#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬৫.
কবীরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সন্দেহভাজন হিসেবে। গোটা জিজ্ঞাসাবাদের সবটাই ছিল—জয় ও হামজার গতিবিধির ব্যাপারে।
অফিসার বললেন, “যেদিন পলাশকে ধরতে যাওয়া হয়েছিল, সেদিন জয় ও হামজা কোথায় ছিল?ʼʼ
কবীর জানে না এখন কেমন মিথ্যা বলা উচিত। কোথায় ছিল বললে জয়ের ক্ষতি হবে না! সে বলল, “স্যার, আমি ওই কয়টা দিন খুব অসুস্থ ছিলাম। জ্বর, সর্দি, কাশি। ক্লাবে যাইনি, যোগাযোগ ছিল না ভাইদের সাথে।ʼʼ
অফিসার মাথা নাড়লেন, “খুবই অবিশ্বাস্য গল্প। আচ্ছা, জয় ও হামজার সাথে পলাশ আজগরের সম্পর্ক আসলে কেমন ছিল?ʼʼ
-“খুব ভালো, স্যার। খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।ʼʼ
-“এজন্যই পলাশের কুকর্মের হদিশ জয়ের গোপন মারফতে এসবি ডিপার্টমেন্ট পেয়েছে? তোরা কী ভাবিস? আমরা কিছুই জানি না? পলাশদের মতো অপরাধীদের ছেঁদ ওদের আপন কেউ-ই করতে পারে কেবল।ʼʼ
পানিভর্তি গামলায় কবীরের মুখ চুবিয়ে ধরে রাখা হলো। নাকে মুখে পানি উঠে চোখমুখ উল্টে এলো কবীরের। টর্চারের এক পর্যায়ে কান দিয়ে রক্ত উঠে এলো।
জ্ঞান হারাবার আগ দিয়ে পানি থেকে টেনে তুলে ফের সেই প্রশ্ন, “কী জানিস, বল! সব জানিস তুই, শালা। তুই খুব ক্লোজ লোক ওদের।ʼʼ
কবীর কথা বলে না। সে অত চতুর নয়। তার ভয় হয়, মুখ খুললে ভুলভাল বেরিয়ে যেতে পারে। চুপচাপ থাকতে হবে। কিচ্ছু বলা যাবে না। হামজা, জয়ের সাথে গাদ্দারি সে করতেই পারবে না।
কবীরের বাবা হামজার ট্রাক ড্রাইভার ছিল। দুর্ঘটনায় চিরতরে পঙ্গু। তবু হামজা এখনও মাসে মাসে বেতন দেয়। চারটা বোন কবীরের। তিনটার বিয়ে পরপর হামজা নিজে দায়িত্ব নিয়ে দিয়েছে। জয়কে কবীর ‘ভাইʼ মানে। সে ঠিক করে নিয়েছে–মরে গেলেও বলবে না ব্যাপারটা।
কবীরকে চামড়ার বেল্ট দিয়ে পেটানো হলো। পিঠের চামড়াগুলো বেল্টের সাথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে উঠে পড়ছিল। কবীর বলল না কিছুই। তার মুখে কথা আসছে না। সে বলতে পারছে না–জয় পলাশকে কীভাবে মেরেছে। তার চোখের সামনে তরুর লা-শ ভেসে উঠছে। জয়ের রসিক মুখখানা হাসছে। সাদা লুঙ্গি উঁচিয়ে হেঁটে এসে জয় কবীরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, “তুমি কি শালা হাফ লেডিস হে? এইটুকু আঘাতে কেউ এরম কাত হয়ে পড়ে? এনার্জি ড্রিংক এনে দেব? দুই চুমুক দিবি?ʼʼ
—
রূপকথাকে ওপর নরক নামলো কারাগারে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে বিভিন্ন মানসিক ও যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছিল। তাকে যে সকল নারী কয়েদীর মাঝে রাখা হয়েছিল, তারা আবার জঙলি পুরুষের চেয়েও বেশি ভয়ানক।
রূপকথা দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। এই দুনিয়ায় তার নিজস্ব কেউ নেই। পরাগ আছে, কিন্তু পরাগের সাথে এক প্রকার সৎ-ভাইগত বিরোধও ছিল, সেটা খুনশুটির মতোই লাগে এখন। রূপকথা জানে, পরাগ রূপকথাকে বোনের চেয়ে কম ভালোবাসেনি। তবে সেই ব্যাপারটা জটিল।
রূপকথার আজ কয়দিন পরাগকে দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ওর ক্ষতগুলি দেখতে। নিশ্চয়ই ওকে খুব মেরেছে! ওর অপরাধ অনেক, আর ভয়ানক! পলাশের জোরে বেঁচে ছিল এতদিন। এবার কি পরাগের ফাঁসি না হয়ে যায় আর?
পলাশের কথা মনে পড়ে রূপকথার। কখনও কখনও রূপকথার ওই লোককে ভালোবাসতে ইচ্ছে করতো। স্বামী তো! পলাশ স্যাডিস্ট ছিল। পাগলামির সময় বাদে বাকিসময় খুব ভালো থাকতো। ঠিক চাচাতো ভাই পলাশের মতো। বাপের ওপর রূপকথার একসময় খুব ভালোবাসা ছিল, সেটা বিয়ের পর লজ্জা ও আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। রাজন আজগরকে সে প্রচণ্ড ভয় পেত তারপর। পলাশের চেয়েও বেশি।
যতদিন না সে পলাশের নিখোঁজ হবার ব্যাখ্যা দেবে, তাকে ছাড়া হবে না। এমনকি তার পরেও না বোধহয়। এই কাহিনি তো বহুদূর বিস্তৃত। তা গোটাটা আইন জানলে এই গল্পের প্রতিটা চরিত্রের জন্য শাস্তি বরাদ্দ।
রূপকথার মৃত্যুতে আগ্রহ বাড়ছে দিনদিন। শরীরের ব্যথাকে সে বহু আগে জয় করেছে। আর বর্তমান মানসিক যন্ত্রণা তাকে শুধু মরতে পরামর্শ দেয়।
দুইদিন রূপকথা কিছু খায়নি। শেষবার সাত-আটঘন্টা আগে এক গ্লাস পানি খেয়েছিল। পিপাসা পাচ্ছে। কিন্তু রূপকথার বুকে ও গলায় প্রচণ্ড ব্যথা। পানি গিলতে আজাব হয়। হাতের ক্ষততে পঁচনের মতো ধরেছে। শুকছে না, স্থানটা গলছে। তার ওপরও আবার মারা হয়েছে। সেসব শরীরের যন্ত্রণা বিশেষ কিছু মনে হয়নি রূপকথার। পলাশ তাকে এসব জয় করতে শিখিয়েছে গেছে সেই কবে!
—
পলাশের মাথা দাফন করার পর জয় আর অন্তূ প্রায় শেষরাত অবধি গোরস্থানের প্রাচীরের পাড়ে বড়পুকুরের ধারে বসে ছিল।
কবীর কিছু পয়সা দিয়ে খাদেমকে খুশি করে একটা ইটের গাদার ওপর বসল।
অন্তূ বসে রইল চুপচাপ। তার ভেতরের প্রশ্নরা বড্ড উতলা! জয়ের শরীরে ও লুঙ্গিতে তখন মাটি ভরা। কবীরের কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিলো। তাতে আগুন ধরিয়ে পাঁজা পাঁজা ধোঁয়া গিলতে লাগল।
-“আপনি খুব অস্থির!
সিগারেট ঠোঁটে গুজে অস্পষ্টভাবে বলল, “তাই নাকি?ʼʼ
-“অস্থির না হলে সচরাচর আপনাকে সিগারেট টানতে দেখা যায় না।ʼʼ
-“বাপরে! আপনি খুব জানেন আমায়?ʼʼ
-“আপনি নিজেও জানেন না নিজেকে। আমিও না।ʼʼ
-“জেনে কী হবে? পুরষ্কার পাব?ʼʼ
-“দায়সারা জবাব দেবেন না। বিরক্ত লাগে।ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে উঠল, “দায়সারা লাগছে?ʼʼ
অন্তূ আচমকা সিগারেটটা জয়ের ঠোঁট থেকে কেঁড়ে নিয়ে ফেলে দিলো পুকুরের ঢালে। বাতাসের ঝাপটায় নাকেমুখে ধোঁয়া ঢুকছিল।
জয় কেমন করে যেন হাসল, “ভয় লাগেনা আমারে? এত বিরোধিতা ক্যান আমার সাথে তোমার?ʼʼ
-“আপনি শুরুটা করেছেন। স্মৃতিশক্তি দূর্বল হয়ে পড়েনি তো!ʼʼ
নাটকীয় স্বরে বলল “আ? আমি? অপবাদ দিচ্ছ, ঘরওয়ালী! প্রথমদিন আমার সঙ্গে কে বিরোধিতা শুরু করেছে?
-“কে করেছে?ʼʼ
-“আমি জয় আমির। এণ্ড আই ক্যান ডু এনিথিং দ্য ফাক আই ওয়ান্ট! এইটুকু এখতেয়ার অর্জন করেছি আমি। তাই বলে তুমি ওইরকম ভাব দেখাবে?ʼʼ
-“ছিঃ! কী যে মারাত্মক পাপ ছিল ওটা। ভাবলে লজ্জাই লাগে এখন। আপনি কোথায় জয় আমির, আর আমি হলাম এক জলে ভাসা পানা। মাফ করেছেন তো আমাকে সেইসব অপরাধের জন্য? নাকি এখনও বাঁধিয়ে রেখেছেন? এখন ক্ষমা চাইব? পা দুটো দেখি আপনার, এগিয়ে দিন তো!ʼʼ
-“উফহহ!আবার শুরু করলে সেই বাদ-প্রতিবাদ!ʼʼ
-“খারাপ লাগছে?ʼʼ
-“না। ভালোই লাগছে।ʼʼ
অন্তূ করল কী! আস্তে কোরে জয়ের কাঁধে মাথা ঠেকালো। জয়ের মেরুদণ্ড শক্ত হয়ে আসে। বুকের ভেতর কেমন যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল। দাঁতে দাঁত আঁটকায়। খানিক ধাতস্ত হয়ে বলে, “দুশমনের কাধে মাথা রাখছো! ঘেন্না লাগছে না?ʼʼ
-“এতগুলো দিন ঘর করার পরেও সেই সেন্সিটিভিটি থাকতে আছে?ʼʼ
জয় একটু মুখ নামিয়ে ফিসিফিস করে অদ্ভুত গলায় বলে, “যার জন্য সীমাহীন ঘৃণা পুষছো ভেতরে, তার কাধে মাথা রেখে তাকে ধ্বংসের পরিকল্পনা-ছক কষছো। তোমরা এই ছলনায় খুব দক্ষ, না!ʼʼ
-“হলে কী? তা তো আর আপনার গায়ে লাগবে না!ʼʼ
-“ছলনা মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। খুব ভয়াবহ ব্যাপার-স্যাপার এটা।ʼʼ
-“আপনার সঙ্গে ছলনা করার কিছু নেই। আপনি সব জানা-বোঝা অবুঝ।ʼʼ
-“ছলনা বুঝি না।ʼʼ
-“সব বোঝেন আপনি।ʼʼ অন্তূ গাঢ় শ্বাসের সাথে কথাটা বলে।
আলতো করে মাথাটা ঠেকানো জয়ের কাধে। বুকের ভেতর পুড়ছে। ঘাঁড় ফেরালেই আব্বুর কবরটা চোখে পড়বে। আব্বু তাকে সেদিন বলেছিল– ‘আমি তোকে মৃত্যুর চেয়েও নিকৃষ্ট মৃত্যু দিচ্ছি, অন্তূ।ʼ ‘লোকেরা বলছে, ব্যবসা যারা করে, তারা বিয়ে করতে চায় না।ʼ
অন্তূ বিয়ে করে নিয়েছে। জয় আমিরকে বিয়ে করে নিয়েছে। চোখ বুজে জয়ের কাঁধের ওপর মাথাটা আরও শক্ত করে চেপে রাখে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে–লোকেরা অন্তূর ওড়নাটা খুলে ফেলল বুকের ওপর থেকে। সেদিন কেউ ছিল না অন্তূর সম্ভ্রম রক্ষা করার! তবে নষ্ট করার মূলে ছিল সেই পুরুষটি, যার নামের পরিচয়ে অন্তূকে বাঁচতে হচ্ছে।
একদলা থুতু এসে জড়ো হয়েছিল অন্তূর মুখের ওপর। সেদিনের সেই লোক সমাগম, সেই সকল ধিক্কারবাণী…অন্তূকে নিয়ে আজও ভার্সিটিতে কত রটনা! মাথায় জড়ানো গামছাটাও সেদিন ছিল না মাথায়। জয় তখন কী করছিল? চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। চোখে তৃপ্তি, মুখে বিরক্তি।
অন্তূর শ্বাস উঠল। এইসব ভাবলে কঠোর অন্তূটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়!
জয়ের কাধে গরম নিঃশ্বাস পড়ছিল। বাহুর স্নায়ুতে অন্তূর বুকের তোলপাড় অনুভূত হচ্ছিল। জয় হাসল, “ঘরওয়ালি! এবার মনে হচ্ছে আপনি খুব অস্থির। একটা সিগারেট দেব? ওয়ান্না ট্রাই এ লিটল?ʼʼ
অন্তূ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “পলাশকে মারলেন কেন?ʼʼ
-“তরুর কাছে ওয়াদা করেছিলাম।ʼʼ
-“আপনি তো দায়বদ্ধ না কারও কাছে! তার ওপর আপনি যখন ওয়াদা করেছেন, তরু তখন জীবিত ছিল না। এক মৃতদেহের কানে কানে করা ওয়াদার খাতিরে জয় আমির এত ঝুঁকি ওঠাতে পারে?ʼʼ
-“সেক্ষেত্রে তুমি কী ভাবতেছ?ʼʼ
অন্তূ মাথা তুলে সোজা হলো, “কাঙাল আপনি। স্নেহের কাঙাল, মায়ার কাঙাল। কারও মায়ার দায়বদ্ধ আপনাকেও কয়েদ করে ফেলতে পারে।ʼʼ
জয় হাসে, “এত ভুল ধারণা পুষো না আমার ব্যাপারে। আমার জীবনে, সমস্যা, ব্যথা, কষ্ট, আবেগ, অনুভূতি—ছাড়া সব আছে। তুমি জানো না আমায়।ʼʼ
-“জানতে চাই।
-“দরকার কী?ʼʼ
-“জানি না। আর এমনও না যে আমি আপনাকে একটুও জানিনা।ʼʼ
-“তাহলে তো হলোই! জানোই তো!ʼʼ
-“আপনি আপনার অতীতকে ভয় পান?ʼʼ
-“আমার কোনো অতীত বা ভবিষ্যত নেই। আছে একটা বর্তমান। যতক্ষণ শ্বাস চলবে, প্রতিটা চলমান মুহুর্তের বর্তমানকে মানি আমি শুধু। আমি তোমাকে আগেও বলেছি, আমি খারাপ, তাই আমি খারাপ, কারণ আমি খারাপ। এর আর বিকল্প আর যুক্তি বা ব্যাখ্যা নেই।ʼʼ
-“আপনি মুস্তাকিন মহানকে মেরেছেন কেন?ʼʼ
-“ইচ্ছে।ʼʼ
-“আপনার সম্পর্কে কোনো কথা বলতে আগ্রহী নন আপনি। তো এটাই তো আসে হিসেবে, আপনি নিজেকে লুকোতে চান।ʼʼ
জয় অন্তূর কানের কাছে মুখ নিয়েছিস ফিসিফিস করে বলল, “ফিল্মি ডায়ালোগ মারছো, ঘরওয়ালি! কী লুকাতে চাই? মানে আমাকে আবার সেইসব হিরোর মতো ভাবতে চাইতেছ না তো–যারা নিজেদের ভালোকে লুকিয়ে রেখে খারাপটা দেখায়, কিন্তু আসলে তারা ভালো। এমনটা ভাবছো?ʼʼ
-“প্রশ্নই ওঠে না।ʼʼ
-“উঠিও না কখনও। জয় আমির আগাগোড়া নষ্ট। তুমি কী যেন বলো না! হ্যাঁ, পাপীষ্ঠ। যদিও পাপ শব্দটাকে বুঝি না আমি।ʼʼ
-“অতীতটা খুব দূর্বল ছিল আপনার?ʼʼ
-“তার মানে এখন আমি খুব শক্তিশালী?ʼʼ
-“এত হেঁয়ালি করেন কেন? মানুষ জানে না, আপনি কতটা রহস্য করে কথার মারপ্যাচ খাটাতে পারেন।ʼʼ
জয় হাসল, “সহজ ভাষায় কথা বলছি আমি। বলো, কী জানতে চাও?ʼʼ
-“আপনি মাজহার, পলাশ, ঝন্টু সাহেব এদের কেন মেরেছেন? যেখানে আপনি নিজেও একই গাছের ফল! ওদের মারতে আপনার এত আয়োজন! পাপীর হাতে কেন পাপীরা মরবে? তা যদি হয়-ই! তবে আপনি আপনাকে কেন মারেন না?ʼʼ
জয় হাসল, “আত্মহত্যা মহাপাপ।ʼʼ
অন্তূ হেসে উঠল, “পাপ? ইশ, মহাপাপ? আপনি বলছেন?ʼʼ
জয় নিজেও হেসে ফেলল গা দুলিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি মেরে দাও। কেউ একজন বলেছিল, বউয়ের হাতে মরলে নেকি হয়। কোন সম্বন্ধির ছাওয়াল বলেছিল, কে জানে!ʼʼ
-“আমার হাতে মরার খুব শখ? আজকাল কেমন নিজেকে সঁপে দেন। ব্যাপারটা যায় না আপনার সঙ্গে?ʼʼ
-“যায় না?ʼʼ জয় হাসল, “কী যায় আমার সঙ্গে? তুমি কি আমায় অবজার্ভেশনে রেখেছ নাকি? প্রেমে-টেমে পড়ে যাওনি তো?ʼʼ
অন্তূ হাসল, “অবজার্ভেশন! হ্যাঁ, অবজার্ভেশন। আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি।ʼʼ
-“তোমার মতে তোমার সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছি আমি। তো তার শাস্তি হিসেবে মেরে দাও, নাকি আরও কঠিন প্লান-প্রোগ্রাম আছে? তাও যদি তৃপ্তি পাও।ʼʼ
-“আমার মতে? অর্থাৎ আপনার মতে আপনি কোনো অন্যায় করেননি আমার সঙ্গে?ʼʼ
-“না।ʼʼ
দুজন কেউ কারও দিকে তাকায় না। এটা জয় ও অন্তূর পারস্পারিক নিজস্বতা। কিন্তু অন্তূ তাকাল এবার, “কোনো অন্যায় করেননি?ʼʼ
অকপটে বলল জয়, “না।ʼʼ
-“মারলেও তবে আমি সেদিনের অপেক্ষা করব, যেদিন আপনার মনে হবে আপনি আমার সঙ্গে অন্যায় করেছেন।ʼʼ
-“তাহলে আর তোমার হাতে মরার সাধ মিটলো না এ জনমে।ʼʼ
-“অনুশোচনাকে ভয় পান?ʼʼ
-“আজ আমার ভয়ের তালিকা তৈরি করতে বসেছ নাকি? কী কী বিষয়ে ভয় আমার?ʼʼ
-“তালিকা প্রস্তুত।ʼʼ
-“সর্বনাশ। শুনি দেখি, তালিকায় কী কী বিষয় অন্তর্ভূক্ত করলে!ʼʼ
—
হামজা যখন ভার্সিটির ছাত্রনেতা হয়ে উঠছিল, সালটা ২০০২। জয় কেবল তখন দশম শ্রেণীতে, বয়স কমবেশি পনেরো। তখন সে জীবনের প্রথম খু-ন হিসেবে সৈয়দ মুরসালীন মহানের বাবা সৈয়দ ফরহাদ মুহাম্মাদ বারী সাহেবকে খু/ন করল। বিরোধী দলের রাজত্ব চলছে তখন বাংলাদেশে।
পুলিশ ফেরত হবার পর জয়কে তারপর প্রায় তিন সপ্তাহের বেশি সময় পাওয়া গেল না। একটা কবরের মতো অন্ধকার বেসমেন্টে সপ্তাহখানেক আঁটকে রাখা হলো। এক গ্লাস করে পানি পেত সে চব্বিশ ঘন্টায় একবার, সাথে দুটো ছোট্ট ছোট বিস্কুট।
আলোহীন কুঠুরি। জয় কখনোই সেই ঘরের বর্ণনা দিতে পারবে না। সে ঘরটাকে দেখেনি। শুধু জানে কোনো এক খসখসে মেঝেতে তাকে বসে থাকতে হতো। চোখের সামনে কবরখানার মতো নিকষ কালো অন্ধকার। জয় চোখ বুজে থাকতো। চোখের সামনে একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি অতি আলো অথবা অতি অন্ধকার মানব মস্তিষ্ক সইতে পারে না। জয় বুঝতে পারছিল, সে পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু চোখ বুজলেও সেই অন্ধকারই! মস্তিষ্কে কত রকমের বিভ্রম তৈরি হয়। কতকিছু যে দেখে জয়, অনুভব করে নিস্তব্ধ আঁধারি আশাপাশটা!
চারদিকে কোথাও আওয়াজ নেই। জন-মানবের শ্বাসের শব্দটুকুও নেই। নিজের বুকের শ্লথ হৃদস্পন্দন আর গাঢ় শ্বাসের আওয়াজ অদ্ভুত শোনায় কানে।
কেউ ছিল না তার কাছে তখন। কিন্তু কেবল মৃত্যুর সঙ্গ পেয়েছে বারবার সে এসব সময় গুলোতে। মৃত্যু এসে বসে জয়ের সম্মুখে। গল্প করে জয়ের সঙ্গে। মৃত্যুর সঙ্গে যেতে চায় জয়, অনুরোধও করে। কিন্তু মৃত্যু বলে, ‘এত দ্রুত নয়। অপেক্ষা করতে হবে।ʼ
জয় অপেক্ষাকে ঘৃণা করে। সে মৃত্যুর প্রেমে পড়েছে খুব ছোটবেলায়। গভীর প্রেম। কিন্তু মৃত্যু বরাবর শেষ পর্যায়ে প্রত্যাখ্যান করেছে জয়কে। প্রতারণা করেছে জয়ের সাথে। ছোটবেলা থেকে করে আসছে। বারবার আসে, বহুদিন জয়ের সঙ্গে সময় কাটায়, জয়ের ভেতরে নিজের জন্য মায়া তৈরি করে। কিন্তু আলিঙ্গন করে না!
মানসিক অবস্থা যখন উলোট-পালোট হবার দিকে, সে-সময় দরজা খোলা হলো। লেপ-তোষক সেলাই করার সুঁচ, যাকে বাঁশসুঁই বলা হয়। জয়ের শরীরে গাঁথা হতো তা। কখনও এবরো-থেবরো ইটের টুকরো দিয়ে পেটানো হতো। শরীরের মাংসপেশী ছিঁড়ে আসতো। কিশোর বয়সের ছিপছিপে লম্বা শরীরটায় গভীর সহ্যক্ষমতা জন্মে যাচ্ছিল জয়ের।
অতিরিক্ত ড্রাগ দেবার ফলে নাক-মুখ দিয়ে গবগবিয়ে রক্ত আসতো। প্রায় মাসখানেক অবিরাম ড্রাগ সেবন করানোর ফলে জয় আসক্ত হলো। দিনদিন ক্রমাগত কড়া হতো ড্রাগের ডোজ। অসীম যন্ত্রণায় জর্জরিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জয় মৃত্যুকে খুব ডেকেছে। মৃত্যু আসে, দূর থেকে চেয়ে দেখে জয়কে। কিন্তু বরাবরের মতো ছলনা করে চলে যায়।
জয়ের মাঝেমধ্যেই নিজেকে নির্লজ্জ মনে হয়েছে। মৃত্যু তার প্রেমকে এত্ত অবহেলা করেছে, এত ছলচাতুরি করেছে। তবু জয় বিমুখ হতে পারে না। তার প্রেম ফুরোয় না মৃত্যুর ওপর থেকে।
হামজা পাগলের মতো চারদিকে ঘুরেছে। দেশে কড়াকড়ি আইন চলছিল তখন। চারদিকে অপরাধী গ্রেফতার, আর দণ্ডের দিন চলছিল। হামজা প্রতিকূল এক পরিবেশে, তখনকার বিরোধী দলের পক্ষে খোলাখুলি দলীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা কর্মী। কারণ তার বিশ্বাস ছিল—সামনে দিন বদলাবে। নতুন এক শাসনব্যবস্থা আসবে বাংলাদেশের সংসদে।
একদিন পুলিশ এলো হামজার কাছে জয়ের খোঁজে। সৈয়দ মুজাহার মহানকে হ-ত্যার দায়ে প্রথম সাসপেক্ট জয় আমির। হামজাকে গ্রেফতার করা হলো জয়ের নিখোঁজ হবার সতেরো দিনের দিন।
প্রসাশনের দৃঢ় বিশ্বাস, সে জয়কে লুকিয়ে রেখেছে। হামজা বলল, “স্যার, আমি নিজেই ওকে খুঁজে হয়রান। আপনারা যেভাবে জয়কে সন্দেহ করছেন মুজাহার সাহেবের মৃত্যুর জন্য, মুজাহার সাহেবের দলীয় কর্মীরাও তাই করছে, স্যার। ওরা জয়কে গুম করেছে। আপনারা ওকে খুঁজতে সাহায্য করুন আমায়।ʼʼ
হামজার সুচতুর কথাবার্তায় প্রসাশন কর্মকর্তারা ভিজলেন না। বললেন, “তাহলে আগে কেন রিপোর্ট করোনি? বেশি শেয়ানা ভাবো নিজেকে? যদি এটাই মনে হতো, তো আগে নিখোঁজ ডায়েরী করতে। নিজে লুকিয়ে রেখে তো আর ডায়েরী করা যায় না!ʼʼ
হামজা ওদের কোনোভাবেই বিশ্বাস করাতে পারেনি, সে জানে না জয় কোথায়! আবার এটাও ঠিক, জানলেও বলতো না, প্রশ্নই ওঠে না। আর এটাও ঠিক–জয় খু-নটা করেছে। কিশোর অপরাধ। জয় তখন ধরা পড়লে তৎক্ষণাৎ ফাঁসি হতো না হয়ত। কিন্তু আইনের হেফাজতে থাকবে সাবালক হওয়া অবধি, এরপর দণ্ড। অথচ হামজার চিন্তা জয়ের ক্যারিয়ার নিয়ে। সামনে ওর এসএসসি পরীক্ষা।
হামজা বুঝতে পেরেছিল, খুব শীঘ্রই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে। এই সরকারের পতন ঘটবে। এরপর দিন আসছে সামনে বোধহয় তাদের।
হামজারকে কারেন্টের শক দেয়া হলো। একেকবারে শরীরটা রিকেটস রোগীর মতো বেঁকে উঠছিল। শরীর থেকে যেন একেকবারে এক লিটার করে রক্ত শুষে নিচ্ছিল বিদ্যুৎ। অবশ হয়ে উঠল স্নায়ুকোষগুলো, থরথর করে কাঁপছিল শরীরটা। ঠোঁটের কোণ ও নাক দিয়ে র-ক্ত বেরিয়ে এলো।
তবু হামজা বোবা। তাগড়া-দূর্বল দেহখানা চেয়ারের পিঠে ঠেকিয়ে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে রইল। শ্বাস পড়ে না ঠিকমতো, দুই হাঁটু ঠকঠক করে কাঁপছে। শরীরের প্রতিটা রগ ঝিনঝিন করছিল। হামজার মুখ থেকে ব্যথার পেক্ষিতে আর্তনাদও বের হচ্ছিল না। জয়ের নামটাও মুখে আনলো না।
এরপর হামজার হাতের আঙুলের উপরিভাগ কেটে ফেলা হলো। অল্প একটু চামড়ার সঙ্গে বেঁধে রইল আঙুলের অংশটুকু। তখনও হামজা নিশ্চুপ। ওকে জিজ্ঞেস করা হলো, “শেষবার জিজ্ঞেস করছি, বল তোর জয় কোথায়?ʼʼ
হামজা হাসল, “শেষবার নয়। আবার জিজ্ঞেস করবেন। এবং প্রতিবার আমার উত্তর থাকবে—আমি জানি না জয় কোথায়! শুধু জানি, মানে পাক্কা আন্দাজ করতে পারি জয়কে কারা ধরেছে। আমার ধারণা জয়কে তারা মারবে না। মারলে গোটা দলটাকে আগুন লাগিয়ে দেব। আর না মারলে এই দুনিয়ার যেকোন প্রান্ত থেকে আমি হামজা একা জয়কে খুঁজে বের করে আনব। আপনাদের সাহায্যের আর দরকার নেই আমার।ʼʼ
হামজার হাতের আঙুল সেলাই করা হলো। দাগটা পরবর্তীতে মেলেনি আর।
জয়কে উদ্ধার করলেন বাপ্পী মণ্ডলের চাচা গিয়াস মণ্ডল। দলের সেই সংকটের সময়ও উনি উল্লেখযোগ্য এক বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী। জয় ও হামজার মতো দুটো বারুদকে দলে পেলে দলের ভর বাড়ে। এভাবেই দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি করতে হচ্ছিল তখন। ছাত্রলীগ ও সন্ত্রাস এবং যে সকল অসাধু রাজনীতিবিদেরা অপারেশন ক্লিনহার্টে ধরা পড়েছিল, তারা এমনিতেই দল ছেড়ে এই দলের প্রতি ঝুঁকছিল। এবং বাপ্পী মণ্ডলেরাও তাদের সাদরে গ্রহণ করছিলেন।
জয়কে ছাড়িয়ে আনারও প্রায় তেরোদিন পর্যন্ত হামজা আইনের হেফাজতে রইল। সে তখন উঠতি ছাত্রনেতা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের কমতি নেই। বড় বড় নেতাকর্মীদের সুনজর হামজার ওপর তীব্র। রাজধানী থেকে রোজ ডাক আসছে।
জয় ড্রাগের নেশায় পাগল তখন। তার বুক-পিঠের ক্ষতগুলো গর্তের রূপ নিয়েছে। হিতাহিত জ্ঞান অনেকটাই লোপ পেয়েছে। দরজা-জানালা খুলতে দিতো না রুমের। দিনের বেলা বাইরে যেত না। আলো সহ্য করা দায়। তার জন্য ড্রাগ জোগাড় করাটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। হামজা থামাতে পারতো না জয়কে।
তরু নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে জয়ের সেবা করেছে। সেই দিনগুলোতে স্কুলে অবধি যেত না মেয়েটা।
শরীরের ব্যথানাশক হিসেবেও কড়া সব ড্রাগের ব্যবহার করতে হয়েছে জয়ের শরীরে। জয়কে ঘরে আঁটকে রেখে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করা হলো। জয় ২০০২-এর এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। সে-বছর পরীক্ষাও দেয়া হলো না। ইয়ার-লস।
মানসিক ও শারীরিক অবস্থা একেবারে বিগড়ানো। সে র-ক্ত ও মৃত্যুর প্রেমে খুবই ছোটবেলায় পড়লেও প্রত্যক্ষভাবে নিজের হাতে প্রথম খুনটা সেবারই করেছিল।
পলাশের হোটেলে তার নিয়মিত যাতায়াত শুরু হলো। পলাশের সঙ্গ তাকে অনেকটা চাঙ্গা করে তুলল। পলাশ জয়কে প্রচুর সঙ্গ দিয়েছে। পলাশের কত নারকীয় অপরাধের সাক্ষী জয়! অদ্ভুত এক সম্পর্ক তৈরি হলো ওদের। মদ, গাঁজাসহ বিভিন্ন ড্রাগ ও নারীনেশায় লেলিয়ে দিলো হামজা।
কলেজে ভর্তি হবার পর পড়ালেখার সাথে সমান্তরাল হারে দুই ভাইয়ের আগ্রাসী যাত্রা শুরু হলো। হামজার তখন অনার্স শেষের দিকে। সে ধীরে ধীরে ছাত্র সংগঠনের কর্ণধার হয়ে উঠেছে। সমাজে পরিচিতি বাড়ছিল, সাথে বদনাম ও পুলিশের খাতায় অপরাধ-অভিযোগও!
জয় জীবনে স্বীকার করে না সে কখনও পুলিশের হেফাজতে গেছে।
হামজা দিন যেতেই আরও গভীর পথিক হয়ে উঠছিল। তার নজর, চাহিদা ও গন্তব্যের বহর বাড়ছিল। অপরাধের সীমাবদ্ধতার সুঁতো ছিঁড়ে-ফেঁড়ে অসীম হয়ে যাচ্ছিল।
রাজধানীতে বড় বড় নেতাকর্মীদের সঙ্গে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠল। বিশাল বিশাল পরিকল্পনার সঙ্গী হতে থাকল হামজা।
চলবে..
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। এখন থেকে নিয়মিত হবার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমার। আপনারাও দোয়া করবেন। যেন হতে পারি।]