহিন। বলল, ‘ফারিয়া নেই। তমাল আছে শুধু।’
‘ কে নেই জিজ্ঞেস করেছি আমি? ওও মেয়েটা নেই বলে খুব দুঃখ হচ্ছে বুঝি?’
হঠাৎ কৌতুক করার ইচ্ছে হলো তুহিনের। ব্যথিত কন্ঠে বলল, ‘ভীষণ! বুকটা ব্যথায় কেমন টনটন করছে।’
‘ মেরে ফেলব কিন্তু। ধ্যাত!’
বলে কলটা কেটে দিল ইরা। তুহিন হালকা শব্দ করে হাসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছু একটা ভাবল চুপচাপ। তারপর বলল, ‘কাউকে বিট্রে করার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমরা মিস করে গেছি তমাল।’
মুহূর্তেই কৌতূহলী হয়ে উঠল তমাল। সাগ্রহে বলল, ‘ কী স্যার?’
‘ হিংসা। যা নারী মনে ভয়ানকভাবে বাস করে।’
*
সকাল সাড়ে দশটা বেজে বিশ। গুলশানের রাস্তা দিয়ে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে তুহিন। কোন তাড়া নেই ওর। নিশ্চিন্ত মনে গুলশানের চকচকে রাস্তা আর দালানকোঠা দেখতে দেখতে এগোচ্ছে গাড়িটা। আজ একাই এসেছে সে। তমালকে শওকত মীর্জার ছেলে আর জাল ইনফরমেশনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। দুজন লোক লাগিয়েছে বর্তমানে আমের ভিলার বাকি সদস্যদের খোঁজ নেওয়ার জন্যে। মানুষগুলোতো সব ভোজবাজির মতো উড়ে যেতে পারেনা। কোথাও না কোথাওতো থাকবেই।
তুহিনও অফিসে বসে সময় অপচয় করেনি। চলে এসছে গুলশান। আমের ভিলার ভেতরের কিছু তথ্য সংগ্রহ প্রয়োজন ওর। কিন্তু কীভাবে জানবে। ইন্সপেক্টরের কাছে? কিন্তু উনিতো ততটুকুই বলতে পারবেন যতটুকু তদন্তের খাতিরে জানতে পেরেছেন। এমন কাউকে চাই যে ঐ বাড়ির ভেতরে ছিল। সবটা জানে। কিন্তু সবতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে একপ্রকার। এমন কাউকে কোথায় পাবে ও? কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে আরেকবার আমার ভিলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও। একাই যাবে। হোলস্টারে হাত দিয়ে একবার চেক করে নিল বেরেটার অবস্থান। এরপর গাড়ি ছোটালো আমের ভিলার উদ্দেশ্যে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল আমের ভিলার কাছে। কিন্তু গাড়িটা আমের ভিলার আশেপাশে নিলোনা তুহিন। অনেকটা দূরে পার্ক করে রেখে নেমে এলো। সহজ ভঙ্গিতে হেঁটে গেল ভিলার দিকে। স্বাভাবিকভাবে। যেন হেঁটে হেঁটে দেখছে এলাকাটা। আমের ভিলার গেইটের কাছে চারপাশটা দেখতে গিয়ে চমকে উঠল তুহিন। সেদিনের সেই পাগল মহিলাটা। গেইটের সামনে বসে আছে। পরনে সেই ময়লা শাড়ি, কালো ছেড়া ব্লাউজ। এলোমেলো চুল। সেদিনের মতো অশান্ত মনে হচ্ছেনা মহিলাকে। বেশ শান্ত আজ। পাত্তা না দিয়ে তালা খুলতে যাচ্ছিল তুহিন।
তখনই ঝট করে তাকাল মহিলা ওর দিকে। তুহিন ভাবল সেরেছে! এইনা আবার চেঁচিয়ে পিলে চমকে দেয়। মনে মনে সে পরিস্থিতির জন্যে তৈরী করে নিল নিজেকে। কিন্তু সেদিনের মতো চেঁচিয়ে উঠল না মহিলা। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘ কীরে! আবার এসছিস? তোকে না বলছি এই বাড়িতে বিষ আছে। চলে যা, নয়তো মরবি। ওগো মতোন তুইও ম’র’বি।’
তুহিন তালা নাড়তে নাড়তে মুচকি হেসে বলল, ‘ বিষের নেশা আছে আমার। মরতেও খুব একটা আপত্তি নেই। তা এ বাড়ির বিষটা কোথায় শুনি? বাতাসে, মাটিতে, খাবারে না দেয়ালে?’
হঠাৎ পিশাচিনীর মতো হেসে উঠল মহিলা। সেই হাসি শুনে তুহিনের মেরুদণ্ডের ভেতর কেমন শিরশির করে উঠল। হতবাক চোখে তাকাল মহিলার দিকে। মহিলা হাসতে হাসতে বলল, ‘ এই বিষ সেই বিষ না। মনের বিষ, মনের। অন্যবিষের তো ঔষধ হয়। মনে একবার বিষ ঢুকলে আর উপায় থাকেনা। মানুষও পশু হয়ে যায়। ঐ বিষ কেউ দেখে না। কিন্তু সব গিলে খায়। সব, সব।’
তুহিন স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মহিলার ঘোলাটে চোখের দিকে দিকে। চোখদুটো স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, কতো ভয়ানক নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়েছে সে।
*
অতীত –
মধ্যরাত। মেতে উঠেছে গুলশানের নামকরা বারটা। রঙিন আলোর মিছিলের সঙ্গে বার ডান্সারদের কোমরের একেকটা বাঁকে মজে উঠেছে পরিবেশ। একের পর এক হুইস্কির গ্লাস শেষ করছে রুদ্র। থামার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা বা লক্ষণ নেই। যেন অন্তকাল চালিয়ে যেতে পারবে এই প্রক্রিয়া। তীক্ষ্ণ চোখজোড়া কেমন লালচে হয়ে আছে ওর।
ভীড় ঠেলে বারের ভেতরে ঢুকল উচ্ছ্বাস। এতো ভীড়ে রুদ্রকে খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো ওকে। দেখা মাত্র স্বস্তির শ্বাস ফেলল। এগিয়ে গিয়ে বসল ওর পাশের চেয়ারে। চোখ ছোট ছোট করে গভীরভাবে দুমিনিট পর্যবেক্ষণ করল রুদ্রকে। রুদ্রর সেদিকে কোন মনোযোগ নেই। সব জাহান্নামে যাক; কিচ্ছু যায় আসে না ওর। কাঁপাকাঁপা হাতে আবার গ্লাস ভর্তি করল ও। মুখের কাছে নিতেই হাত ধরে ফেলল উচ্ছ্বাস। বলল, ‘এতোই যখন কষ্ট হচ্ছে তখন ছেড়ে দিলি কেন?’
রুদ্র পিটপিটে চোখে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘রুদ্র আমেরের কষ্ট হয়না।’
বলে আবার এক ঢোকে গ্লাসটা ফাঁকা করে ফেলল রুদ্র। উচ্ছ্বাস চোখের ইশারায় সেদিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘তাই? সেজন্যই বুঝি দেবদাসের মতো গ্লাসের পর গ্লাস ফাঁকা করছিস?’
‘ আমাকে নেশা করতে এই প্রথমবার দেখছিস?’ আরও একবার গ্লাস পূর্ণ করে বলল রুদ্র।
‘ না, কিন্তু রুদ্র আমেরকে নেশায় টালমাটাল হতে এই প্রথমবার দেখছি।’
হাসল রুদ্র। গ্লাসটা ফাঁকা করে উঠে দাঁড়াল। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিল। উচ্ছ্বাস ধরতে নিচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সামলে নিল নিজেকে। বলল, ‘চল।’
‘কোথায়?’ উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল উচ্ছ্বাস।
‘ বাড়িতে। ঘুম পাচ্ছে।’
হাত ভাজ করে রুদ্রর মুখে দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ ইদানিং কোন শয্যাসঙ্গিনীর প্রয়োজন হয়না দেখছি। একটা মেয়ে এসে মনের সাথে সাথে শরীরকেও নিজের বশবর্তী করে ফেলল না-কি? এতো একেবারে নাটকীয় ব্যপার-স্যাপার।’
উত্তর দিলোনা রুদ্র। টালমাটাল পায়ে বেরিয়ে এলো বার থেকে। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। নিজেও বেরিয়ে এলো রুদ্রর পেছন পেছন।
#চলবে…