#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
২৭.
বিপদের সময় দীর্ঘায়িত হয়। সেদিন সকাল হতে বোধহয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লেগেছিল।
অন্তূর বারান্দাতেই আমজাদ সাহেব হরহর করে বমি করে ফেললেন। খাওয়া নেই সারাদিন, বমিতে শুধু পিচ্ছিল মিউকাস জাতীয় পদার্থ উঠে আসছিল। বেশ কয়েকবার বমির উপক্রম হলো, দু’বার বমি করলেন।
উনাকে তুলে এনে অন্তূর বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলো, তখন রাত সাড়ে তিনটার মতো বাজে। উনি চোখে ঝাপসা দেখছিলেন, চোখের সামনে দুনিয়াটা ঘুরছিল চরকীর মতো। চোখের শিরায় রক্ত জমে উঠল। চোখের মণি হলুদাভ-লালচে হয়ে উঠল। প্রেশারেরওষুধ খাওয়ানোর পরেও রাতের বেকায়দা সময়ে কোনো রকমের উন্নতি দেখা গেল না উনার শরীরে।
অন্তিক বেশ কয়েকবার গিয়ে ঘুরেও গাড়ি পেল না। সময়ের সাথে সাথে আমজাদ সাহেবের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠছিল। অন্তূ এবং রাবেয়া বেগম উনার হাতে-পায়ে তেল মালিশ করে দিলেন। প্রচুর ঘামছিলেন আমজাদ সাহেব। শীতের রাতে উনার গলা ঘেমে ভিজে উঠেছিল। অন্তূ আন্দাজ করল, ব্লাড-প্রেশার ১৮০/১২০ পেরিয়ে গেছে। ওষুধ খাওয়ানোর পরেও তা ডাউন করছিল না।
সকাল ছয়টায় যখন উনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা গেল, তখন উনার ভেতরে যেসব উপসর্গ প্রকাশ পাচ্ছিল, অন্তূর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তাতে। আমজাদ সাহেব মাথার ব্যথায় ছোট বাচ্চার মতো ছটফট করছিলেন। চোখে দেখছিলেন না। অন্তূকে একবার রাবেয়া বলে ডেকে উঠলেন। অন্তূ অনিয়ন্ত্রিতভাবে অন্তূ ডুকরে ওঠে তখন।
খানিক বাদে বোঝা গেল উনার একপাশ অকেজো হয়ে এসেছে বোধহয়। নিথর লাগছে ডানপাশটা। ডাক্তার দৌঁড়ে এসে উনার ব্লাড প্রেশার মাপলেন, মুখটা ছোট হলো ডাক্তারের। কথা বললেন না। দ্রুত নার্সকে আদেশ করা হলো উনাকে সিটিস্ক্যান রুমে শিফ্ট করার জন্য। চলে যাবার সময় শুধু এটুকু বলে গেলেন, “রোগীর উচ্চ রক্ত-চাপ অনিয়ন্ত্রণে। গড সেইভ হিম।ʼʼ
অন্তূ চুপচাপ বসে রইল বেডের ওপর। এখন বড় ডাক্তার নেই। হাসপাতালে বড় ডাক্তার রাউন্ডে আসবে কমপক্ষে সকাল দশটায়। অন্তূ বাচ্চাদের মতো অন্তিককে জিজ্ঞেস করে, “ওরা কী বলছে? কী বোঝাতে চাইছে? আব্বুর ব্রেইনে স্ট্রোক হয়েছে? কী বলতে চাচ্ছে রে ওরা?ʼʼ
অন্তিক জবাব দেয় না। চুপচাপ পাশে বসে হাত চেপে ধরে অন্তূর। থরথরিয়ে কাঁপছে অন্তূর দেহ। চোখদুটো অশান্ত, চঞ্চল। কাঁদছে না। আমজাদ সাহেব বলতেন, ‘ব্যথার ওপর ব্যথা লাগলে নাকি মানুষ ব্যথাহীন হয়ে পড়ে। আঘাতের ওপর আঘাত মানুষের সহনশীলতা বাড়িয়ে দেয়।ʼ
ডাক্তার জানালেন, “রোগীর উচ্চ রক্তচাপ বেড়েছে কোনো জটিল উত্তেজনা এবং দুশ্চিন্তার ফলে। আর তা অনিয়ন্ত্রণে যাবার ফলে..ʼʼ
আপাতত উনাকে সাধারণ ওয়ার্ডেই রাখা হলো। ডাক্তাররা কী বুঝছেন, বলছেন না কিছুই। বেড পাওয়া গেল না। মেঝেতে মাদুরের ওপর কাঁথা বিছিয়ে শোয়ানো হয়েছিল আমজাদ সাহেবকে।
—
আধাঘন্টাও হয়নি ঘুমিয়েছে জয়। দরজায় ধুমধাম আওয়াজ। জয় গায়ের কম্বল মাথায় তুলে তার ওপর বালিশ তুলে কান ঢাকে। কাচের দরজায় যে ধাক্কাধাক্কি চলছে, ভেঙেও যেতে পারে আর কিছুক্ষণ এমন চললে।
হামজা আবারও কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল, “জয়! এই শুয়োরের বাচ্চা, উঠবি তুই? ওঠ হারামজাদা।ʼʼ
মাথার ব্যথায় মাথাটা খন্ড-বিখন্ড হয়ে আসছিল জয়ের। চোখের নিচে দাগ পড়ে গেছে, চোখ লাল হয়ে আছে ঘুমের অভাবে। হামজা ভেতরে ঢুকে বলল, “আরমিণের বাপ হাসপাতালে। যা ওখানে, দ্রুত বের হ।ʼʼ
জয় ভ্রু কুঁচকে হাই তুলে বলল, “শালীর বাপের আবার কী হইলো দুম করে? ডায়রিয়া না কলেরা?ʼʼ
-“দুম করে হয়নি? তোকে ধরে বলি দিলেও গায়ের আগুন নিভবে না। যা বলছি, সেটা কর। জনগণ জানে গতকাল কী হয়েছিল। এর দায় আমার রেপুটেশনের ওপর এসে পড়লে তোকে জীবিত দাফনাবো আমি।ʼʼ
-“আমার জন্যে হইছে নাকি? সেদিন পলাশ মারছে, সেজন্যেও অসুস্থ হতে পারে। আর আমি ওইখানে যায়ে কী করব? ওই শালীর মেয়ে এমনিই সহ্য করবার পারে না আমারে।ʼʼ
-“কথা বাড়াচ্ছিস কেন? বাথরুমে যা, ফ্রেশ হ। কোনো প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করবি, আশেপাশেই থাকবি ওদের। যা বুঝলাম শুনে, স্ট্রোক হয়েছে হয়ত। পাপ করেছিস, তার মাশুল হিসেবে অথবা তোর বিয়ে করা বউয়ের খাতিরে। যাহ।ʼʼ
জয় বিরক্ত হয়ে ঝারি মারল, “আমার ঘুমে মাথা ভেঙে আসতেছে। ধোনের অসুখ হইছে এক ঠাপ দিয়া!ʼʼ
হামজা নরম হলো, “যা। মাঝেমধ্যে সেক্রিফাইজ করা স্বাস্থের জন্য ভালো, আর রেপুটেশনের জন্যও। ফিরে এসে ঘুম দিবি।ʼʼ
-“ভাই, আমি না তোমারে বুঝি না। মাঝেমধ্যে মন চায় মাথার খুলিডা উড়াই দিই।ʼʼ জয় দাঁত খিঁচে ওঠে।
-“আমিও বুঝিনা আমাকে। তুইও বোঝার চেষ্টা করিস না। আমি পরে যাব। পাশের এলাকায় রাস্তার কাজের কন্ট্রাক্ট সাইন করা হয়েছে, তা দেখতে যেতে হবে। তুই যা এখন, আমি পর আসছি।ʼʼ
জয় অলসভাবে হেঁটে বিছানার দিকে যেতেই ধমকে ওঠে হামজা, “আবার গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লে বিছানাটা আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেব আমি।ʼʼ
জয়কে ধরে ঠেলে নিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয় হামজা।
-“কখন কী হয় ওখানে, জানাস আমায়। তোর কাজকর্মে কতদিন ধৈর্য্য বজায় রাখতে পারব, আমি বুঝতে পারছি না। তবে আশা থাকবে, রাজনৈতিক কাজের বাইরে তোর নোংরামি যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমি যেমন প্রশ্রয় আর আদর দিয়ে মাথায় তুলতে পেরেছি তোকে, পাপ বেশি হয়ে গেলে, একবার ধৈর্য্যে টান লাগলে এক আছাড়ে তোর রুহুটা বের করে নিতে হাত কাঁপবে না, জানিস তুই। তাই পাপও সেই অবধি করবি, যে অবধি আমার ধৈর্য্যচ্যূতি না ঘটে।ʼʼ
কথাগুলো বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে হামজা।
জয় গলা উঁচিয়ে নির্লজ্জের মতো বলে, “আমি কিছুই করি নাই, বাল। ভালো মানুষ বলে যে পারে দোষ দিয়ে যায়। তোমার তো খালি অভিযোগ আমার ওপর। যাই করি সহ্য হয় না।ʼʼ
-“জিহ্বাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলি, এগিয়ে আয় এদিকে আমার কাছে। গলার আওয়াজ উঁচু হচ্ছে কেন?ʼʼ
জয় ব্রাশ মুখের মধ্যে রেখে একহাতে লুঙ্গি উঁচিয়ে ধরে বলল, “জিহ্বা ছেঁড়ার ইচ্ছা তোমার হইছে, আমি ক্যান আগায়ে আসব? তুমি আসো..ʼʼ
লুঙ্গি ঘেঁষে যাচ্ছিল বাথরুমের ভেজা মেঝেতে। টেনে শক্ত করে বাঁধল সেটা। হাত দিয়ে মুঠো করে লুঙ্গি ধরে দুই ঠ্যাঙের মাঝে গুঁজে আয়নার দিকে তাকায়। দেখতে কালো লাগছে চেহারাটা। আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “ও দয়াল! জান নিবা নাও, দম ক্যান বাইর হইয়া যায়?ʼʼ
চোখ লাল হয়ে আছে ঘুমের অভাবে। হামজার কণ্ঠ শোনা গেল, “দেরি করিস না, জয়। তাড়াতাড়ি বের হ।ʼʼ
—
সিটিস্ক্যান রুম থেকে বের করে ওয়ার্ডে আনার পর আমজাদ সাহেবের একপাশ পুরোপুরি অবশ পাওয়া গেল। উনাকে পাঁজাকোলা করে ধরে মাদুরে শোয়ানো হলো। পড়ে রইলেন ওভাবেই। অপলক তাকিয়ে আছে তার চোখদুটো অন্তূর দিকে। জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। অন্তূর থেকে চোখ ফিরিয়ে রাবেয়ার দিকে তাকালেন। কম্পিত বাঁম হাতটা এগোতে চাইলে কাঁদতে কাঁদতে তা চেপে ধরেন রাবেয়া। কথা বলতে গিয়ে ঠোঁট বেঁকে আসে আমজাদ সাহেবের। অন্তূ ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এই দৃশ্য দেখতে নেই। অন্তূ পারছে না।
যে মানুষটার ভরাট কণ্ঠস্বর ও স্পষ্ট ভাষায় বলা দামী কথা আর ধমক শুনে অভ্যস্ত অন্তূ, সে মানুষের অর্ধঙ্গ অসুস্থতা দেখা যায় না।
অন্তূর চোখ বাঁধা মানতে চায় না। কিন্তু স্বার্থপর আব্বুর জন্য সে কাঁদবে না। যে তাকে এই পরিস্থিতির সামনে, এই অবস্থার মধ্যে ফেলে এভাবে অসুস্থতার ভয় দেখায় তার জন্য অন্তূ কাঁদবে না।
রাবেয়া উনার মুখের কাছে কান এগিয়ে নিয়ে গেলেন অস্পষ্ট কণ্ঠে একপেশে ধরণের স্বরে শোনা যায়, “আমায় তুমি ক্ষমা কোরো, রাবেয়া। তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি এই জীবনে। আমায় বাঁধিয়ে রেখো না, তুমি। মাফ কোরে দিও আমায়। অন্তূকে দেখে রেখো।ʼʼ আরও অনেক কিছুই বলার ছিল, পারলেন না বোধহয়।
রাবেয়া উনার হাতের ওপর কপাল ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। অন্তূ বসে আব্বুর শিওরে, “তুমি কীসের ক্ষমা চাইছো? আম্মু বোকা, আম্মু তোমায় ক্ষমা করতে পারে, আমি অন্তূ তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না, আব্বু। আচ্ছা, কী ভেবে এসব বলছো তুমি? কিচ্ছু হবে না তোমার। এখনও রিপোর্টই আসেনি। চুপচাপ শুয়ে থাকো।ʼʼ
পাগলের মতো বলে চলে অন্তূ। অন্তিকের চোখে পানি চিকচিক করে ওঠে। আজ কতগুলো বছর সে এই দেবতাতূল্য মানুষটার সাথে কথা বলেনি। তার সাথে কথা না বলেই আব্বু কোথায় যাচ্ছে? এই ক’দিনে সুযোগ বা সাহস পায়নি কথা বলার। সেদিন যখন ক্ষমা চাইল, আমজাদ সাহেব চুপচাপ তাকিয়ে ছিলেন কেবল। অন্তিক পুরুষ মানুষ, পুরুষদের কাঁদতে নেই। চোখদুটো রক্তলাল হয়ে ওঠে অশ্রু জমে। আমজাদ সাহেব হাসার চেষ্টা করলেন বোধহয়, অথচ ঠোঁট বেঁকে গেল। অন্তূ সহ্য করতে না পেরে উঠে দৌঁড়ে বারান্দায় যায়। আবার ফিরে আসে ছুটতে ছুটতে। অন্তিকের ঠোঁটদুটো কাঁপছে, অথচ কিছুই বলতে পারল না ছেলেটা।
ছেলেরা বাপের সামনে বোবাপ্রাণী, এরা জান দেয়া স্বীকার তবে মুখ ফুটে বাপের কাছে ক্ষমা বা ভালোবাসা প্রকাশে চরম ব্যর্থ। চোখের ভাষায় আব্বুর কাছে কাঁদলো ছেলেটা, ক্ষমা চাইল, কত কথা বলল, সব দুজনের চোখের ভাষায় সীমাবদ্ধ। অভিমান, অভিযোগ, আড়ষ্টতা ও বহুদিনের বাকহীনতা জমে জমে যে শক্ত দেয়ালটা বাপ-ছেলের মাঝে খাঁড়া হয়েছিল, তা ভাঙে দুজনের নীরব দৃষ্টি বিনিময়ে।
অন্তিক বেরিয়ে যায় রাবেয়াকে নিয়ে। অন্তূকে আব্বুর কাছে বসার সুযোগ দেয়। সে অপদার্থ ছেলে, ছেলে হবার যোগ্যই না। অন্তূ ছিল আব্বুর একমাত্র অবলম্বন।
অন্তূ বসে আব্বুর সামনে। কান্না থামানোর উপায় নেই তার কাছে আজ। হাতটা চেপে ধরে অঝোরে কিছুক্ষণ কাঁদল অন্তূ। আমজাদ সাহেবের চোখ ছলছল করে। তবে পানি গড়ায় না।
অন্তূ ডেকে ওঠে, “আব্বু? তুমি কী বোঝাচ্ছ? তুমি আমায় রেখে চলে যাচ্ছ, এটা বোঝাচ্ছ? তুমি পাষাণ্ড জানতাম। তবে এত্ত পাষাণ্ড আব্বু তুমি? আব্বু! আমি কী করে কী করব একা? আব্বু…..আব্বু? আমি তো এক পা-ও চলতে পারি না তোমায় ছাড়া। তুমি আমায় এসব ভয় দেখিও না! আমি জানি, কিচ্ছু হবে না তোমার। এসব মিছেমিছি ভয় অন্তূ পায় না। বুঝলে!ʼʼ
থামে অন্তূ। কান্নাটুকু গিলে ফের বলে, “তুমি এত তাড়াতাড়ি যেতে পারবে না। আমি যেতেই দেব না তোমাকে। মগের মুলুক নাকি? তুমি বললে আর চলে গেলে? আমায় কী মনে হয় তোমার? যেতে দেব আমায় ফেলে? সে তুমি যাবে ভালো কথা। চলো, আমায় নিয়ে চলো। সেদিন যখন তোমার কাছে মরণ চেয়েছি তুমি মারোনি আমায়, অথচ আজ নিজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আচ্ছা, আব্বু! পৃথিবীর সব বাপেরাই কি তোমার মতো কঠোর স্বার্থপর হয়? আজ আমার উত্তর চাই। তুমি চুপ করে থেকো না। তোমার গলার ভারী আওয়াজ শুনতে চাই আমি। বলো যে, ‘না সব বাবা এমন হয় না, শুধু তুমিই এমন নিষ্ঠুর, পাষাণ্ড, মায়াহীন, কঠিন স্বার্থপর বাপ।ʼ বলো। আমি একজন স্বার্থপর বাপকে ভালোবেসেছি, বলো আব্বু, স্বীকার করো। আম্মা কাঁদছে কেন? তুমি কী বলেছ? চলে যাচ্ছ, তাই বলেছ? কথা বলো, কথা বলো…ʼʼ
টপটপ করে পানি পড়ে অন্তূর চোখ দিয়ে। মেয়েটা নাক টানে, আর আব্বুকে ঝাঁকায়। একেকটা করে অভিযোগী প্রশ্ন করে, “শোনো আব্বু। আমার একটা কথা রাখো, রাখবে? আব্বু, রাখবে? আমি চলো তোমার সাথে যাই। একা একা থাকতে ভালো লাগবে না আমার, বুঝেছ! আমি তোমার সাথে যাব। তুমি না চাইলেও যাব। তোমার তো আমার প্রতি মায়া নেই। তুমি পারবে চলে যেতে আমায় ফেলে। কিন্তু আমি তো থাকতে পারব না তোমায় ছেড়ে। সকালে ফজরের নামাজের অযুটা তোমার সাথে করি, তখন তোমায় লাগবে আমার। ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলে দরজায় এসে ধাক্কাধাক্কি করার জন্য তোমাকে লাগবে আমার। কোথায় পাব বলো? জবাব দাও। আমাকে নিতে হবে সাথে, আমি যাব তোমার সাথে। একা যেতে দেব না স্বার্থপরের মতো আমায় ফেলে। আমার পরীক্ষা দিতে যাবার সময় তোমাকে লাগে আমার, বুঝতে পারছো তুমি? আমি পরীক্ষা দিতে একা যেতে পারি না। কে নিয়ে যাবে আমায়? বিকেলে চা আর টোস্ট খাবার সময় পাশের চেয়ারে তুমি না বসলে আমার চলে না। তখন কোথায় পাব তোমায়?ʼʼ
আমজাদ সাহেব কথা বলছেন না। অন্তূ অধৈর্য হয়ে উঠল, “ইশ রে! কিছুই কি বলবে না তুমি? শোনো, আমায় এই ব্যবস্থাগুলো করে দাও, তারপর ভাববো তোমায় যেতে দেয়া যায় কিনা! ওহ, আমি একা রাস্তাও পার হতে পারি না। আমায় রাস্তা পার হওয়াও শেখাতে হবে। নয়ত তো তুমি যেতে পারবে না। এতই সহজ নাকি তোমার জন্য অন্তূকে ফেলে চলে যাওয়া? শোনো আব্বু! রাতের খাবারটা তোমার পাশের চেয়ারে বসে খাই আমি, ভুলে যাচ্ছ? তুমি না ডাকলে রাতে খেতে যাই আমি? পড়তে পড়তে তোমার ধমকানো ডাক কানে না এলে তো উঠতেই মন চায় না আমার। আম্মার কথা কানেও লাগে না আমার। কে ডাকবে আমায় খেতে, সেই জবাব দাও আগে। বেশি রাত জেগে পড়লে কে আমায় রাতে এসে দেখে যাবে, বিস্কুটের কৌটোটা এগিয়ে দিয়ে একটা ধমক দেবে, ‘দুটো বিস্কুট খেয়ে পানি খেয়ে ফের পড়তে বস। একাধারে পড়লে শরীর খারাপ হবে, মনোযোগ পাবি না। নে, খা। একটু হাঁটতে যাবি? চল বাড়ির সামনে দুই পাক মেরে আসি দুজন।ʼ কে বলবে, এই ব্যবস্থা আগে করো তুমি। আমায় কে ডেকে ধমকে বলবে, মশারিটা টাঙিয়ে দে তো অন্তূ। আজ মশা খুব বেশি।ʼ তুমি বুঝতে পারছো আমার সমস্যাগুলো? আমার পদে পদে সমস্যা তোমাকে ছাড়া। একটা দিন কাটাতে পারব না। দেখলে তো কাল, তুমি ছিলে না, আর কী হয়ে গেল আমার সাথে!ʼʼ
আমজাদ সাহেবের চোখের কোণা বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল কানের গোড়া দিয়ে চুইয়ে পড়ে। অন্তূ চোখদুটো মুছে নড়েচড়ে বসে। নাক টেনে শান্ত স্বরে বলার চেষ্টা করে, “আব্বু? বুঝলে, আমার বুকের ভেতর খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। তোমারও হচ্ছে? হচ্ছে না, জানি। কারণ তুমি খুব স্বার্থপর, আব্বু। খুব স্বার্থপর।ʼʼ
গা কাঁপিয়ে কেঁদে ফেলল অন্তূ, “তুমি একাটাও কথা বলছো না, আব্বু? কী করেছি আমি? কীসের অপরাধে এই যন্ত্রণা দিচ্ছ? তুমি বুঝতে পারছো না, আমি সহ্য করতে পারছি না? আব্বুউউ? তুমি জবাব দিচ্ছ না কেন? আমায় কষ্ট দিয়ে কী পাচ্ছ? আমার সহ্য হচ্ছে না তো। আমি সইতেই পারছি না। কী করব, বলো তো!ʼʼ
বুকের মাঝখানটায় আঙুল গেড়ে বলল অন্তূ, “এই এই এখানে কেমন যে লাগছে, তুমি বুঝলে ঠিক কথা বলতে। তুমি টেরই পাচ্ছ না। তুমি খুব কঠোর আব্বু, খুব নিষ্ঠুর।ʼʼ
অন্তূর বিলাপে আশপাশের লোকজন থমকে যায়। কারও কারও চোখে ছলছলে পানি নেমেছে। আমজাদ সাহেবের চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা পানি সরু হয়ে গড়িয়ে পড়ে। অন্তূ তা সযত্নে মুছে দিয়ে বলে, “কাদছো কেন তুমি? কিচ্ছু হয়নি তো। আচ্ছা, আমি আর কাঁদছি না। তুমিও কাঁদবে না কেমন?ʼʼ
আমজাদ সাহেব নিশ্চুপ। বাচ্চারা যেমন ঘুমন্ত মানুষকে ঝাঁকায়, অন্তূ ওইভাবে আমজাদ সাহেবকে ঝাঁকালো, “আব্বু!ʼʼ
অন্তূ ঝেরে উঠে দাঁড়ায়। চিৎকার করে ডাক্তার ডাকে। নার্স আসে, ডাক্তার আসে। অন্তূকে অন্তিক সরিয়ে নিয়ে যায় টেনে। ধরে রাখা যায় না অন্তূকে। পাগলের মতো লাফালাফি করছে মেয়েটা। অন্তিক শক্ত হাতে টেনে ওকে বারান্দায় নিয়ে যায়।
রিপোর্ট হাতে নার্স আসে। মহিলা ডাক্তার তা দেখেন চোখ বুলিয়ে। হেমোরেজিক স্ট্রোক। অর্থাৎ মস্তিষ্কের ধমণিগাত্র বিদীর্ণ হয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রক্ত বেরিয়ে তা জমাট বেঁধে গেছে। রোগী বাঁচানোর সুযোগ এই স্ট্রোক দেয় না। উন্নত চিকিৎসা প্রাপ্তি অবধি যাবার সুযোগ থাকেনা এই ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে। ডাক্তার রিপোর্ট রেখে বেরিয়ে গেলেন চুপচাপ।
মেঝের ওপর পড়ে আছে আমজাদ সাহেবের নিথর দেহটা। নাক দিয়ে রক্ত আসছে। কান দিয়েও বেরোবে বোধহয় রক্ত। এই লাশ বেশিক্ষণ না রাখার পরামর্শ দিলেন ডাক্তারেরা। যেদিক দিয়ে সম্ভব এখন গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্তূ চুপ করে বসে রইল হাসপাতালের নোংরা মেঝের ওপর। জলন্ত আগুনে পানি ঢালার পর ঠিক আগুন যেমন ধপ করে নিভে যায়, ওভাবে নিভে গেছে অন্তূটা। একদৃষ্টে চেয়ে আছে অন্তূ ওই তো দূরে পড়ে থাকা লম্বাটে দেহাবয়বের দিকে।
জয় হাসপাতালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে গেইটের সামনে দাঁড়ায়। অস্থির লাগছে ভেতরটায়। দ্রুত একটা সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটের ভাঁজে রাখে। অন্তূর কান্না খুব জ্বালাতন করছে। তখন ইচ্ছে করছিল, গিয়ে মেয়েটাকে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে আসতে। ওভাবে আহাজারি করে কাঁদার কিছু তো নেই। বাপ কি আর মানুষের মরে না? জাভেদ আমির মরেনি? জয়ের সামনে মরণের প্রক্রিয়া চলেছে উনার, জয় কি বেঁচে নেই? এত ন্যাকামির কী আছে?
বারবার চোখের সামনে অন্তূর কান্নাজড়ানো পাগলের বিলাপ ভেসে উঠছে। বিরক্তিতে দু চারটা গালিও বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। এসব আবেগ বোধ করার মতো বোধশক্তি তার মাঝে নেই। সে স্বাধীনচেতা মানুষ। আবেগ ভালো মানুষকে খারাপ কাজ করতে বাধ্য করে, উল্টো খারাপ মানুষদের নিজের কাজ থেকে দূরে আনে। জয় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। তার খারাপের কোনো চিকিৎসা নেই, কারণ খারাপ হওয়াটা তার রোগ নয়, তার সত্ত্বাগত বৈশিষ্ট্য। আধখাওয়া সিগারেটা দূরে ছুঁড়ে মারল।
চলবে..
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]