অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৪১.

0
2

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৪১.

অন্তূর মাথায় শুধু ঘুরছিল, আচ্ছা! পলাশ কি এই পৃথিবীতে একাই এমন নির্যাতনকারী? হামজারা কি একাই ক্ষমতালোভী? আর জয়েরাই শুধু এমন শক্তিশালী সামাজিক ব্যক্তিত্ব! আর নেই? অন্তত বাংলাদেশেই অসংখ্যা রয়েছে। অন্তূ এটা ভেবে নাক ছিটকাতো, এদের বাড়ির লোক কী করে? বউ, মেয়ে…এরা কী করে? রুখতে পারেনা?

ধারণাটা এত বাজেভাবে হারবে, তা জানতো কে? সে নিজেও তো এতগুলো দিন এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। পেরেছে নাকি ওই স্টোর রুম পেরিয়ে কাঠের দরজা ভেদ করতে? অথবা বাগানের পেছনে, প্রাচীরের কাছের ওই লোহার গেইটের ভেতরে ঢুকতে? হামজার বিরুদ্ধে বলতে, জয়কে থামাতে? বরং সে নিজেই অবরুদ্ধ, বন্দি। রূপকথারা এভাবেই মরতে মরতে বেঁচে আছে? আচ্ছা, এসব পুরুষদের সঙ্গিনীরা সবাই কি এমন শিকার? নাকি ব্যতিক্রম আছে?

অন্তূ রূপকথাকে বলেছিল, “পলাশ ঘুমায় না? রান্নাঘরে বটি বা ছুরি থাকেনা? হাতও তো আছে আপনার!ʼʼ

রূপকথা হেসেছিল, “কেবল পলাশের একটা মানসিক রোগের ব্যাপারে শুনলে।ʼʼ

-“আর কত আছে? সে কি মানসিক রোগের ফ্যাক্টরি?ʼʼ

-“স্বাভাবিক মানুষদের মতো ঘুম আসেনা ওর। অর্থাৎ, শরীরে স্বাভাবিকাভাবে ঘুমিয়ে পড়ার হরমোন মেলাটোনিন ক্ষরণ হয়না দেহে। আর্টিফিশিয়ালি মেলাটোনিন পুশ করতে হয় দেহে। এরপর ঘুমায়। সেটাও নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে।ʼʼ

-“আপনি ফেরাউনের ঘর করছেন, রূপকথা!ʼʼ

-“আছিয়া বলে লজ্জিত কোরো না। মা আছিয়ার মতো ইমাণী জোর নেই আমার, আর না আছে প্রতিবাদের ক্ষমতা।ʼʼ

থেমে থেমে আরও অনেক কথাই হয়েছিল ওদের। হঠাৎ-ই অন্তূ নিষ্ঠুরের মতো জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি এখানে এসব জানাতে এসেছেন আমায়? কী বাবদে?ʼʼ

রূপকথা হেসে ফেলল, “উকালতি র-ক্তে জড়িয়ে তোমার? না না, সন্দেহ ভালো। বিশ্বাস করার নয় কাউকে।ʼʼ

-“শব্দটাকে ভীষণ সস্তা লাগে আজকাল।ʼʼ

-“লাগারই কথা। এমনিতেই সচেতন তুমি। আরও হচ্ছ।…পলাশের সাথে দেখা হবার পর কতদিন কেটে গেছে তোমার?ʼʼ

অন্তূ অবাক হলো। রূপকথা সেটাও জানে! সে বলল, “বেশ অনেকদিন।ʼʼ

“এরপর আর বের হওনি না?ʼʼ

-“বিয়ের পর ভার্সিটি যেতে দেয়া হয়নি, থার্ড ইয়ারের ক্লাস তো শুরু হয়েছে ক’দিন হলো। বন্দি জীবন যাপন করছি আপাতত।ʼʼ

-“বের না হলেই ভালো। এজন্যই জানাতে এসেছিলাম। কোনো স্বার্থ-টার্থ নেই। বলতে পারো তোমার নিজের অর্জন। তোমার মতো মানুষদের এড়িয়ে চলা মুশকিল, বুঝলে! জয় আমিরকে জিজ্ঞেস করলে সে যদি বলে কখনও, তো বুঝবে এটা। আর পাঁচটা মেয়ের মতো নও যেমন তুমি, এটা খুব সহজেই ধরা পড়ে তোমার চোখে তাকালে। ব্যতিক্রমের সাথে মানুষের আচরণ ব্যতিক্রমই হয় সচরাচর। আমিও তাই করছি। সাবধানে থেকো। পলাশ তোমায় ছাড়বে না। জয় নামক ঢালে বাঁধা পড়ে আছো এ বাড়িতে। বাইরের জগত তোমার জন্য ভালো নয়। পলাশ ছাড়াও বহুলোক আছে জয়ের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে তোমার ক্ষতি করার।ʼʼ

অন্তূ ভাবল, হয়ত মাজহার। নাকি আরও কেউ, বা কারা?


অন্তূ এটা বুঝল, সে অনেকটাই ব্যাক-আপ পেয়েছে জয়ের কাছে। অন্তূদের একটা বুড়ো হিন্দু স্যার ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “পেছন মেরে বালুর ছ্যাঁক দেয়া বুঝিস রে, তোরা?ʼʼ

তখন বোঝোনি অত। আজকাল আমজাদ সাহেবসহ এসব বুজুর্গ, প্রবীণদের কথার মর্ম খুব গাঢ়ভাবে মনে পড়ে। জয় হলো সেই লোক, যে পেছন মেরে আবার বালুর ছ্যাঁক দিয়ে ব্যথা কমাতে আসে! অন্তূর হাসি পায় এসব ভাবলে।

বোঝা গেল, জয়ের ফিরতে দেরি হবে ক’দিন। অন্তূ ভাবল, এই ফাঁকে বাড়ি থেকে ঘুরে এলে হয়না? ভাবি অসুস্থ, অন্তিক কী করছে না করছে? আম্মুকে দেখার ইচ্ছেটাও হচ্ছিল।

অন্তূকে অবাক করে দিয়ে সকাল এগারোটার দিকে পাটোয়ারী বাড়ির দরজায় অন্তিক এলো। অন্তূ ভাবেনি এমনটা। স্মিত হাসি ছেলেটার মুখে। হাতে দু প্যাকেট মিষ্টি, ছোট্ট দুটো অসময়ের তরমুজ, ব্যাগে অনেক রকম খাবারের পাত্র, নিশ্চয়ই রাবেয়া কিছু বানিয়ে দিয়েছেন! অন্তূর অদ্ভুত লাগল। অন্তিক ছোট বোনকে দেখতে এসেছে তার শ্বশুরবাড়ি, সাথে এনেছে কুটুমবাড়ি আসার ঐতিহ্য। এই হাসিটা অনেকদিন দেখা হয়নি অন্তিকের চোখে। সে খুব হালকা এবং খুশি যেন। অন্তূ বুঝতে পারল না তার কী করা উচিত! আব্বুর কথা মনে পড়ছিল খুব। অন্তিকের সাথে আব্বু থাকতে পারতো না কি? বুকটা হু হু করে ওঠে তার। ভোলাই যায় না আব্বুকে? তবুও খোদা তায়ালাদ ইই নিষ্ঠুরতা!

রিমি খুব যত্ন করল অন্তিকের। দুপুরে না খাইয়ে যেতে দিলো না। এতসব কিছু আনার জন্য ধমকালোও। অন্তূর কিছু করতেই হলো না। যা সব রিমিই সামলাচ্ছিল। যেন সে নিজের ভাইকে আপ্যায়ন করছে।

যাবার সময় আচমকা অন্তিক বোনের হাতটা ধরল, অদ্ভুত গলায় বলল, “ক্ষমা করিসনি, না?ʼʼ

-“ধরে রাখিনি। তুই এসেছিস, খুশি হয়েছি আমি। ভাবি ভালো আছে? আম্মু?ʼʼ

অন্তিক একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো, “এটা রাখ, অন্তূ। আমার নিজের রোজগারের টাকায় কেনা। সুদ বা অনৈতিকতা নেই একটুও, আমার খাটুনির আয়। ফুড-বেভারেজ কোম্পানির ড্রাইভারের চাকুরি পেয়েছি।ʼʼ

অন্তূ চেয়ে রইল অন্তিকের দিকে। কত বদলে গেছে অন্তিক! ঠিক সেই পাঁচ-সাত বছর আগের অন্তিক। অন্তিক চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই ভালো আছিস, অন্তূ?ʼʼ

-“ভালো নেই?ʼʼ স্লান হেসে চেয়ে থাকে অন্তূ।

অন্তিক হাসল, “ভাগ্যের পরিহাস?ʼʼ

-“জানিনা তো। তুই বলতে পারসি, কী ঘটছে এসব?ʼʼ

দু ভাই-বোনের বিদায়ের ক্ষণটাও অদ্ভুত ছিল। অন্তিককে এগিয়ে দিতে গেল না অন্তূ। অথচ যেই না সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল, অন্তূ দৌড়ে সিঁড়িঘরের জানালা খুলে দাঁড়ায়। রাস্তায় দেখা যাচ্ছিল অন্তিককে, হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে। যতদূর দেখা গেল, চেয়ে রইল। পেছনে এসে দাঁড়ায় রিমি। সে কাল সারারাত ধরে অন্তূর গল্প শুনছে।

দুপুরে গোসল করে পরল সেই পোশাকটা। সে বুঝল, ভাবি বানিয়েছে জামাটা। মার্জিয়া টুকটাক ভালোই দর্জির কাজ জানে। বারবার আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখছিল। বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে আসা তোহ্ফা! রিমি মুগ্ধচোখে দেখে বলল, “খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে, অন্তূ!ʼʼ

অন্তূ চমকালো, এ বাড়িতে কে অন্তূ ডাকতো না তাকে।

হুমায়ুন পাটোয়ারী শাহানাকে নিয়ে ফিরলেন বিকেলের দিকে। অন্তূ সামনে গেল না। ওর মনে হচ্ছিল, ও বমি করে ফেলবে আর নয়ত হাত র-ক্তে ভিজে উঠবে। দিনের দুপুরে র-ক্তে হাত ধুতে নেই। তার হাত তো আর হামজার মতো দক্ষ নয়।

তরু তুলির কাছে একা ছিল। রিমি সন্ধ্যার পর বেরিয়ে গেল ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে। তরু একা একা সামলাতে পারবেনা।

সীমান্ত নিখোঁজ। এ নিয়ে চারদিকে তোলপাড় চলছে। পুলিশ ফোর্স নিয়ে চারদিকে খোঁজ চালাচ্ছে তারা। ঝন্টু সাহেব চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। বোনের ছেলে গুম! প্রথম সন্দেহ পাটোয়ারী বাড়ি তাদের। কিন্তু হাতে ক্ষমতা না থাকলে সন্দেহ ভোঁতা। হামজাকে কল করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সে বলেছে, তার কাছে এসেছিল ঠিকই, তবে চলে গেছিল দশ মিনিট পরেই। এরপর আর দেখা হয়নি।
সে মেয়র মানুষ। তাছাড়া দাপটই আলাদা। প্রসাশনের কর্মকর্তারা খুব বেশি জোর দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারেনা।

অন্তূ ঘরের দরজাটা ইশার আজান পড়তেই আঁটকে দিলো। তার মনে কীসের এক শঙ্কা জেগেছে। হুমায়ুন পাটোয়ারীর মুখটা মনে পড়লেই বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠছে। শরীরে এক প্রকার শিহরণ টের পাচ্ছিল। রাতে খেতেও বের হলো না আর। শাহানা কতবার ডাকলেন। নামাজ পড়ে খেয়ে নেবে, বলে কাটিয়ে দিলো। এত বড় বাড়িতে ওরা তিনজন, তার মাঝেও ও একা। গা শিরশির করছিল।

বেডসাইড টিবিলের ওপর পড়ে আছে জয়ের কাজুবাদামের পাত্রটা। সারা ঘরের দেয়ালে অনেক ছোট ছবি টাঙানো। ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে করতে বারবার সেসবে চোখ পড়ে অন্তরাত্মা পুড়ে উঠছিল। আঁখির লা-শটা চোখ থেকে সরছে না। বহুদিন ভুলে ছিল। তা তাজা হয়েছে। ত্বকের নিচে মাংসপেশীতে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল, উত্তেজনায়।

জয় যদি আঁখির শরীরের একটা ক্ষতর জন্যও দায়ী হয়, অন্তূ ওয়াদা করে ফেলল চট করে—এক কোপে ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলবে সে জয়ের। আর হুমায়ুন পাটোয়ারীর? হামজা, পলাশ? এরা ওর নাগালের বাইরে। তাই বলে মাফ?

রাত তখন একটা বাজে। অন্তূ তখনও উদাস পায়ে ঘরের মেঝেতে পায়চারী করছে। পা শিরশিরে অসহ্য উত্তেজনা। র-ক্তে আগুন জ্বলছে। অথচ নারীমনে দ্বিধা। হুমায়ুন পাটোয়ারীকে নিজের সন্দেহের ওপরই এত ভয় লাগছিল। অন্যকেউ হলে হতো। মামাশ্বশুর মানুষ যদি নোংরা হাত অল্পও বাড়ায় তার দিকে? অন্তূর গা’টা মৃগী রোগীদের মতো কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। নিস্তব্ধ, অবরুদ্ধ রাত। ঘরের জানালা-দরজা সব বন্ধ। তবুও অন্তূর মনে হচ্ছিল, কেউ যেন ওই দরজা ভেঙে এসে তার দিকে হাত বাড়াবে। সে এই ভয়টা প্রথম অনুভব করেছিল পলাশের রুফটপে।

জানালার বাইরে কেউ গুঙরে উঠল না? অন্তূ সজাগ হয়ে ওঠে। কোনো মানুষের চাপা ঘোৎ-ঘোৎ আওয়াজ। গা ছমছমে লাগছিল। যেন কেউ কোনো জীবন্ত কারও র-ক্ত পান করছে। জয়ের রুম সদর ঘরের শুরুর দিকেই। বাড়ির গড়নটাই আজব। বাইরে থেকে একরকম, ভেতরটা অন্যকিছু। অন্তূর মনে হলো, নিচ থেকে গোঙানি বা ধস্তাধস্তির আওয়াজ আসছে। পরে ভাবল, বদ্ধ ঘর, বাতাসের ঘাটতির কারণে এমন ভোঁতা আওয়াজ কানে বাজছে।

দোতলার সদর দরজায় টোকা পড়ছে এবার। অন্তূ সচেতন হলো। এই মাঝরাতে কে এসেছে? জয়? দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে এক সময় ড্রয়ার খুলে পছন্দমতো একটা ড্যাগার তুলে নিলো হাতে। ছোটখাটো অস্ত্রাগারই বটে জয়ের রুমটা।

দরজার সামনে গিয়ে মিনিট পাঁচেকেও ওপাশ থেকে জবাব পেল না মনমতো। যতবার জিজ্ঞেস করল, “কে?ʼʼ প্রতিবার অস্পষ্ট স্বরে শুনতে পেল, “খোলো।ʼʼ

জয়? ‘তুমিʼ সম্বোধন ব্যাপারটি খুব গোলমাল তৈরি করল। ড্যাগার হাতে উচিয়ে ধরে দরজা খুলতেই কেউ একজন হুড়মুড়িয়ে ঢুকে দরজা আঁটকে তবে পেছন ফিরল। অন্তূ তখনও ড্যাগার নিয়ে প্রস্তুত। অথচ আগন্তুকের মাঝে তাকে আক্রমণ করার কোনো তাড়া নেই।

অন্তূ অবাক হলো। মুখটা কালো হাজী রুমালে বাঁধা। কালো জ্যাকেট, কালো প্যান্ট, হাই-বুট জুতো পায়ে, হাতে কালো গ্লাভস। শরীরের শুধুমাত্র চোখ এবং মাথাভর্তি ঘন চুল ছাড়া কিছু দেখতে পাবার উপায় নেই। চোখের মণি ডাইনিং স্পেসের ডিম লাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। অন্তূ পেছন ফিরে দেখল, হুমায়ুন সাহেবের রুমের দরজা এখনও ভেতর থেকে বন্ধ। গভীর ঘুম।

অন্তূ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “কে আপনি?ʼʼ

আগন্তুক ঠিক জয়ের মাফিক লম্বা। আশপাশ দেখে নিয়ে বলল, “আপনি জয় আমিরের স্ত্রী, সঠিক ধরেছি?ʼʼ ভরাট স্বর, গমগমে তেজ যেন কণ্ঠের আগায়।

অন্তূ সে জবাব না দিয়ে বলল, “আপনি কে? এভাবে ডাকাত অথবা আততায়ীর মতো কারও অন্দরে প্রবেশ করাটা অভদ্রতা বোধহয়।ʼʼ

-“তাহলে আমি আজ ভদ্রলোক নই। ভদ্রলোক হবার যুগ নয় এটা। পথ ছাড়ুন।ʼʼ

-“উদ্দেশ্য না জেনে ভেতরে যেতে দেবার নয়। কে আপনি, জবাব দিন।ʼʼ

-“উদ্দেশ্য জানলে যেতে দেবেন, এমনটাও মনে করছি না।ʼʼ

-“কেন এসেছেন এখানে? সোজা জবাব দিন।ʼʼ

-“আমার মনে হয়না, আপনি আমায় আসলেই রোধ করতে চাইছেন। কারণ আপনি নিশ্চিত এতক্ষণে, আমি আপনার বিশেষ ক্ষতি করব না। আর আপনি ছাড়া আপাতত বাড়িতে উপস্থিত আর কারও চিন্তাও বিশেষ নেই আপনার মাঝে।ʼʼ

-“হুশিয়ারী করছেন?ʼʼ

-“ধারণা করছি। সময় কম হাতে, সরে দাঁড়ান।ʼʼ

-“ভেতরে কী কাজ আপনার?ʼʼ

“আপনার মামাশ্বশুরের ঘরটা কোনদিকে? ঘরটা দেখিয়ে দিন।ʼʼ

অন্তূ ভ্রু জড়াল। তার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় তাকে কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছিল যেন। আগুন্তুককে তার কেন জানি ভয় লাগছিল না আশ্চর্যজনকভাবে। এত কড়া পাহারার পর লোকটা দোতলায় উঠে এসেছে, অথচ কোনো আক্রমণাত্মক অভিব্যক্তি নেই…আজব! আগুন্তুক অন্তূকে বলল, “আসুন আমার সঙ্গে।ʼʼ

হুমায়ুন সাহেবের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল, “ডাকুন।ʼʼ

অন্তূ ডাকল। আগুন্তুক দরজার সামনের থেকে সরে একপাশে দাঁড়াল। যেই না হুমায়ুন সাহেব দরজা খুললেন, অমনি পা বাড়িয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল হুড়হুড় করে। হুমায়ুন সাহেব চমকে বলল, “কে রে? কে তুমি? কে, কে? কে এইটা, আরমিণ?ʼʼ

-“বসুন, চাচা। উত্তিজত হবেন না। ভেতরে এসে বসুন।ʼʼ

শাহানা হৈ চৈ শুরু করে দিলেন। আগুন্তুক বলল, “চাচিমা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি অসময়ে এসেছি ঠিকই, তবে আমার কাছে এটাই সময়।ʼʼ

হুমায়ুন সাহেব তাকিতুকি করছেন। বোধহয় অস্ত্র-সস্ত্র কিছু খুঁজছেন। আগুন্তুক বলল, “আমি একটা গল্প শুনতে এলাম আপনার কাছে। আল্লাহ পাক আমাকে সবর দিয়েছেন, আমি তার কাছে আরও সবর প্রার্থনা করছি। যা জিজ্ঞেস করব, কোনো রকম শিরোনাম বা অজুহাত ছাড়া বলে যাবেন।ʼʼ

-“কে তুমি?ʼʼ

-“আজ পরিচয় থাক। আখিরাতে জাহান্নামে যাবার পথে আমার-আপনার আবার দেখা হবে। মৃত্যূর আগে কিছু মহাপাপ আর কুফরি করে মরব আমি। জাহান্নামের দিকে এগিয়ে যাবার পথে পরিচিতিসহ অনেক আলাপ হবে। আপাতত মূলকথায় আসি।ʼʼ

অন্তূ অবাক হয়ে গেল। হুমায়ুন সাহেব দরদর করে ঘামছেন! পাপ তার চোখে-মুখে চামড়ার মতো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কে এই আগুন্তুক? বিছানায় বসে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করছে, “মুমতাহিণাকে এই বাড়িতেই মারা হয়েছিল, তাই তো?ʼʼ

হুমায়ুন সাহেব হাত দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ মুছলেন। শাহানা স্বামীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বাহু চেপে ধরলেন। আগুন্তুক ফের বলল, “কী হয়েছিল মুমতাহিণার সাথে আসলে? আপনি কখন গেছিলেন ওর কাছে?ʼʼ

অন্তূ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। মুমতাহিণা ওরফে আঁখি! এটা কে তাহলে? মুমতাহিণার ভাই? কিন্তু সে তো মরে গেছে। কী সুন্দর নামটাকে এই জানোয়ারের দল বিকৃত করে রেখে দিয়েছিল। কোরআনুল কারিমে একটা সুরা আছে মুমতাহিণা নামে।

হুমায়ুন সাহেব মুখ খুলছিলেন না। এক পর্যায়ে আগুন্তুক উঠে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা ধরল ঠিক হুমায়ুন সাহেবের গালের ভেতর। ট্রিগারে বারবার ছটফটে হাত রেখেও আবার সরিয়ে নিচ্ছিল।

শাহানা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিলেন। আগুন্তুক অনুরোধ করল, “চাচিমা, আপনি চিৎকার করবেন না। আমার হাতে সময় কম। রাত ফুরিয়ে আসছে। আমি কিছু জানতে এসেছি, তা উনি বলছেন না, সময় কেটে যাচ্ছে, এভাবে ছাড়া উপায় নেই। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। আল্লাহর ওয়াস্তে, চিৎকার করবেন না। এটুকু রহম করুন।ʼʼ

মুমতাহিণাকে যখন আনা হলো এখানে, তার আগে তাকে পলাশের হোটেলে রাখা হয়েছিল। এখানে আনার পর বেশ কিছদিন আঁটকে রাখা হলো। মেয়েটা চমৎকার মায়াবতী ছিল। যেন এরাবিয়ান সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা কোনো শাহজাদী। লম্বা হাতার ঢিলা পোশাক, চুলগুলো দেখা যেত না কখনও, ওড়না মাথায় থাকতো সবসময়। ওকে রোজ খাবার দিতে যাবা বা দেখাশোনার দায়িত্ব হুমায়ুন সাহেবের ছিল। বাড়ির মেয়েদের কিছু জানানো যাবেনা। জয় তখন ঢাকাতে। তার সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা। হামজা সারাদিন বাইরে থাকে, বিভিন্ন কাজে। হুমায়ুন সাহেব যেতেন তিনবেলা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরের নিচের ঘাঁটিতে। স্ত্রী থেকেও বিপত্নীক হয়ে গেছিলেন স্ত্রীর রোগের জন্য। কিন্তু পৈশাচিক পুরুষত্ব কি বাঁধ মানে? এমনও হয়েছে, রোজ দু-তিনবার তিনি ধর্ষণ করেছেন মুমতাহিণাকে।

তবুও মেয়েটা বেঁচে ছিল কোনোরকম, তাকে বাঁচিয়ে রাখা হলো। কিন্তু পলাশের হোটেল থেকে ওই চাঁদের টুকরো কিশোরী অক্ষত চলে এসেছে, পলাশ সুযোগ পায়নি তাকে নষ্ট করার, পাগলামী করার। পলাশ চুপচাপ বসবে? কেন বসবে? সে-ই গেল শেষবার ষোলো বছরের সেই অর্ধমৃত মুমতাহিণার কাছে। এরপর আর মুমতাহিণাকে দৈববলেও বাঁচানো সম্ভব নয়।

অন্তূর শরীরটা থরথর করে কেঁপেছিল সেসব শুনে। মুমতাহিণার লাশ নীলচে হয়ে উঠেছিল। কতদিন পর লা-শ ছেড়েছিল কে জানে? অথচ অচেনা যুবক জমাট বরফের মতো শীতল।

আগুন্তুক সে- রাতে হুমায়ুন পাটোয়ারীর বুকে কম-বেশি সত্তরটা ছুরিকাঘাত করেছিল। তাকে থামানোর উপায় নেই, থামানোর কেউ নেই-ও। অন্তূ একদৃষ্টে চেয়ে দেখছিল যুবকের খুবলে খাওয়া। রক্তে ছুটে এসে দু এক ফোঁটা অন্তূর শরীরে লাগতেই শরীরটা শিহরণে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল। জয় ভুল বলেনা, মানুষের র-ক্ত কখনও কখনও অমৃত সুধার মতো লাগে। অন্তূ ভাবছিল, এত সন্তুষ্টিদায়ক দৃশ্য সে কি আগে দেখেছে জীবনে?

হুমায়ুন পাটোয়ারীর যকৃত এবং হৃৎপিণ্ডের টুকরোগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুরির ডগায় উঠে এসেছিল। অন্তূ তৃপ্তির সাথে দেখেছিল তা। বুক ভরে শ্বাস নিয়েছিল।

এসবের আগে শাহানা আর্তনাদ করে আগুন্তুকের পায়ের কাছে বসে পড়েছিল, “বাপ! মারিস না, বাপ। আমার নাকফুল খুলে নিস না, তুই। আমি উনারে খুশি করতে পারিনাই। যা করার করেই তো ফেলছে, আমার নাকফুল কেড়ে নিস না, তুই। ছেড়ে দে। তোর দোহাই লাগে। ভাব তো, তোর মা যদি এমনে বলতো! পারতি, পারতি কথা না রাখতে। ছেড়ে দে, বাপ। মারিস না। আমার সুখ-দুঃখের সাথী। আমার পাপ-পূণ্যের সাথী…..ʼʼ

অন্তূ এগিয়ে গিয়ে শাহানার ঘাঁড়ের কাছে বাঁ-পা দিয়ে কষে একটা লাত্থি মেরেছিল। শাহানা ছিটকে পড়ে গেলেন। দমলেন না। আবার উঠে এসে যুবকের পায়ের কাছে বসে আহাজারি করে উঠতেই কাঁচের ফুলদানিটা তুলে অন্তূ বিকট আওয়াজে শাহানার মাথায় আঘাত করে। কাঁচের ফুলদানী চুরমার হয়ে গেঁথে যায় শাহানার কপাল ও মাথায়। আগুন্তুক ততক্ষণ বিমূঢ় চেয়ে ছিল। আক্রমণ করেনি, সরায়নি শাহানাকে, একটুও খারাপ খারাপ আচরণ করেনি, যেন সে শেখেনি সেসব। কিন্তু অন্তূর সহ্য ক্ষমতায় আসেনি। শাহনার র-ক্তে হাত ভিজতেই একটা অদ্ভুত সুখ অনুভূতি হলো। ইচ্ছে করল, যে ঠোঁট দিয়ে মিনতি করেছে শাহানা স্বামীকে বাঁচানোর, সেই ঠোঁটদুটো কেটে পশু দিয়ে খাওয়াতে। অনেক রকম হিংস্র ইচ্ছে জাগছিল অন্তূর শাহানার জন্য।

এইসকল নারীদের সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই পঁচা গু মাটিতে পরিণত হওয়া মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন! এদের চেয়ে জঘন্য নারীও কি আর আছে সৃষ্টিকর্তার এই সুন্দর দেখতে দুনিয়াতে? নেই বোধকরি। এরা ময়লা, এরা নরকের ক্ষুধা মেটানোর খাবার। এজন্যই বোধহয় বুজুর্গজনেরা বলে গেছেন, সৃষ্টিকর্তা জুড়ি বেছেই মেলান। খারাপ লোকের বউ সচরাচর ভালো হয়না।

আগুন্তুক যখন থামল, তখন পুরো ঘর একটা লা-শকা-টা ঘরের চেয়ে কম লাগছিল না। ছুরির আঘাত হুমায়ুন পাটোয়ারীর পাঁজরের হাড় গুড়ো করে মেরুদণ্ড ছেঁদ করে বেরিয়েছিল। আগুন্তুকের কালো জ্যাকেটে লাল র-ক্তের ছিটা দৃশ্যমান না হলেও উন্মুক্ত চোখের পাতা, ভ্রুতে র-ক্তের চাপড়ি পড়েছিল।

আগুন্তুক চলে যাবার সময় একবার অন্তূর দিকে তাকিয়েছিল। দুর্বোধ্য সেই দৃষ্টি বিনিময়। সন্তুষ্ট দুটো প্রাণ একে অপরকে শুকরিয়া জ্ঞাপন করল? বোঝা গেল না। ওই চোখদুটো অন্তূ ভুলবে না কখনও। মুখটা দেখা হলো না, জানা হলো না পরিচয়, হলো না বিশেষ কথা। তবুও তারা খুব পরিচিত একে অপরের। তাদের মানসিকতা এবং পথ তো এক!


সকালে দেখা গেল, ওয়ার্কশপের সামনে এবং বাগানের ধারে ছেলেদের যে আবাসিক একতলা বিল্ডিংটা আছে, সেখানে লা-শ বিছিয়ে আছে। ধ্বংসলীলা চলেছে অন্ধকার এক অবরুদ্ধ রাতে।

ঢাকায় সম্মেলনের জেরে রোডে-ঘাটে হানাহানি তো চলেছেই। আবারও জামায়াত ইসলামীর কয়েকজনের ফাঁ-সি-র রায় কার্যকর হলো। দেশে উত্তাল শিবিরগোষ্ঠী। বিরোধী দলের নেতৃবর্গরা তখন অবরুদ্ধ আছে। কতজনের মৃত্যুদণ্ড জানান দেয়া হলো, কতগুলো গোপন হলো, সে খবর রাখল কে? জনগণ তখন নিজেদের জীবন নিয়ে অতিষ্ট। চারদিকে হাহাকার। রাজধানীর জনজীবনে শোক লেগেছে। মাসের হিসেবে তখন দেশে শতাধিক করে লোক মরে। আসলে কত মরে, জানে কে? মেধাবী ছাত্ররাও নজরে পড়ছিল তখন। গণপিটুনি, গুলি করে মারা, অথবা না জানা সব মরদেহ উদ্ধার রোজকার কাহিনি। তখন দেশটা সন্ত্রাশদের, তখন দেশটা ক্ষমতাসীনদের ও বিশৃঙ্খলের রাজত্বে বন্দি গোটা দেশটা।

সেসব ছেড়ে হামজা ও জয়কে দিনাজপুর ফিরতে হলো। জয়ের পায়ের গোড়ালিতে ব্যান্ডেজ। হাতের কনুইতে টেপ মারা, ভ্রুর ওপরে কেটে গেছে। হামজার ডানহাত মারাত্মক আহত।

তারা পৌঁছাল ইশার নামাজের পর। শাহানা হাসপাতালে, অবস্থা খারাপ। তুলি অসুস্থ অবস্থায় চলে এসেছে বাড়িতে। বাড়ি ভর্তি লোকজন আর পুলিশ। কিন্তু কোথাও অন্তৃ নেই।

জয় ঘরে ঢুকতেই হতবাক হয়ে গেল। মেয়েটা কোথায় গেছে? মামার লাশের পাশে পুলিশসহ বিভিন্ন গভমেন্ট এজেন্সি থেকে লোক এসেছে। মেয়রের বাড়িতে মেয়রের তারই বাবার এমন নৃশংস হ-ত্যাকাণ্ড!

সেসব ফেলে জয় ছুটল অন্তূকে খুঁজতে। গালির খই ফুটছে মুখ দিয়ে। এই অসময়ে হয়রানী না করালেই না! অন্তূদের বাড়িতে গিয়ে যখন জানল, অন্তূ যায়-ইনি সেখানে। তখন টনক নড়ল। বকে উঠল, “শালির মেয়ে! পেরেশানী ছাড়া আর কিছু করালো না জীবনে!ʼʼ

কোথায় যেতে পারে? এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে অন্তূর মতো ঘরবন্দি মেয়ে যেতে পারে। হন্য হয়ে চারদিকে খুঁজল। কোথায় খুঁজবে এই রাতের বেলা মেয়েটাকে? মাথা গরম হয়ে উঠছিল। গোটা শহর ঘুরল। এতক্ষণের উত্তেজনা শেষে চট করে মাথায় এলো, খু-নি অন্তূর কোনো ক্ষতি করেনি তো?

চলবে..

[টাইপিং মিসটেক থাকলে ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here