#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩৫.
নবমদিন অন্তূর পাটোয়ারী বাড়িতে। সারাদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা, ঘুরে ফিরে জয়ের ঘরটা দেখা, রান্নাঘরে গিয়ে রিমির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আবার রুমে আসা। সকালে হুমায়ুন পাটোয়ারী ডেকে বললেন, “আরমিণ, আম্মা!ʼʼ সুমধুর ডাক।
অন্তূ কাছে গেলে সহস্যে বললেন, “মামা শ্বশুরকে এক কাপ চা দিতে পারো?ʼʼ
অন্তূ রান্নাঘরে যেতে যেতে ভাবে, “আসল শ্বশুরের খবর নাই, মামা শ্বশুরের ঘুম নাই, তার আবার চা চাই।ʼʼ বাংলার সব ঘরে চা এর চলন নেই নিয়ম করে। উচ্চবিত্তরা এসব মানে।
পাটোয়ারী সাহেব ভালো লোক। ব্যবহার, কথাবার্তা সব আন্তরিক। অন্তূর উনাকে ভালোই লেগেছে। কিন্তু শাহানা অন্তূকে সহ্য করতে পারছেন না। অন্তূ বাড়িতে পা না-ই রাখতে বাড়িতে র-ক্তের ছাপ লেগেছে। রিমির হাতের কব্জি বয়ে জয়ের রক্ত এসেছিল সেদিন, জয় আসেনি। দুই ভাই রাজধানীতে পড়ে আছে। কল করলেও হামজা কিছু বলেনা বিশেষ। বলে, “সব ঠিক আছে। জলদি দিনাজপুর ফিরব।ʼʼ জয়ের অবস্থা কিছুই বলেনা। সেসবের জন্য তার অন্তূকে দায়ী মনেহয় শাহানার।
আগামীকাল থেকে দু’দিন হরতাল। বহুদিন থেমেছিল এইসব অবরোধ। আবার শুরু হলো কীসে, কে জানে! ওরা আসতে যে আরও কয়েকটা দিন লাগবে, এটা বোঝা যাচ্ছে। শাহানার শরীরে কোনো উন্নতি নেই। সে সারাদিন পেটের ব্যথায় কাঁতরায়। কথা বলার লোক নেই তার। অন্তূ গিয়ে বসেছিল। দু চার কথা শুনিয়ে রুম থেকে বেরোতে বলেছেন।
বিকেল বেলা তুলির রুমে ঢুকতেই ফিডার রেখে দৌড়ে এসে ঝেপে পড়ল কোয়েল, “আরিণ! চলো চক্কেত কিনে আনি। জয়টা আসছেনা। তুমি ওর বউ, তুমি চলো।ʼʼ
অন্তূ কানে গলিত সিসার মতো ঢোকে ‘জয়ের বউʼ কথাটা। সে হাসে, “পরে যাব, আম্মা। চলুন, এখন দুধটুকু শেষ করুন। নয়ত চকলেট কিনে দেব না।ʼʼ
অন্তূ বসে থাকে কিছুক্ষণ। পরে দ্বিধা ভেঙে জিজ্ঞেস করে, “দুলাভাইকে তো দেখলাম না আসতে! মেয়েকে দেখতে আসেনা? আপনি কি এখানেই থাকছেন?
-“এত দ্বিধা করছো কেন? সৌজন্যের কিছু নেই। সরাসরিই প্রশ্ন করো, যা মনে আছে।ʼʼ হাসল তুলি।
-“কী হয়েছে আপনার দুলাভাইয়ের সাথে?ʼʼ
তুলির মনে হয়, জয়ের বউটা অন্তর্যামী। নতুন এ বাড়িতে এসে শুধু সবার চাল-চলনে অন্তূ যেসব সত্যগুলো বুঝে গেছে, তা সাধারণ চিন্তার মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তুলি করুণ হাসে, “এতগুলো দিন এসে রয়েছি। এ বাড়ির কেউ-ই জিজ্ঞেস করেনি একবারও। তুমি কেন করছো?ʼʼ
-“আমি এ বাড়ির কেউ নই।ʼʼ
তুলি চেয়ে থাকে অন্তূর মুখের দিকে। চোখে-মুখে অনেককিছু, কিন্তু সেসব নীরব। চোখ যেসব কথা বলে এই মেয়ের, তা বোঝা যায়না। শুধু বোঝা যায়, বহু কথাই বলে যায় নিঃশব্দে।
ওড়নাটা মাথায় পরে শাড়ির আঁচলের মতো করে। কপাল অবধি পড়ে থাকে। চলনে একটা অভিজাত্য আছে। তুলির খুব পছন্দ হয়েছে জয়ের বউকে। এখন সে বুঝতে পারে, যা তা ধরে আনেনি, জয়।
—
অন্তূ নামাজ শেষ করতেই ঘড়িতে—১১:৪৩।
বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার কোনো ঠিক নেই এদের। কেউ অসুস্থ, কেউ বা বিষণ্ন, কেউ ঘুমন্ত। অন্তূ নিজেই খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে বসল। খানিক পরে হুমায়ুন পাটোয়ারী এসে বসে বললেন, “খাবার দে তো, আম্মা! কেউ খাক না খাক, আমি তুই খেয়ে বাঁচি।ʼʼ
অন্তূ খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে, “আপনার হাই-প্রেশার আছে, মামা?ʼʼ
-“না। কিন্তু অ্যাজমার ভাব আছে।ʼʼ
-“তাহলে মাংস খাবেন না। ওটা আমি আমার জন্য বের করেছি। আপনি ডাল দিয়ে খেয়ে নিন। আমি তরুকে ডেকে আনছি।ʼʼ
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন হুমায়ুন সাহেব। সিরিয়াস, গম্ভীর, আবার কেমন অদ্ভুত মেয়েটা বাড়িটাকে দুই বাহুতে আঁকড়ে ধরেছে নাকি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
তরুকে রুমে না পেয়ে ছাদের দিকে পা বাড়াল অন্তূ। সে ওখানেই বেশি কাটায় আজকাল। একা একা, নির্জনে। অন্তূর দিকে তাকায় না। অন্তূর এটাও বোঝা হয়ে গেছে, তার কাছে সর্বোচ্চ ঘৃণ্য পুরুষটারও একটা বিরহিনী আছে! আশ্চর্য হলেও আশ্চর্য নয়। কারণ মানুষের মন বড় বিচিত্র। তরুর কাছে হয়ত জয়কে ভালোবাসার কারণ আছে!
অর্ধেক সিঁড়ি উঠতেই রিমির চিৎকারে বাড়ি কেঁপে উঠল। অন্তূ পিছু ঘুরতেই ওর আগে তরু নেমে আসে পাশ কাটিয়ে। ধাক্কায় অন্তূ পড়ে যেতে নিলে তরু বাহু চেপে ধরে গম্ভীর হয়ে বলল, “এত নড়বড়ে হলে চলবেনা। সিড়িঘরের দরজা আঁটকে দ্রুত নেমে এসো।ʼʼ
এবার সকলে শুনতে পায়, সজোরে ঠাস করে কাঁচ ফাটার আওয়াজ। বেরিয়ে আসে রিমি, তার বাহুর ওপরে কামিজের হাতা রক্তে ভেজা। কাঁচের আঘাত পেয়েছে। অন্তূ ভেতরে ঢুকে দেখে, রিমির ঘরের জানালার কাঁচে তিনটে ছিদ্র। পাথর ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। অন্তূ থাকা অবস্থায় আরও দুটো পাথর এসে অন্য জানালার কাঁচ ভেঙে দেয়ালে ছিটকে পড়ে। নিচে যেন বিক্ষোভ শুরু হয়েছে এত রাতে। দলে দলে পদচারণার আওয়াজ বাড়ির চারপাশে টহলের মতো ঘুরছে। অন্তূ বেরিয়ে আসে দ্রুত। রিমি সাবধান করে, “আরমিণ, এখানেই দাঁড়ান। ঘরে যাবেন না। জয় ভাইয়ার ঘরে হামলা সবসময় আগে হয়।ʼʼ
দরজায় করাঘাত পড়লে খুলে দেয় অন্তূ। কবীর অন্তূকে সালাম দেয় কপালে হাত ইশারা করে। হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢোকে। রিমিকে বলে, “রাহাত মরে গেছে, ভাবী। ক্লাবঘরে আগুন জ্বলছে। সব শেষ। ক্লাবের সব শেষ। বিরোধী দলের শুয়োরের বাচ্চারা ক্লাবঘর জ্বালিয়ে দিয়ছে।ʼʼ
রিমি চেয়ারে বসে পড়ে শ্বশুরকে বলে, “আব্বু! আপনার ছেলেকে কল করুন তো। এই সময় বাড়ির লোকগুলোকে মারবে সে? জয় ভাইয়ার চিকিৎসা বাড়িতে হবে। জেলায় ফিরতে বলুন। আমি আর এসব নিতে পারছি না। আমি কিন্তু ও বাড়িতে চলে যাব।ʼʼ
তুলি বলল, “শান্ত হও, ভাবী। আব্বু আপনি নিচে যান। গেইট খোলার দরকার নেই। এসব করছে ওরা গেইট খেলানোর জন্য। নিচে যান। মেইন ফটকে লোক দাঁড় করান।ʼʼ
হুমায়ুন সাহেব বললেন, “কবীর? নিচে কে কে আছে রে?ʼʼ
-“সবাই আছে, মামা। আপনি বললে একশান নেবে।ʼʼ
-“দরকার নেই। দুই ভাই জেলায় নেই। এখন একশান নেবার কিছু নেই। ওর ফিরুক, যা করার করবে। চল।ʼʼ
তুলি তরুর হাতে কোয়েলকে দিয়ে পেছনের বারান্দায় যায়। খানিক বাদে ফিরে এসে রিমির পাশে বসে বলে, “পেছনের জঙ্গলে দলে দলে ঢুকেছে সব। হরতাল ডেকেও একটা রাত সহ্য হয়নি হারামজাদাগুলোর! আবার ক্ষমতা চায়? গদিতে বসলে এইসবই করে বেড়াবে!ʼʼ
অন্তূ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। সবাই যেন পেশাগত এসব ব্যাপারে। খুব অভ্যস্ত লাগছিল সকলকে। এবার বলে উঠল, “বিএনপির কথা বলছেন? আওয়ামীলীগই বা গদিতে বসে কী শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ফেলল? মোটকথা, গদিতে যেই থাকুক, খেলা একই রঙের দেখাবে। দলের লোকে কিছুই না। যা যায় সব তো জনগণের! ওরা তো শুধু নিজেদের মধ্যে ধরাধরি খেলে বিনোদন নেয় জীবনের!ʼʼ
অনেকক্ষণ আর কেউ কথা বলল না। বারবার সবাই অন্তূর দিকে তাকাচ্ছিল। অন্তূ সযত্নে একটু স্যাভলন মাখিয়ে রিমির হাতে একটা কাপড় বেঁধে দিলো। রিমি জিদ ধরে বলে, “কাল সকালে যদি এ বাড়ি না ছেড়েছি, আমার জিহ্বা কাটা পড়ুক। ওই লোক আসুক বাড়িতে। না নিজের জীবনের গ্যারান্টি রেখেছে, না আমার। আমার বাপ চাচা রাজনীতি করেনি? এমন কখনও বাড়ির লোক নির্যাতন সঁয়নি। কারণ ওদের এ বাড়ির লোকদের মতো ক্ষমতার লালসা ছিল না। রাজনীতি বহুলোকে করে, এদের মতো জান হাতে করে মাঠে নামা রাজনীতিবিদের মুখে আগুন দেই আমি।ʼʼ রাগে কটমট করে ওঠে রিমি।
কল লাগালো হামজাকে, “আপনি আসবেন? নাকি আমি বাড়ি ছাড়ব? কী করছেন কোথায়? বাড়ির নিরাপত্তা দিতে পারেন না, কীসের নেতাগিরি দেখান? বাড়িতে এরকম মরতে রেখে কোথায় মরতে গেছেন নিজে?ʼʼ
-“শান্ত হও তুমি। আজ রাতে রওনা দেয়া হলোনা। নিচে এখন দেখো হাঙ্গামা থেমেছে। পুলিশ গেছে, ছেলেরা এসে জমেছে। ওরা সারারাত থাকবে ওখানেই। আর কিছু হবেনা। শান্ত হও, আসছি আমি। জয়কে চাইলেও হাসপাতালে রাখার উপায় নেই। ও তিনদিন আগে হাসপাতাল ছেড়েছে জ্ঞান ফিরতেই। আমি গাড়িতে, পরে কথা বলছি।ʼʼ
-“ফিরবেন কবে?ʼʼ গর্জে উঠল রিমি।
-“কাল রওনা দেব। বললাম তো, আর কিছু হবেনা। খেয়ে নাও। ভেতরের ঘরে শুতে যাও। ঘরে থাকার দরকার নেই।ʼʼ
আসলেই বাইরের গেটের ওপর ধুমধাম আঘাত কমেছে। পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি বন্ধ হয়েছে। অনেকের সমস্বরের আলোচনার গোঙানি ভেসে আসছে। অন্তূ নিজের ঘরে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। জয়ের ঘর ডান পাশে। পেছন থেকে, সামনে থেকে সমান। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তায় ভিড় দেখা যায়। পোলের লাইট বোধহয় ভেঙে ফেলেছে ওরা। অন্ধকারে জটলা বাঁধা লোকজন। আগামী দু’দিনের হরতালে বাড়ি ফেরাও মুশকিল হবে জয়েদের। অবশ্য ওদের জন্য মুশকিলের কিছু নেই। একটা কথা খুব খঁচখঁচ করছিল, জয় যদি তিনদিনে চেতনা ফিরে হাসপাতাল ছাড়ার শক্তি পায়, তাহলে তো ঢাকা নেবার প্রয়োজন ছিল না। ঢাকাতে নিশ্চয়ই অন্যকাজে গেছে দুইভাই! আবার হতে পারে, জয়ের শরীরে ব্যথাটাই কম!
—
ক্লাবঘর পুরোটা পুড়ে যায়নি। আবাসিক যে বিল্ডিংটা ছিল, ওটার ভেতরটা ঠিক আছে টুকটাক। বাইরের দেয়ালে কালি পড়েছে।
জয় ফিরল তারও সপ্তাহখানেক পর। সকলে স্বাভাবিক নিলেও অন্তূ অবাক হয়েছিল। এখনও মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ। চোখ-মুখে অসুস্থতা স্পষ্ট। অথচ জয় দিব্যি হেঁটে ভেতরে ঢুকেছিল। কাউকে ছুঁতে দেয়নি নিজেকে। আঘাত নেহাত কম ছিল না। হামজা পরিস্থিতি সামলে নিতে পটু। মিথ্যা বলেছিল। এতদিনের চিকিৎসার সাথে সাথে কিছু কাজ করেও ফিরেছে।
বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসা ছিল জয়। তখন রাত সাড়ে এগারোটা। পরনে ঘিয়ে রঙা প্রকাণ্ড শাল জড়ানো। সকলে ভিড় করে আছে জয়কে। হামজা বিছানার ওপর জয়ের পায়ের কাছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে টানটান হয়ে শোয়া। জয়ের মুখ অসম্ভব গম্ভীর। চোখে-মুখের ভাব গাঢ়। শুধু মামিকে জিজ্ঞেস করল, “শরীর কেমন?ʼʼ
শাহানার ব্যথা অসহ্য পর্যায়ে চলে গেছে। জরায়ুতে ঘা তার। এই সংকটের মাঝে অপারেশনের সুযোগ নেই বললেই চলে। হুমায়ুন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “বিএনপি হঠাৎ ক্ষেপেছে কেন আবার?ʼʼ
হামজা বলল, “ওরা ক্ষেপে ছিল না কবে? ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই ক্ষেপে আছে। এবারের নির্বাচনের পর মাঝখানে কিছুদিন হতাশা পালন করেছে, তাই মনে হয়েছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে সবকিছু। সংসদ নির্বাচনের বছর পূর্তি হবে। ওদের জ্বলন আবার বেড়েছে। ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ।ʼʼ
-“সেদিনের হামলা ওরাই করেছিল?ʼʼ
-“না। আবার হ্যাঁ-ও। বিএনপির দল ভারী হয়েছে, বুঝতে পারছ না? ক্ষমতায় এসেছে একদল। আর আসেনি বহুদল। ওই বহুদল এখন ধীরে ধীরে আর-এক দল হচ্ছে।ʼʼ
-“মাজহার নাকি তোর সাথে কথা বলতে চায়।ʼʼ
-“কথা নেই আমার কোনো। ও শালা ধান্দাবাজ। ওর বাপের অফিসে কাল কয়েকটা জঙ্গি ঢুকেছিল, এখন হাত মেলাতে চাইবেই। না মেলালে আবার নতুন ফন্দি আঁটবে আমাকে বাঁশ দেবার।ʼʼ
-“রাস্তার কাজ থেমে আছে। কনট্র্যাক্টর এসে ঘুরে গেছে কয়েক দফা।ʼʼ
-“ওদের তো ওলিফলি বেঁধে গেছে। রাস্তার কী বাল হয়েছে? কয়েকদিন আগেও প্রাইমারী স্কুলের সম্মেলনে নতুন বিল্ডিং মঞ্জুর করা হলো। ভরে না জনগণের? এই পরিস্থিতিতে রাস্তার কাজ হয়? কয়েকটাকে বোম মেরে উড়িয়ে দিয়ে গেলে তবে হয়ত সুখে থাকার চিন্তা দূর হবে জনগণের!ʼʼ
আর কেউ কথা বলল না। শান্ত হামজার এই কথাগুলোই আগুনের মতো গরম। সহজে না রাগা মানুষটার সামান্য একটু চেতে যাওয়াও অনেক। রিমি বেরিয়ে গেল ভারী পা ফেলে। জয় চুপচাপ খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিল।
অন্তূ গরম পানি নিয়ে ঘরে ঢুকল। হামজা বলল, “পেসক্রিপশনটা আমার কাছে দাও। বুঝিয়ে দিচ্ছি। এন্টিবায়োটিক দিয়েছে। সময়মতো খাওয়াবে।ʼʼ
অন্তূ কাগজ এগিয়ে দিয়ে দাঁড়াল। জয় চোখ খুলে তাকায়। আটসাঁটো জামা যদিও পরেনি অন্তূ, তবুও শরীর মাপা হয়ে গেল ওর চোখ দিয়েই। অভিজ্ঞ চোখদুটোর একটুও অসুবিধা হলোনা নারী শরীরের ভাঁজগুলো কাপড়ের ওপর দিয়ে পরিমাপ করে নিতে। তাতেই নিঃশ্বাস ভারী হলো। এদিক-ওদিক তাকালো বারবার।
অন্তূ ওড়নাটা শাড়ির আঁচলের মতো মাথায় দিয়েছে। আগের চেয়ে যেন ভিন্ন দেখতে লাগছে। এটাই বোধহয় বিয়ের জাদু! হাতে, গায়ে কোনো ধরণের অলংকার না থাকা সত্ত্বেও বউ বউ লাগছিল। জয়ের বুক ওঠানামা করে। র-ক্তে তেজ বাড়ে। অধৈর্য্য হয়ে উঠল এক মুহুর্তে। রাশভারী গলায় বলে উঠল, “মামা, বের হও রুম থেকে।ʼʼ
সকলে একে একে বেরিয়ে যায়। হামজা গম্ভীর হয়ে বলল, “ডাক্তার তোকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করছে। নতুন রক্ত দেয়া হয়েছে শরীরে।ʼʼ
জয় গোঁয়ারের মতো বলল, “বাইরে যাও।ʼʼ
অন্তূ ওষুধ খুলছিল। অস্বস্তিতে হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। ইচ্ছে করছিল, ছুট্টে পালিয়ে যেতে এই সীমানা যেতে। ঘৃণ্য এই লোকটার সাথে একঘরে কী করে থাকবে, তা ভাবার শক্তিটুকুও ভেতরে নেই। তার ওপর বেলেহাজ লোকেরা খুব বিপজ্জনক। অন্তূর র-ক্ত জমাট বেঁধে আসে যেন। জয় আদেশ করে, “দরজা আঁটকে দিয়ে এসো।ʼʼ
ভালোভাবেই ওষুধগুলো খেলো আস্তে আস্তে। অন্তূর পা দুটো যেন চাকা হয়ে গেছে। একা একাই ছুটতে চাইছে। আড়ষ্ঠতায় শরীরটা ভার হয়ে উঠছিল, ঠিক যেমন ভূতের ভয়ে মানুষ ভার হয়ে ওঠে। হেলান দিয়ে বসে আছে জয়। শার্টের বোধহয় নিচের দুটো বোতাম লাগানো। ওপরের খোলা বোতামেল মাঝ দিয়ে পশমে ভরা বুকে নজর যেতেই গা ঝিমঝিম করে ওঠে অন্তূর। আল্লাহকে ডেকে উঠল, পানাহ চেয়ে উঠল ভেতরটা। মিনতি করে উঠল যেন, মুক্তি চায়।
জয় ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিল। শরীর ঘেমেছে অল্প। অন্তূ উঠে যেতে উদ্যত হতেই বলল, “পানি দাও। আরেকটু পানি খাবো। ওষুধ আঁটকে আছে গলায়।ʼʼ
অন্তূ গ্লাস এগোতেই জয় থাবা দিয়ে খপ করে ধরে হাতের কব্জি। অন্তূর হাতের শিথিলতায় ঝনঝনিয়ে গ্লাসটা পড়ে ভেঙে যায় মেঝেতে। ঝাঁকি মেরে ওঠে অন্তূর দেহটা। হাতটা মুচড়ায় জয়ের মুঠোর মাঝে। মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে অন্তূর। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় জয়ের দিকে। জয় শীতল চোখে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, “হাত মুচড়াচ্ছো কেন, ঘরওয়ালি? এতগুলো দিনে একা শুতে খারাপ লেগেছিল, হ্যাঁ?ʼʼ
চোখদুটো হেসে ওঠে জয়ের। সেই হাসি, সেই হাসি জয়ের। ভ্র-টা নাচায় নিজস্ব ভঙ্গিতে। একটানে অন্তূকে বিছানায় ফেলে ব্যান্ডেজ জড়ানো হাতেই ওড়নাটা হিঁচড়ে খুলে ফেলে। হাতের ক্ষততে বোধহয় টান লাগতেই মুখ কুঁচকায়। মাথার ব্যান্ডেজর ওপর রক্তের তরল দেখা দেয়। কারণটা বোঝা যায়না। প্রথমে একটা চুমু ঠিক কণ্ঠনালির ওপর খেয়ে মুখ তুলে আস্তে করে বলে, “মোহরানা বাকি রইল। পরে শোধ করব সেসব।ʼʼ
সে-রাতে জয়কে খু-খার জঙলির খাদকের মতো লেগেছিল। অন্তূর চোখের আর্তনাদ, হাতের প্রতিরোধে জয় বোধহয় শক্তি পাচ্ছিল আরও। ধীরে ধীরে জয় যত উত্তাল হলো, ওর কপালের ব্যান্ডেজে তাজা রক্তের দাগ গাঢ় হচ্ছিল।
অন্তূর কান্না পেয়েছিল, কতকিছু ভাবনা এসেছিল। কিন্তু সে কাঁদেনি, অন্তত জয়ের সামনে না। একদিন এরকম কিছুরই আশঙ্কাকে জনগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে কত কী করে ফেলছে! এই পর্যন্ত এনে ফেলেছে ওকে। অথচ আজ আসলেই তেমন কিছু হচ্ছে। জয় নামক অভিশাপ আজ অন্তূকে ছুঁয়ে দিচ্ছে, তাও আবার দলিল আছে হালালের। কিন্তু কেউ আজ ধরতে আসছে না, বদনাম রটতে আসছে না। আচ্ছা আজ বলাৎকার হচ্ছে না? অন্তূর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে ছোঁয়া হচ্ছে। ওহ! আজ তো জয়ের কাছে হালাল সার্টিফিকেট আছে।
জয় শুয়ে পড়ার পর অন্তূ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার শরীরে তখন জয়ের বিশাল শালটা জড়ানো। এই বারান্দা দিয়ে বাঁয়ে তাকালে বাড়ির সামনের রাস্তা দেখা যায়। আর ডানে বাড়ির পিছনের পতিত জায়গা। বেশ কিছুক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে রইল ওভাবেই। আব্বুর কথা মনে পড়লে এখন আর কান্না পায়না। কলিজাটা চিড় ধরে, তবে ফোট ফাটে না। আজ ফাটল। ঝরঝর করে অশ্রু গড়ালো চোখ দিয়ে। নিজেকে খুব অপবিত্র লাগছিল। খুব গভীরভাবে লেগে আছে জয় আমিরের ছোঁয়া গোটা দেহে।
দূরে কোথাও বাচ্চা কাঁদছে। কেউ কাঁদছে। অন্তূ চমকালো। এত রাতে আবার কে কাঁদছে? করুণ সেই স্বর। কোথা থেকে আসছে কান্নার আওয়াজ? গা-টা ছমছম করে ওঠে। ঘড়িতে তখন রাত চারটা। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অন্তূ। ভেতর থেকে জড়ানো গলায় জয় ডাকে, “ঘরওয়ালি? ভেতরে এসো। এত রাতে মেয়ে মানুষ বাইরে দাঁড়ানো ঠিক না।ʼʼ
অন্তূ জবাব দেয়, “অভিশাপ তো ভেতরে শুয়ে আছে, জয় আমির। বাইরেটাই বরং আমার জন্য নিরাপদ।ʼʼ
চোখ বুজেই ঠোঁট এলিয়ে হাসে জয়, “ভুল বলোনি। তবে এটা আমার বিশেষত্ব।ʼʼ
চলবে..
[টাইপিং মিসটেক থাকলে ক্ষমা করবেন।]