অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৩২.

0
2

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩২.

মার্জিয়ার শরীরে দিনদিন গর্ভাবস্থার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, শরীরটা অসুস্থও হচ্ছে ঘনঘন। ডাক্তার দেখিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাস্তার মোড়ে রিক্সা নামিয়ে দেবার পর হাঁটতে হাঁটতে মার্জিয়া আনমনেই বলল, “বোরকা ছাড়া তোমাকে দেখতে একটুও ভাল্লাগে না, অন্তূ।ʼʼ

-“জয় আমির কী বলে জানেন? ‘আমার খুব ভালো লাগে, যখন কারও আমাকে ভালো লাগে না।ʼ কথাটার মর্ম আছে, তাই না?ʼʼ

-“তোমারও কি তাই? মানে আমার এখন তোমাকে দেখতে ভাল্লাগতেছে না, এইটা তোমার ভাল্লাগতেছে?ʼʼ

অন্তূ অল্প হাসল, “চরিত্রহীনদের বোরকা পরতে নেই, ভাবী।ʼʼ
মার্জিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, “তাহলে ওই জানোয়ারের কথা বলবা না আমার সামনে। হইতে পারে তোমার স্বামী। কিন্তু আমার শ্বশুর একটা কথা বলতো, ‘গু এর এপিঠ-ওপিঠ সমান। তা খোঁচাতে গেলে তুমি নিজেই নাপাক হবে, ছিটে তোমার গায়ে লাগবে, তাতে তোর শরীর নোংরা হবে, এতে গু-এর কি কোনো ক্ষতি আছে?ʼ তুমি কী করতে চাও বলো তো? তোমার কিছুই বুঝি না আমি।ʼʼ

-“কিছুই করতে চাই না। কিছু না করতে চাওয়াটাই এখন সবচেয়ে বড় করতে চাওয়ার বিষয় আমার।ʼʼ

মার্জিয়া ক্যাটক্যাট করে উঠল, “আবার শুরু করলা? বলছি না, তোমার এসব হেঁয়ালি কথা শুনলে রাগ হয় আমার? সহজভাবে কথা বলবা আমার সাথে।ʼʼ

-“কঠিনের কী আছে? আপনাদের সমস্যা আমার বোরকা না পরা নিয়ে। আম্মু এজন্য কথা বলে না আমার সাথে।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ কিছুটা দূর হেঁটে হঠাৎ-ই বলতে লাগল, “আপনি ছিলেন না সেদিন। আমার গায়ে থুতু পড়েছিল মানুষের ছুঁড়ে দেয়া। কেন জানেন? পুরুষ ঘরে ঢুকিয়ে কাপড় খোলার অপরাধে। শুনতে খারাপ লাগছে? আরও খারাপ কথা শুনুন। টেনে হিচড়ে খুলে ফেলা হয়েছিল আমার বুক থেকে ওড়নার পর্দা। মাথায় জড়ানো গামছাটা কেঁড়ে নিয়ে চুলগুলোকে আলগা করে ফেলা হয়ছিল। এই সুন্দর যাত্রাপালার দর্শক ছিল সেদিন হিউজ পরিমাণ। কিছু বলবেন?ʼʼ

মার্জিয়ার হাঁটার গতি কমে যায়। অন্তূ নিঃসংকোচে, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “ওড়না ছাড়া আমাকে অতগুলো দর্শক দেখলো, চোখের তৃষ্ণা মেটালো, নোংরামি করে ধরা পড়ার দ্বায়ে বিয়ে দিয়ে দিলো নাংয়ের সাথে। এরপর সেই শরীরে বোরকা জড়ানো, মুখ ঢাকাটা পাগলামী হবে না?ʼʼ

মার্জিয়া তাকিয়ে রইল অন্তূর দিকে। অন্তূ সাবধান করল, “সামনে তাকিয়ে হাঁটুন, হোঁচট খাবেন।ʼʼ

বাড়ির গলি সামনেই, আর কয়েক পা এগোতে হবে। রাস্তায় লোক নেই। ওদের পার করে একটা গাড়ি গিয়ে থামল সামনে। ওরা দুজন হেঁটে গাড়িটা পার করে এগিয়ে যাওয়ার সময় কেউ ডাকল, “শোনো!ʼʼ

অন্তূর বুকটা ধুক করে ওঠে। প্রখর মস্তিষ্কে কণ্ঠস্বরটা চাপ ফেলল। এই কণ্ঠ চেনে অন্তূ। ফিরে তাকায়। হুডির টুপি মাথায় পলাশের। মার্জিয়া জানতে চায়, “কে এইটা, অন্তূ? চেনো তুমি? এইটা জয়ের বড় ভাই নাকি?ʼʼ

অন্তূ জবাব না দিয়ে ভাবীর হাতখানা চেপে ধরল। পলাশ আজগর এগিয়ে আসে, ঠোঁটে লেগে আছে স্থায়ী সেই হাসি।

অন্তূ শুধায়, “ভালো আছেন?ʼʼ

পলাশ হেসে উঠল, “তোমাদের ওখানেই যাচ্ছিলাম। সেই কবে থানা থেকে আসলাম, এরপর আর খোঁজ নাই। অন্যসব লোকের এতদিনে বউ, বাচ্চাসহ সব চলে যায়। তোমাদের সাথে কিছুই করলাম না তেমন। আগের সব ঋণকারীদির সাথে না-ইনসাফি হয়ে যাবে। দেখা যাবে, ওরা অভিযোগ তুলবে, ওদের সাথে যা হয়েছে, তোমাদের সাথে নয় কেন? ঠিক বলিনি?ʼʼ

-“হ্যা ঠিক বলেছেন। আসলেই আমাদের এত সুযোগ দিয়ে ঠিক করেননি। আমরাও ঋণী, ওরাও ঋণী। ওরা যদি এতকিছু হারায়, এত অত্যাচারিত হয়, আমরা কেন না?ʼʼ

পলাশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “চলো, গাড়িতে ওঠো। একসাথে যাই।ʼʼ

অন্তূ মার্জিয়াকে বলল, “ভাবী আপনি চলে যান এটুকু। আমি আসছি খানিক বাদে।ʼʼ

পলাশকে বলল, “বাড়িতে গিয়েও আমার সঙ্গেই কথা বলবেন। চলুন আশপাশেই কোথাও বসে কথা বলি। ভাবী, আপনি বাড়িতে চলে যান। আমি আসছি।ʼʼ

এটাই পলাশ আজগর। মুখরা, বদমেজাজী মার্জিয়া একদম মিইয়ে গেছিল। ভয়াতুর চোখে অন্তূর দিকে চেয়েছিল। অন্তূ চোখে আশ্বাস দিয়ে বলল, “যান। কিচ্ছু হবে না আমার। এটুকু ভরসা রেখেছি নিজের ওপর। আম্মাকে বলবেন, ওষুধ কিনতে গেছি। আপনার অসুস্থ লাগছিল, আগে ফিরেছেন। আমি চলে আসব, ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ।ʼʼ

মার্জিয়া যেতে যেতে বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল। পলাশ অন্তূকে বলল, “আচ্ছা তোমার বাড়িতে আজ আপাতত গেলাম না। গাড়িতে ওঠো। অন্য কোথাও যাই।ʼ†

-“পায়ে হেঁটে যাই চলুন। একটু হাঁটাও হবে। সন্ধ্যার রাস্তায় হাঁটতে খারাপ লাগবে না।ʼʼ

পলাশ ভ্রু কুঁচকে ঠোঁটদুটো একপাশে বাঁকিয়ে হাসছিল। অন্তূর ভেতরে ধুকপুক করছে। মস্তিষ্ক সেই আতঙ্ক ভুলতে পারেনি। পলাশ যে কফিশপে নিয়ে গেল, কফিশপ হিসেবে বেশ লাক্সারিয়াস। ভেতরের আলোকসজ্জা ডার্ক। পলাশকে দেখে ম্যানেজার দৌড়ে এসে সালাম দেয়। অন্তূ বুঝল, কফিশপটা পলাশের নিজস্ব।

পলাশ গা ছেড়ে দিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। অন্তূ চারপাশে তাকাচ্ছিল। লোকজন নেই। ভেতরের পরিবেশটা তৈরি করা হয়েছে আলো আঁধারের সংমিশ্রণে। টেবিলের ওপর তিনটে গ্লাস, একটাতে টিস্যু রাখা। একটা পানির বোতল, আর একটা কাঁচের ফুলদানি।

-“ভয় পাচ্ছ?ʼʼ

অন্তূ উপর-নিচ ঘাঁড় নাড়ল, “পাচ্ছি।ʼʼ

পলাশ হো হো করে হাসল, “প্রয়োজন নেই। বসে পড়ো। পাবলিক প্লেসে দুষ্টুমি করার ক্লাস পেরিয়ে এসেছি বহুদিন আগে। ছোট বয়সে ওসব করতাম। যাকে তোমরা ভদ্রলোকেরা বলো, ওই বখাটেপনা। পাবলিকের সামনে খেলি দেখানোটা প্রাথমিক ছাত্রদের কাজ, আমি হাইস্কুলের মাস্টার।ʼʼ

অন্তূ পলাশকে যতবার, যতক্ষণ দেখেছে, ততবার ততক্ষণ পলাশের ঠোঁটে হাসি আর জ্বলজ্বলে চোখদুটোয় ভয়ানক এক ইশারা খেলতে দেখেছে। পলাশ কফি আনতে বলল একটা ছেলেকে।

-“আপনার টাকা দু’দিনের মধ্যে দিয়ে দেব। আপনি ছাড়াও আরও কিছু পাওনাদার আছে। জমি বিক্রি করতে হবে। জমি নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলো মীমাংসা হচ্ছে না বিধায় দেরি হচ্ছে। এর মাঝে আব্বুর ইন্তেকাল হলো। আমি আপনার কাছে দু’দিন সময় চাইছি। এবার আমি সময় নিচ্ছি।ʼʼ

-“তোমার বাবা মারা গেছে? ইন্না লিল্লাহ।ʼʼ

পলাশ দুঃখিত হওয়ার নাটক করল। অন্তূর শরীরকে বেশ কিছুক্ষণ চোখে গিলে হাসি প্রসারিত করে বলল, “সুন্দর একটা ঘ্রাণ পাচ্ছি, তোমার শরীর থেকে আসছে বোধহয়।ʼʼ

অন্তূ তাকাল, “আমি কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করিনি।ʼʼ

হা হা করে হেসে ওঠে পলাশ, “গরু মরলে শকুন খোঁজ পায় কীভাবে? গরু মরার আগে সুগন্ধি মেখে মরে? মেয়েদের শরীরের নিজস্ব একটা ঘ্রাণ আছে, তার তুলনা বিশ্বের কোনো পারফিউমের সাথে হয় না।ʼʼ

অন্তূর শরীরটা ঝাঁকি দিয়েছ উঠল। জীবন তাকে কোন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তা এখনও বুঝে ওঠা যাচ্ছে না।

পলাশ গা ছেড়ে আরাম করে বসে ঘাঁড় বেঁকিয়ে বলল, ভাবছি, “তোমার পাশে গিয়ে বসলে গন্ধটা আরও ভালো পাওয়া যাবে। তাছাড়া খালি খালি চেয়ার ফাঁকা রয়েছে তোমার পাশেরটা।ʼʼ

অন্তূর দৃষ্টি টেবিলের দিকে ছিল। মুচকি হেসে ফেলল, “শুধু ভাবছেন? এতটাও আশা করিনি আপনার কাছে। আপনার এতক্ষণে বসে পড়ার কথা ছিল। আপনার সাথে ব্যাপারটা মানায়।ʼʼ

পলাশ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে অন্তূর দিকে ঝুঁকে আসে। চোখের পলকে অন্তূ টেবিলের উপরে থাকা কাঁচের ফুলদানিটা তুলে কাঠের চেয়ারে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে ফুলদানি ভেঙে তিন টুকরো। হাতে থাকা টুকরোটাপলাশের গলায় উঁচু হয়ে থাকা স্বরনালীর ওপরে ধরল।

পলাশ চমকে গিয়ে ঝুঁকে পড়া থেকে সোজা হলে অন্তূ উঠে দাঁড়াল। ভাঙা কাঁচের চাপে পলাশের গলার চামড়ায় ছেঁদ পড়ে, কয়েক বিন্দু রক্ত বেরিয়ে আসে।

-“ভুললে চলবে, সেদিন কোনোরকমে আপনার ডেরায় ছিলাম, আজ পাবলিক প্লেসে। জবাই করে রেখে যাব একদম। তারপর মরার পর যা করার করবেন আমার।

জয় আমির আর আপনার মধ্যে ফারাক একটাই—জয় বেঁচে থাকা নিয়ে খুব বিরক্ত, মৃত্যুকে বোধহয় খুব একটা ভয় পায় না। কিন্তু আপনি মৃত্যুকে খুব ভয় পান।ʼʼ

অন্তূ কাঁচের টুকরো ফেলে দিলো ছুঁড়ে। ফ্লোরে পড়ে খানখান হয়ে গেল। অন্তূ বসে পড়ে চেয়ারে। পলাশ ধীরে ধীরে দু-কদম পেছায়। টেবিলের উপর থেকে টিস্যু নিয়ে গলার রক্তটুকু মুছে নেয়ার সময় মুখ বিকৃত করে। আচমকা রেস্তোরা কাঁপিয়ে তোলে পলাশের ফেটে পড়া অট্টহাসির শব্দ। বাচ্চাদের মতো হাতে তালি দিলো পলাশ, “মাইন্ড ব্লোয়িং!ʼʼ

আবারও হাসে হা হা করে। চেয়ারে বসে পড়ে ধপ করে। দৃষ্টি স্থির অন্তূর ওপর, “আমি ভাবতেছিলাম। আমি সত্যিই খুব হয়রান ছিলাম, জয় কাত হলো কীসে? তুমি জানো? মানুষ যেমন ঠোঁটের সিগারেট কেঁড়ে নেয়, ও সেভাবে মেয়ে ভাগাভাগি করেছে আমার সাথে। আর ও তোমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেল সেদিন আমার সাথে ঝামেলা করে। অথচ ও আমায় চেনে। কিন্তু তুমি সেদিন যেভাবে কাঁদছিলে, ছেঃ! আর পাঁচটা মেয়ের মতো লেগেছিল। মাগার এরপর একটা চমক, ‘থুহ!ʼ সোজা জয়ের মুখে। আমি খুব ভেবেছি, আমার বউকেও বলেছি তোমার কথা।ʼʼ

পলাশ চট করে থামল। কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ধুম ধরে চুপচাপ। কিছু মনে পড়েছে যেন, এভাবে তুড়ি বাজালো, “ওয়েট! আসছি। এক মিনিট।ʼʼ

হাই-কমিশন ব্রান্ডের, ব্যালেন্ডেড স্কট্চ উইস্কি মদের বোতল নিয়ে ফিরল। গলগল করে গ্লাসে ঢেলে তাতে চুমুক দেবার আগে বলল, “নেবে এক সিপ?ʼʼ

অন্তূ মাথা নাড়ল, “উহু।ʼʼ

চোখ বুজে পুরো এক শট শেষ করে গ্লাস টেবিলে রেখে বলল, “এবার কথায় এনার্জ আসবে। তোমাকে সেদিন একদম সাধারণ লেগেছিল। শিট! হতাশ আমি নিজের ভাবনায়।ʼʼ

উঠে যেতে যেতে বলল, “জয় যেমনই হোক, ওর রুচি ভালো এটা আমি জানতাম। বড় বংশের ছেলে তো! আজ প্রমাণ হলো আর একবার।ʼʼ

একটা ট্রে এনে বসল আবার। তা থেকে এক টুকরো আদা, কয়েকটা পুদিনা পাতা, সোডার কৌটা থেকে খানিকটা সোডা, দু টুকরো লেবু, দুই চামচ চিনি দিয়ে তাতে উইস্কি ঢাললো। দুই চুমুক খেয়ে বলল, “বারবার ভালো লেগে যাচ্ছে তোমাকে। আমার বউ না থাকলে একটা চান্স নিতাম তোমার ওপর। তোমাদেরকে একরাত পর ছেড়ে দেয়া যায় না, বুঝলে! রেখে দেবার মতো, তুমি। কিন্তু আমি আমার বউকে খুব ভালোবাসি।ʼʼ

-“আসলেই। বোঝা যায়। অনেক বেশি ভালোবাসেন আপনার স্ত্রীকে আপনি।ʼʼ

-“তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কী?ʼʼ

-“বুঝি না।ʼʼ

অন্তূর দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার সমস্যা কী জানো? আমাকে ভয় পাওয়া লোকের তো অভাব নেই, সেসবের ভিড়ে ব্যতিক্রম হিসেবে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা কারও সামনে খুব কাবু হয়ে যাই। দুনিয়ার খারাপ মানুষের আরেকটা স্বভাব আছে। এরা ভালো মানুষের ওপর খুব সহজে পিছলা খায়। একে বলে বিপরীতে আকর্ষণ বোধ করা। পজিটিভ-নেগেটিভ তারের মতো ব্যাপার আর কী! বুঝছো?ʼʼ গা দুলিয়ে হাসল পলাশ।

সাধারণ দেখতে লোকটা। কোনো জাকজমকতা নেই। অভিজাত্য আছে, তবে তা প্রকাশের যেন তাগিদ নেই ভেতরে। হুডির টুপি নামানো। নকশালদের মতো অস্বাভাবিক লম্বা কাঠামো। জ্বলজ্বলে চোখের মাঝ দিয়ে খিলানের মতো নাক। হাসলে গা ছমছম করে ওঠে। অথচ সারাক্ষণ হাসে ঠোঁটদুটো।

পলাশ জিজ্ঞেস করল, “আর তো কথাই বলছো না? শুধু কি টাকার জন্য এখানে এনেছি তোমাকে? তুমি চাইলে এই মুহুর্তে টাকা সব মওকুফ করে উল্টো আমি তোমাকে টাকা দিতে পারি।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ বসে রইল। মাথাটা ফাঁকা লাগছে। উঠে যাবার জন্য পা চলছে না।

-“আচ্ছা, আর কী কী পর্যবেক্ষণ করেছ আমার? বলো শুনি। তোমার কথা শুনতে খারাপ লাগছে না। শ্যাহ! গলার কাছে জ্বলছে, এই একটা কাজ করলে?ʼʼ

অন্তূ বলল, “এখনও তেমন কিছুই জানা হয়নি। সাধারণ জ্ঞান দিয়ে বিচার করতে জানাশোনার দরকার পড়ে না। যা পর্যবেক্ষণ একদিনেই করেছি।ʼʼ

পলাশ আবারও ঝুঁকে পড়ে অন্তূর কানে ফিসফিস করে বলল, “তোমার পর্যবেক্ষণ আর আমার অভিজ্ঞতা, তোমার মানুষ খুন করার ইচ্ছা–বিদ্রোহ আর আমার পেশা। চলো এই নিয়ে একটা সিন্যামাটিক খেলা খেলা যাক।ʼʼ

ম্যানেজার এসে পলাশের হাতে একটা ইনটেক্ট মদের বোতল ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। পলাশ হিপফ্লাস্কে মদ ঢেলে নিতে নিতে বলে, “তোমার পেছনে আমার লোক পড়ে থাকবে। আমার আদেশেই থাকবে। ছেড়ে তো দিতে পারি না তোমাকে। বিন্দু জলের মতো বহুদূর গড়াবে তুমি, যা বুঝলাম। তুমি আজকের মতো শিউরে উঠে যতদিন বাঁচতে পারবে, ততদিন খেলা তোমার। কিন্তু হারলে দামী মূল্য চেয়ে নেব আমি।ʼʼ

-“আমি কোনো খেলা খেলছি না যদিও। আপনি আমার ভাইয়ের পাওনাদার। ভাই অপারগ টাকা পরিশোধ করতে, তাই তা আমার জিম্মায়। তবুও যদি ধরুন, আমি জিতে যাই…ʼʼ

পলাশ হুডির টুপি মাথায় তুলল, “কী চাও?ʼʼ

-“তখন চেয়ে নেব।ʼʼ

পলাশ মাথা দুলিয়ে হাসে, “সাবধানে থেকো। আসছি, খোদা হাফেজ।ʼʼ কপালে তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল ঠেকিয়ে সালাম জানানোর ভঙ্গিমায় ইশারা করে মদের বোতলটা হাতে ধরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “রুবেল! ম্যাডামকে কফি না খাইয়ে যেতে দিস না।ʼʼ


সোমবার বিকেল চারটা। ছাঁদের ওপর পাশের বাড়ির পুঁচকে ছেলের ঘুড়ি এসেছিল। তখন জয় কবুতরকে দানা খাওয়াচ্ছিল। ঘুড়িটা ছাদে পড়তেই ধরেছে। তা তো পুঁচকেটাকে ফেরত দেয়-ইনি, লাটাইটা অবধি জোর করে কেঁড়ে নিয়ে সে এখন নিজে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। সাদা লুঙ্গিটা দুপাশ থেকে এনে দুই ঠ্যাঙের মাঝে আঁটকে রেখেছে। খালি গায়ে গলায় লাল টকটকে চওড়া গামছা ঝুলছে। কিন্তু লুঙ্গি-গামছার সাথে পায়ে কালো চামড়ার বেল্টওয়ালা ফ্ল্যাট স্যান্ডেল। এটা এক অসঙ্গতি, তার ওপর আবার চামড়ার স্যান্ডেলটার বেল্ট খোলা।

দুর্দান্ত উড়ছে ঘুড়িটা। পুঁচকে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। জয়ের ভয়ে জোরে কাঁদার উপায় নেই। জয় বলে দিয়েছে, “কান্নার সাউন্ড কানে আসলে এখনই ধরে একদম দা দিয়ে কোপ মেরে সুন্নতে খৎনা করে দেবো।ʼʼ

পুঁচকে এমন ভয়ানক রিস্ক নেয়নি। সে নিঃশব্দে ফোপাচ্ছে, আর দেখছে নিজের ঘুড়িটা জয় কীভাবে হানাদার বাহিনীর মতো দখল করে উড়াচ্ছে। জয় জিজ্ঞেস করল, “তোর ঘুড়ির দাম কত রে?ʼʼ

-“কাগজ কিনে বানাইছি। তুমি আমার ঘুড়ি দাও।ʼʼ

-“তোতলু শালা, সেই কাগজ তো আর তোর রূপ দেখে দেয় নাই দোকানদার। যে ফটকা মারা সুরত তোর। কাগজের দামই ক হে।ʼʼ

-“ছয় টাকা।ʼʼ

-“তোর বোন আছে?ʼʼ

-“বিয়ে হয়ে গেছে।ʼʼ

-“শিট! আমি মানুষ খারাপ হলেও লোক ভালো। ভাবলাম, তোর বোনকে জ্বালানোর দামে তোর ঘুড়িটা ফিরিয়ে দেব। সেই বালিতে গুড়। মাইনষের এঁটোতে মিছেমিছিও মুখ রোচেনা আমার। বিয়ে দিবি ভালো কথা, আর ক’দিন পরে দিলেই আজ ঘুড়িটা ফেরত পেয়ে যাইতি।ʼʼ

-“এএঅ্যা! আমার ঘুড়ি দাও।ʼʼ

-“ওয়েট! ওই শালা তোতলু, তোরে আমি জিগাইছি, তোর বোন আছে কিনা? তুই ‘বিয়ে হয়ে গেছেʼ কইলি ক্যা? বিয়ের প্রস্তাব দিছি আমি? তুলে মারব এক আঁছাড়?ʼʼ

ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল পুঁচকে। জয় ঠোঁট কামড়ে থাপ্পড় তুলে শাসালো, “চুপ কর! এত বিশ্রীভাবে কেউ কাঁদে? হারুনফাটার মতো গলা নিয়ে কাঁদিস ক্যান, বোয়াল? যার কণ্ঠ ভালো না, তার উচিত জীবনে না কাঁদা।ʼʼ

নিচে থেকে কবীরের চ্যাঁচানো শোনা যায়, “ভাই, নামেন। আইছি।ʼʼ

-“তো কী? নাচবো একচোট? আইছিস, দাঁড়া। পায়ে মরিচা ধরছে?ʼʼ

ঘুড়ির সুঁতো লাটাইয়ে পেঁচিয়ে তা ছুড়ে দিয়ে বলল, “তোতলু, ধর তোর ঘুড়ি। আজ প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি, তোর ওই বিশ্রী কান্নার অভিশাপ সাথে করে গেলে, দেখা গেল গাড়ি উল্টে মরে পড়ে রইলাম। শ্বশুরবাড়ি তো যাওয়া হবেই না। জীবনে বাসর না করেই ম্যারিড-ব্যাচেলর অবস্থায় মরা লাগবে। বাসর না করে মরা ঠিক না। কতকাল স্ট্রিটফুড খাবো? এবার লিগ্যালি ঘরের খাবার খেয়ে মরব।ʼʼ

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here