#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬২.
মুরসালীন ও হামজা দুজনেই অনেকক্ষণ কথা বলেনি সেদিন। বাচ্চারা জেগে উঠেছিল। ভয়ে ভয়ে এসে পানি খাচ্ছে কেউ কেউ। খুব পিপাসা তাদের। একটু মুক্তির পিপাসা, মায়ের কোলে ফেরার পিপাসা, দুনিয়ার আলো দেখার পিপাসা! এত পিপাসা থাকা ঠিক না। তবু ওরা পিপাসার্ত।
হামজা বলল, “দলের বহুত লোক জিম্মি তোমাদের কাছে। তাদের হদিশ দাও।ʼʼ
মুরসালীন চুপ। হামজা নিজেকে দমন করল। যথাসম্ভব শান্ত স্বরে বলল, “একই কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, তুমি হচ্ছো না শুনে শুনে!ʼʼ
-“ফজরের আজান পড়ছে। নামাজ পড়ব।ʼʼ
হামজা বেরিয়ে এসেছিল।
ওদের হাত-পা বাঁধা নয়। কিন্তু সবাই আঘাতপ্রাপ্ত, ক্ষত-বিক্ষত। না হলেও ওই অবরুদ্ধ কুঠুরি ছেড়ে বেরোবার উপায় নেই। ওযু করে মুরসালীনের ইমামতিতে এক বদ্ধ দেয়ালের বেষ্টনিতে ফজরের নামাজ আদায় করল সকলে। নামাজ শেষে অনেকক্ষণ মোনাজাতে হাতে তুলে বসে রইল মুরসালীন।
ওকে বোঝা যায়না। গায়ে পাঞ্জাবী বা জুব্বা চড়ায় না। পরে জিন্স প্যান্ট, গালে সুন্নতি দাড়ি নেই, নেই কোনো ইসলামী লেবাস। দেখতে উচু-লম্বা আর্মিদের মতো। শুধু নামাজটা পড়ে। কথাবার্তা স্পষ্ট। বংশ পরম্পরায় এইটুকু ধর্মীয় আচার পেয়েছে বোধহয়, অথবা অন্যকিছু! জাতীয়তাবাদী দলের নেতাকর্মী আর জামায়াত একই জলীয় দ্রবণের মিশ্রণ তো!
—
সেইরাতে মহিলা যখন হারিকেন নিয়ে এসে দাঁড়াল, জয় দ্রুত সতর্ক করল, “চিৎকার করবেন না। আমি সাহায্য চাইতে এসেছি।ʼʼ
এরপর দুজনই চুপ। অবাক হয়ে দেখল দুজন দুজনকে। লতিফের স্ত্রী আসমা। মহিলা আতঙ্কে জড়িয়ে গেল। জয় ওদেরকে দেশের শেষ সীমান্তে চলে যেতে বলেছিল, নয়ত দেখা হলেই মেরে ফেলবে। ওরা জয়ের থেকে আত্মগোপন করেছে, কিন্তু জেলা ছাড়েনি। আজ কি খোঁজ পেয়ে জয় এসেছে!
জয় হাসল, “কথা রাখেননি, ভাবী। ভেরি ব্যাড।ʼʼ
আসমা কথা বলতে পারেনা। জয় বলল, “দরজা খোলা রাখুন।ʼʼ
সে গাড়িটাকে নিয়ে এসে টিনের ফটক খুলে উঠোনে ঢুকিয়ে রাখল। উঠোনটা ছোট। লতিফ ঘামছে। এখনও ক্রাচে ভর করেও ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। সমস্ত সম্পত্তির প্রায়টাই পায়ের চিকিৎসায় খরচা হয়ে গেছে।
কবীর ও জয় মিলে পলাশকে নামিয়ে বারান্দায় রাখল। মাটির ঘর, পাঠখড়ির বেড়া। পাশে টিনের কাঠের মিল।
জয় জিজ্ঞেস করল, “লতিফ ভাই, উডমিল কি আপনার নাকি?ʼʼ
লতিফের শরীরটা কাঁপছে। সে কোনোমতো ঘাঁড় নাড়ল। জয় বলল, “আপনার একটা ক্ষমার পথ আছে। মানে আমি কাউকে ফার্স্ট টাইম সেকেন্ড চান্স দেব।ʼʼ
আসমা পলাশের অবস্থা দেখে বমি করে ফেলল। এত বিদঘুটে জীবিত লা/শ সে দেখেনি আগে। দ্রুত ঘরে চলে গেল। সঙ্গে অন্তূকে নিয়ে গেল টেনে। জয় আমিরের স্ত্রী বলে কথা।
জয় বাড়ির সমস্ত আলো নিভিয়ে একদম স্বাভাবিক ও নীরব থাকার আদেশ দিলো সবাইকে। আপাতত আগামী তিন-চার ঘন্টা চুপ থাকতে হবে। পুলিশ রাস্তা দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই বিরান জায়গায় অথবা কোনো বসতিতেই সার্চ করে দেখবে না। প্রশ্নই ওঠেনা।
আসমা কিচ্ছু শুনল না। সকলের জন্য রান্না করতে গেল। অন্তূ গিয়ে বসল তার পাশে। বিভিন্ন কথাবার্তা হচ্ছিল। রান্নাঘরটা ভেতরে। অন্তূ সাহায্য করছিল। তার আসমাকে ভালো লাগছে। আসমারও তাকে চরম পছন্দ হয়েছে। অন্তূর ভেতরে শঙ্কা কাটছিল না, তবু সে স্বাভাবিক থাকতে চাইল। আজকাল এসব আর গায়ে লাগেনা।
জয় রাত আড়াইটার দিকে গোসল করে লতিফের একটা লুঙ্গি পরল। কবীর রাস্তার পাশে পেশাব করার ভঙ্গি করে আশপাশ দেখে এলো। কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। জয়ের উপস্থিত বুদ্ধিতে তার বুক গর্বে ফুলে উঠলো। কারণ সে জয়ের মতো চতুর লোকের বিশ্বাসভাজন লোক। পুলিশ কল্পনাও করতে পারবে না, ওরা এত কাছে এমন এক বাড়িতে উঠে আরাম করছে। পুলিশ হোক বা সাধারণ লোকও সবসময় এসব ক্ষেত্রে দূরবর্তী চিন্তা করে।
লতিফের মেয়ে জেগে উঠে জয়কে চিনতে সময় নিলো। সে হাসপাতালের সেই ক্ষণ ভোলেনি। জয়কে বলল, “এই তুমি আমাকে একটা মদার গেলা দেখাতে চাইছিলে না? এখন দেখাও?ʼʼ
জয় বলল, “তোমার আব্বু বোধহয় সেই খেলাটা পছন্দ করবে না, আম্মা।ʼʼ
-“কেন করবে না? আব্বু আমাকে খেলতে দেয়। কিতু বলে না। দেখাও।ʼʼ
জয় লতিফকে বলল, “ভাই, মেয়ে পিস্তলের খেলা দেখতে চায়। বাপ হিসেবে প্রাণটা উৎসর্গ করতেই পারেন। বাচ্চা মানুষের আবদার ফেলা ঠিক না।ʼʼ
তারপরই মনে পড়ল, তার কাছে এক্সট্রা বুলেট নেই, ম্যাগাজিন খালি। কিন্তু এই দূর্বলতা তো প্রকাশ করা যাবেনা। পিস্তল হতে পারে মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও কার্যকর সঙ্গী, হোক তার ভেতর ফাঁপা। দেখলেই লোক ডরায়।
রাত সাড়ে তিনটার পর পলাশকে কাঠের মিলে নেয়া হলো। পলাশের শ্বাস পড়ছে ধীরে ধীরে। লতিফ ঠকঠক করে কাঁপছে। তার চোখে-মুখে নিদারুণ আতঙ্ক। জয় যা করতে চাইছে, তা সুস্থ মানুষ দেখতে পারেনা।
সেদিন শেষরাতের দিকে লতিফের কাঠের মিলের উডওয়ার্কিং সারফেস মেশিন চালু করা হলো। যা দিয়ে শত শত বছরের হাতির মতো মোটা মোটা গাছ এক নিমেষে ফালা ফালা করে ফেলা হয়।
পলাশকে সেই মেশিনের ওপর শোয়ানো হলো। হাত-পা বাঁধা। জয় অপেক্ষা করল ওর চোখে-মুখে মৃ/ত্যু/র করুণ সেই অসহায় ভয়টা ফুটে ওঠার। পলাশ তো পাগল। তবু বোধহয় মৃত্যু বিষয়টাই এমন, যাকে-তাকে গ্রাস করে তার অন্ধকার গর্ভে।
পলাশের চোখের সেই কাতরানি জয়কে খুব শান্তি দিচ্ছিল।পলাশের দেহটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিল চলন্ত ব্লেডের দিকে। চিইচিইই শব্দ হচ্ছে। কবীর ও লতিফ বেরিয়ে গেল।
সারা মেঝেতে ত্রিপল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। রক্ত আঁটকে থাকতে পারে এমন সব যন্ত্র সরিয়ে নেয়া হলো।
পলাশ সেই চলন্ত উডকাটার ব্লেডের দিকে চেয়ে দেখল। সাথ সাথে চোখটা বন্ধ করল। হাতদুটো থেতলানো কিমা। হাড়ের সন্ধি নেই। ঝুলছে। সেই যন্ত্রণা ভুলে গেল সে। তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। তবে অদ্ভুত এক ভয় গ্রাস করেছে। তার এত ক্ষমতা, এত বড়াই! পলাশ নামে মানুষ থরথরিয়ে উঠেছে, এই তো ক’দিন আগের কথা।
সে মানুষের বসত জমি, ব্যবসার পয়সা, বউ, সন্তান, মেয়ে, দেশের সম্পদ কিছুই ছাড়েনি। মানুষ এভাবেই কাতরেছে। কত লোকই যে এই জীবনে তার নোংরা পা দুটো জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদেছে। কেউ প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে। কেউ বা বলেছে, ‘আর মারবেন না। আর মারবেন না। ওরে আল্লাহ!ʼ
পলাশ সেই সব আহাজারি শুনতে পাচ্ছিল। রূপকথার চিৎকারও কানে এলো। কী আশ্চর্য! কত মেয়ে হাতজোর করে সম্মান প্রার্থনা করেছে, তার খারাপ লাগেনি। মানুষ ভাতের চাল কেনার পয়সাটুকুও তার হাতে সঁপে দিয়েছে জানের ভয়ে। তারপর নিশ্চয়ই না খেয়ে থেকেছে! সামান্য মুদির দোকানিকেও যে ছাড়েনি পলাশ! মৃত্যুর ভয় এত তাদের? বোকা ওর। ওরা কি জানে, ওদের চেয়ে পলাশেরা কত কঠিন শাস্তির ভোগ করে বিদায় হয়! তা জানলে ওরা ভয় পেত কি?
সবচেয়ে বড় আশ্চর্য হলো পলাশ, সে সেইসব লোকের হাতে মরছে না। না, তারা তাকে শাস্তি দিচ্ছে না। আজব ব্যাপার! তার কাল আজ জয়। জয় আমির। যার নিজের পাপেরই অন্ত নেই। আর সে আবার শাস্তিকে ভয় পায়না।
প্রথমে পলাশের কোমড় সমান দুইভাগ হয়ে গেল। একভাগ দুটো পা ও কোমড়, অপর ভাগ পেট থেকে মাথা। গোসল করে বিশেষ লাভ হলো না। ফোয়ার মতো রক্ত ছুটছে চারদিকে। জয়ের গোটা দেহ ভিজে উঠল পলাশের র-ক্তে।
উপরের ধড়টাকে ঘুরিয়ে মেশিনের ব্লেডের নিচে দিলো। ছোট ছোট টুকরো হলে বহন করতে সুবিধা হবে। তার শুধু মাথা চাই। বাকিটা অপ্রয়োজনীয়।
দুটো হাত ও মাথা সহ মোট চার টুকরো হলো। বাকি টুকরো গুলো বিশাল এক পলিথিনে ভরে তারপর ছালার বস্তায় ভরল। মাথাটা আলাদা করে আরেক বস্তায় ভরে লতিফকে ডাকল।
হামজাকে কল করল। লোক দরকার। এরকম ভয়ানক কাজ কারা করতে পারবে, তাদের যেন পাঠায়। চর্বি, রক্ত, মাংসের টুকরো, শরীরের কত রকমের কী রক্তের সাথে মিশে মেশিনে পড়ে আছে। মেশিনটা খুলে ফেলে দিতে হবে। ত্রিপল উঠিয়ে ফেলল, গোটা ঘর পরিস্কার। ত্রিপলটাও ভাঁটার পুকুরে ধুয়ে আনলো কবীর। অন্ধকার থাকতে থাকতে সব করলে ভালো।
তা বোধহয় হবেনা। হামজা এখন লোক পাঠাবে না। সেটা ঝুঁকিপূর্ণ।
পরদিন সকালে নিজেই বেরিয়ে গিয়ে কোত্থেকে যেন বড় বড় ইলিশ কিনে আনলো জয়। ইলিশ মাছে তার জন্মের দূর্বলতা। লেজ ভর্তা, ইলিশ মাছ ভাজা, সেটাকে জ্বালিয়ে খাওয়া অথবা যেকোনো পদে তার ‘নাʼ নেই। ইলিশ মাছ খেতে খেতে তার নিজেকে খাঁটি বাঙালি মনে হয়।
খাওয়া দাওয়া করে অন্তূ কবীরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জয়। বাকিটা হামজা সামলাবে। কবীরকে দিয়ে একটা ভালো এমাউন্ট লতিফকে দিলেই সে খুশি। রাজনীতি ছেড়েছে দায়ে পড়ে, ভেতরের সেই ছোটলোকি তো যায়নি!
গাড়ি উল্টোদিক থেকে ঘুরিয়ে দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করল। যখন-তখন পুলিশ বাড়িতে হানা দেবে তাদের। সন্দেহের তালিকার সবচেয়ে আগে হামজা পাটোয়ারী ও জয় আমিরের নাম থাকবে। স্বাভাবিক। বাড়িতে এসে না পেলেই আইনের লোক দুই দুইয়ে চার মিলিয়ে নেবে।
ড্রাইভিং করতে করতে জয় গান ধরল,
আমি যত চাই আমার মনরে বোঝাইতে…
মন আমার চায় রঙের ঘোড়া দৌড়াইতে
ও পাগল মনরে, মন কেন এত কথা বলে…..
লতিফের লুঙ্গি প্রিন্টের। তার বিরক্ত লাগছিল। লুঙ্গি হবে সাদা। এসব প্রিন্ট কেন?
—
কাস্টডিতে বসে রূপকথার ভীষণ গরম লাগছিল। মাথার ওপরে স্পটলাইট জ্বলছে। তাতে অস্বস্তি বাড়ছিল। খানিক বাদে দুজন কর্মকর্তা এলো। পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো।
রূপকথার পিপাসা নেই। সে কক্ষের চেয়ারের টেবিলের মতো নির্লিপ্ত। অফিসার জহিরুল আলমগীর জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার স্বামী এখন কোথায়?ʼʼ
-“আমি জানিনা।ʼʼ
-“খুব কমন একটা জবাব। কানে পঁচন ধরেছে এই শব্দ দুটো শুনে শুনে। নতুন কিছু বলুন।ʼʼ
রূপকথা বলল, “আমি জানিনাʼ কথাটিকে নতুন আর কীভাবে বলা যায়, সেটা জানা নেই। জানা থাকলেও আপাতত মাথায় আসছে না।ʼʼ
-“খুব পেরেশানীর মধ্যে আছেন?ʼʼ
-“জি না। পেরেশানী কী? ভালোই তো লাগছে।ʼʼ
-“ভালোই লাগছে?ʼʼ
-“লাগছে।ʼʼ
-“লাগবে না বেশিক্ষণ। আর কিছুক্ষণ ‘জানিনাʼ বলতে থাকলে খারাপ লাগার কাছে নিয়ে যাব।ʼʼ
রুপকথা চুপচাপ। জহিরুল বলল, “পানিটা খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।ʼʼ
-“আমার খারাপ লাগছে না।ʼʼ
কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল জহিরুল। খানিক বাদে কক্ষে আরও কয়েকজন কর্মকর্তা এলেন। সাথে একজন মহিলা কনস্টেবলও। রূপকথার নির্বিকার, দুর্বোধ্য মুখখানাও সুন্দর। শাড়ির আচলটা চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে।
-“আমাদের কাছে খবর আছে, কুখ্যাত স-ন্ত্রা-সী পলাশ আজগর নিজের তৃতীয় আবাসে আমাদের দুটো অফিসারকে খু/ন করে পালিয়েছে, এরপর গাঙের পাড়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। আর সেখানে আপনি আগে থেকেই ছিলেন।ʼʼ
-“জি, খবরটা ঠিক।ʼʼ
-“আর আপনি বলছেন, আপনি জানেন না? আমরা কি বোকামির ফাণ্ড খুলে বসে আছি? ভালো কথায় জীবনেও আপনারা মুখ খোলেন না। তখন ক্যালানি দিতে হয়, আর লোকে বদনাম করে ডিপার্টমেন্টের। আপনি ওখানে উপস্থিত ছিলেন, আর আপনি জানেন না?ʼʼ
-“হ্যাঁ। যতক্ষণ সে ওই বাড়িতে ছিল, ততক্ষণ জানতাম। এরপর ও বাড়ি থেকে যখন পালালো, তখন তো আমাকে বলে যায়নি, সঙ্গে নিয়েও যায়নি। আপনারা আমাকে ওই বাড়িতে একা পেয়েছিলেন।ʼʼ
-“একা পাইনি, ম্যাডাম। আশপাশ থেকে কয়েকটা ছোঁকরাদেরও সাসপেক্ট করা হয়েছে। তাদের পরেই ধরি। আগে আপনারা জন্মের বাটপারি করে নেন।ʼʼ
-“বাড়িতে আমি ছিলাম। ছোঁকরাদের হিসেব আমার সাথে নেই, অফিসার।ʼʼ
-“তা ছিলেন। তার মানে এই নয় যে, আপনাকে বলে যায়নি।ঘরের বউকে বলে যায়নি।ʼʼ
রূপকথা হাসল। অবর্ণনীয় হাসির রেখা। উপস্থিত কর্মকর্তারা একে অপরের দিকে তাকাল রূপকথার সেই হাসিতে।
-“পলাশ আজগর এত বড় কুখ্যাত সন্ত্রাসী, তার মাথা খারাপ তো থাকার কথা না। সে এটুকু নিশ্চয়ই জানে, যত আপনই হোক, পুলিশের মার খেলে সবাই সত্যি কথা গড়গড় করে বলে দেয়। আমাকে বলার হলে আমাকে সঙ্গেও নিতো।ʼʼ
সকলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। জহিরুল খুব তীক্ষ্ণ সন্দেহীন চোখে চেয়ে বলল, “আপনি খুব শেয়ানা মহিলা। যুক্তির মারপ্যাচে পুলিশকে ঘোল খাওয়াতে চাচ্ছেন, অ্যা?ʼʼ
খুব উগ্র হয়ে উঠল অফিসার। রূপকথা চুপচাপ। জহিরুল ছোট দুটো অফিসারকে আদেশ করল, “রিমুভ হার টু রিমান্ড।ʼʼ
রূপকথা নির্দিধায় চুপচাপ সাথে চলল। তার চলনে উদ্বেগ নেই, ভয় নেই, চিন্তা নেই। মুখে কঠোর নির্লিপ্ততা। চোখদুটো ভীষণ জ্বলছে। জীবনের গড়মিলে হিসেবগুলো সামনে আসছে, মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা।
-“রূপ!ʼʼ
রূপকথা তাকাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরাগ হাসল সামান্য, “ভালো আছিস?ʼʼ
পরাগের হাতে ব্যান্ডেজের ওপর হাতকড়ার পরানো হয়েছে। রূপকথাও হাসল, “ভালোই তো।ʼʼ
দুজনকে দুইদিকে নিয়ে চলে গেল কর্মকর্তারা। পরাগ একবার পেছন ফিরে রূপকথার নিঃশব্দ চলন দেখল। শাড়ির আঁচল মেঝের ওপর ছেঁচড়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে হাটিহাটি এগিয়ে যাচ্ছে রূপকথা। সে রাজন আজগরকে কত নিষেধ করেছিল, রূপকে পলাশের ঘরে বিয়ে না দিতে।
—
জয়দের আসনের এমপি সাহেবের ভাগনি বাপ্পী মণ্ডল। বিরাট নেতা। সে এলো বড়ঘরে। হামজা বিরক্ত হয়ে গেছে। হামজার বিরক্তি মানে আস্তে করে খালাস করে দেয়া। কখন জানি মেরে-টেরে ফেলে। কিন্তু হুট করে মেরে ফেললে স্বীকারক্তি কে দেবে?
হামজা জিজ্ঞেস করে, “তুমি হেফাজতে ইসলামীর সমর্থক, মুরসালীন?
-“আমি কিছুতেই খাঁটি নই, ভাই। আমি শুধু আপনাদের সমর্থক নই। আর এটা খাঁটি।ʼʼ
হামজা হাসল, “২০১৩ এর সেই রাজধানীর আন্দোলনে ছিলে না তুমি?ʼʼ
-“আমি ছিলাম না, মুস্তাকিন ভাই ছিল। জানেন তো, মুস্তাকিন ভাই হাফেজে কোরআন, আর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। আমি তো বেদুইন। আমি ওসব আন্দোলনে থাকব কেন?ʼʼ
-“আজ যা করছো, সেটা কী?ʼʼ
-“ওহ! এই বাচ্চাদের জন্য? কী করছি?ʼʼ
-“অনেককিছুই তো করছো।ʼʼ ক্লান্ত স্বরে বলল হামজা।
-“করলেও সেটা ওরা কওমী মাদ্রাসার ছাত্র অথবা জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত বলে নয়। ওদের জায়গায় যেকোনো বাচ্চারা থাকলেও আমার ব্যবহারে পরিবর্তন হতো না। তাছাড়া ওরা কোনো দলের সাথে সংযুক্ত নয়, অন্তত এই বয়সে। কেউ সাবালক নয় এখানকার। আপনারা জুলুম করছেন।ʼʼ
-“কী করছি?ʼʼ
মুরসালীন চুপ রইল। বাপ্পী মুখ খুলল, “জুলুম এখনও করিনি, মুরসালীন। করব। বিরোধী দলের একটিভ নেতাকর্মী তুমি।ʼʼ
-“তাতে কী? রাজনীতিতে কি বিরোধী দল থাকবে না? নাকি আপনারা একচ্ছত্র অধিপতিত্ব চান?ʼʼ
-“না, তা চাই না।ʼʼ
-“তাহলে তো হলোই।ʼʼ
-“তোমরা জঙ্গিবাদদের সাথে হাত মিলাইছো।ʼʼ
-“সে তো আপনারাও কত দলের সাথে মহাজোট করে ক্ষমতায় এসেছেন। আর এবার নির্বাচন ছাড়াই। এটাকে কীভাবে দেখেন?ʼʼ
বাপ্পীর মুখ লাল হয়ে উঠল। কষে এক ঘুষি মারল মুরসালীনের মুখে। ফাঁটা ঠোঁটে শুকনো ক্ষত তাজা হয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। মুরসালীন আলতো হাসে, সত্যি কথা নিতে পারেন না, এটা আপনাদের দলের সবচেয়ে বড় সংক্রামক ব্যাধি। সত্যি কথা কইতে গেলেই কারাবাস, খু/ন, গুম, মিথ্যা মামলায় ক্ষমতাচ্যুতি! খারাপই লাগে আপনাদের অবস্থা দেখলে।ʼʼ
আর কে ঠেকায়। বৃষ্টির মতো মার পড়ল মুরসালীনের গালে। তখন মুরসালীনের হাত-পা বাঁধা। রক্তাক্ত হয়ে উঠল গোটা মুখটা। দাঁত নড়ে গিয়ে মাড়ি থেকে রক্ত পড়ছে। হামজা থামালো, “পাগলামি করিস না, বাপ্পী। কিছুই হবেনা এতে। বড়জোর জ্ঞান হারাবে, সময় নষ্ট হবে। কথা বলতে থাক।ʼʼ
বাপ্পী বকে উঠল, “খানকি মাগীর চেংরা। তোরা মারোস নাই আমাগোরে? আমাদের ছেলেরা তোদের হাতে জখম হয়, খুন হয়। শুয়োরের বাচ্চা! সেসব হিসেব রাখোনা, মাগীর পুত।ʼʼ
মুরসালীন রক্তাক্ত মুখে চমৎকার হাসে। দেখতে অদ্ভুত লাগে। বলে, “এক পীর আর তার মুরীদ একবার ডালিম খাচ্ছিল। দেখা গেল, মুরীদের সামনে ডালিমের অনেক বীজ জড়ো হয়েছে। পীর ঠাট্টা করে বলল, ‘ওহে, বৎস। এত ক্ষুধা তোমার? এতটা ডালিম খেয়েছ?ʼ
মুরীদ তাকিয়ে দেখল, তার পীরের সামনে কোনো বীজ পড়ে নেই। মুরীদ হেসে বলল, ‘হুজুর, আমি ডালিম খেয়ে তাও বীজ রেখেছি। আপনি তো বীজও ফেলেননি যে, গুণে দেখা যাবে, কতটা ডালিম খেলেন। ক্ষুধা কি হুজুর আমার বেশি?ʼʼ
মুরসালীন হাসল, “আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা? আমাদের ছেলেরা যখন অত্যাচারিত হয়ে মরে আপনাদের হাতে, তখন ওদের মরদেহর হদিশটুকুও পাওয়া যায়না যে গুণে দেখব, কতগুলো মরল। অথবা তা দেখিয়ে আইনের কাছে বিচার চাইব বা মানুষের কাছে সিমপ্যাথি। কিন্তু আমরা মারলে তার একেকটা খামছিও দেশবাসীকে দেখিয়ে সমর্থন কামাচ্ছেন…ʼʼ কথা শেষ না করে হাসল মুরসালীন।
চলবে…
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।