#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
২৯.
লতিফের কেবিন নং-৪। জ্ঞান ফেরার পর সে বিশেষ কোনো কথা বলেনি। আসমাও জিজ্ঞেস করেনি কিছু। কেবল সে মনে মনে তৈরি মাজহারের বিরুদ্ধে একটা বিহিত করতে।
রাত আটটার দিকে মাঝারি উচ্চতার এক লোক ঢুকল কেবিনে। ডান হাতে তার আর্ম স্লিং বাঁধানো।
-“ভালো আছেন, ভাবী? আমি মাজহার আলমগীর। লতিফ ভাই কেমন আছে এখন?ʼʼ
লতিফ কথা বলার চেষ্টা করল। মাজহার নিজেও খুব সহজ মুখে কথা বলে সবসময়। আসমা সিঁটিয়ে বসে রইল। এই মাজহারই তার স্বামীর এই হাল করেছে। মাজহার একটা চেয়ারে বসে লতিফকে বলল, “কী দল করতেন এতদিন, এবার কি বুঝতে পারছেন কিছু? ওই দুই শুয়োরের বাচ্চা মানুষের বাচ্চাই না।ʼʼ
আসমা বুঝতে পারছিল না কিছু। মাজহার ফের বলে, “আপনি এই অবস্থায় আমার বহুত কাজে আসতে পারেন। জয়কে ধরার একটা সূবর্ণ সুযোগ আপনার এই অবস্থা। পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিতে হবে কিন্তু আপনার! পাটোয়ারী বাড়িকে ফোকলা না করা অবধি মরণ নেই আমার। জিন্দা হয়ে ফিরে আসছিই একমাত্র ওই বাড়ির তিন ব্যাটার কবর খুঁড়বো বলে। আব্বা আসতে চাইছিল, পরে-টরে এসে দেখে যাবে। আপনার কোনো খরচা-পাতি দরকার?ʼʼ
লতিফ মাথা নাড়ল মৃদু। মাজহার আশ্বাস দেয়, “তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবেন আপনি। আমি একটা কেইস ফাইল করে দিই। আর আমার হিসেব আমি পুলিশ দিয়ে না, নিজে মেটাবো। তবে একটু সময় নেব।ʼʼ
চোখের ইশারায় জানতে চায় লতিফ, “দেরি কেন?ʼʼ
-“কিছু হিসেবে বাকি আছে, এখনই দুইজনকে উড়ানো যাচ্ছে না, মাঝখানে পলাশ ভাই দাঁড়ায়ে আছে। পলাশ ভাই ধৈর্য্য ধরতে বলতেছে। সে কী চাচ্ছে, বা কারণ কী বুঝতেছি না। কিন্তু কিছু করারও নেই তার ওপর দিয়ে। আর হারামজাদা দুইটা আরও খানিক সময় পাবে আমার কাছে। অথচ লতিফ ভাই, যতদিন আমার রক্তের বদলা আমি না তুলব ওদের থেকে আজরাইলও আমায় মারতে পারবে না।ʼʼ
মাজহার আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায়। আসমার মনে হলো, মাজহার ছেলেটা খুব বদমেজাজী আর বোকা। কিন্তু এতক্ষণের কথায় সে যা বুঝেছে, তা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সংশয় কাটাতে স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে আসলে মারছে কে?ʼʼ
—
ক্লাবের ছাদ থেকে পলাশের শহরের ভেতরের নাইটক্লাবের বিল্ডিংটা দেখা যায়। রঙ বেরঙের আলো জ্বলছে বিল্ডিংয়ের গা বেয়ে।
হামজা এসে দাঁড়াল পাশে। কাচের বাটি ভর্তি করে কাঠবাদাম, পেস্তা ও কাজু নিয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে জয়। কাজু বাদাম খেলে গা চুলকায়, এলার্জি আছে তার। তবু খাওয়া বাদ দেওয়া যাবে না। এক মুঠো ভরে নিয়ে মুখে পুড়ল। হামজা এসে দাঁড়ানোর পরেও কোনো কথা বলল না, চোখও ফেরালো না।
হামজা নীরবতা ভেঙে বলল, “নারীর চোখের পানি অম্লের মতো। তা জারে সাজিয়ে রাখলে ঠিক আছে, তাতে বেশি মনোযোগ দিয়ে কাছে টানলে ক্ষয় হয়ে ঝলসে যাবি।ʼʼ
ওয়াহ ওয়াহ! কবি কবি মেজাজ, কবির নেই তো লজ্জা লাজ! আমার কবিতাডা কেমন হইলো কও!
হামজা হাসল, কথার লাইন কাটছিস।
-“তাই নাকি? তাইলে তো বড় দুর্দিন চলে আসছে আমার, হ্যাঁ? আইজকাল মাগী মাইনষের চোখের জলে ডুবে ডুবে মরে যাচ্ছি? মেজাজ খারাপ করা কথা না বলে বাড়ি যাও।ʼʼ
-“তাকা তো আমার দিকে।ʼʼ
জয় তাকাল, হেসেও ফেলল হো হো করে। জয়ের অট্টহাসির আওয়াজটা খুব অদ্ভুতুরে শোনায়। হেসে বলল, “কী বোঝাইতে চাচ্ছ?ʼʼ
-“ঘায়েল হলে পুরুষ মাতাল হয় আর নারী কুচক্রী। নারীর কুচক্র অম্লের চেয়েও বেশি ক্ষয়সাধক।ʼʼ
জয় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “জয়কে ক্ষয়ও করা যায়? জেনে ভাল্লাগলো। এমন ভাবনা ভাবার ক্ষেত্রে অধঃপতনটা তোমার নাকি আমার?ʼʼ
-“যেহেতু আমি সঠিক ভাবছি, তাই অধঃপতনটা তোর।ʼʼ
মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ায় জয়, “হামজা ভাই জিন্দাবাদ!ʼʼ
-“জয়, তুই যদি মাটির তৈরি ফুলদানী হোস, তো সেই মাটি দিয়েছে জমিন অর্থাৎ তোর বাপ। কিন্তু সেই মাটি পিটিয়ে হাতের দক্ষতায় সাজিয়েছি কিন্তু আমি তোকে। তোর চেয়ে তোকে ভালো জানা মানুষটা আমি। আমার লেখা বই তুই।ʼʼ
দুটো কাজুবাদাম মুখে তুলে নেয় জয়, আওয়াজহীন হাসে, “তোমার লেখা বই? তা হোক বা না হোক, শয়তানী কালামের বই আমি। যার প্রতিটা মন্ত্র প্রয়োগ করো নিজের স্বার্থে।ʼʼ
-“এ আর পুরোনো কথা কী? আমি স্বার্থপর, এ কথা পূর্বদিকে সূর্য ওঠার মতোই চিরন্তন সত্য।ʼʼ
জয় কাজু বাদাম চিবোচ্ছে। খানিক চুপ থেকে হাসে হামজা, “মাঝেমধ্যেই অভিযোগ হয় তোর আমার ওপর, তাই না?ʼʼ
-“অভিযোগ? ওসব সস্তা লোকেদের হয়। আমি হাইফাই, ভিআইপি মানুষ, ওসব ছোটলোকি ব্যাপার আমার হয় না। তবে হওয়া উচিত। তুমি ভালোবাসো না আমায়। সব ভণ্ডামি। তবে হয়না কেন জানো, কারণ আমি ভালোবাসার মতো লস প্রজেক্ট টাইপ অনুভূতির আশা রাখিনা কারও কাছে। অদ্ভুত এক সম্পর্ক, বর্ণনা করা যায়না তোমার-আমার প্যাঁচ। না আমি তোমায় ভালোবাসি না তুমি আমায়। তবুও দূরত্ব সঁয়না, জটিল কেইস। ঠিক বলিনি?ʼʼ হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙে জয়।
হামজা গা ঘেঁষে দাঁড়ায় জয়ের, জয়ের জ্যাকেটের চেইন খোলা ছিল। তা লাগিয়ে দিয়ে বলল, “ঠান্ডা লাগেনা তোর? ধাক্কা মেরে ফেলে দিই ছাদ থেকে।ʼʼ
-“এক শর্তে ধাক্কা মারার অনুমতি দিতে পারি।ʼʼ
হামজা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জয় আবদার করার মতো নাটক করে বলে, “আমার জন্য একটা ফাইভ-স্টার কবরের ব্যবস্থা করতে হবে।ʼʼ
হামজা হেসে ফেলল। এরপর অনেকক্ষণ নীরবতা। হামজা টের পায়, জয় অস্থির, অশান্ত। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা ভেঙে বলে, “তোর জন্য আমার অনুভূতি শূন্যের মতো, জয়। সংখ্যার আগে বসাবি তো ওটা মূল্যহীন লাগবে, যেটাকে তুই আমার প্রশ্রয় বলিস। কিন্তু সংখ্যার পরে বসালে দেখবি, সমান্তরাল হারে সংখ্যার মান বাড়ছে। একক থেকে দশক, শতক, হাজার, অযুত… ওটা ভালোবাসা কিনা জানি না, তুই যা ধরে নিবি তাই।ʼʼ
জয় কিছু গাল থেকে উগরে দেবার মতো হেসে ওঠে, “এসব কাব্যিক কথা রাখো। ভালোবাসা আবেগী অনুভূতি, আবেগের সাথে জয়ের কোনো আপোষ নেই। মেয়েলোক চাহিদার সামগ্রী আমার কাছে, নাথিং ইলস।ʼʼ
জয়ের কথা কানে গেল না যেন, আচমকা স্বর বদলে গেল হামজার, “তোর চোখে আফসোস দেখার অভ্যাস নেই আমার। পাপ করে এসে সেই পাপের খেয়ালে ডুবে থাকতে দেখার অভ্যাস নেই, তা শেখাইনি আমি। পাপ যেখানে হয়েছে, সেখানেই রয়ে গেছে, তুই ফিরে এসেছিস। তা সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শেখাইনি। জয়, আমি ছাড়া অন্য কিছু তোর অস্থিরতার কারণ হয় তা সহ্য করতে পারি না আমি।ʼʼ
হাতের কাজু বাদাম দুটো হাতে ধরে জয় তাকিয়ে থাকে হামজার দিকে।
-“তোকে গড়েছি আমি। খারাপ হোক ভালো হোক, একটু একটু করে গড়ে তুলেছি তোকে। সেই তোর ভাঙনের কারণ অন্যকিছু হলে তা বরদাস্ত করতে পারব না আমি। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে জান দেয়, কেড়ে নেয়ার মালিক সে। তোকে গড়েছি আমি, ভাঙার হলে, আঘাত করার হলে তা করব শুধুই আমি। তোর ওপর আঘাতের অধিকার শুধু আমার, আমার। বিয়ে দিয়েছি, বউকে ভালোবাসবি, চলবে। কিন্তু আমি ছাড়া কোনো ভাঙন তোর চোখে দেখা গেলে দুনিয়াটা জ্বালিয়ে দেব, কসম।ʼʼ
জয় কাজুবাদাম দুটো গালে পুরে গলা জড়িয়ে ধরল হামজার, “তুমি তো দেখতেছি মহিলা মাইনষের চেয়েও বেশি হিংসুটে! রাশিগত সমস্যা আছে নাকি? কন্যারাশি? আমার কিচ্ছু হয় নাই। খালি শান্তির অভাব। একটা গান গাই? ওরে শান্তি কেন নাই রে দুনিয়ায়..ʼʼ
-“সান্ত্বণা আশা করছিস আমার কাছে?ʼʼ
-“করতেছি না। যা তুমি দেবে না, সেই আশা করব ক্যান? আরে বাপ, কিছুই হয় নাই আমার। মেয়ে মাইনষের মামলা বোঝোই তো। আগুন জ্বলতেছে বুকে, আগুন নেভানো দরকার। হোটেলে যাই চলো, একটু সুখ দরকার। আমি গরম হয়ে আছি খুব, ঠান্ডা হলেই সব ওকে। ওহ, তোমার তো ঘরে বউ আছে, তুমি ক্যান যাবা? আমরা বাল বিয়াইত্তা ব্যাচেলর পাবলিক… ʼʼ
হামজা বিরক্ত হয়, “মিথ্যা হাসি সবার ঠোঁটে মানায় না। বিশেষ করে তোর ঠোঁটে পাপের হাসি আর নিষ্পাপ হাসি ছাড়া হাসিই মানায় না। হাসিস না, বিরক্ত লাগছে। কিছুক্ষণ আনমনে দাঁড়িয়ে থাক, দুঃখগুলো ক্লান্ত হয়ে গেলে চলে যাবে। আমি আসছি।ʼʼ
জয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সম্পর্কে সবসময় খাঁটি অনুভূতি প্রয়োজনীয় না, সম্পর্কে সততা দরকার, একমাত্র সততা। তার আর হামজার সম্পর্কের বিশেষত্বই এটা। দুজনের কাছে দুজনের কোনো কপটতা নেই। যা মনে তাই মুখে। বানোয়াট কিছু দেখানোর চেষ্টা নেই, এখানেই দুজন অবিচ্ছেদ্য। জয় চেয়ে থাকে অন্ধকার আকাশের দিকে। হামজা খুব হিংসুটে একটা ব্যাপারে। জয়ের কোনো ক্ষতি হামজার ওয়াস্তে হলে ঠিক আছে, কিন্তু অন্যকিছুর জন্য নয়। কারণ, হামজা মানে জয়ের দুঃখের অধিকার শুধু তার, সুখের অধিকার যে কারো হতেই পারে।
মদের বোতল এনে রাখে হামজা টেবিলের ওপর। অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে বসতে বসতে বলে, “পাপীদের ধ্বংস কোথায় জানিস?ʼʼ
-“জানা দরকার।ʼʼ
-“এক পাপের পর, পরবর্তী পাপের আগে কিছুটা সময় নেয়ায়। মানুষের ভেতরে আবার বিবেক নামক এক চুলকানি আছে। পাপ করে কিছুটা সময় দিলেই ওই শালা কুরকুর করে ওঠে। আর সেখান থেকেই এক ক্রমশ বর্ধনশীল ছিদ্র তৈরি হয়— ধ্বংসের ছিদ্র। এজন্য বুদ্ধিমান পাপীরা থামে না, একাধারে অবিরত পাপ করে যায়, বিকেককে কুরকুর করে ওঠার সময় দেয় না।ʼʼ
জয় হাসল, “আমি পাপের মাত্রা কমিয়ে এনেছি, তাই তো? বিবেকানন্দ নাচছে ভেতরে।ʼʼ
-“বিবেকানন্দ ভালো লোক ছিল, বিবেকের মতোই ভালো। বস। বহুদিন পর তোর নামে জাস্ট এক প্যাগ মারব। তোর ভাবী কিছু বললে তোর দোষ।ʼʼ
-“ভাবীর অবস্থা কী? সে কি ঠিকঠাক হয়েছে?ʼʼ জয় বসে চেয়ারে।
হামজা চোখ খিঁচে এক ঢোক গিলে বলে, “মেয়ে মানুষ তৈরির মাটিতে সৃষ্টিকর্তা সামান্য পরিমাণ বিষ মিশিয়ে দেয়। যেটা সাধারণত মায়া হয়ে রয়ে যায় মেয়েলোকের মাঝে। কিন্তু কোনো আঘাত পেলেই সেই মায়া বিষ হিসেবে প্রকট হয়। এজন্যই ওই জাতের থেকে সাবধানের মার নেই। গলা জ্বলছে আজ।ʼʼ
-“রেকর্ডার অন থাকলে ভাবীর জন্য একটা স্পেশাল গিফট তৈরি হতো।ʼʼ
-“অন করিসনি কেন? আমার সব কথা জরুরী। সবগুলো বিশ্ব-সংবাদ হবার যোগ্য।ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে ওঠে, “তোমার কি চড়ে গেছে?ʼʼ
-“আমার চড়েনি, তবে আর একবার এমন পেট বানানো বাটপারি হাসি হাসলে কান সারার নিচে এমন একটা মারব, তোর চড়ে যাবে। হাসি যখন আসছে না, মাথা ভার লাগছে, মন মতো গিলে গিয়ে ঘুমা। নাটক করছিস কেন?
জয় ঠোঁটে আঙুল চাপল, “ওকখে। চুপ করলাম। হাসি পেলে অনুমতি নিয়ে হাসব। সরি সরি।ʼʼ
-“কাল রাতে মাজহার গেছিল লতিফের কাছে। আগামীকাল তোকেও একবার সাক্ষাৎ করে আসতে হবে। এরপর তোকে ট্যুরে পাঠাব কয়েকদিনের। ট্যুর থেকে ফিরলে বউ এনে দেব। ঢাকা যাবি?ʼʼ
জয় নিঃশব্দে হাসল। জয়ের মতো আজগুবি কথা বলার চেষ্টা করছে হামজা। আর জয় উল্টো চুপচাপ আজ। হামজা গ্লাস শেষ করে নিজস্ব ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে নির্মল হাসল, “আমি তোর শিক্ষক নই, জয়। শিক্ষকের মনে থাকে ক্ষমা আর হাতে থাকে দণ্ড। আমার মনে তোর জন্য ক্ষমার ভাণ্ডার থাকলেও হাতে কোনোদিন দণ্ড উঠাইনি। কারণ আমি শিক্ষক নই, তোর কারিগর। আর গড়ে তুলতে শুধু যত্নের প্রয়োজন হয়, প্রশ্রয় দিতে হয়। ভালোবাসা আমার কর্ম নয়। আমি তোকে ভালো-টালো বাসি না।ʼʼ
-“বাসা লাগবে না। ওসব আমার পোষায় না। চলো গান ধরি।ʼʼ জয় উদাস চোখে আকাশের দিকে মুখ তুলে গেয়ে ওঠে,
ইট গামলায় ইট বানাইয়া, চৌদিকে ভাটা সাজাইয়া
মাঝখানে আগুন জ্বালাইয়া দিলো গো…
ভিতরে পুড়িয়া সারা, মাটি হইয়া যায় অঙ্গারা
এখন আমি কী করি উপায়…
—
সাতদিন পর শুক্রবার বাদ জুম’আ মসজিদে কিছু মিলাদ ও দান-সদকা, দোয়া করা হলো। ততদিন অন্তূর চাচা-ফুপুরা ছিলেন দিনাজপুরে।
শনিবার সকাল সকাল উনারা তৈরি হলেন ফিরে যাবার জন্য। অন্তিকটা কেমন মৃতপ্রায় হয়ে উঠেছে। সে সাতদিনে দু তিনবেলা খাবার খেয়েছে। সেটাও উল্লেখযোগ্য হারে সামান্য। মার্জিয়া ধমকে, জোরপূর্বক খাইয়েছে। সে চাচাদের জন্য গাড়ি ডাকতে গেল বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে দেবার।
আফজাল সাহেব অন্তূকে ডেকে কাছে বসালেন। অন্তূর হাড্ডিসার দেহটা পোশাকের নিচেও লুকোনো যায় না। একটা কালো ওড়না শরীর ও মাথায় জড়িয়ে অল্প একটু জায়গা নিয়ে সোফায় বসে রইল।
চাচা বললেন, “আইজ কয়দিনে তো ম্যালা পাওনাদারের যাওয়া-আসা দেখলাম। বিষয়টা খারাপ লাগছে আমার, বুঝছো? ভাই তো আর নাই। তুমি আর অন্তিক এক সময় আসো কুড়িগ্রাম সময় করে। জমিজমা বিক্রির আর দরকার নাই। ও আমার খামার যেমনে চলতেছে চলুক। পাওনাদারের টাকা মিটমাট করে দিবানি আমি। ভাইয়ের দেনা শোধ না করে যাব কই?ʼʼ
অন্তূ সামান্য হাসল, “তার প্রয়োজন হবে না, কাকা।ʼʼ
-“ক্যান? এই কথা ক্যান?ʼʼ
অন্তূ কথা শেষ করতে চাইছিল পাশ কাটিয়ে। মাথার চাঁদিতে তীক্ষ্ণ এক চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে। তা খুব শীঘ্রই মারাত্মক পর্যায়ে যাবে।
সে তাকাল চাচার দিকে, “আপনি যা বলছেন, তা শুনতে দয়া করার মতো লাগছে, কাকা। আমার ধারণা আপনি সেটাই করতে চাইছেন। যেটা গ্রহন করতে শেখানো হয়নি আমাকে।ʼʼ
-“কথা বেশি শিখছিস? পাকনা মাইয়া এক থাপ্পরে দাঁত ফালায়া দিমু। বেলেহাজ মেয়েলোক। কাকার সামনে কেমনে কথা কইতে শিখাইছে তর বাপে ওইডা আগে শুনি।ʼʼ
অন্তূ আর কথা বলল না। হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে রইল মনোযোগ সহকারে। তার নির্লিপ্ততায় ধৈর্যহীন হলেন আফজাল সাহেব, “কথা ক। কী চাস?ʼʼ
-“ওই জমি আপনার কাছ থেকে হাসিল করার পেছনে দৌঁড়ে ভালো পেরেশানি গেছে, আব্বুর! পাওনাদারদের এতদিন যখন ঠেকাতে পেরেছি, আর ক’টা দিন সবুর করে নেবে ওরা। আমি ওই জমি হাসিল করে তা বিক্রি করেই বরং পাওনা মেটাবো। আবার আসবেন, কাকা! বাইরে গাড়ি এসে গেছে বোধহয় আপনাদের।ʼʼ
আফজাল সাহেব অপমানে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “বাপরে কথা! সাহস ভালোই তর। ওই চেংরি! আমি না দিলে কেমনে হাসিল করবা জমি? কিচ্ছু তো আর নাই, তবুও দেমাগ কমে নাই? ভালো বুইঝা পাওনা টাহা দিতে চাইলাম, আবার দেমাগ দেহাও? আমি দেখমুনে কেমনে আমার থেইকা জমি আদায় করো, আর পাওনা মিটাও। হ দেখুমনে আমি।ʼʼ
অন্তূ মুচকি হাসল, “আপনি সে চিন্তা কোরে চাপ নেবেন না, কাকা। বয়স হয়েছে। এ বয়সে উত্তেজিত হওয়া উচিত না। সে-সব আমার জিম্মা, ইনশাআল্লাহ সামলে নেব। আপনার গাড়ি এসে গেছে। আবার আসবেন। আল্লাহ হাফেজ।ʼʼ
অন্তূ বসে থাকে ওভাবেই। বাড়ি ফাঁকা হতেই রাবেয়া কাঁদতে শুরু করলেন। অন্তূর মাথার ব্যথাটা চিটমিটিয়ে উঠল। অন্তূ ধমকে উঠল, “কান্না থামাও। জোয়ার নেমেছে চোখে? কান্নার জন্য বিশেষ পরিস্থিতির দরকার হয়। লোকের আর স্বামী মরে না? তারা আজীবন কাঁদে? কাঁদলে আড়ালে কাঁদবে, খেয়াল রাখবে কান্নার করুণ সুর যেন আমার কান অবধি না পৌঁছায়। অসহায়ত্ব ও চোখের পানিকে ঘৃণা করি আমি।ʼʼ
অন্তূ চেয়ারটার ওপর মাথা এলিয়ে দিয়ে চেয়ে থাকে ছাঁদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে। মার্জিয়া এসে বসে। অন্তূ ওভাবেই জিজ্ঞেস করে, “শরীর ভালো আপনার?ʼʼ
-“অন্তূ……ʼʼ
মার্জিয়ার ক্ষমাপ্রার্থী সুরের ডাকটা অন্তূর কানে পৌঁছাতেই ছাদ থেকে চোখ সরিয়ে সোজা হয়ে বসে, হাত উঁচিয়ে ধরে মার্জিয়ার উদ্দেশ্যে। থেমে যায় মার্জিয়া।
অন্তূ স্থির নজরে তাকিয়ে বলে, “আমি বাংলা সিনেমার মমতাময়ী নায়িকা নই, ভাবী। পুরো সিনেমাতে যে যা-ই করুক, শেষে সব মাফ করে বুকে জড়িয়ে নেয়া, তারপর খালি ভালোবাসা আর প্রেম। আমি ছাড়িও না ধরিও না।ʼʼ
শোনো অন্তূ!
-“একটা কথা বলব ভাবী?ʼʼ
-“হু!ʼʼ
অন্তূ শূন্যে দৃষ্টি মেলে উদাস স্বরে বলল, “যাকে জীবিত অবস্থায় দেখেনি মৃত্যুর পর তাকে দেখতে হায় হায় করতে করতে ছুটে যাওয়ার বিষয়টা মানুষের ভেতরে থাকা আবেগের সবচেয়ে ময়লা দিকের একটা। মৃতদেহ একটা ঘরের আসবাবের চেয়েও মূল্যহীন জড়, তা দেখাতে ফজিলত কী? আব্বু আজও যদি এই সোফায় এসে বসতো, আপনি এখানে এসে দাঁড়াতেন না আব্বুর সামনে।ʼʼ
মার্জিয়া কেঁদে ফেলল।
অন্তূ কপাল চেপে ধরে বড়ই অনীহার সাথে বলল, “আপনি কেন কী করেছেন তার বিচারে যাবার রুচি নেই আমার আপাতত। কিন্তু আমার আব্বু অবহেলিত হবার মতো মানুষ না। কিন্তু আপনি তার একমাত্র ছেলের স্ত্রী হিসেবে তাকে একবার ‘আব্বা’ বলে ডাকেননি। তার নাতিকে গর্ভে ধরেছেন, সামনে গিয়ে সেই খবরটা দেননি। কিন্তু তিনি খেলনা কিনে এনে আম্মুর আলমারীতে রেখেছে।ʼʼ
অন্তূ আলগোছে উঠে চলে যেতে যেতে বলল, “পরবর্তিতেও অন্তত আব্বুকে নিয়ে কোনো শব্দ যেন আপনার মুখে উচ্চারিত না হয়, অন্তত আমার সামনে।ʼʼ
পড়াটা হচ্ছিল না। আব্বু এসে বিছানায় বসে অন্তূর খাতাপত্র নেড়েচেড়ে দেখে বলছে না, “লেখা তো ডাক্তারদের মতোন হয়েছে, অথচ হবি উকিল। কাহিনি কী?ʼʼ
রাত বারোটা বাজছে। অন্তূ ছটফটিয়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আব্বু এসে পাশে দাঁড়ায় অন্ধকারে দাঁড়ালে। আগামীকাল সকালে তার পরীক্ষা। আব্বুকে ছাড়া সে প্রথমবার পরীক্ষা দিতে পারবে। অন্তূ রুমে এসে ঘুমের ওষুধ খুঁজল। নেই। অন্তিক সরিয়ে নিয়েছে। আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
অন্তিক এসে পাশে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কাটার পর অন্তূ বলে, “তোর বউ-বাচ্চার পরিবারে আম্মাকে শামিল করে নে। আর পরিবার চালাতে একটা কাজের ব্যবস্থা কর। টাকা-পয়সা যা লাগবে, ব্যবস্থা করা যাবে।ʼʼ
অন্তিক হাসে, “খুব গৃহিনী হয়ে গেছিস? কখনও জিজ্ঞেস করিসনি আমাকে কিছুই আমার ব্যাপারে।ʼʼ
-“রুচি নেই রে।ʼʼ
-“ভালোই। আচ্ছা, আম্মার ব্যবস্থা হলো, আর তোর? তোর কী?ʼʼ
-“আমার কী? আমার বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। আমি ফিট থাকব। এ আর কী!ʼʼ
অন্তিক চুপ রইল। অন্তূ হঠাৎ-ই জিজ্ঞেস করে, “পলাশ আজগরের কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছিলি?ʼʼ
-“পাঁচলক্ষ।ʼʼ
-“মার্জিয়া তোকে স্টিমেটলি গহনা দিয়েছিল কত টাকার?ʼʼ
-“দুই লাখ টাকার মতো।ʼʼ
-“এছাড়াও কিছু আছে। বলছিস না।ʼʼ
-“তুই শুনতে চাইছিস না।ʼʼ
-“হ্যাঁ। চাওয়াটা অপ্রয়োজনীয়। আর হারানোর কিছু নেই। হারানোর থলি ভরপুর। এখন কারণ জানাটা সময়ের অপচয় আর শব্দ দূষণ হবে।ʼʼ
-“শব্দ দূষণ?ʼʼ
-“হ্যাঁ। তুই বলবি, সেই আওয়াজ আমার কানে যাবে। যা সময়মতো আসেনি, যখন তোর বলার ছিল।ʼʼ
-“বলার মতো উপযুক্ত সময় ছিল না। তাই অনেককিছু হয়ে গেছে।ʼʼ
-“এখনও এমন কিছু ঘটেনি যে বলার উপযুক্ত সময় এসেছে। বাদ। কিছুই হয়নি।ʼʼ
-“ভুল বুঝতেছিস।ʼʼ
-“আচ্ছা, বুঝতে দে। তো তোকে পলাশ আজগর দুই লাখ টাকার গহনার বদলে পাঁচ লক্ষ টাকা দিলো?ʼʼ
অন্তূ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, “শিক্ষা মানুষের মূর্খতা দূর করতে পারে হয়ত, তবে বোকাদের তো কোনো চিকিৎসা নেই। মহাজনদের কাছে যা বন্ধক রাখা হয়, তার মোট মূল্যের ততটুকু তারা মানুষের হাতে দেয়, যতটুকু বাদ দিয়ে মূলটাকা এবং সুদসহ তাদের হাতে থেকে যায়। যাতে সময়মতো টাকা পরিশোধ না করলেও জিনিসের মূল্য মূলটাকা ও সুদের যোগফলের সমান হয়। সেখানে পলাশের মতো একজন নরকের কীট তোর কাছ থেকে দুই লক্ষ টাকার জিনিস রেখে পাঁচলক্ষ টাকা ধরিয়ে দিলো, তুই তা নিয়ে ব্যবসা শুরু করলি, সাহস বটে…. উমম দুঃসাহস বলা চলে।ʼʼ
অন্তিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, জবাব দিলো না। অন্তূ বলে, “জিদ আর পলাশ তোর দোকান খেয়েছে, বাপটাকে খেয়েছে, বোনের ইজ্জত খেয়েছে। আফসোস, অন্তিক তোকে খেয়ে ফেলেনি। পলাশ তোকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেললে আব্বু বেঁচে যেত, আমি বেঁচে থাকতাম, পরিবার বেঁচে যেত।ʼʼ
অন্তিক অদ্ভুতভাবে হাসে, “তুই নিষ্ঠুর হয়ে গেছিস, আব্বুর চেয়েও বেশি।ʼʼ
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। বরাবরের মতো আজও রিচেইক করার সময় পাইনি।]