#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬০. (প্রথমাংশ)
পলাশের হাসি পাচ্ছে। দুঃখে না আনন্দে বুঝতে পারছিল না। পায়ের কাছে দুজন অফিসাদের মরদেহ পড়ে আছে।তার একটুও ইচ্ছে নেই জয়-হামজার হাতে ধরা পড়ার। এত নিখুঁতভাবে স্নাইপার চালানোর দক্ষতা হামজার আছে। অর্থাৎ দুজন তাকে পুলিশের হাতে পড়তে না দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
হাতের হ্যান্ডকাফের দিকে তাকালো। এত বছরের পাপের জীবনে প্রথমবার এটা হাতে পড়েছে। বাইরে বোধহয় আততায়ীদের সাথে টুকটাক লুকোচুরিও চলছে পুলিশদের। পাশের বিল্ডিংয়ে জানালা বা ছাদে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। অর্থাৎ হামজা নিচে নেমে গেছে। তাহলে জয় কোথায়? গণ্ডগোল বাঁধানো শেষ। ফোর্স লণ্ড-ভণ্ড হয়ে গেছে। পলাশ ভুলেও পালানোর চেষ্টা করল না। সে পুলিশের হাতছাড়া হতে চায়না।
আগুন জ্বলছে চারদিকে। পেছনের ডোবার কাছের প্রাচীরের ওপার থেকে আরও কয়েকটা ককটেল এসে পড়ল বাগানে। জয়ের ছেলেরা আর পলাশের দলের চ্যালারা সব একাকার হয়ে গেছে। উদ্যেশ্য আলাদা হলেও আপাতত কাজ একই দুই দলের। পলাশকে পুলিশের হাতে না পড়তে না দেয়া। ককটেল একটা পলাশকে ঘেঁষে গেল, দ্রুত মাথা নামিয়ে বকে ওঠে পলাশ। রূপকথার জন্য বেশ টেনশন হচ্ছিল। ওকেও কি ধরা হবে? ও তো কোনো দোষ করেনি! তার নিজের বউকে আঘাত করার অধিকার শুধু তার আছে।
পাশের বিল্ডিংয়ে বাহিনীর তিনজন ঢুকে পড়ল, হামজা তখনও বিল্ডিংয়ের ভেতরেই। দোতলায় নেমে এসেছে ছাদ থেকে। দোতলায় প্রধান কার্যালয় এনজিওটির। একাধিক কেবিন আর ডেস্ক সাজানো একেক ইউনিটে। বাথরুমের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল হামজা। বাহিনীর লোক প্রথমত ছাদে উঠবে। কারণ ওরা নিশ্চিত বুঝেছে ফায়ারিং ছাদের ওপর থেকে হয়েছে।
হাতের এম-টুয়েন্টি ফোর স্নাইপার রাইফেলটির ওজন কম-বেশি পনেরো-ষোলো পাউন্ড। সেটাকে ঠ্যাং-য়ে ঠেকিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ-মাথা বেঁধে ফেলল। চোখদুটোও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। এরপর গিয়ে দোতলার প্রবেশ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। ঘুটঘুটে অন্ধকার গোটা বিল্ডিং। ওদের হাতে টর্চ আছে অবশ্য। তবে সেটার আলো সরু সামনের দিকে। বাকিটা অন্ধকার। ওরা যখন দরজা পেরিয়ে সোজা হুরহুর করে দোতলার ইউনিটের ভেতরে ঢুকে পড়ল, হামজা পায়ের স্যান্ডেল খুলে হাতে ধরে আস্তে করে বেরিয়ে এলো অন্ধকারে। নিঃশব্দে সিড়ি দিয়ে নেমে বাড়ির পেছনের ডোবার ধার এগিয়ি গিয়ে আমবাগানের ধারে ঝোপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
জয় কারও অস্তিত্ব টের পেতেই পেছন না ঘুরেই পিস্তলের মুজেলটা হাত বাঁকিয়ে তার পেটে তাক করে। হামজা শান্ত স্বরে বলল, “এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকিস না। এই ঝোপটাকেও সার্চ করা হতে পারে। এগিয়ে যা।ʼʼ
জয় খ্যাকখ্যাক করে উঠল, “ভাই, তুমি এইখানে কার বাল লাড়তে আইছো? ফোর্স ছড়ায়ে পড়ছে চারদিকে। কবীর দাঁড়ায়ে আছে মোড়ের ওপারে, বাড়ি যাও। আরমিণ, ভাবী, তুলি বাড়িতে একা। কেউ নাই কিন্তু বাসায় ওরা ছাড়া।ʼʼ
হামজা জয়কে ছোট্ট একটা পকেট চাকু ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা রাখ।ʼʼ মুখের রুমালটা খুলে জয়ের হাতে পেচাতে পেচাতে বলল, “সাবধানে ব্যবহার করবি ওটা। হাতে লাগলে সর্বনাশ।ʼʼ
জয় ঠেলে বের করে দেয় হামজাকে, “যাও তুমি। আমার কিছু হবেনা।ʼʼ
তখনও চারদিকে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। আরও ব্যাক-আপ টিম এসে ভরে গেছে চারদিকে। সব ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। তিনজন অফিসার অজানা আততায়ীদের গুলিতে নিহত। তাতে ক্ষেপা মৌমাছির মতো ছিটকে পড়েছে গোটা এলাকায় সবগুলো। বাহিনীর লোক ভাবেনি পলাশকে ধরতে এমন কাণ্ড হবে। হবার কথা তো নয় আসলেই, কিন্তু…।
হামজা স্পটটা পেরিয়ে বাকিটা পথ আরাম করে আম পাবলিকের মতো হেঁটে এসে মোড়ের এপারে কবীরকে বলল, “সিচুয়েশন হ্যান্ড-আউট হয়ে গেছে। জীপ নিয়ে তুই জয়ের কাছে যা। উল্টো পথ ধরে যাবি, তারপর পলাশের বাড়ির পেছনের আমবাগানের ভেতর থেকে ঢুকবি। জয় ওদিক দিয়ে বের হবে। অন্য উপায় নেই আর।ʼʼ
-“আচ্ছা, ভাই।ʼʼ কবীর কোনোমতো মাথা নেড়ে গাইগুই করা শুরু করল, “জয় ভাই বলছে আপনারে বাড়ি পৌঁছায়া দিতে।ʼʼ
হামজা নীরব চোখে তাকাল, “আর আমি কী বলছি?ʼʼ
কবীর আর একটা কথাও বলল না। চুপচাপ সোজা জীপে উঠে বসল। যাবার আগে শুধু আস্তে করে একবার বলল, “ভাই, আপনি কি আলাদা গাড়ি করে বাড়ি যাবেন?ʼʼ
-“বাড়ি যাব না আপাতত। বাড়িতে কয়েকজনকে রেখে এসেছি। তুই দ্রুত যা।ʼʼ
কবীর চুপচাপ চলে যায়। হামজা জয়কে এমন অবস্থায় ফেলে বাসায় যাবে, এই ভাবনা ভাবার মতো কঠিন বোকামি করেছে সে, বুঝল।
পলাশ তখনও পুলের ধারে দাঁড়ানো। ওর হাতে হ্যান্ডকাফ পরানোর পর পুলিশদের ওর দিকে আর খেয়ালই নেই। পুরো মনোযোগটা তিন মরদেহ ও অজানা হামলাকারীদের ওপর পড়েছে। পলাশের কাছে তখন মাত্র দুজন রক্ষী। তবু বেশ দায়সারাভাবে দাঁড়িয়ে। কারণ পলাশের কোনো হেলদোল নেই, সে যেন হাতকড়া পরে বেশ সুখেই দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে মাঝেমধ্যে পকেট হাতরানোর চেষ্টা করছে। একটু লেবুপানি পেলে ভালো হতো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার।
জয়ের মুখ বাঁধা। তবুও বোতলের কর্ক খুলতেই ঝাঁজালো এক শ্বাস আটকানো ধোঁয়ার মতো গন্ধ এসে নাকে ঠেকল। হালকা কেশে উঠল। লোহার গেইটের ছিটকিনির ওপর অল্প-অল্প করে তরল ঢালছিল, তাঁতাল ছোঁয়ায় প্লাস্টিকের মতো ক্ষয় হয়ে হয়ে পড়ছিল ধাতুগুলো।
মাটিতে পড়ার পর চিরচির করে শব্দ হচ্ছিল। এক সময় গোটা ছিটকিনির সিস্টেমটাই ক্ষয় হয়ে পুরো নিঃশেষ হয়ে গেল। জয় বোতলটার কর্ক কোনোমতে আঁটকে বোতলটা দূরে ছুঁড়ে মারল। হাতের রুমালের ওপর পড়েছে বোধহয় দু-এক ফোঁটা। রুমাল না পেঁচানো থাকলে হাতে লাগতো।
পিস্তলের ম্যাগাজিন খুলে কয়েকটা এম্মো রি-লোড করে সাইলেন্সর লাগিয়ে নিয়ে আস্তে করে গেইটটা খুলে ভেতরে ঢুকলো। শুকনো পড়ে গাদা হয়ে আছে। হাই-বুটের নিচে মরমর করছিল।
পলাশ এদিক-ওদিক তাকিতুকি করছিল। জয়কে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল, তারপর কেমন একটা অস্থিরতা ঘিরে ধরল পলাশকে। হাজার হোক, এই জয়কে পলাশ ছোট থেকে দেখেছে, হোটেলে একসাথে বসে মদ খাওয়া, আড্ডা দেয়া…তার সামনে এমন নিকৃষ্ট অপরাধীর মতো দাঁড়াতে বেশ অপ্রস্তুত লাগছিল পলাশের। তারা দুজনই পাপীষ্ঠ, অথচ সেইসব পাপকে ছাপিয়ে আজ এক পাপীর কাছে আরেক পাপী, পাপী হয়ে ধরা দিলো।
জয় ইশারায় সালাম দেয় পলাশকে। পলাশ ছাড়া আর কারও সাধ্যি নেই জয়কে চেনার, এমনভাবে প্যাকিং করেছে নিজের। পুলিশদুটো জয়কে খেয়াল করে রাইফেল তাক করার আগেই লুটিয়ে পড়ল মাটিয়ে। জয়ের সেমি-অটোমেটিক পিস্তলের তিনটা বুলেট, দুটো প্রাণহীন দেহ।
পলাশ দৌঁড়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। ফোর্সের সবাই সামনের দিকে। এটাই বোকামি ওদের। দুজনকে রেখে ওরা নিশ্চিন্তে আততায়ী খুঁজছে। অবশ্য কারণ আছে। এখনও খণ্ড যুদ্ধ চলছে সামনে।
পলাশ বাড়ির পেছন দরজা অবধি পৌঁছালো না, জয় নিখুঁত নিশানায় পলাশের ডান পায়ে গোড়ালি বরাবর শ্যুট করল। থুবরে পড়ে যায় পলাশ। তখনই ঢুকল কবীরের সাথে তিনজন। পলাশের মুখে খানিকটা কাপড় গুঁজে ওকে টেনে বাগারের ভেতরে নেবার পর পুলিশের কয়েকজন এপারে এলো।
গোটা ঘটনাটা পুলিশ বাহিনী পলাশের বাড়িতে ঢোকার পাঁচ মিনিটের মাঝে ঘটে গেল। একই সাথে বিভিন্নদিকে বিভিন্নভাবে সেট-আপ হয়ে শেষ অবধি জয় গাড়ি ভাগিয়ে আমবাগান পেরিয়ে ঢুকে পড়ল এক গ্যারাজে। সেখানকার সাটার ডাউন হলো। পুলিশের বাহিনীর নাগালের ভেতরেই তারা তখন নাগাল ছাড়ানো ফেরারি।
পলাশের পায়ের গুলিটা কোনোমতো পা ছুঁয়ে গেছিল। নেহাত থামানোর উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়া। কোনোমতো রক্ত বন্ধ করে ওকে সাডেটিভ ড্রাগ দেয়া হলো।
শেষরাতের দিকে যখন গাঙের পাড়ের বাড়িতে পৌঁছানো ওরা। রূপকথা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে। কবীর অবাক হয়ে যায়। হামজা বসে আছে সোফায়।বাড়িতে না গিয়ে এখানে এসে জয়ের অপেক্ষা করছে। কী দৃঢ় বিশ্বাস, জয় জয়ী হয়েই ফিরবে, সে জয়কে সেই ধাঁচেই গঠনগতভাবে কাঠামো দিয়েছে।
পলাশের বাড়ি, নির্জন জায়গা। কারও সন্দেহও হবার কথা নয়, যে পলাশ এভাবে পালিয়ে নিজের কোনো বাড়িতে যাবে। হলেও সে ব্যবস্থা আছে। পুলিশের ধারণা পলাশকে নিয়ে পালিয়েছে ওর দলের লোকেরা।
—
রূপকথা স্বামীকে সেই রাতে একবার দেখেছিল অচেতন অবস্থায়। জয় ওকে ধরে নিয়ে এসে বেসমেন্টের এই কক্ষে শিকল পরিয়ে রেখে গেছে। তারপর যেসব অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছে, সেসব সময় রূপকথা দূরে থেকেছে। ওসব ভালো লাগেনা।
পলাশের গোঙানি কানে এলে নিজের সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে বিয়ের সেই প্রথম রাত। তার ফর্সা, নমনীয়, অক্ষত চামড়ায় পলাশের পাগলাটে থাবা পড়েছিল। এরপর আর সব…. কত যন্ত্রণা, কত ছটফটানি, প্রতারণা, আর বাধ্যগত সেইসব পাপ! নিষ্পাপ এক চাঁদ মুমতাহিণা! রূপকথার নিজেকে নোংরা কীট মনে হয় সর্বক্ষণ!
রূপকথা মেঝেতে আঁচল বিছিয়ে বসে। জয় তাকে কতটুকু সময় দেবে পলাশের কাছে কাটানোর, জানা নেই। তার কেমন লাগছে? কে জানে কেমন লাগছে! এই লাগার নাম নেই, বর্ণনা নেই। সে কি শেষবার মানুষের মতো দেখতে এই পশুকে দেখছে! বিয়ে আগ অবধি যে তার পলাশ ভাইয়া ছিল, এরপর হলো নরকের দ্বাররক্ষী!
আচ্ছা রূপকথার অস্থির লাগছে কেন? কীসব হিসেব-নিকাষের অংক ঘুরপাক খাচ্ছে জীবনের! অবর্ণনীয় সব অযাচিত অনুভূতিরা নৃত্যরত চারধারে।
অনেকক্ষণ বসে থাকে পলাশের মাথার কাছে। খুব ধীরে নিঃশ্বাস পড়ছে পলাশের। রূপকথার অবচেতনা ভাঙলো, হিংস্র এক লাত্থি পড়ল দরজায়। রূপকথা নড়ল না, উঠল না, শুধু বলল, শব্দ কোরো না, “জয়। নিশ্চুপ থাকো কিছুক্ষণ।ʼʼ
চলবে…
[আপনাদের কথা দিয়েছিলাম, আর সকলের মন খারাপ দেখে না দিয়ে পারলাম না। ক্ষমা-টমা চাইবার মুখ নেই আমার। তবু ক্ষমা করবেন। বর্ধিতাংশ খুব তাড়াতাড়ি দেব ইনশাল্লাহ]