#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩৪.
বিগত ২০১৪ এর ৫ই জানুয়ারী দশম জাতীয়সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ভোট দিতে গেছিলেন না আমজাদ সাহেব, কাউকে যেতেও দেননি। অন্তূ তখন নতুন ভোটার। সে আব্বুকে খুব আগ্রহের সাথে বলে, “কাল আমি নাগরিক হব, আমার প্রথম ভোট দেব।ʼʼ
আব্বু হেসেছিলেন, “তোর জন্য ব্যালট পেপার বেঁচে থাকলে নাহয় ভোট দিতি। আজ রাতেই সেসবে সিল পড়ে যাবে। কষ্ট করে ভোট দিতে যাবার ঝামেলা নেই। জনগণের খাটুনি কমাতে সরকার দেখ কত কী করে! তবুও লোকে বলে, রাজনীতি আর রাজনৈতিকতা ভালো না।ʼʼ
সে খবরের কাগজে পড়েছিল, নির্বাচনের আগের রাতে কমপক্ষে পাঁচশো ভোটকেন্দ্র আগুনের হল্কায় দাউদাউ করে জ্বলেছে। বিশ-পঁচিশ জনের মৃ-ত্যু-র খবর যদি ছাপাই হয়, আমজাদ সাহেব ধারণা করলেন, মৃত্যু এর চেয়ে অনেকবেশি হয়েছে, আহত অগণিত। তার মধ্যে নিশ্চয়ই শিবির আর বিরোধীদলীয় বিএনপির ছেলেরা বেশি মরেছে! অন্তূ সতর্ককণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল, “আব্বু! তুমি কি জামায়াত শিবিরকে সমর্থন করো?ʼʼ
আমজাদ সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলেন, “আমি অন্তত এ দেশের বর্তমান ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচার নেতাদের সমর্থন করি না।ʼʼ
অন্তূদের ভার্সিটি ছুটি হয়ে গেল। চারদিকে হাহাকার। মাসজুড়ে স্কুল-কলেজে ছুটির পর ছুটি। একে একে জেলে যায় লোকে, তার কয়েকদিন পর তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। সুবিচারে দেশ ভরে উঠতে লাগল কানায় কানায়। লোকে রাতে বাইরে বের হয় না সুবিচারের ভয়ে। কোথাও তাদের ওপর না সুবিচার ঘটে যায়! এমনিতেই এত সুবিচার এই ১৪৭৫৭০ বর্গ কি.মি. সীমানার দেশে আঁটছে না, উতলে পড়ে যাচ্ছে।
বাইরে বের হওয়া লোকের নিশ্চয়নতা নেই ঘরে ফেরার। বিনা নোটিশে কারাদন্ড হয়ে যায় আজকাল মানুষের। এভাবে পেরিয়ে যায় প্রায় ছয়মাসের মতো। জুলাই মাসে সবকিছু সামান্য স্বাভাবিক হওয়ার পরেই সবকিছু চলতে শুরু করল। কতদিন এভাবে চলা যায়? উত্তাল ঢাকা শান্ত যেন। নির্বাচন থামানো যায়নি, ঠিক ক্ষমতায় বসে পড়েছে ভক্ষকগণ। এই শোক এবং হতাশায় আর বিরোধী বিপ্লবীরা একে একে জেলে যাওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত তারা। আইনস্টাইন বলেছিলেন, পৃথিবীর প্রায় সকল তুলনাকে আপেক্ষিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। আপেক্ষিকভাবে বিরোধীদলগুলো নির্বাচনের পর ঠিক যতটা হতাশা নিয়ে দমে গেল, হামজা জয়ের মতো ছাত্রলীগের তরুণেরা উপরমহলের প্রশ্রয়ে তত বেশি হুংকার দিয়ে নিজেদের জাহির করার সুযোগ হাতিয়ে নিলো।
আজ ১২ই ডিসেম্বর, ২০১৪; রোজ শুক্রবার। অন্তূ বিয়ের সাজে বসে এসব ভাবে। অবাক হয়, জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে? সে ধীরে ধীরে সাধারণ একটা স্বপ্নদেখা মেয়ে থেকে কেমন আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের দিক ঝুঁকে পড়ছে। কীসের সংগ্রামের আগুন বুকে ধিকধিক করে জ্বলছে? পরিস্থিতি তার ভেতরে যে আগুন জ্বালিয়েছে তা তাকে আর কতদূর নিয়ে যাবে?
অন্তূ মাঝেমধ্যেই বিরক্ত হয় নিজের ওপর। সে আজ এমন প্রতিবাদ করতে না গেলে, সহ্য করা শিখলে জীবনটা এর চেয়ে অন্তত ভালো হতো। তখনই আব্বুর সেইসব শিক্ষা এসে সামনে দাঁড়ায়, “অন্তূ! পরিণামের চিন্তা যদি তোকে প্রতিবাদ করা থেকে পিছপা করে তোলে, সহ্য করতে শেখার পরামর্শ দেয়, সেই চিন্তাধারায় অল্প একটু কেরোসিন ঢেলে ছোট্ট একটা দিয়াশলাই জ্বালিয়ে দে। আর যদি সবাই এটা করতে পারতো দেশে কখনোই স্বৈচারার সোচ্চার হয়ে ওঠার সুযোগ পেত না। পৃথিবীতে ক্ষমতা এবং দূর্বলতা আলো এবং অন্ধকারের মতো। অন্ধকার না থাকলে আলো কখনও দৃশ্যমান হতো না। এখানে আপেক্ষিকতার সূত্র খাটে। দূর্বলতার আপেকিকতায় ক্ষমতা জাহির হয়। তুই যতক্ষণ দূর্বল, তার তুলনায় বরং তোর সম্মুখে কেউ শক্তিশালী। যখন তুই-ও শক্তিশালী, তখন তোরা দুজন বরাবর। কাটাকাটি হয়ে যাবে শক্তির, আর কারোটাই তখন শক্তি থাকবে না। ঠিক যেমন আলোর বিপরীতে আলো অতুলনীয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ফলে যে ক্ষতিগুলো জীবনে নেমে আসে, এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যারা ক্ষতি ও অবিচারের সম্মুখীন হয়, আল্লাহ তায়ালা তাদের বলেছেন, মজলুম। আর তিনি স্বয়ং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—নিশ্চয়ই তিনি তার মজলুমদের সাথেই আছেন।ʼʼ
অন্তূ ভেতরে বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে। শুরুটা হয়েছিল, একটা বোরকা পরা মেয়েকে সিগারেট হাতে তুলে দেয়ার মাঝ দিয়ে। এরপর প্রতিটা দিন একটা মেয়েকে নিয়ে রঙ্গ-তামাশা কথা তরুণ যুবনেতার বিরুদ্ধচারণ দিয়ে শুরু এই কাহিনি আজ অন্তূকে, পর্দাহীন, মনুষত্বহীন, সুস্থতাহীন এক অস্বাভাবিক চিন্তাধারার মানুষের পরিণত করেছে।
মেয়েরা যুদ্ধে ইজ্জত দিয়েছে, গর্ভের ছেলে, মাথার সিঁদুর, গায়ের কাপড়…কেন? কেন শুধু ওরা দিয়েছে? ওরা কেন কেড়ে নিতে পারেনি? ওরা কেন কেঁড়ে নিতে আসা হানাদারের বুকে বটির কোপ বসাতে পারেনি, চালের বাটাম খুলে কেন দিতে পারেনি মাথায় একটা বাড়ি, সেসব কুকুরদের র-ক্তে কেন চুড়ি পরা হাতদুটো ধুয়ে ফেলতে পারেনি? আজও কী হচ্ছে? সেদিন আঁখি কেন একাধিক নারকীয় পিশাচদের দৈহিক খোরাক হয়েছে? কেন দিখণ্ডিত করে ফেলতে পারেনি সেইসকল ক্ষুধার্ত জন্তুদের পাপী দেহপিণ্ডটাকে? অন্তূর সাথে কি এর কম কিছু হয়েছে?
এত হানাহানি কীসের? যারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা কেন জেলে পঁচে মরছে? গত ২০১৩ এর ১২ই ডিসেম্বর এক ইসলামি রাজনৈতিক নেতাকর্মী আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। তার অপরাধ, সে মুক্তিযুদ্ধের মানবতাবিরোধী অপরাধী। টুপি, দাড়ির সাজে একজন মুসলমানবেশী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তা কতটুকু সত্যি? যদি এভাবে সকল জামায়াত পার্টির সদস্যরা অপরাধী হয়, তাদের তো ধরে জেলে পুড়ে দেয়া হচ্ছে, অথবা পড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কালো মুখোশ, ঝুলে পড়ছে ফাঁসির কাষ্ঠে। এরপর ক্ষমতায় আছে নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধা, এবং দেশপ্রেমিকে মানুষেরা! তাহলে এই রাহাজানি, সহিংসতাগুলো কাদের কাজ? সকল অপরাধীর শাস্তি হয়ে গেছে। এখন গোটা বাংলা শান্তিতে ছেয়ে যাওয়ার কথা। তবুও কেন শহরে শহরে বাস-ট্রাম পুড়ছে, মানুষ মরছে, ছিনতাই, নির্যাতন, অপরাধের সীমা থাকছে না? জয়েরা কেন এত শক্তিশালী? হামজারা কী করে জনসাধারণের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে? বাংলাদেশ তো মুসলিমের দেশ, বাংলাদেশ তো সকল ধর্মের ঐক্যের দেশ! তাহলে শান্তি কেন নেই? অথচ প্রতিটা ধর্মেই তো জীবনবিধান রয়েছে। তবুও কেন এখানে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের ধার ধারার মতো সংবিধান নেই? সংবিধানে কেন ধর্ম নেই? ধর্মের ডাক দেয়া মানুষগুলো কেন শেলের শিক ধরে দাঁড়িয়ে কালকুঠুরিতে?
মার্চের ষোলো তারিখে অন্তূ গেল থানায়। চাচার নামে কেইস ফাইল করতে। আমজাদ সাহেব জানতেন না, যে অন্তূ টুকটাক বিষয়গুলো জেনেও আরও জানার জন্য না-জানার ভান করছে। পরেরদিন বঙ্গবন্ধুর ৯৪তম জন্মদিন। থানার গেইটে এক পুলিশ থামিয়ে অন্তূকে বলল, “বোরকা খুলে ভেতরে যান। হিজাব খুলে ফেলুন। মুখ দেখান।ʼʼ
-“বোরকার ওপর দিয়েই তল্লাশি করুন।ʼʼ
-“ম্যাডাম, যা বলছি তা করুন। আজ জঙ্গির দল বোরকার আড়ালে বের হবে কত এমন। এসব পর্দা সব স্থানে চলেনা। খুলে ভেতরে যান।ʼʼ
অন্তূ ধৈর্য্য হারায়। জ্বালা ধরানো হাসি হেসে বলেছিল, “কোথাও শুনেছিলাম, ‘ধান পোড়ে চুলায়, পানি ঢালে পাছায়।ʼ আপনি সারাদেশে আছেন? যেখানে বোরকার তলে আসলেই ধান পুড়ছে, সেসব জায়গায় গিয়ে পাহারা দিন বরং। কর্তব্যপরায়নতার নাটক করে অজায়গায় পানি ঢালবেন না। নয়ত দেখবেন ওদিকে ধান পুড়ে সিদ্ধ-পাতিলটাসহ ব্লাস্ট হয়ে গেছে।ʼʼ
অন্তূ আর দাঁড়ায়নি সেদিন। সেই কর্তব্যপরায়ন পুলিশ অফিসারকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চলে এসেছিল।
অন্তূর বরযাত্রী আসলেই খুব বেশি নয়। হুমায়ুন পাটোয়ারী, হামজা, পার্টির বিশিষ্ট কিছু ছেলেরা ছাড়া আর কেউ আসেনি। জয়ের পরনে সাদা শেরওয়ানি। মাথাটা খালি, পাগড়ি নিয়ে পিছে পিছে ঘুরছে রাহাত।
খাওয়া শেষ করে অন্তূকে বের করে নিয়ে যাওয়া হলো। অন্তূ একফোঁটা কাঁদল না। অন্তিক বোনের হাতটা চেপে ধরে গেইট অবধি নিয়ে যায়। রাবেয়া দূরে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঝরঝর করে পানি পড়ছিল অসহায় মায়ের চোখ দিয়ে। অন্তূ এগিয়ে গিয়ে বলে, “আম্মা! বিদায় দাও। নতুন এই জীবনে কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই। বেঁচে থেকে কিছু নতুন অভিজ্ঞতায় ভিজিয়ে ফেলতে চাই হাতদুটো। সেই অভিজ্ঞতা সামলে নেয়ার দোয়া কোরো। আমি আসব তোমায় দেখতে। খবরদার ওই পাপের ইট-বালুতে গড়া দালানে তোমার পা ফেলো না, আম্মা। আব্বু আমায় যেদিকে দিয়ে গেছে, তা আমার মাঝে থাক। তোমরা পা নোংরা করতে যেও না। দেশের পরিস্থিতি ভালো না, আর না মানুষ, সমাজ ময়লা হয়ে গেছে। তোমরা সরল মানুষ কোনোরকম বেঁচে থাকলেই অনেক।ʼʼ
রাবেয়া হু হু করে কাঁদেন। অন্তূ বড় হয়ে গেছে। ছোট ছোট প্রতিবাদ থেকে জন্ম নেয়া অন্তূ কিছু বিঁষমাখা অভিজ্ঞতার আয়োজনে আজকাল কেমন যেন লাগামছাড়া হয়ে গেছে।
অন্তিক ফিসফিস করে বলে, “যতদিন ছিলি, কথা হয়নি বহুবছর। আজ বহুত কথা টের পাচ্ছি ভিতরে। বলার সুযোগ নেই। বহুদিন রাতে ঘুমাইনি, চোখদুটো খুব জ্বলছে। তোর চোখ জ্বলছে না?ʼʼ
-“জ্বলছে না। আম্মার খেয়াল রাখিস। ভাবী আর তোর বাচ্চার হাল ধর। হতাশা হলো দূর্বলদের দেহে লেগে থাকা জীবাণু। যা তোকে গ্রাস করেছে। হতাশা ঝেরে একবার জিতে ফেরার মতো করে গা ঝারা দে। দেখবি নিজেকে পুরুষের মতো মনে হবে। যা করেছিস, সেইকাল পেরিয়ে এসেছিস। আমিও তো জীবনে কতকিছু করেছি। পর্দাও করেছি। আজ এই বিয়ে সাজে শ মানুষ দেখছে। এখন কি সেই অতীতের বোরকা পরা অন্তূকে ভেবে কাঁদবো? নতুন করে শুরু কর। আম্মার তোকে প্রয়োজন, ভাবীর তোকে প্রয়োজন, তোর বাচ্চার তোকে প্রয়োজন।ʼʼ অন্তূর স্বর হালকা কাঁপলো পর্দার কথা বলতে গিয়ে।
-“আর তোর? তোর প্রয়োজন নেই আমাকে?ʼʼ
-“আমার আমাকে খুব প্রয়োজন। এছাড়া আশপাশে প্রয়োজনীয় কিছু তেমন চোখে পড়ছেনা আপাতত।ʼʼ
—
গাড়ি তখন চলছে হাইওয়ের ওপর দিয়ে। অন্তূর পাশে জয় নেই। সে পেছনের গাড়ির ড্রাইভার। উদ্ভট কর্ম খুব মানানসই তার সাথে। সামনের গাড়িতে হামজা ড্রাইভারের পাশে ছিল। রিমি বসেছে অন্তূর পাশে, ওর কোলে কোয়েল। একদৃষ্টে অন্তূকে দেখছে, বোঝার চেষ্টা করছে। কবীর আর একজন মুরব্বী এবং হুমায়ুন পাটোয়ারী পেছনের সিটে। অন্তূ তাকিয়ে আছে নিজের বাঁ হাতের তালুতে। মেহেদিতে রাঙা হাতে কী খুঁজছে কে জানে!
বিকট একটা আওয়াজে কানের তালা লেগে গেল। রিমি কান চেপে ধরে নিচু হয়। গাড়ি থামতেই ছুটে বেরিয়ে যায় হামজা ও হুমায়ুন পাটোয়ারী। ককটেল পুড়ছে জয়ের গাড়ি থেকে দুই হাত দূরত্বে। গাড়ি ছিটকে এসে উল্টে যাবার আগে ব্রেক কষতেই জয়ের কপালটা স্টিয়ারিংয়ে সজোরে ধাক্কা খায়। কপালটা চিড়ে দিখণ্ডিত হয়ে গেছে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। হামজা পাগলের মতো ছুটে যায়। গাড়ির কাঁচ তোলা ছিল। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে আশপাশে তাকায়। কিচ্ছু নেই। একদৌড়ে সামনের গাড়িতে ফিরে ভরা বোতলটা আনে। গ্লাসের ওপর দুটো আঘাত করে। কাঁচ চিড়ে গিলেও ভাঙে না। এবার দুটো ককটেল ফাটে রাস্তার ওপর। গাড়ির পেছনে আগুন জ্বলে ওঠে। কেউ কেউ সজাগ হয়ে উঠলেও রক্তাক্ত শরীরে নেই একফোটা জোর। কেউ-ই বের হবার মতো অবস্থায় নেই।
রিমি কোথা থেকে যেন একটা ভাঙা ইটের টুকরো এনে হাতে ধরিয়ে দেয় হামজার। হামজা এক পলক সেদিকে তাকিয়ে জয়কে বলে, “মাথা তুলিস না কিন্তু।ʼʼ
ইটের চারটে আঘাতে কাঁচ ভেঙে হাত ঢুকিয়ে কাঁচের লক খোলে। যা ধারণা করেছিল তাই। জয় অর্ধচেতন। ওকে হিচড়ে বের করে বুকের সাথে চেপে ধরে দৌড় লাগায় সামনের দিকে। যখন তখন অ্যালকোহল ভর্তি বোতল এসে পড়তে পারে গায়ে। হামজা অপরহাতে রিমির হাতটা ধরে ছোটার চেষ্টা করে। আরও দুটো ককটেলের বোতল সামনে এসে পড়ে। পরেরগুলো গাড়ির ওপর। কে মরল কে বাঁচলো তা পরে হবে। আরও কিছুদূর এগিয়ে আসার পর গাড়িতে এসে তিনটা কাঁচের বোতল গ্রেনেড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তরলগুলো গড়িয়ে পড়তেই বোতলের কর্কের আগুনে দহন শুরু হয়ে যায়।
জয়ের হাতের চামড়া ছিলে মাংস উঠে এসেছে। কপালে চাপটি ধরা র-ক্ত। ভ্রুতে এসে র-ক্ত চাপ ধরেছে। গোটা সাদা শেরওয়ানি রক্তে ভেজা। এবার হামজা খেয়াল করে, কপাল অল্প, আসলে কপালের কোণা দিয়ে মাথার ডানপাশ ফেটে গেছে। কান দিয়ে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। এতক্ষণে জয় একেবারে জ্ঞান হারায়। হাত-পা ছেড়ে দেয় হামজার কাঁধে। লোকজন দূর থেকে দেখে দৃশ্য। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ফুল সাজানো গাড়ির পেছনটা জ্বলছে। লাল টুকটুকে শাড়ি পড়া বউ দাঁড়িয়ে সামনে গাড়ির দরজার সামনে।
হুমায়ুন পাটোয়ারী জয়ের হাতটা ধরে ঝাঁকায়, জয়? মামা? ও জয়…
হামজা বলে, “আব্বু, আপনি আরমিণকে বাড়ি নিয়ে যান। এখানে কিচ্ছু হয়নি। মাঝপথে কল আসায় আমরা জরুরী কাজে ঢাকা গেছি, কেমন? বউভাত দু’দিন পর হবে। গান-বাজনার কমতি রাখবেন না। লোকজন যা আছে, সবার ভালো আপ্যায়ন করবেন। খুব শীঘ্রই ফিরব আমরা। এ খবর নিজে থেকে লিক না হওয়া অবধি এরকম কিছুই হয়নি, ঠিক আছে?ʼʼ
পথ এখনও বেশ খানিকটা বাকি পাটোয়ারী বাড়ির।
—
গাড়ি থেকে নামার পর সামনে শত শত লোক। পুরো পাড়া এসেছে জয় আমিরের বউ দেখতে। তার উপর যে তামাশা করে জয় আমির বিয়ে করেছে! আজ অন্তূর রাঙা গম্ভীর সুশ্রী চেহারাটা গিলে খেল কত-লোকে। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে চোখের নজর ঘোরায় অন্তূ। দোতলা বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি। তখনই অন্তূর মাথায় আসে, হামজা করে কী? মেয়র হয়েছে সেদিন। জনগণের টাকা-পয়সা মেরে বড়লোক হতেও তো সময় লাগার কথা। এত বড় বাড়ি, গাড়ি বিলাসিতার উৎস কি শুধু এই ওয়ার্কশপ? লোহার ব্যবসায় এত আয়? অন্তূর বিশ্বাস হয়না। আবার মাথায় ঘুরছে জয়ের রক্তাক্ত মুখটা। ঘাঁড়ের পেছন দিয়ে সেই র-ক্তের স্রোত। এরকম র-ক্ত প্রথমবার আব্বুর দেহে দেখিছিল সে।
পার্টির ছেলেরা ভরা চারদিকে। সবার মাথায় লাল গামছা বাঁধা। এই বাড়িতে যে এত বড় আয়োজন, তা বরযাত্রীর সংখ্যা দেখে বোঝা যায়নি। কিছু বিশেষ লোক মোতায়েন করা হয়েছে, তাদের হাতে লাঠি, ফাঁড়া খড়ি, কেউ কেউ চাদর পড়েছে। হাঁটার সময় হাতের রাম-দা গুলো বেরিয়ে আসছে চাদরের প্রান্ত থেকে। এইসব নিরাপত্তা কেন? হামলার ভয়? কীসের হামলা?
ছোট বেলা। সন্ধ্যা লেগে যায় বউ ঘরে তুলতে তুলতে। আজ পাটোয়ারী বাড়ির মেইন গেইট খুলে দেয়া হয়েছে। সিড়ি বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে দলে দলে লোক। গেটের ডানদিকে ছোট্ট বাগান, তার বাঁ পাশে ওয়ার্কশপের সীমানা শুরু। ডানদিকের ঝোপের পাশ ঘুরে গেছে একটা গলি। তা বোধহয় বাড়ির পেছনের দিকে যায়। কিন্তু বাড়ির পিছনে বিশাল প্রাচীর তোলা। ওদিকে এই রাস্তা কীসের?
অন্তূর মাথাটা নত ছিল। যখন দরজায় পা রাখল, শাড়ির কুচি ধরে এগিয়ে অল্প মাথাটা তুলতেই একটা মেয়ের জ্বলজ্বলে চোখ নজরে এলো। অন্তূকে গিলছে যেন চোখদুটো, দুটো ঢোক গেলাও নজরে আসে অন্তূর। কৌতূহল তৈরি হলো মেয়েটার প্রতি।
বাসরটা সাজানো হয়েছে কাঁচাফুলে। জয়ের ঘরে পা রাখতেই যে জিনিসটা চোখে বাঁধে—ঘরের দেয়ালভর্তি জয়ের ছবি। সবচেয়ে বড় ছবিটা সাদা পাঞ্জাবী পরা, গলায় চাদর পেঁচানো। ওটা দরজার সামনের দেয়ালে টাঙানো। একটা খাট, ড্রেসিং টেবিল, কাঠের আলমারি, ছোট্ট দুই সিটের সোফা(কাউচ), বুকশেল্ফ, কর্ণার শোপিসটা রাখা বাথরুমের দরজা থেকে একটু দূরের দুই দেয়ালের কোণায়। অন্তূর তাচ্ছিল্যই এলো। এসব বড়লোকির চলাফেরার সোর্স কী? চাঁদাবাজি! জয় এখন কোথায়?
একের পর এক লোক আসছিল। দেখছিল, কেউ কেউ মুখ দেখে টুকটাক উপহার বা টাকা হাতে গুঁজে দিচ্ছিল। সেই সময় কোথা থেকে কোয়েল ছুটে এসে কোলে চড়ে বসে অন্তূর মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে শুরু করে। হাস্যকর ছিল দৃশ্যটা। কোলে চড়ে বসে মুখ দেখা। তুলি পাশে জিজ্ঞেস করল, “পছন্দ হয়েছে বউমণিকে?ʼʼ
-“বউ?ʼʼ
-“জয় মামার বউ এটা। তোমার রিমি মামির মতো আরেকটা মামি। মামিকে ভালো লেগেছে তোমার? কোলে চড়ে বসলে যে!ʼʼ
কোয়েল আধোস্বরে বলে, “জয় তো…ʼʼ
থেমে গিয়ে চেয়ে থাকে অন্তূর দিকে বাচ্চাসুলভ দৃষ্টিতে, যেন বুঝতে চেষ্টা করছে ব্যাপারটা। দারুণ মায়া লেগে গেল অন্তূর। গালটা টেনে দিয়ে ভালো করে টেনে কোলে বসিয়ে একহাতে জড়িয়ে রাখলো কোয়েলকে। তুলি মিষ্টি হেসে নিজের পরিচয় দেয়, “আমি তোমার এক ননদ। তোমার তো আপন ননদ, ভাসুর কেউ নেই। আমি হামজার ছোটবোন।ʼʼ
অন্তূ হাসল অল্প। তুলি অল্প টিস্যু ছিঁড়ে সযত্নে অন্তূর মুখের ঘাম মুছে দেয়, “কী করে কী হলো, সেটাই ভাবছিলাম। জয় এমন ঘর বাঁধার ছেলে না। তবুও দেখেছ সাথে আসেনি! তুমি তো ভীষণ সুন্দরী! এত ঘামছো কেন? চিন্তা করছো কী নিয়ে? চার্জার ফ্যান দেব?ʼʼ
-“উহু। ঠিক আছি।ʼʼ অন্তূর পর্যবেক্ষক দৃষ্টি কিছু আবিষ্কার করে ফেলে তুলির মুখে। ফর্সা ধবধবে চেহারায় কালচে দাগগুলো খুব দৃষ্টিকটু। ঘাঁড়ের কাছের জখমটা ওড়নার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে। চোখের নিচে কালি পড়া, যা জানান দেয় বহুরাত ঘুমায়নি চোখদুটো। অথচ দারুণ সুন্দর চেহারা তুলির। হামজার মতোই নাক-চোখ, তবে হামজা পুরুষ হিসেবে এমন ফর্সা না।
রিমি এসে দাঁড়াতেই তুলি চমকায়, “মুখটা এমন ছোট লাগছে কেন তোমার, ভাবী? জয় আর হামজা ভাই কই? ওরা কি আজকের দিনটাও স্বাভাবিক পালন করতে পারতো না?ʼʼ রেগে উঠল তুলি।
রিমি যান্ত্রিক স্বরে জানায়, “রাস্তায় গাড়িতে হামলা হয়েছিল। জয়কে বোধহয় আপনার ভাই রাজধানীতে নিয়ে গেছে।ʼʼ
আঁৎকে ওঠে তুলি। মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়। দরজার বাইরে ধপ করে বসে পড়ে তরু। মৃত ঝরনার মতো ঝিরঝির করে গড়িয়ে থুতনি ছোঁয় নোনাজল। শাহানা জানতে পেরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে হামজার জন্য। তার ভয় হয়, ঢাকা যেতে যেতে আবার যদি হামলা হয়?
লোকের আনাগোনা কমলো রাত এগারোটার দিকে। তোড়জোড় কমে গেল। ঠিক খবর হয়ে গেছে, বিয়ের গাড়িতে হামলা হয়েছে। পুলিশ এসেছিল। হুমায়ুন পাটোয়ারী সামলে নিয়েছেন।
অন্তূ ঘরটা দেখল দৃষ্টি ঘুরিয়ে। বেড-সাইড টিবিলের ওপর কাঁচের বৌল ভর্তি কাজুবাদাম রাখা। তার পাশে ছোট্ট একটা হিপফ্লাস্ক পড়ে আছে। অন্তূ কর্ক খুলে শুঁকলো। মদের বিশ্রী গন্ধ, তবে তরল নেই। হলুদ একটা স্মাইলি হ্যান্ড প্রেস বল পাওয়া গেল ড্রয়ারে। এটা ব্যবহার করা হয় মেজাজ ঠান্ডা রাখতে। মানসিক বিশেষজ্ঞরা এটাকে হাতের মুঠোয় রেখে প্রেস করার পরামর্শ দেন মেজাজ শান্ত রাখতে। ড্রয়ারে ছোট-বড় ছুরি অনেকগুলো। বুলেট-কেস পড়ে আছে। অনেকগুলো সিগারেটের বাক্স, দেয়াশলাই, লাইটার। কাগজের মোড়কে বিভিন্ন রকম বড়ি পেল অন্তূ। দুটো খালি সিরিঞ্জ। স্লিপিং ড্রাগের বলেই মনে হলো।
ভারি গহনা ও শাড়ি খুলে সুটকেস থেকে একটা সাদা লম্বা জামা বের করে নিলো। বাথরুমে এগোনোর পথে গয়না তুলে রাখার জন্য আলমারি খুলল। সারি সারি শার্ট, পাঞ্জাবী, টি-শার্ট, প্যান্ট ঝুলছে। দুধ-সাদা থানের মতো লুঙ্গি ভাঁজ করে রাখা। নিচের তাকে পারফিউমের কৌটো, বেশ কয়েকটা ঘড়ির বক্স সাজিয়ে রাখা। অন্তূ অবাক হয়ে দেখল, একটা দুমড়ে যাওয়া আধখাওয়া সিগারেট। অন্তূ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। জয়ের সাথে প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে পড়ে। এই সিগারেটের টুকরো পায়ে পিষে ফেলার মাঝ দিয়ে জয় নামক অভিশাপের আগমন হয়েছিল তার জীবনে।
চলবে…
[অবরুদ্ধ নিশীথে ঢুকলাম বলা চলে। এতদিন শুধুই ভংচং চলেছে। পটভূমি, পেক্ষাপট অথবা মুখবন্ধ চলছিল। আস্তে আস্তে এখন মূল অবরুদ্ধ নিশীথের পথে এগিয়ে যাব।
কথা হলো, এটা রাজনৈতিক উপন্যাস/কাহিনি। কেউ যদি এটাকে সুশ্রী পাঞ্জাবী পরিহিত জনদরদী নেতা এবং বীরবল তরুণ রাজনীতিবিদের গল্প ভেবে পড়েন, তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। রাজনৈতিক কাহিনি বলতে রাজনীতির সাথে জড়িত একজন মানুষের কাহিনি বুঝিনা আমি। আসলে তা বোঝায়ও না। রাজনৈতিক উপাখ্যান মানে হলো, ঘাত-প্রতিঘাত, সংঘাত, বিদ্বেষ, কিছু মতবাদ, প্রতিহিংসা, জনগণের অধিকার, মানবাধিকার বিপর্যয় ইত্যাদি, বহুত কিছু। ওসব আমি তুলে ধরার সাধ্য রাখিনা। তবে…
এখানে আমার মতামত বা উপস্থাপনার সাথে অনেকের মত মিলবে না। হয়ত বিতর্কিত চঞ্চলতা তৈরি হবে। সেসব প্রস্তুতিসহ অবরুদ্ধ নিশীথের সাথে চলার অনুরোধ রইল।❤️ ]