অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৩৫.
মধ্যদুপুর। মাথার ওপর চড়াও হয়ে আছে তেজি সূর্য। চারদিকে রোদের আলো জ্বলজ্বল করছে। ভীষণ গরম পড়েছে আজ। হঠাৎই যেন কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেছে তাপমাত্রা। চৈত্রের আগমনের আভাস পেয়ে প্রকৃতি যেন তেঁতে উঠেছে। ছাদের রেলিং এর ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে রুদ্র। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। কপালে বিরক্তির ভ্রুকুটি। এক সপ্তাহ জরুরি কোন ব্যপার না ঘটলে সব কাজ থেকে দূরে থাকতে বলেছে রাশেদ ওকে। মাত্র এক সপ্তাহ সময় আছে হাতে। এরমধ্যে প্রিয়তাকে নিয়ে আসতে হবে আমের ভিলায়। শুধু নিয়ে আসলেই হবেনা, বিয়েও করতে হবে। কোন মানে হয় এসবের? কোনভাবেই রাশেদকে বোঝাতে পারেনি রুদ্র। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় সে। প্রিয়তাকে নিজের পুত্রবধু না করে দম নেবেন না উনি। এক্ষেত্রে রুদ্র অপারগ। তার ওপর প্রিয়তাকেও ফোনে পাচ্ছেনা। দীর্ঘ বারোদিন পর মেয়েটাকে কল করেছিল আজ। কিন্তু কিছুতেই কানেক্ট করতে পারলোনা। এই সব মিলিয়েই সকাল থেকে মেজাজ খারাপ করে বসে আছে। রাশেদের এরকম হঠকারী সিদ্ধান্তে বিরক্ত রুদ্র। পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে গেল সে? আগেতো এরকম ছিলেননা রাশেদ। হঠাৎ কী হলো?
রুদ্রের ভাবনার মাঝেই কোথা থেকে হাজির হল উচ্ছ্বাস। এসে বসল ওর পাশে। ঠোঁটে সিগারেট চেপে লাইটার বের করতে করতে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘কী ব্যাপার গুরু? এখনও এখানে? যাও যাও, প্রাণপ্রিয়াকে নিয়ে এসো। এক সপ্তাহের মধ্যেই দ্য রুদ্র আমেরের বিয়ে! ভাবা যায়! আমিতো আজ থেকেই সব এরেঞ্জমেন্ট শুরু করে দেব। ধুমধাম করে হবে সব। ইশ! আমার তো মারাত্মক হিংসে হচ্ছে। তুই বিয়ে করে বছর ঘুরতেই বাচ্চার বাপ হয়ে যাবি। আর আমি? সারাজীবন কাকা আর মামা ডাক শুনেই জীবন পার করব। নিজের ওপরই করুণা হচ্ছে আমার।’
‘চু্ঁ চুঁ’ আওয়াজ করে নিজের প্রতিই আফসোস প্রকাশ করল উচ্ছ্বাস। বিরক্তি বাড়লো রুদ্রর। ছোট্ট একটা টান দিলো সিগারেটে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বিতৃষ্ণায় ভরপুর কন্ঠে বলল, ‘ চুপ করবি, নাকি ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেব?’
‘ আজব তো! এতোদিন তো মেয়েটা ছিলোনা বলে দেবদাস হয়ে ঘুরছিলি। এখন মেয়েটাকে পাওয়ার সুযোগ পেয়েও করলার জুসের মতো মুখ করে রেখেছিস। সমস্যা কী?’
‘ সমস্যা কী তুই জানিস না?’
উচ্ছ্বাস কিছু বলল না। ধীরেসুস্থে সিগারেটটা জ্বালালো। প্রথম টান দিয়ে তৃপ্তি সহকারে ধোঁয়া ছাড়ল। এরপর কৌতুক ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘ রাশেদ বাবা বোঝেন কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। ওনার ওপর বিশ্বাস রাখ।’
রুদ্র কিছু বলল না। গম্ভীর মুখ করে বসে রইল। উচ্ছ্বাস আবার বলল, ‘ কখন যাচ্ছিস চট্টগ্রাম?’
‘ ভাবছি।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রুদ্র।
হেসে ফেলল উচ্ছ্বাস। সিগারেটে আরেক টান দিয়ে বলল, ‘তুই নিজেও জানিস তুই কী চাস। তোর দিকে আঙুল তোলার সাহস কারো হবেনা। সোলার সিস্টেমতো তোরই। সুতরাং মন যা চায়, সেটাই কর। সে অধিকার শুরু থেকেই আছে তোর।’
‘ এখন আমার চাওয়ার ওপর কিছু নির্ভর করছেনা। স্বয়ং রাশেদ আমেরের অর্ডার।’
কথাটা শুনে আবার হাসল উচ্ছ্বাস। কিছু বলল না। চাপা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। ওর আর নাজিফার সম্পর্কটাও যদি এতো সহজে পরিণতি পেতো! এমন আদেশ যদি ওকেও রাশেদ দিতো। খুব কী ক্ষতি হতো?
–
গোধূলি পেরিয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে চারপাশে। আজ আমের ভিলার বৈঠকঘরে কোন মিটিং বসেনি। গুলশানে নেই রুদ্র। বর্তমান আলোচনা গুলো ওকে ছাড়া করা সম্ভব নয়। তাই আজ আমের ফাউন্ডেশনের অফিসে বসেছেন রাশেদ আমের। সেই আমের ফাউন্ডেশন যার আড়ালে পরিচালিত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্রুপ। দ্য সোলার সিস্টেম।
নিজের কামরায় বসে আছেন রাশেদ। দরজার বাইরে দুজন সশস্ত্র প্রহরী। মনোযোগ দিয়ে ডায়েরিতে কিছু লিখছে সে। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। নিস্তব্ধ ঘরটাতে কলমের খসখস শব্দটাই শোনা যাচ্ছে কেবল। প্রায় দু মিনিট পর, কালো পোশাক পড়া একজন লোক ট্রেতে দু কাপ চা নিয়ে ঢুকলো। পেছন পেছন প্রবেশ করল জাফর। লোকটাকে হাতের ইশারায় চায়ের ট্রে টেবিলে রেখে চলে যেতে বলল জাফর। লোকটা তাই করল।
একটা চেয়ার টেনে বসল জাফর। আরও মিনিট খানেক খসখসে আওয়াজে লেখা শেষ করলেন রাশেদ। ডায়েরিটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলেন। চশমাটা খুলে রাখলেন টেবিলের নির্দিষ্ট জায়গায়। চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে বললেন, ‘কিছু বলবি?’
শিরদাঁড়া সোজা করে বসল জাফর। নিজেও চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বলল, ‘ সকাল থেকেই বলব বলব করে ছটফট করছি ভাইজান। কিন্তু কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।’
‘ যেভাবে এখন কথা বলছিস, সেভাবেই বলবি।’
‘ আসলে রুদ্রর ব্যপারে কথা বলার ছিল।’
‘ শুনছি।’
চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে গলা কিছুটা ভিজিয়ে নিল জাফর। নাকের নিচের ঘামটা মুছে দ্বিধাগ্রস্ত মনে বলল, ‘এরকম একটা মুহূর্তে রুদ্রের বিয়ের কথা না ভাবলেই হচ্ছিল না? মানে সামনে আমরা যা করতে চলেছি তাতে একাগ্রতা ভীষণ জরুরি। রুদ্রকে প্রতিদিন, প্রতি সেকেন্ড মৃ-ত্যুর পরোয়ানা কাঁধে নিয়ে চলতে হবে। সদা সতর্ক থাকতে হবে। এ অস্থায় এখনই বিয়ে_ মানে_ ‘
মনোযোগী শ্রোতার মতো জাফরের কথাগুলো শুনলেন রাশেদ। জাফর থেমে যেতেই নিজের কাপটা আবার টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ সেইজন্যই এখন ওর বিয়ে দেওয়াটা জরুরি হয়ে উঠেছে।’
রাশেদের কথায় ভ্রুকুটি করল জাফর। কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রাশেদ বললেন, ‘ তুই ভালো করেই জানিস, ছোটবেলা থেকে ওকে আমি অন্যরকমভাবে তৈরী করেছি। সমস্ত রকম শারীরিক, মানসিক কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তৈরী করেছি ওর মধ্যে। নিষ্ঠুর, বেপরোয়া, অদম্য রুদ্র আমের। আন্ডারওয়ার্ল্ডকে কাঁপিয়ে তোলার জন্যে যার নামটাই যথেষ্ট। একদিনে তৈরী হয়নি রুদ্র আমের। তিল তিল করে তৈরী করেছি আমি ওকে। বাপ থেকে জল্লাদও হয়েছি। এতোগুলো বছরের প্রতি মুহূর্ত, প্রতি সেকেন্ডের পরিশ্রমে একটু একটু করে তৈরী হয়েছে আজকের রুদ্র। এক অভেদ্য বলয়। আমার তৈরী করা সেই দুর্ভেদ্য বলয় ভেদ করে কেউ রুদ্রর মনে প্রবেশ করেছে। সেই অনুভূতির ধার কতটা সেটা আমি জানি। শরীর যদি ভবন হয় তো মন তার স্তম্ভ। মানসিকভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলে শরীরকে বেশিদিন দাঁড় করিয়ে রাখা যায়না। সেটা রুদ্র আমেরই হোক না কেন। যার নমুনা আমি দেখতে পেয়েছি এই বারোদিনে। সামান্য ভাটা পড়তে শুরু করেছে রুদ্রর চারিত্রিক শক্তিতে। এই মুহুর্তে সেটা সোলার সিস্টেমের জন্যে ভয়ানক। এবং রুদ্রর জন্যে আ-ত্ম’হ-ত্যা’র-ই নামান্তর। তাই যত দ্রুত সম্ভব রুদ্রর মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন ছিল।’
ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল জাফর। বুঝতে পারল রাশেদের কথার গুরুত্ব। কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে চিন্তা করে বলল, ‘এটাই একমাত্র কারণ?’
এবার সরাসরি জাফরের দিকে তাকাল রাশেদ। যান্ত্রিক ভঙ্গিতে বলল, ‘ ভবিষ্যতে সোলার সিস্টেমকে সামলানোর জন্যে রাশেদ আমের, রুদ্র আমেরের পর আরেকটা আমের প্রয়োজন জাফর। সেটা কেবল রুদ্রই দিতে পারে।’
বোকার মতো নিজের বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল জাফর। কয়েক সেকেন্ড লাগল কথাটার অর্থ বুঝতে। বুঝতে পেরে ভেতরে ভেতরে আরও একবার চমকে উঠল সে।
উপলব্ধি করল কী ভীষণ মাত্রার ধূর্ত আর দূরদর্শী এই লোক! জীবনটাকে দাবার ঘর বানিয়ে ফেলেছে। পরিকল্পনা ছাড়া একটা পাও ফেলেননা।
জাফরের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে টেবিলে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠলো। রাশেদ হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘ রাশেদ আমের।’
ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে কেউ বলে উঠল, ‘ তাজওয়ার বলছি। করিম তাজওয়ার।’
কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা রাশেদের মাঝে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘ ব্লাক হোলের কর্ণধার করিম তাজওয়ারের হঠাৎ একজন ফাউন্ডেশন ওউনারকে প্রয়োজন পড়ল?’
হেসে ফেলল তাজওয়ার। বলল, ‘ ঠাট্টা করছেন?’
রাশেদও মৃদু হেসে বললেন, ‘বেয়াই হলে করা যেতো। কিন্তু তেমন কোন সম্পর্ক আমাদের মধ্যে নেই। তাই বোধ হয় ঠাট্টা করছিনা। কেন ফোন করেছেন?’
‘ বেয়াই! কখন কে, কার কী হয়ে যায় কে বলতে পারে? শুধু এতটুকু বলছি, আপনি যেটা করার কথা ভাবছেন সেটা করবেন না। অনেক ক্ষতি করে ফেলেছেন আমাদের। আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিলোনা আমার। আর রাখতেও চাইছিনা। অপ্রয়োজনেই বারবার আমাদের ডালে বাঁ হাত দিচ্ছেন আপনি। এবার দেবেন না। আমরাও পেছনের সবকথা ভুলে যাব।’
‘ অনুরোধ?’
‘ না, সাবধানবাণী। আমাদের কাছে ব্যপারটা ডু ওর ডাইয়ের পর্যায়ে চলে গেছে আমের সাহেব। আপনি ঐ প্রজেক্টা নিয়ে নিলে কতবড় লোকসান হবে আমাদের ধারণা আছে আপনার।’
‘ব্যাবসায় লাভ লোকসান থাকবেই। প্রত্যেকে নিজের বুদ্ধি এবং ক্ষমতা অনুযায়ী লাভ বা লোকসানের মুখ দেখে। এক্ষেত্রে যদি আপনাদের লোকসান হয় সেটা সোলার সিস্টেমের দোষ নয়; আপনাদের ক্ষমতা এবং বুদ্ধির দোষ। সত্যি মানতে শিখুন।’
‘ সে সুযোগ নেই আমের সাহেব। এটাই বাঁচার শেষ সুযোগ আমাদের। কিন্তু এবারেও যদি আপনি বাঁ হাত দিতে আসেন তাহলে সব গুটিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড ছাড়তে হবে আমাকে। তার চেয়ে মৃত্যুও সম্মানের। আর তাই এবার বাঁচার জন্যে হলেও মরণ ছোবল দিতেই হবে আমাদের। রুদ্রকে আটকান। নয়তো মা-রা পড়বে। ম-র’তে হলে ওকে নিয়ে মরবো আমি।’
ঠোঁটে বাঁকিয়ে হাসলেন রাশেদ। তাজওয়ারের হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘চট্টগ্রামের ঘন জঙ্গলের ঐ বাংলোতে সেদিন আপনারও লা’শ পাওয়া যেতো। যদি আমার আদেশের বাঁধাটা রুদ্রর সামনে না থাকতো। রুদ্র এতো দয়ালু নয় তাজওয়ার। আপনাকে জীবিত ছেড়ে এসে সে খুব বেশি খুশি হয়নি।’
কিছুক্ষণ চুপ থাকল তাজওয়ার। তারপর বলল, ‘কথায় আছে কাল সাপকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। বিষাক্ত ছোবলটা শেষে সেই মারে। আর আমরা যেই জগতে আছি সেখানে এরকম দয়া মানায় না আমের সাহেব। একটা সময় একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা। তাই একটা উপদেশ দিচ্ছি। ভবিষ্যতে এমন আদেশ কোনদিন রুদ্রকে দেবেন না। কারণ ভবিষ্যতে কোনদিন যদি শত্রুকে প্রাণ ভিক্ষা দেওয়ার ভুলটা ও করে। সেটাই ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হবে। যার মাশুল গোটা সোলার সিস্টেমকে দিতে হবে। আফসোস করার সময়টুকুও পাবেনা কেউ। সব শেষ হয়ে যাবে।’
‘ লতার ধর্ম হচ্ছে বিশাল বৃক্ষকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা। সেই বৃক্ষকে সমূলে উপড়ে ফেললেও লতা তাকে ছেড়ে যেতে পারেনা। আমার কিছু কিছু স্বভাব আমার রুদ্রর মতোই অবাধ্য তাজওয়ার। শাসন মানেনা। ভবিষ্যতে কী হবে সেটাতো ভবিষ্যৎ বলবে।’
কথাটা বলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন রাশেদ। জাফর ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে। কিন্তু রাশেদের মস্তিষ্কে শুধু একটা বাক্যই ঘুরপাক খাচ্ছে। “সব শেষ হয়ে যাবে।”
*
রাত সাড়ে আটটা বাজে। অটোতে করে বাসায় ফিরছে প্রিয়তা। বিষণ্ন মনে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এখনো অবধি একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। বাড়িবাড়ি ঘুরে টিউশন করাতে হচ্ছে! চাকরির বাজার যে এতোটা নির্মম সেটা চাকরির সন্ধানে না বের হলে বুঝতে পারতো না প্রিয়তা।
কাল রাতেও মীরা বলছিল রুদ্রর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। রুদ্র হয়তো কোনভাবে কোন একটা ব্যবস্থা ঠিক করে দিতো। কিন্তু প্রিয়তা রাজি হয়নি। রুদ্রর কোনরকম কোন সাহায্য নেওয়া যাবেনা। রুদ্রর জানা উচিত, প্রিয়তা তার সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগে আগ্রহী নয়। নাম্বারটাও ব্লক করে দিয়েছে কয়েকদিন আগে। রুদ্র জানুক, তীব্র অভিমানে তিক্ত হয়ে আছে ওর সব অনুভূতি।
বিল্ডিং এর সামনে অটো দাঁড়াতেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে এলো অটো থেকে। ভাড়া মিটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই থমকে দাঁড়াল প্রিয়তা। দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে গেইটের সামনে। রুদ্রের জিপটা চিনে নিতে এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি ওর। দু পা এগিয়ে পেছনের গাড়িটার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে আরও একদফা অবাক হল প্রিয়তা। কালো রঙের একইরকম পোশাক পড়া পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজনকে প্রিয়তা চেনে। শ্যামলা রঙের ছেলেটা। সাড়ে পাঁচফিট উচ্চতা। তার নাম রঞ্জু। বয়স পঁচিশ হবে। প্রিয়তা যখন রুদ্রর ফ্ল্যাটে ছিল তখন এই লোকটাই ওকে বাজারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস এনে দিতো। ছেলেটা ভীষণ চঞ্চল আবার সরলও। চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলেই মায়া মায়া অনুভব হয়।
পাঁচজনই গাড়ির সঙ্গে একেক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে মনে সুখে সিগারেট টানছিল। প্রিয়তাকে দেখেই ওরা সোজা হয়ে দাঁড়াল। রঞ্জু সঙ্গেসঙ্গে ফেলে দিলো সিগারেটটা। দ্রুত এগিয়ে গেল প্রিয়তার কাছে। শ্রদ্ধাভরে তাকাল। দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘স্লামালাইকুম ( আসসালামু আলাইকুম ) ভাবি।’
ভাবি ডাকাতে খানিকটা ভড়কে গেল প্রিয়তা। রঞ্জুতো ওকে আপামণি বলে ডাকতো। খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কী ব্যপার রঞ্জু ভাই? আপনারা?’
রঞ্জু এগিয়ে এসে শার্ট ঝেড়ে ভদ্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাই এসেছে। ভেতরে অপেক্ষা করছে।’
প্রিয়তা চমকালো। স্থির দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল রঞ্জুর দিকে। এরপর শুকনো এক ঢোক গিলে বাড়ির ভেতরের দিকে তাকাল। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল ও। এলোমেলো লাগছে সবকিছু। গভীরভাবে কিছু ভাবতে ভাবতে ভেতরের দিকে পা বাড়াল প্রিয়তা। দরজা খোলাই ছিল। ভেড়ানো। মনকে শক্ত করে দু হাতে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল প্রিয়তা। দু পা এগোতেই পা দুটো থমকে গেল ওর। টেবিলের কাছের চেয়ারটাতে পায়ে পা তুলে বসে আছে রুদ্র। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চোখ বোলাচ্ছিল খবরের কাগজে। দরজা খোলার শব্দে চোখ তুলে তাকাল। প্রায় একইসঙ্গে চোখাচোখি হলো দুজনের। কিছুক্ষণ স্তব্ধ নয়নে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিল ওরা। বারো দিনের এই বিচ্ছেদকে হঠাৎ এক যুগের বিচ্ছেদের মতো মনে হলো। রুদ্র কাপটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে নিউসপেপারটা রেখে দিল টেবিলে। এখনো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। যেন জ্বলন্ত বুকে কেউ শীতল বরফের স্পর্শ দিয়ে দিয়েছে, বহু বছরের তৃষ্ণার নিবারণ হয়েছে আজ। প্রিয়তা ঠোঁট ভেঙ্গে আসতে চাইল। অপূর্ব সুন্দর চোখদুটো ছলছল করে উঠল। সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছে ওর কাছে। এমন স্বপ্ন এই বারোদিনে বহুবার দেখেছে প্রিয়তা। প্রতিবারই সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। ততবারই ভেঙ্গেছে প্রিয়তার মন। রুদ্র এক পা দু পা করে সামনে এসে দাঁড়াল প্রিয়তার। চোখে চোখ রেখে বলল, ‘কেমন আছো প্রিয়?’
নিজের অজান্তেই কেমন কেঁপে উঠল প্রিয়তা। ‘প্রিয়’ ডাকটা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল ওকে। রাগ, অভিমান, অভিযোগ ঠিকরে বেরিয়ে এলো। সত্যিই এবার ঠোঁট ভেঙ্গে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। রুদ্র মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল নিজের প্রেয়সীর দিকে। কাঁদলেও বুঝি কাউকে এতো সুন্দর লাগে?
#চলবে…
#অন্তর্নিহিত_কালকূট