#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬৭. (প্রথমাংশ)
রাত দুটো। বৃষ্টি হালকা কমেছে বাইরে। হামজা শুয়ে ছিল। তার অভ্যাস এক কাত হয়ে মাথার নিচে হাতের তালু রেখে ঘুমানো। সাদা চশমাটা বালিশের পাশে পড়ে আছে। চশমা সে সবসময় ব্যবহার করে না, কেবল বই পড়ার সময়।
পরনে একটা অফ-হোয়াইট রঙা ফতোয়া। সাদা পাজামাটা উঠে আছে ঠ্যাংয়ের কাছে। কালো কুচকুচে পশমের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল রিমি। হাতে ছাদ থেকে তুলে আনা শুকনো কাপড়চোপড়। রিমি আগে একা অন্ধকার ড্রয়িং রুমে যেতেও ভয় পেত। এখন লাগে না। আরমিণ পারতো, এখন সেও পারে।
রিমি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে। তার কিচ্ছু ভালো লাগেনা আজকাল। সে কত খুশি ছিল সংসার জীবনে। ছোট্ট বয়সে কলেজের পড়ালেখা অবধি ছেড়েছিল এই লোকটার খাতিরে। আজ তার সঙ্গে এই দূরত্ব রিমির সহ্য হয় না।
সে নিজেকে রোজ বলছে, লোকটাকে সে ঘৃণা করে। খুব ঘৃণা। কিন্তু মনে হয় না কথাটা সত্যি। ঘৃণায় মায়া ও স্মৃতির দংশন থাকে কিনা জানা নেই রিমির। আবার রিমির আজও শুধু মনে হয়–হামজা শুধু একবার ফিরে আসুক এসব থেকে, সে হামজাকে কলিজা চেরা রক্ত দিয়ে ধুয়ে গ্রহণ করবে। ঘৃণায় এমন হয় কিনা তাও জানে না রিমি।
ঠান্ডা বাতাসে জানালার পর্দারা উড়ছে। সেই বাতাসে হামজার চুলগুলোও উড়ছে। রিমি অস্থির বুকটাকে নিয়ে মেঝেতে গেড়ে বসল হামজার সামনে। কান্নাটা থামানো যাচ্ছে না। এসব সময় কান্না ঠেকানো যায় না। খুব মুশকিল।
সে আসলেই ঘৃণা করে লোকটাকে। কিন্তু এটা ভাবলেও কষ্ট হয়। কোনো একসময় কাউকে প্রচণ্ড ভালোবেসে তারপর একবার তাকে যদি প্রচণ্ড ঘৃণা করতে হয়, সেটা করুণ এক যন্ত্রণার! এই যে রিমির ভেতরে যে প্রাচীর দাঁড়িয়েছে—লোকাটকে ভালোবাসার, ছোঁয়ার, অধিকার দেবার অথবা সমর্থন করার! এটা অসহ্য!
রিমি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। গম্ভীর মুখখানা। নেতা নেতা ভাব ছড়ানো। কঠোর ভদ্রলোক লাগে হামজাকে দেখতে। সেই ভদ্রলোকির মাঝে সূক্ষ্ণ এক ধূর্ততা, সাথে ভাবুকতাও। সময় পেলেই চোখে চশমা এঁটে ভারী ভারী সব বই খুলে বসতে দেখা যায়! তবু কীসের নেশায় ছুটছে হামজা! বড় হবার, আরও আরও বড় হবার! মানুষের মাঝে প্রবৃত্তি না থাকলে দুনিয়াটা স্বর্গ হতো।
চট করে এক লহমায় চোখ খুলে তাকায় হামজা। রিমি চমকে ওঠে। হামজা স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বলে, “কাঁদছো কেন?ʼʼ
রিমি জবাব দেয় না। দুজন তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে।
-“কিছু বলবে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?ʼʼ
-“ঘৃণা মাপছি।ʼʼ
হামজা হাসল, “পেলে কতখানি?ʼʼ
-“মেপে শেষ করি!ʼʼ
হামজা উঠে বসে। অন্ধকারে প্যাকেট হাতরে সিগারেট বের করে তা ধরায়। ধোঁয়া ছেড়ে বলে, “পাবে না। আমি যাদেরকে জীবনে ভালোবেসেছি, তারা আমার প্রতি বিমুখ তো হতে পারে, আর সেটাই তাদের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণার কারণ হবে।ʼʼ
রিমির গালে আলগোছে হাত রাখে হামজা।
রিমি শুধায়, “আপনার কষ্ট হয় না?ʼʼ
-“কষ্ট কী, রিমি?ʼʼ
-“বাঃ বাহ! সেটাও জানেন না! খুব সুখী লোক বুঝি, আপনি?ʼʼ
-“অসুখী?ʼʼ
-“বুঝি না আমি।ʼʼ
রিমি শক্ত হাতে চোখের পানি মুছলো। হামজার হাতদুটো সরিয়ে দিলো মুখ থেকে।
-“আমাকে খুব নিষ্ঠুর ভাবো?ʼʼ
তাচ্ছিল্যের সাথে স্লান হাসে রিমি, “না না। এমন সব বড় বড় ভুল ভাবনা ভাবতে নেই। তা ভাববো কেন?ʼʼ
-“এরকম সব কথা কে শেখাচ্ছে? আরমিণ?ʼʼ
-“আমার মুখ নেই?ʼʼ
হামজা চট করে হাসে, হাসির সাথে তামাকের ধোঁয়া উড়িয়ে বলে, “মুখ তোমার। কথাগুলো নয়।ʼʼ
-“আপনারা আরমিণকে ভয় পান?ʼʼ
-“নারীর প্রতিশোধপরায়নতা ও জেদ খড়ের গাদায় লাগা আগুনের চেয়েও ভয়াবহ। তা শুধুই ধিকিধিকি জ্বলতে জ্বলতে উপরের দিকে ওঠে, সব নিঃশেষ না করে নেভে না।ʼʼ
-“তাহলে আরমিণ সফল।ʼʼ
হামজা গভীর চোখে তাকা, কণ্ঠস্বর শ্লথ করে আবদার করে, “একটু কাছে আসবে?ʼʼ
রিমির মনে হলো—হামজা এক নিঠুর ও কৌশলগত শিকারী। যার মুখের বুলি বল্লম অথবা বর্ষার চেয়েও ধারালো। এভাবে একটা আহ্বানের মাঝে রিমির মতো দূর্বলপ্রাণ নারীকে মরণ দিতে শিকারী ছাড়া কে বা পারে?
রিমি ডুকরে কেঁদে উঠে হামজার বুকে হামলে পড়ল, “আপনি জানোয়ার। আপনি অমানুষ, আপনি আমাকে তিলে তিলে মেরে ফেলেছেন। একটুও দয় করেননি।ʼʼ শিউরে উঠছিল রিমির শরীর।
হামজা রিমিকে দুহাতের বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করে নিলো। রিমি ছটফট করছিল। হামজা শক্ত করে জড়িয়ে রেখে বলল, “তুমি আমার সহধর্মিনী হতে পারোনি, রিমি।ʼʼ
-“পারতে কী করতে হতো?ʼ
-“সহধর্মিনী শব্দটার একটা সাধারণ অর্থ আছে আমার কাছে।ʼʼ
-“আর সেটা কী?ʼʼ
-“সহ-ধর্ম। অর্থাৎ স্বামীর ধর্মে নিজেকে সমর্পিতকারিনী হয় সহধর্মিনী। সহযাত্রী বলতে যেমন একই পথের যাত্রাসঙ্গী বোঝায়। সহধর্মিনীর ব্যাপারটাও তাই। অথচ তুমি দিনেশেষে আমায় অস্বীকার করেছ, আমার ধর্মে ধার্মিক হতে পারোনি, সঙ্গ ছেড়েছ। মানতে পারোনি।ʼʼ
-“তার মানে আমি এখনও একটু হলেও মানুষ। মানুষেরা আপনাদের মানতে পারবে না।ʼʼ
হামজা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল কেমন করে যেন। শান্ত, স্থির দৃষ্টি, একটু বিস্ময়। তার চোখদুটো হিসাবমেশিন যেন। কিছু মাপছে, হিসাব করছে। তা শেষে বলল, “শেখানো বুলি, রিমি। তোমাকে তৈরি করা হয়েছে।ʼʼ
রিমি চোখদুটো বুজে হিংস্র হাতে হামজার ফতোয়ার কলার খামছে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে ছটফট করতে করতে বলে, “কিচ্ছু শেখানো হয়নি। আমি ঘরের আসবাব নই, মানুষ। আপনি যে পর্দা আর খাঁচাটার সীমায় আমার বন্দি রেখেছিলেন, তা কোনো এক আঘাতে ভেঙে গেছে, এইতো! তবুও তো আপনার সব পাপকে প্রশ্রয় দিয়েছি তো। শুধু মনে মনে মানতে পারছি না। আর তো কিছু করার নেই আমার! নয়ত আজও পর্যন্ত পড়ে আছি আপনার এই নরকে? আমিও তো সমান পাপী। এত ভাবছেন কেন?ʼʼ
হামজা হাসে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বোজে, দুপাশে মাথা নেড়ে গাঢ় স্বরে বলে, “আরমিণ, আরমিণ! আমার খুব ক্ষতি করে ফেলেছে, রিমি।ʼʼ
-“কেমন ক্ষতি?ʼʼ
-“অনেক বড় ক্ষতি! বিশাল ক্ষতি। অপূরণীয় ক্ষতি।ʼʼ
কী যেন ছিল হামজার কণ্ঠে। শিউরে উঠে দ্রুত মুখ তুলল রিমি, “কী ভাবছেন আপনি?ʼʼ
হামজা হাসল, “তুমি জানো রিমি–ও কখনও কখনও চেঁচায়, তামাশা করে। তখন মনেহয় ও প্রচুর বোকা, অশান্ত নির্বোধ। কিন্তু সেইসবই যদি ওর পরিকল্পনামাফিক হয়? ও যদি এটাই চায় যে, আমরা ওকে ফাঁপা আর বোকা ভাবি? যেন ও কিছুই করতে পারছে না, শুধু তড়পাচ্ছে।ʼʼ
-“মানে?ʼʼ
হামজা হতাশ গলায় বলল, “রিমি, ভাঙনের চেয়ে ফাটল ভয়ঙ্কর। এই সূত্রটা আরমিণ প্রয়োগ করেছে। আমার পরিবারটাকে সূক্ষ্ণভাভে চিড়ে ফেলেছে। ও আমাদের সবাইকে ঘৃণা করতো। এরপর তরু জয়কে ঘৃণা করেছে, তুলি আমাদের সবাইকে ঘৃণা করেছে, তুমি আমাকে ঘৃণা করেছ, কখন না জানি জয় আমাকে……ও সফল, রিমি। সবার চোখে সবার জন্য ঘৃণার পটি বেঁধে দিতে পেরেছে।ʼʼ
রিমি মাথা নাড়ে, “আপনি ওর বিরুদ্ধে ভড়কাতে চাইছেন আমায়।ʼʼ
হামজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসল, “আমার বোকা, বউ! খুব বেশি সময় কাটিয়েছ তুমি ওর সঙ্গে, হ্যাঁ?ʼʼ
রিমি চেতে উঠল, “ও আমাকে কখনোই কিছু বলেনি। ও খুব কম কথা বলে। আমি নিজে চোখে আপনাদের অপরাধ দেখেছি। ওকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেও বলতে চায়নি।ʼʼ
-“আজ মনে হচ্ছে, তোমায় মূর্খ রেখে ভুল করেছি। তুমি জাননো রিমি, চিরকালই অনাগ্রহের প্রতি মানুষের প্রবল কৌতূহল। এজন্য ওর বেপরোয়া স্বভাব, ভীতিহীন চালে তুমি খুব ফেঁসেছ। জয়ের অবস্থাও খারাপ। পুরুষ মানুষ তো!ʼʼ
-“ফাঁসা কোনটাকে বলছেন?ʼʼ
-“এই যে! আমার সাথে তর্কে আসছো!ʼʼ
রিমি বলল, “আরমিণ বলেছিল, আপনি আমাকে আপনার অধীনে কয়েদ করে রেখেছেন। আপনার খারাপগুলো তাই দেখেও চোখে পড়েনা। আর আমি মেয়েও তো ভালো পরিবারের না। আমি শুধু ওর কথাগুলো মেলাচ্ছি, আর মুগ্ধ হচ্ছি ওর ওপর!ʼʼ
হামজা হেসে রিমিকে বুকে টেনে নিলো। শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বুজল, “ওকে বন্দি রেখেছিলাম যাতে বাইরে বেরিয়ে কিছু পাকাতে না পারে। ও তখন ভেতরেই ছেঁদ শুরু করেছে। ইশ! বিশাল ক্ষতি, বিশাল ক্ষতি, রিমি! থেমে থাকেনি।ʼʼ
হামজার বুকে এভাবে সে হাজারবার মাথা রেখে তলিয়ে গেছে স্বর্গসমুদ্রে। আজও সেই বুক, সেই রিমি। শুধু সেই স্বর্গসমুদ্রের পানি শুকিয়েছে, সেখানে আজ খরখরে মরুর উত্তাপ বিরাজমান।
রিমির শরীরটা কাঁপছিল। হামজা বলল, “কাঁদছো কেন? ঘৃণা ফুরিয়েছে না বাড়ছে?ʼʼ
-“কোনোদিন ফুরোবে না।ʼʼ গর্জে উঠল রিমি। কান্নার সাথে ক্ষোভ ও গর্জন মিশে কেমন যেন লাগল রিমিটাকে।
হামজা হাসল, “যে অবধি কেউ পৌঁছায়নি, সেখানে তুমি জায়গা পেয়েছিলে। আর তুমিও সেখানে একটা খুব গভীর ছিদ্র করেছ, রিমি।ʼʼ
-“আপনি আমাকে খুব সুখ দিয়েছেন?ʼʼ
-“আশা রেখেছিলে কেন? আমি তো সুখের ব্যাপারী নই!ʼʼ
রিমি মৃদু চেঁচিয়ে উঠল, “আপনি তবে কীসের ব্যাপারী? রক্তের? অন্ধকারের? চিৎকার আর যন্ত্রণার?ʼʼ
হেসে জানালার দিকে তাকাল হামজা, “এগুলোই বা খারাপ কী? দুনিয়াতে শুধু সুখ থাকলে সুখের কদর থাকবে না। তাই কাউকে না কাউকে এসবের আমদানী করতেই হবে।ʼʼ
-“চুপ্প। চুপ। চুপ করুন, মুখোশধারী পুরুষ!ʼʼ
হামজা আস্তে কোরে ঠোঁটে আঙুল রেখে স্থির চোখে বলল, “চুপ করলাম।ʼʼ
-“আপনি তো এমন না। তবু আমার সামনে এমন নাটক কেন করেন?ʼʼ
-“আমি আসলে কেমন, রিমি? তোমাকে কী বোঝানো হয়েছে আমার ব্যাপারে?ʼʼ
-“আপনি জানোয়ার।ʼʼ
-“এখন কি মানুষদের মতো লাগছে?ʼʼ
রিমি কত কিছু বলতে গিয়েও পারে না। চোখ বুজে এলোমেলো শ্বাস ফেলে শব্দ করে। এরপর আবার চট করে হামজার কলারটা চেপে ধরে, “আমার…আমার খুব কষ্ট হয়, বোঝেন আপনি? বোঝার কথা না। কসাইয়েরা পশু জবাই করার সময় পশুর চোখে তাকিয়েও গলায় ছুরি চালাতে পারে। পেশা তো। তারা পশুর ভেতরের আর্তনাদ বুঝবে কেন?ʼʼ
-“তুমি বোঝো?ʼʼ
-“আপনার তো কষ্টই নেই। বোঝার কী?ʼʼ
-“এই বুঝেছ?ʼʼ
-“তাছাড়া আর কী বুঝিয়েছেন?ʼʼ
হামজা হেসে ফেলল, কেমন যেন হাসিটা! হাসি ঠোঁটে রেখে বলল, “তোমার মতো কাঁদতে বলছো? আমার সন্তানদুটো কোরবানী করার দুঃখে , আমাকে তোমার কাছ থেকে বঞ্চিত করার দুঃখে, আমার বিরুদ্ধে কারও নিন্দাকে মেনে নেবার দুঃখে, আরও কত কত দুঃখে কাঁদতে বলছো?ʼʼ
-“নিন্দা? আপনি নিজেও জানেন, একমাত্র আরমিণ আপনাকে সঠিক চেনে। যদি আরমিণের কাজকর্মে আমি কিছু শিখেও থাকি, তো ভুল শুধরে এতদিনে সঠিকটা শিখেছি। আর দুঃখ, সেটা আছে আপনার? দুঃখ তো মানুষেরা পায়। কসাইদের দুঃখ থাকে না। কান্না পায় আপনার?ʼʼ
-“তা পায় না ঠিকই। তবে…ʼʼ অস্পষ্ট স্বরে বলে, “তোমার প্রধান বিরোধী তবে আমি ছিলাম, আরমিণ! শ্যাহ! দূর্বল প্রতিদ্বন্দী ভেবে চোখের নাগালে রেখে যেন নিশ্চিন্ত ছিলাম। কী কী কেঁড়ে নিতে চাও?ʼʼ
রিমি ঠোঁট বাঁকিয়ে মলিন হাসে। হামজার সামনে মুখ উঁচিয়ে বাবু মেরে বসে। চোখে ছলছল করছে পানি। দাঁতে দাঁত শক্ত। ভ্রু-দুটো কাঁপছে। বুকের ভেতরে বোধহয় কালবৈশাখীর বাতাস বইছে। নিঃশ্বাসের শব্দ সন্ধ্যার স্তব্ধতায় আলোড়ন তুলেছে। রিমিও এবার দৃষ্টি স্থির করল হামজার চোখে। বারবার ঢোক গিলছে, বুকের সাথে শরীরটাও নড়ে নড়ে উঠছে। চঞ্চল চোখে হামজার গোটা মুখে বারবার চোখ বোলাচ্ছিল।
হামজা আচমকা শব্দহীন হেসে উঠল, চোখের পাতা নেমে এলো হাসির সাথে। বলল, “এভাবে তাকিয়ে থেকো না। চোখদুটোকে সামলাও। হামজা ওরকম দুটো গভীর দুঃখের সাগরে তলিয়ে গেলে কারবার সামলাবে কে?ʼʼ
-“কেন? তাকান আমার দিকে। আপনার তো কষ্ট নেই। অনুভূতির অভাবে ফেটে চৌচির জমির মতো আপনি। ʼʼ
হামজা অনড়, নির্বিকার মুখে ও অতল গহ্বরের মতো চোখদুটো মেলে তাকিয়ে রইল।
-“আরমিণ আর কী করেছে আমি জানি না। তবে আপনি এতটাই নির্লিপ্ত যে আমার দেয়া শাস্তিও আপনার নির্লিপ্ততায় প্রতিফলিত হয়ে আমার ওপরেই ফিরে এসেছে। আপনি এখনও অটল। একটু শেখাবেন আমায় এমন কঠোর প্রাণহীন হতে? আমার না ভেতরে খুব তীব্র অনুভূতি আর আবেগ। খুব জ্বালায় আমাকে। আমি আপনার মতো উদ্দেশ্যপ্রবণ হতে চাই। যাকে টলানো অসম্ভব।ʼʼ
হামজা হেসে মাথা নাড়ে দুপাশে। নীরবে ব্যাপারটা অস্বীকার করে নিচু করে চোখ। রিমি জোর করে থুতনি ধরে হামজাকে নিজের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। শক্ত কণ্ঠে বলে, “তাকাতে চাচ্ছেন না কেন? তাকান। তাকান আমার দিকে। আমি আপনার নিষ্ঠুরতা দেখতে চাই। আপনি আমার ওপরে ঠিক কতটা উদাসীন ছিলেন, আর কতটা দায়সারা ছিলেন তার হিসেব করতে হবে তো! কারণ আমি আপনার চোখের সেইসব মিথ্যা মুগ্ধতা আর কর্তব্যপরায়ন চাহনিকে ভালোবাসা ধরে নিজেকে সঁপেছিলাম। তাকান… আমার চোখের দিকে।ʼʼ
হামজার চোখের পাতা নড়ে উঠল। রিমি বলল, “বিয়ে তো সবাই করে, মেয়র সাহেব। সংসারও করে যায় দিব্যি। কিন্তু আমি যে বয়সে আপনার বউ হয়ে এসেছি, না ছিল বয়সের মিল, না অনুভূতির। কিশোরী বয়সে এক তরতাজা পুরুষের কর্তব্য আর হাতের বাঁধনের প্রেমে পড়ার অপরাধে কী কী শাস্তি আর দেবেন? দিন। আজ সামনে আছি আমি। আপনার হাতের নাগাল ছেড়ে বেরোবার পথ তো নেই। সবটুকু শাস্তি দিয়ে দিন। দিনে দিনে সইতে পারছি না।ʼʼ
হামজা মুখ খুলতে চাইলেই রিমি হামজার ঠোঁটে আঙুল চাপে, “চুপ।….চুপ চুপ।ʼʼ
কেমন হাঁপানি রোগীর মতো নিঃশ্বাস ফেলল রিমি, “কেন ওভাবে ভালোবাসার ঢং করেছিলেন? আমার তো বয়স কম। আমি আপনার অত গভীর মারপ্যাচ বুঝিনা। আমার চারদিকে প্রেমে পড়ে বেড়ানোর বয়সে প্রায় জোর করে বিয়ে করে আনলেন। বিশাল এক নেতার ঘরের আদুরে, আহ্লাদী বউ হলাম। ও বাড়ি যেতে চাইলে যেতে দেননি। আপনার আশপাশেই পড়ে থাকতে বাধ্য করেছেন। আর তাতে আমার নারীমনের সবটুকু অনুভূতি আপনার ওপর আঁটকে রইল, অন্য কোথাও মনোযোগ যাবার সুযোগ পেল না। বিয়ের পর হাতে গুণে আপনার গন্ধ মিশে থাকা এই রুম থেকে বাইরে বেরিয়েছি।ʼʼ
রিমির স্বর থরথর করে কেঁপে উঠল, “আর কোথায় যাব আমি, হ্যাঁ? আমার গণ্ডি আপনি অবধি। এবার বলুন, সেই পুরুষটার কাছে এমন সব বিশ্বাস ভাঙা আঘাত পেতে আমার কেমন লেগেছে? আর কতটা শাস্তি বাকি আমার? পুতুল বানিয়ে রাখতে ওরকম ভালোবাসতেন? ঘরে আঁটকে দুনিয়ার থেকে আলাদা করে রেখে শুধু আপনার মাঝে বিলীন রাখতে এসব আয়োজন? ঠিক আছে, তা সফল হয়েছে। যে বয়সে মেয়েটা উশৃঙ্খল হয়ে ওঠে, আমি আপনার ঘরণী হয়েছি। সারাদিন পাক্কা গিন্নির মতো সংসার সামলানো আর দিনশেষে স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষা। আমার মাথায় এ ছাড়া আর কিছু রইলনা আর। সবটা আপনি, আপনার ঘর-সংসার, আপনার পাঞ্জাবীটা, গামছা, লুঙ্গি, পছন্দের খাবার, পছন্দের সাজ–কী পেলাম? দিনশেষে এক অমানুষ ক্ষমতালোভী কুকুর স্বভাবের পুরুষের জন্য আমার এতকিছু?ʼʼ
হামজা শুধু চেয়ে রইল চুপচাপ। রিমি বলল, “আপনি ঠিক। যতদিন না আরমিণ এ বাড়িতে পা রেখেছে, এসব যে আমি কী করছি, তা-ই জানতাম না। ও আমাকে তুলনা শিখিয়েছে। এসবের হিসেব কষার সূত্র শিখিয়েছে ওর ব্যবহার। কিন্তু ওর কোনো চেষ্টা ছিল না আমাকে শেখানোর। ওর চরিত্রটা আকর্ষণীয়। আমি নিজেই ওকে ফলো করতে লাগলাম। একটু একটু ধারণ করতে থাকলাম ওকে।
ও গোলামিকে ঘৃণা করে, ও যা করে সবের পেছনে একটাই চিন্তা—দিনশেষে যেন অনুভূতির অপচয় না হয়ে যায়। কারও কাছে নত না হয়ে যেতে হয়। আর কেউ যেন এইসব দূর্বল অনুভূতির নাম ধরে ক্ষমা না পেয়ে যায়। আজ যেমন আমি পারছি না–আপনাকে পর্যাপ্ত ঘৃণা করতে! কারণ আমি এক দূর্বল অনুভূতির জালে বন্দি। ও আমাকে স্বামীকে ভালোবাসতে নিষেধ করেনি, ও আমাকে কিছুই বলেনি কখনও। শুধু ওর চালচলনই আমাকে চিনিয়েছে কোন সীমাটা মানুষকে মানুষ আর অমানুষ হিসেবে ভাগ করে…ʼʼ
হামজা হঠাৎ-ই রিমির ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল। খানিক পর একটু আলগা করে বলল, “চুপ! আরমিণকে অথবা আরমিণের ধরণকে জয় সহ্য করতে পারে। আমি পারব না। ওর একফোঁটাও আমি তোমার মাঝে বরদাস্ত করতে পারি না। তুমি আমার বউ। আরমিণের সামান্য একটুও তোমার মাঝে থাকবে না।ʼʼ
-“তো বলছেন চলে এসেছে? তাহলে সেটা কি আপনার জন্য কষ্টকর?ʼʼ
হামজা দাঁতে দাঁত পিষল, “আমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক। এই খেলায় ওকে জিততে দেয়ার ভুলটা আমি করব না, রিমি। আমার সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রু ওই মেয়েটা। তুমি বুঝতে পারছো না, ও কী খেলা খেলছে!ʼʼ
থম মেরে গেল হামজা। চুপ করে গেল আচমকা। দুই সেকেন্ড, থেমে রইল, কিছু ভাবলো। এরপর রিমির ঠোঁটে গাঢ় একটা চুমু খেলো। খুব হিংস্র চুমু। রিমির ওপর যেন কঠিন এক আক্রোশ প্রকাশ পেল।
খানিক বাদে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “একটা সত্যি কথা শুনবে রিমি?ʼʼ পেছন ফিরে রিমির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি যা করেছ আমার সঙ্গে, আর আমার থেকে তোমার এই মুখ ফিরিয়ে নেয়া আমাকে যে যন্ত্রণাটুকু দিচ্ছে, কসম তোমার জায়গায় অন্য যে কেউ থাকলে তার শরীরের প্রত্যেকটা হাড় ছড়িয়ে আলাদা আলাদা করে দাফন করতাম। কবর হতো ২০৬ টা। আফসোস, আমি জয়ের পর আরও একজনকে ধারণ করে বসেছি ভেতরে।ʼʼ
রিমি একসময় শুধায়, “আপনি যে বললেন—কী খেলা খেলছে, আরমিণ?ʼʼ
হামজা চুপচাপ জানালার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অদ্ভুত স্বরে বলে, “কঠিন কিছু।ʼʼ
-“কেমন কঠিন?ʼʼ
-“ভয়ানক কঠিন। এর ফল আমি তাকে দিলে নিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে বড় চিন্তা হচ্ছে আমার।ʼʼ
—
ওদের ওপর অত্যাচার বেড়েছে। রোজ তিনবেলা করে লোক আসছে বড়ঘরে। অন্তূ দেখল, “কিছু বড় বড় ইস্পাতের বীম ও লোহার খণ্ড সরানো হয়েছে।ʼʼ
জয় অন্তূকে দাঁড় করিয়ে রেখে পাশের কক্ষে যায়। ফিরে আসে পিস্তল হাতে। এগিয়ে গিয়ে বসে মুরসালীনের সামনে। অন্তূর দিকে মুরসালীন একবার তাকায়, তৎক্ষণাৎ চোখ সরায়।
জয় পিস্তলটা পাশে মেঝেতে রেখে মুরসালীনকে জিজ্ঞেস করে, “তোর চাচা কোথায়, মুরসালীন?ʼʼ
মুরসালীন তাকাল জয়ের দিকে, হেসে ফেলল, “এতদিন পরে একথা জিজ্ঞেস করছিস! আমি অধীর অপেক্ষায় ছিলাম তোর এই প্রশ্নের।ʼʼ
জয় বিনিময়ে একই হাসি হাসল, “তাড়া কীসের? এই যে কাতরানি, যন্ত্রণা, না খাওয়া, আঘাত…তোর ছোট্ট ছোট্ট আমানতগুলোর অসহায় আবদার, শুকনো মুখ, তৃষ্ণার্ত চাহনি! এসব দেখলি, মজা পেলি। এতে কোরে আর দু-একবারের বেশি জিজ্ঞেস করতে হবে না। দ্রুত জবাব পাব।ʼʼ
মুরসালীনের মুখ নরকের কূপের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল, চোখের মণি লালচে হয়ে উঠল আচমকা। তাকে সচরাচর খুব শান্ত দেখা যায়। আজ আচমকা জয় ও মুরসালীনের সম্মুখীন দৃশ্যটা দেখতে দুই আগ্নেয়-স্ফূলিঙ্গর সংগর্ষের মতো লাগল। দাঁতের মাড়ি চেপে মুরসালীন বলল, “আমার বাপকে মেরেছিস তুই। কিচ্ছু বলিনি।ʼʼ
-“বলিসনি?ʼʼ
-“তোকে কারা কোথায় ঘায়েল করে ছেড়ে দেয়, তার জিম্মা অন্যের ঘাঁড়ে চাপিয়ে হালকা হোস। তুই শালা ভুল বুঝেই শহীদ হয়ে যাবি।ʼʼ
জয় খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে মুরসালীনের দিকে। তারপর বলে, “আমার নামে একটা শহীদ মিনার তৈরি হলে শহীদ হতে আমার কোনো সমস্যা নেই।ʼʼ
-“আমার ভাইকে মেরেছিস তুই, জয়।ʼʼ
জয় ঘাঁড় নত করে বাহবা নেবার মতো ভঙ্গি করে বলে, “ওহ! নিজের হাতে। গলা কেটে দুই ভাগ করেছি।ʼʼ
মুরসালীনের চোখে রক্তের দানা বাঁধে, দু’পাশে মাথা ঝেড়ে প্রগাঢ় শ্বাস ফেলে, “কিন্তু আমাকে খুঁজতে আমার বোনকে যখন অপহরণ করলি, আমি কেন জানি নিশ্চিন্ত ছিলাম রে, জয়!ʼʼ
জয় ঠোঁট উল্টায়, “কী বাবদে?ʼʼ
মুরসালীন স্লান হাসে জয়ের চোখে চেয়ে, “তুই বেঁচে থাকতে আমার মুমতাহিণার গায়ে আঘাত লাগবে না বোধহয়! এই ভাবনা বাবদে। তুই যখন চলে এলি, মনে আছে–মুমতাহিণা আম্মুর কোলে? ক্যাঁ ক্যাঁ কোরে কাঁদতো সারাদিন খালি…ʼʼ মুরসালীনের কণ্ঠস্বর কেমন অস্তমিত হয়ে এলো, কেঁপে উঠল একটু, ঠোঁট উল্টে মলিন হাসল।
মুরসালীন ওপরের দিকে তাকায়। অন্তূ নিজের বুকের ভেতর এক কঠিন অস্থিরতাবোধ করল। সাধারণ কথাগুলো এত নিষ্ঠুর শুনতে লাগবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে শোয়ানো মুমতাহিণার লাশ চোখে ভাসছে। অন্তূ দীর্ঘ করে শ্বাস টানে। জয় নির্লিপ্ত মুখে মেঝের দিকে চেয়ে আছে।
মুরসালীন নিজেকে এক মুহুর্তের মাঝে সামলায়, “ওর লাশও দেখতে পাইনি। বিশ্বাস কর জয়, মুস্তাকিন ভাই থাকলে তোকে কেটে চিড়িয়াখানার পশু দিয়ে খাওয়াতো নিজের হাতে।ʼʼ
জয় মুখ তোলে, উপর-নিচ মাথা নাড়ে “আর তুই? তুই কিছু করবি না?ʼʼ
কিন্তু বলে না—মুমতাহিণাকে এনে গোডাউনে রেখে চারঘন্টা পর সে রাজধানীতে চলে গেছে। ফেরার আগেই মুমতাহিণার দেহ পলাশের ডেরায় পৌঁছেছে।
যেদিন মুমতাহিণার সঙ্গে মুরসালীনের শেষ দেখা হলো, মুরসালীন রাজধানীর উদ্দেশ্যে বেরোচ্ছিল। চুপিচুপি এসে মুরসালীনের পেছনে দাঁড়ায় মুমতাহিণা। বয়স ষোলোতেই রূপ ছিটকে এসেছে! পরনে লম্বা গোল জামা। ওড়না জড়ানো শরীরে, মাথায় ঘোমটা। ফর্সা টকটকে হাতে কালো লোম। ঘন পাপড়িওয়ালা চোখদুটো ঠিক বড় বড় মার্বেলের মতো। তিন ভাই-বোনের চেহারাই দেখতে লাগে ইরানি ইরানি।
মুরসালীন পেছন না ফিরে বলে, “কী?ʼʼ
মুমতাহিণা ওর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। মুরসালীন গম্ভীর হয়, “থাপ্পড় খাবি? আমার ঘরে কী?ʼʼ
-“ভাইয়ু তুই ঢাকা যাচ্ছিস, ঠিক বলেছি?ʼʼ
-“না।ʼʼ
“মিথ্যা বলে বের হবি, রাস্তায় কুত্তার তাড়া খাবি, আবার ফিরে এই আমার কাছেই আসা লাগবে। মনে রাখিস, তোর তো বউ নেই, সেবার জন্য আমার কাছে ধর্না ধরতে হবে।
মাথায় একটা গাট্টা মারে মুরসালীন। মুমতাহিণা চেঁচিয়ে ডাকে, “আম্মা?ʼʼ
-“ছাগলের বাচ্চার মতো ম্যা ম্যা করিস ক্যান সবসময়?ʼʼ
মুমতাহিণা আস্তে কোরে বসে বিছানায়, চঞ্চলতা ভুলে নিভু নিভু স্বরে বলে, “বড় ভাইয়ার খোঁজ পাসনি রে ভাইয়ু?ʼʼ
সুন্দর পুতুলের মতো মুখটা মলিন হয়ে উঠেছে, তা জানে মুরসালীন। রাগ হয় মুরসালীনের। ওই মুখ দেখার সাহস নেই, মুরসালীন তাই তাকায় না। মুরসালীনের কাছে জবাব নেই, তাই কোনো কথাও বলে না। মুমতাহিণার বড় ভাইয়া আর নেই, তা বলার নয় মুমতাহিণাকে।
মুমতাহিণা চট করে হাসে, “এই শোন, ভাইয়ু!ʼʼ
মুরসালীন খেয়াল করে, মুমতাহিণা একদম মুস্তাকিনের মতো হয়েছে। আবেগ লুকোতে পেশাদার পটু। ভ্রু নাচায়, “কী?ʼʼ
মুমতাহিণা উঠে এসে ছোট ভাইয়ের পাশে দাঁড়ায়। ঠোঁট টিপে বলে, “আমার কী মনে হয় জানিস?ʼʼ
-“ইচ্ছে নেই জানার। দূরে থাক।ʼʼ
-“চুপ। বলছি শোন। খ্যাকখ্যাক করবি কেন আমার ওপর? আমি ছোট না?ʼʼ
মুরসালীন হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এসব বাচ্চামি এড়ানো দুঃসাধ্য। ইচ্ছে করে, মুমতাহিণাকে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরতে। ধরে না সে। নিচু হয়ে হাসে।
মুমতাহিণা কাধে কাধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আয়নায় মুরসালীনের চোখে তাকিয়ে বলে, “বড় ভাইয়া একটা মেয়ে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। কিন্তু লাজুক লোক তো! আর আম্মার ভয়ে বাড়িতে আসতে পারছে না। বল, আমার আন্দাজ কেমন?ʼʼ
মুরসালীন রেগে ওঠে। বাড়িতে থাকলে এই মেয়ে সারাদিন বড় ভাইয়া বড় ভাইয়া করে কান খায়। মুরসালীনের বুকে আগুন জ্বলে, তা টের পায়? ধমকে ওঠে মুরসালীন, “বের হ আমার রুম থেকে। তোর প্যাঁচাল শুনতে ভাল্লাগছে না।ʼʼ
মুমতাহিণা অভিমান করে সরে দাঁড়ায়, যায় না। যতক্ষণ না মুরসালীন মানিয়ে নেবে, যাবে না। মুরসালীন আচমকা জিজ্ঞেস করে, “জয় আমিরকে মনে আছে তোর, মুমতু?ʼʼ
-“মনে থাকার কথা? কে লোকটা?ʼʼ
মুরসালীন প্রসঙ্গ এড়ায়, “কেন এসেছিস?ʼʼ
মুমতাহিণা বিশাল বিশাল ভরাট দুটো অক্ষিপল্লব মেলে তাকায়। মুরসালীন টের পায় বুকের ভেতর এক তিরতিরে ব্যথা! ওই চোখদুটোকে বড় ভয় মুরসালীনের। এখন আবার পানি জমছে। টলমল করছে। মুশকিল বড়।
মুমতাহিণা চোখের পানি ছাপিয়ে হাসে, “কয়দিনের মনে যাচ্ছিস রে?ʼʼ
-“তা জেনে কী?ʼʼ
-“হিসেব করব, কয়দিন বাড়িয়ে শান্তিতে থাকতে পারব।ʼʼ
মুরসালীন হাসে, “এবার আমিও তোর বড় ভাইয়ার মতো নিরুদ্দেশ হবো। কেমন হবে?ʼʼ
এবার আর বাঁধ মানে না চোখ। টুপ করে গাল বেয়ে যায় মুমতাহিণার। মুরসালীন দেখে তা। বুক মুচড়ে আসে তার। বাপহীন পুঁচকেটাকে মুস্তাকিন কলিজার সবগুলো ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখতো। মুরসালীন তুলনামূলক রুক্ষ্ণ। তার সাথে ভালোবাসার চেয়ে ঝগড়া বেশি।
মুমতাহিণা হামলে পড়ে ভাইয়ের বুকে, “আসিস না আর। তুই না থাকলে সারাদিন আমাকে কেউ ধমকায় না, খাটায় না, সন্ধ্যার পর বাদাম কিনে এনে দেয় না, ঝগড়া করার লোক থাকে না, স্কুলে একা যেতে হয়। কত আরাম। তুই থাকলেই যত ঝামেলা।ʼʼ
মুরসালীন মাথায় হাত রাখলে তা ছিটকে সরিয়ে দেয়, “সরা হাত। হাত রাখছিস কেন আবার মাথায়?ʼʼ
মুমতাহিণার চেয়ে কমপক্ষে দশ বছরের ছোট। অথচ মানামানি নেই সেসব। চুপ করে থাকে দুজন। মুমতাহিণার ফুঁপানির মৃদু আওয়াজ মন ভরে শোনে মুরসালীন। বাড়িতে শুধু আম্মার সাথে একা থাকে। রাজধানীতে মুরসালীনের ঘুম হয় না তা ভেবে।
মুমতাহিণা খানিক বাদে আস্তে কোরে বলে, “বড় ভাইয়ার খোঁজে যাচ্ছিস, ভাইয়ু। তাই না?ʼʼ
মুরসালীন চোখ বোজে। গাঢ় শ্বাস নেয়। কণ্ঠনালি ঠেলে ডাহা মিথ্যা আশ্বাসটুকু বের করে, “হ্যাঁ। তোর ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে শুনতে কানের পোকা মরে যাচ্ছে। এবার ইনশাআল্লাহ তোর বড় ভাইয়াকে নিয়ে আসব, যা।ʼ
-“তোকে দরকার নেই। শুধু বড় ভাইয়ার সঙ্গ চাই।ʼʼ
বের হবার সময় মুরসালীনের আম্মা মরিয়ম বেগম দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁক দেন ছেলের শরীরে। রাস্তায় আয়াতুল কুরসী, দরুদ শরীফ পাঠ করতে বলেন মনে মনে।
মুমতাহিণা ধমক দেয়, “শোন বেদুইন। নামাজ পড়বি ঠিকমতো। তোকে ভার্সিটিত পড়িয়ে কাফের বানিয়েছে, আম্মা। পোশাকের কী ছিরি! সাহেব হয়েছে।ʼʼ
মুরসালীন গাট্টা মারে মাথায় একটা।
বাঁশের চ্যাগারে ঘেরা বাড়ির সামনের পথটুকু পেরিয়ে যায় মুরসালীন। পেছন থেকে মুমতাহিণা মাথায় ওড়না তুলতে তুলতে দৌঁড়ে যায়, “এই শোন, ভাইয়ু! শোন, শোন।ʼʼ
মুরসালীন পেছন ফেরে। মুমতাহিণা মুখ নামিয়ে দাঁড়ায়। মুরসালীন হাসে, “কিছু লাগবে না তোর, তাই তো?ʼʼ
মুমতাহিণা চোখ তুলে হাসে। দুই ভাই-বোন একে অপরের চোখে তাকিয়ে সমানতালে হাসে। মুমতাহিণা মুরসালীনের হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। ভারী শ্বাস ফেলে দুজনই। কত কিছু বলতে চায় দুজন, বলা হয় না কারোরই। কেবল চুপচাপ চেয়ে থাকে।
এক সময় মুমতাহিণা হাসি সামলে বলে, “ফেরার পথে একটা ঢাকাই শাড়ি আনিস তো।ʼʼ
মরিয়ম বেগম পেছষ থেকে শাসন করেন, “খবরদার! ওসব কিচ্ছু না। শাড়ি পরা লাগবে ক্যান, হ্যাঁ? বেশি স্পর্ধা?ʼʼ
ধার্মিক পরিবার সৈয়দ পরিবার। সেখানে মেয়েদের বেলেহাজ হয়ে চলার চল নেই। মরিয়ম বেগম রাগ করেন।
মুরসালীন গম্ভীর হয়, “পারব না আনতে।ʼʼ
মুমতাহিণা হাসে, “তোর ঘাঁড় পারবে। যা বিদায় হ তো এবার। আর আসিস না তাড়াতাড়ি।ʼʼ
অন্তূ স্তব্ধ হয়ে শোনে সেসব। জয় ওভাবেই বসে আছে। কোনো হেলদোল নেই। না আছে মুখে অভিব্যক্তি। অন্তূর মনে হয়—জয় বুঝি লোহার খণ্ডগুলোরই এক টুকরো।
মুরসালীন হাসে, “ঢাকাই শাড়িটা এখনও আমার ফ্ল্যাটে পড়ে আছে। পড়ার মেয়েটা পালিয়েছে আমাকে রেখে। প্রথমে ভাই গেল তারপর বোনটাও। আমি একা আছি। মেরে ফেল আমায়। ও, আমার পরিবারে আর আছে আম্মা। তার খোঁজ চাই, জয়? সে ছাড়া আর কেউ নেই।ʼʼ
বাগানের রাস্তার পিছনের লোহার গেটে করাঘাতের হালকা আওয়াজ ভেসে আসছে। রাত বোধহয় দুটো পার। কেউ এসেছে! করাঘাতের আওয়াজটা কেমন যেন শোনাচ্ছে। গা ছমছম করে ওঠে। মৃদু হলদে আলোয় বিশাল ঘরটা গুমোট। কতগুলো দেহ ছড়িয়ে আছে। যেন জীর্ণ-শীর্ণ, ময়লা সাদা কাপড়ের স্তূপ।
চলবে…
[বিশাল পর্ব দিয়েছি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আমি ভীষণ দুঃখিত—ষাট পর্বের মাঝে শেষ করতে পারিনি। কী যে অস্বস্তি হয় বিষয়টাতে! যাহোক, সামনের পর্বটা বিশেষ হবে। মন্তব্য করবেন সকলে।]