অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৬৭. (বর্ধিতাংশ)

0
3

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬৭. (বর্ধিতাংশ)

করাঘাত গাঢ় হচ্ছে। জয় উঠে যায়। পিস্তলটা পড়ে থাকে মেঝেতে। সেই ফাঁকে অন্তূ আব্দুল আহাদকে বলে, “কতদিন আগে আঁটক হয়েছ তোমরা, মনে আছে?ʼʼ

জবাবটা আব্দুল আহাদ দিতে পারে না। ওরা এতটাই দূর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে! এছাড়া ওদের সেই হিসেব নেই-ও!

মুরসালীন জবাব দিলো, “এখানে সময় আবদ্ধ। আর এই অবস্থায় দিন মনে রাখা অসম্ভব। তবে আমার একটা হিসেব আছে। মাস দেড়-দুয়েকের মতো হবে। কম-বেশি হতে পারে।ʼʼ

অন্তূ তাকায়। চোখাচোখি হলে দুজন চোখ নামায়। অন্তূ ঠোঁটে ঠোঁট গুজে নিয়ে আস্তে কোরে বলে, “মুরসালীন মহান! কয়েকদিন আগে ঘটনাক্রমে আমার আনসারী মোল্লার সঙ্গে কথা হয়েছে।ʼʼ

মুরসালীন ভ্রু কুঁচকে ফেলল, “আপনার সঙ্গে?ʼʼ

-“অবাক হচ্ছেন কেন?ʼʼ

মুরসালীন চোখ নামায়, “কী বলেছেন উনি?ʼʼ

-“জিন্নাহ আমির আপনাদের হাতে বন্দি।ʼʼ

-“এটা আনসারী ভাইজান বলেছেন?ʼʼ

-“আমি বলছি।ʼʼ

পাশ থেকে এমদাদ বলল, “এত বিশ্বাসের সাথে কীভাবে বলছেন?ʼʼ

অন্তূ আলতো হাসল, “আমার মনেহয় আমার আন্দাজশক্তি ভালো।ʼʼ

মুরসালীন জিজ্ঞেস করল, “আনসারী ভাই কী বলেছেন আপনাকে? তার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হলো কী করে?ʼʼ

-“আপনার অনুমতি পেলে উনি জিন্নাহ আমিরকে ছেড়ে দেবেন। তার বদলে যদি এটা নিশ্চিত হয় যে আপনাদের মুক্ত করে এরা, তবে এই লেনদেনটা করবেন উনি।ʼʼ

মুরসালীন সন্দিহান হলো, “আপনি তো এখানে আসার সুযোগ পান না। আজ যদি না আসতে পারতেন, আমাকে খবরটা দিতেন কীভাবে?ʼʼ

-“দিতে হতোই যেকোনোভাবে! আর সেজন্য একটা তামাশা করে হলেও আসতে হতো।ʼʼ

-“আমাদের ব্যবস্থা হবে ইনশাআল্লাহ। আর না হলেও দুঃখ নেই। আমি বেঁচে থাকা অথবা মৃত্যু কোনোটা নিয়েই আশাবাদী নই। আপনি কেন করছেন, কী করছেন, সেটা আর জানতে চাইলাম না। কিন্তু আপনি আমাদের জন্য নিজেকে বিপদে ফেলবেন না।ʼʼ

অন্তূ হাসল, “বিপদ আবার বিপদে পড়বে কী? বিপদ আমাকে এতই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে নিয়েছে, আমি নিজেই আজ স্বয়ং বিপদ হয়ে গেছি।ʼʼ

মুরসালীন একবার তাকাল অন্তূর দিকে। অন্তূ সন্দেহীন গলায় জিজ্ঞেস করে, “জিন্নাহ আমির কি বেঁচে আছে আপনাদের হেফাজতে?ʼʼ

জবাবটা দেবার সময় পেল না মুরসালীন। জয়ের সঙ্গে চারজন ঢুকল। আজ চয়ন নেই। দোলন সাহেব, বাপ্পী, কামরুল। সঙ্গে আছে রবিউল। পেশায় সে মেকার। আসলে দালাল, রাজনীতির দালাল। দোলন সাহেব অন্তূকে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। তা দেখল জয়। মেয়ে মানুষ কেন বারবার এইসব কারবারে থাকবে? আগের দিনও জয়ের বউকে এখানে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। জয়কে আস্তে কোরে বললেন, “তোমার স্ত্রী এখানে কী করছে, জয়? দৃষ্টিকটু লাগে ব্যাপারটা, বুঝেছ? তাকে এখানে আনা কেন?ʼʼ

জয় জবাব দিলো না।

বাপ্পী মণ্ডল ঢুকেই গজরাতে গজরাতে মুরসালীনের দিকে এগিয়ে যায়। ঢাকায় এক সম্মেলন ও মিছিলে ছাত্রদলের লাঠিঘাতে তার দুলাভাইয়ের মৃত্যু হয়। সে জানতে পেরেছে, সেই ছাত্রদলের লিডিংয়ে মুরসালীন ছিল। মুরসালীনকে বোঝা যায় না। সে যে আসলে কী চায়, কোন দলকে সমর্থন অথবা বিরুদ্ধাচারণ করে, অথবা করেই কিনা!

জয় এসে বসল আবার মুরসালীনের সামনে। দোলন সাহেব বললেন, “শেষ একটা চেষ্টা করব মুরসালীন? একটা স্টেটমেন্ট দেবে? নয়ত দায়িত্বটা সরাসরি আইনের হাতে হস্তান্তর করাই শ্রেয় হবে।ʼʼ

মুরসালীন হ্যাঁ-না কিচ্ছু বলল না। ওরা যে স্বীকারক্তি চাইছে, তা বেঁচে থাকতে দেবে না মুরসালীন।

দোলন সাহেব বললেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে দল হিসেবে কোনটাকে সমর্থন করতে পছন্দ করবে তুমি?ʼʼ

অকপট জবাব দিলো মুরসালীন, “দলহীনতাকে। দল শব্দটাই বাংলাদেশের কাল, স্যার। কোনো দলই এই বাংলার জন্য শুধুই ধ্বংসাত্বক ছাড়া আর কিছু নয়। আর আমি তাই এমন এক দুর্যোগ চাই, যাতে করে বাংলাদেশের প্রধান, আলোচিত, বিশিষ্ট দলগুলো সমূলে উপড়ে যাক। তাদের কোনো চিহ্ন এই বাংলার মাটিতে না থাকুক। শুধু আমরা সাধারণ মানুষ থাকব। আমাদের দেশে আমরা থাকব। সেখানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক, অথবা কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা হবে, সাম্যবাদের জয়গান চলবে, সমাজতন্ত্রে ছায়ায় আমরা বাঙালি মানুষের মতো বেঁচে থাকতে পারব এক জীবন। আবার এতেও সেই একই হাল হবে কিনা বাংলার জানি না, তবু আশাবাদী আমি।ʼʼ

দোলন সাহেব অবাক হবার মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন, “তুমি কমিউনিস্ট, মুরসালীন?ʼʼ

-“না তো।ʼʼ

দোলন সাহেব হাসলেন, “তুমি কি খেলছো, মুরসালীন?আমি তোমাকে বুঝতে পারি না।ʼʼ

-“আমিও না, স্যার। শুধু এটুকু জানি, ক্ষমতার লোভে সাধারণ মানুষ, শিশু, নারী, নিরপরাধীদের ওপর অপবাদ এবং তার জের ধরে এই যে মৃত্যুদণ্ড, কারাবরণের হিড়িক চলছে, এটা আমি নিতে পারি না। আর তা অন্তত কমাতে আমি সব দলকে হাতের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। অথচ কারও প্রতিই আমার অনুরাগ নেই। কারণ আমি জানি, দেশের জন্য কেউ-ই উপকারী নয়।ʼʼ

ধীরে মাথা নাড়লেন দোলন সাহেব, “বুঝলাম, বামপন্থী রাজনীতিকেও সাপোর্ট করো, তুমি। তোমাকে যদি ফাঁসি দেয়া হয়, তো আসলে কোন অপরাধে দেয়া হবে? প্রত্যেকটা অপরাধে একটা করে ফাঁসির রায় শুনবে তুমি। কিন্তু জীবন তোমার একটা।ʼʼ

-“এই সৌভাগ্যকে আমি আমার জীবনে স্বাগত জানাই, স্যার। আমি নিজেকে এতদিন কিছুই মনে করতাম না। কিন্তু এখন যখন দেখছি আমার কার্যক্রম বর্তমান শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর পীড়ার কারণ হয়েছে, এবং মৃত্যুদণ্ডের মতো বীরত্বপূর্ণ দণ্ডের শাস্তির দিকে এগোচ্ছি আমি, এবার মনে হচ্ছে আমি সত্যিই কিছু করতে পেরেছি। কারণ এই দুনিয়ায় অধিকাংশ মৃত্যুদণ্ড বীরদের এবং কারাবরণ কথা বলা পাখিদের হয়েছে।ʼʼ

দোলন সাহেব কিছু বলতে নিলে জয় উনাকে থামালেন, “চুপ চুপ চুপ চুপ! চুপ থাকেন। ওই যে কিছু ফ্যান আছে না, সুইচ দিলেই ঘ্যারঘ্যারঘ্যার করতে করতে চালু হয়, আপনাদের এই ফ্যাকফ্যাকানি কানে ওইরকমভাবে ঢুকতেছে। এত রাতে আমি এইখানে আসতে বলিনাই আপনাদের।ʼʼ

বাপ্পী এগিয়ে এসে মুরসালীনের মুখের ক্ষতর ওপর আঙুল চেপে ধরে মুখ উচিয়ে ধরে বলে, “শুয়োরের বাচ্চা। বল, বল আমার দুলাভাইরে তুই মারিস নাই?ʼʼ

-“বেশ কয়েকটা ক্ষ্যাপা শুয়োর বধ করেছি। কাউকেই পার্সোনালি চিনি না। হতেই পারে তার মধ্যে আপনার দুলাভাই থাকতে পারে।ʼʼ

-“তোর অত কথা শুনবার চাই নাই। যেটুকু জিগাইছি, জবাব দে।ʼʼ

-“এরকম আপনার মতো আরও অনেকের চোখের বিষ আমি। স্বয়ং দলীয় নেতাদের অবধি। কত ক্ষ্যাপা শুয়োরদের বিরুদ্ধে বলেছি, কার্যক্রম চালিয়েছি, আর্টিক্যাল লিখেছি, ছাত্রদের উৎসাহিত করেছি, মিছিল, মিটিং কত কী! অত মনে নেই।ʼʼ

বাপ্পী পশুর মতো গর্জে উঠে এমদাদ ও তৌফিককে দুটো লাত্থি মারল। থেতলা হয়ে গেল তৌফিকের মুখের চোয়াল। এমদাদের কান দিয়ে পুঁজ বা রক্তের মতো তরল বেরিয়ে এলো।

জয় চুপচাপ দেখে সেসব। পিস্তলটা তার বাম পাশে মেঝেতে পড়ে আছে। তার পাশে অন্তূ আব্দুল আহাদকে ধরে বসে আছে। তার নারীসুলভ দুটো দূর্বল হাতে ওদের রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা।

বাপ্পী মুরসালীনের মাথাটা সজোরে দেয়ালের সাথে বাড়ি মারে। মাথার ওপরের চটা ফেটে রক্ত চুইয়ে পড়ল। মুরসালীন অজ্ঞান হলো না ঠিকই, কিন্তু অচেতনের মতো পড়ে রইল।

অন্তূর হাতটা নিষপিষ করে ওঠে। চোখ বুজে ফেলে সে। তার দেহে এক ধরণের শিহরণ জাগছে। কীসব অদম্য ইচ্ছারা জাগছে।

জয় একটা লোহার খণ্ডের ওপর বসা ছিল। কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা বাপ্পীর পা বরাবর একটা লাত্থি মারল। বাপ্পী ধুপ করে মেঝের ওপর উল্টে পড়ে যায়, নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো, কনুই ছিঁলে গেল।

জয় মুরসালীনকে জিজ্ঞেস করে, “জিন্নাহ কি বেঁচে আছে মুরসালীন?ʼʼ

মুরসালীন জবাব দেয় না। বাপ্পী উঠে এসে আবারও মুরসালীনকে ধরে, জয়ের দিকে রক্তচোখে তাকিয়ে বলে, -“তুই কী করতেছিস? এইরকম মাগী মার্কা প্রশ্নে এই খানকির বাচ্চার মুখ খুলান যাইবো? লাগাইতে অইবো না? কুত্তাচোদাডারে মাইরা ফেলিস নাই ক্যাই আইজ পন্তক? আর তোরে আমি পরে দেখুমনে।ʼʼ

কামরুল টেনে হিঁচড়ে মুরসালীনের পাশ থেকে দুটো বাচ্চাকে উঠিয়ে নিলো। আদিম উল্লাসে মেতে উঠল ওরা জীবিত ছোট ছোট দেহগুলো নিয়ে। উদ্দেশ্য মুরসালীনকে উত্তেজিত এবং দূর্বল করা। মুরসালীন নিজের শরীরের ব্যথায় আরও শক্তিশালী হয়। কিন্তু বাচ্চদের আঘাতে ওকে অস্থির দেখা যায়।

জয় জিজ্ঞেস করে, “জিন্নাহকে কোথায় রেখেছিস তোরা? তোদের সংগঠনের আর সব কোথায়?ʼʼ

তার কণ্ঠস্বর শান্ত। কোনো তাড়া নেই, উত্তেজনা নেই। অন্তূর মনে হলো, সে নরকের কোনো এক বিভাগে বন্দিনী। মৃদু হলদেটে আলোয়, গুমটে গন্ধে এক নারকীয় অবস্থানে বসে থেকে অন্তূর ভেতরটা কেমন উল্টে-পাল্টে উঠছিল। তার মনে হচ্ছিল সে নিজের ভেতর থেকে হারাচ্ছে।

মুরসালীন বলে, “জিন্নাহকে ফেরত দেব, তার বদলে আমায় কী দিবি?ʼʼ

-“আগে ফেরত পাই সহি-সালামত! তারপর যদি মনে কয়, তো কিছু প্রতিদান পাবি। না দিলেও ঋণ নাই। ঋণ আছে তোর আমার কাছে। পুরানা ঋণ। যা তোরে আশিবার খুন করলেও পরিশোধ হবে না। কিন্তু খুন একবারই করতে পারব। অর্থাৎ তোর কাছে আমারই আরও ঊনআশিবার পাওনা থাকবে।ʼʼ

রক্তাক্ত মুখে হাসে মুরসালীন, “মঞ্জুর। যাইহোক, জিন্নাহকে ফেরত দিলে তুই ওদের ছেড়ে দিবি। এই কথায় একটা সওদা করতে পারি।

-“এরম কোনো প্রস্তাব দিছি আমি তোরে?ʼʼ

-“কেউ একটা দিলেই হয়। আমি দিলাম। আর তুই যা শোধের কথা বলছিস না? আমার ক্ষতির পরিমাপ করলে তোকে আশি দুই গুণো একশো ষাটবার খুন করলেও ঋণ থেকে যাবে। অথচ তোর জান একটাই। আমি বলব, তুই হিসেবে কাঁচা, চোখে অন্ধ আর বোঝার ভুলে ডুবে মরা মৃতদেহ।ʼʼ

-“ভুল বোঝার মধ্যে একটা আনন্দ আছে।ʼʼ

-“রাখ তোর পাগলের প্রলাপ।ʼʼ

-“জিন্নাহ কোথায় আছে?ʼʼ

মুরসালীন জবাব দিলো না।

জয় ধৈর্যহারা হয়ে উঠছিল। গাঢ় শ্বাস ফেলে বলল, “দুই-আড়াই বছর ধরে ধৈর্য ধরতেছি, মুরসালীন। আমার ধৈর্য ধরার রেকর্ডে এইটাই সবচাইতে দীর্ঘ। একটু কদর কর। খালি ক, জিন্নাহ কি বেঁচে আছে?ʼʼ

-“বেঁচে যদি না থাকে, তাহলে কী?

জয় হাসল, “তয় আর সময় অপচয় করবাম ক্যালা? অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আমি শয়তানের সম্বন্ধি। সময় কাজে লাগাই।ʼʼ

মুরসালীনের অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত, সে গম্ভীর মুখে বলে, “আর ও যদি বেঁচে থাকে এবং ওকে যদি ফেরত দেই। তুই ওদের মুক্ত করাতে পারবি হামজা ভাইয়ের হাত থেকে?ʼʼ

মুরসালীনের পায়ের ক্ষততে ডান পা চেপে ধরল জয়। চামড়ার স্যান্ডেলের শক্ত নিচের তলার আঘাতে ক্ষত থেতলে উঠল। জয় অধৈর্য গলায় বলে, “যদি বেঁচে থাকে? না নাহ না! যদি না। ক, বাঁইচে আছে কি-নাই! এইটা আগে কনফার্ম হই! মরে গেলে এত নাটক মারাবো কোন দুঃখে? গলির মাথায় চাইপা ধইরা পাগলে চোদে নাই আমারে। জীবিত আছে না মেরে দিছিস, ওইডাই জানতে চাইতেছি খালি।ʼʼ

আবার জয় দ্রুত মাথা নাড়ল দু’দিকে, “তো চল। তোর কথাই রইল।ʼʼ নিজেকে বলে জয়, “সেকরিফাইজ, জয় সেকরিফাইজ! তুই না ভালো লোক।ʼʼ

মুরসালীনকে বলে, “জিন্নাহ বেঁচে থাকলে ওর বদলে তোর এই ছানাপোনাদের আজাদ করে দেব, যাহ! তোহ, জিন্নাহ বেঁচে আছে তো, না?ʼʼ

-“নেই।ʼʼ

জয় বাচ্চাদের মতো ভ্রু কুঁচকে তাকাল, ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “নেই? বলিস কী রে? পরিশ্রম করলাম যে এত্ত! যাঌ, ভোদাই সেজে গেলাম রে আগেই না জিগাইয়া!ʼʼ

হতাশ শ্বাস ফেলল সে। মুরসালীন আর কিচ্ছু বলার সুযোগ পেল না।

কামরুল ও রবিউল জয়ের কাছে দুজন পূর্ণ মনোনয়ন পেয়ে গেছে, যেন এবার। এমদাদের অর্ধ-অচেতন দেহটাকে লাত্থিতে ভরিয়ে তুলল। জয় লৌহখণ্ডের ওপর বসে ঝুঁকে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ।

কামরুলের হাতে বাচ্চারা ছিল কয়েকটা। ওদের গাল চেপে ধরল। শব্দ করে কেঁদে উঠল ছোট ছোট প্রাণগুলো। খালিপেট, পিপাসার্ত গলার কান্না গায়ে কাঁটা দেয় বড়।

দোলন সাহেব একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন শুধু জয়ের দিকে। মুরসালীনের দাঁত ভেঙে গেছে। ঠোঁটের কিনারা দিয়ে মাড়ি থেকে বেরোনো রক্ত ভেসে আসছে।

কামরুল এক বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো মেঝের ওপর। বয়স সাত-আট বছর হবে বোধহয়! ওইটুকু বাচ্চার ওপর কামরুলের বড় ক্ষোভ। ওরা রাজাকারদের উত্তরসূরী। বড় হয়ে সরকারবিরোধী হবে। ধর্মের কথা বলে। কামরুলের শান্তি হতো–ওদের টেনে টেনে ছিঁড়তে পারলে। তাতেও যদি মুরসালীন, এমদাদ, তৌফিক ওদের একটু যন্ত্রণা হয়!

বাচ্চাটার পড়ে গিয়ে ঠোঁট কাটলো, মুখের চামড়া ছিঁলে গেল। হাঁটুতে আঘাত পাওয়ায় উঠতে পারছিল না। হাঁটু চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। অথচ আশ্চর্য, সেই কান্নার আওয়াজ নেই। আওয়াজ করে কাঁদছে না ভয়ে সে। মুখে-চোখে কাতর যন্ত্রণা, কিন্তু কান্নায় আওয়াজ নেই।

অন্তূ চুপচাপ দেখে সেসব। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকায়। তার হাতের মুঠোয় আব্দুল আহাদের জীর্ণ হাত। হাতদুটো কাঁপছে, অন্তূ টের পায়।

কামরুল হাতে বাচ্চাটিকে দুটো কঠিন থাপ্পর মারল। কচি মুখের চামড়ার নিচে রক্ত জমে যায়। মুরসালীন চোখ বুজে মুখ ফেরায়। কামরুলের খুব আনন্দ হয় এবার।

কিন্তু কামরুল এবার বিশাল ভুল করে ফেলল একটা।ওদের মাথা থেকে সাদা পাঁচকলির টুপিগুলো খুলে ছুঁড়ে মারল দূরে। অন্তূ দেখল। দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলো ভেতরে

পকেট থেকে ছোট্ট একটা ছুরি করে রবিউল কামরুলের হাতে দেয়। দাঁত বের করে হাসে। দাঁতগুলো লাল, কালশিটে ধরণের স্পট পড়ে গেছে।

কামরুল খুব মজা পাচ্ছ। বাজারে গেলে বাচ্চারা খেলনার আবদার করলে, মা যখন খেলনা কিনে হাতে দেয়, সেইসময় বাচ্চাদের মুখে খেলনা পাবার তৃপ্তিখানা কামরুলের মুখে। এতকিছুর পরেও মুরসালীনের চুপ থাকাটাকে নির্লিপ্ততা মনে হচ্ছে। যা খুবই হতাশাজনক। কামরুলের উচিত এমন কিছু করা, যাতে মুরসালীনের চোখে-মুখে কাকুতি ফুটে ওঠে।

সে ছুরিখানা বাচ্চাটার গলায় ঠেকিয়ে চারদিকে সবার দিকে তাকিয়ে হাসল। উপস্থিত সব বাচ্চার মুখে এক করুণ আতঙ্ক দেখা দিলো। এটা খুবই মজার বিষয়। যেন তাকে অনুষ্ঠানে গান গাইতে বলা হয়েছে। মাইক হাতে সে একটু লজ্জা পাচ্ছে, সবার আরেকটু উৎসাহ চাচ্ছে। সবার মুখে সেই সুখ, শুধু দোলন সাহেব তখনও জয় আর মুরসালীনকে দেখছেন।

মুরসালীনকে ডাকে কামরুল, “ওই চেংরা! দেখ তো রে, আয় বাঁচায়ে নিয়া যা। মাগীর পুত, এইরম বন্দি থাইকাও ব্যবসা কইরবার চাও? এই জঙ্গিগুলানরে ছাইড়া দিলে আমাগোরে লোক ছাড়বা? ল, মুক্ত কইরা দিই তোর পাখিগুলারে।ʼʼ

এক ঝটকায় জয়ের পাশ থেকে পিস্তল তুলে নেয় অন্তূ। তাক করে ধরে কামরুলের দিকে। জয় চমকে তাকায়। সে অন্যমনস্ক ছিল।

অন্তূর চোখের মণি জ্বলছে। ধিকধিক করে জ্বলছে। বুকের ওঠানামা প্রবল। অন্তূ ট্রেগারে আঙুল রেখে কেমন মন্ত্রপুতের মতো গলায় বলে, “ছেড়ে দে। ছাড, ছাড়। তোর ছুরির চেয়ে পিস্তলের গুলি দ্রুত চলবে। আল্লাহর কসম এখানে চারটা লাশ ফেলব আমি। ছেড়ে দে ওকে।ʼʼ

জয় অন্তূর সামনে দাড়ায়, “ঘরওয়ালি! মাথা ঠান্ডা করো। অল ইজ ওয়েল। রিল্যাক্স, কিচ্ছু হয় নাই। মজার খেলা হচ্ছে, দেখো, এনজয় করো। আবার এইসব ডেঞ্জারাস চিন্তাভাবনা ক্যান?ʼʼ

অন্তূ জয়ের নাগাল পেরিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়, পাগলের মতো দাঁতে দাঁত আঁটকে হিষ হিষ করে ওঠে, “জানোয়ারের বাচ্চা! তুই সরে যা সামনে থেকে। নয়ত আজ তোর বুকটা আগে ঝাঁজরা করে তারপর বাকি বুলেটগুলো ওদের জন্য খরচ করব।ʼʼ

অন্তূকে ক্ষ্যাপাটে বাঘিনীর মতো লাগছিল। অনেকটা মানসিক বিকারগ্রস্থ পাগলিনীর মতো। সাপের মতো হিষহিষ করে, বিক্ষিপ্ত নিঃশাসে বুক দুলছে।

জয় একটু থমকায়, ভ্রু কুঁচকায়, তবুও এই অবস্থায়ও হেসে ওঠে, “কিন্তু তোর তো হাত কাঁচা, শালির মেয়ে। গুলি জীবনেও নিশানায় লাগবে না, বড়জোর অ-জায়গায় লেগে আমার সবর্নাশ হবার চান্স আছে। আর নয়ত গোডাউনের ক্ষতি হবে। পিস্তল দে। আমার হাতে পিস্তল। খালি খালি মানুষ মেরে কী লাভ? তার চেয়ে বড় কথা, পিস্তলে তো বুলেট নাই।ʼʼ

অন্তূ কী করল! এক মুহুর্তের মাঝে পিস্তলের তাক ডানদিকে ঘুরিয়ে ঠিক দেয়াল বরাবর শ্যুট করল। পিচ্ছ্ করে একটা শব্দ হয়, সাইলেন্সরের বদৌলত। গুলি ছুটে গিয়ে ইটের গাঁথুনিতে ঠুকল। অন্তূ চরম এক ধাক্কা খায়। পিস্তলের পেছনের বেগের টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাবার মতো অবস্থা হয়। হাতটা ঝিনঝিন করছে তখনও। রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেছে যেন।

অন্তূ জয়ের দিকে তাকায়, “বুলেটহীন পিস্তল নিয়ে এখানে আসেননি আপনি।ʼʼ

গোটা ঘর নিস্তব্ধ। কেউ নিঃশ্বাসও ফেলছে না। সবার চোখ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার জো। অন্তূর বিদ্রোহী শ্বাসের আওয়াজ কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে বদ্ধঘরে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ঘটনাটা ঘটে গেল।

কামরুল ছুরিটা ভালোভাবে বাচ্চাটার গলায় ধরে সতর্ক করে অন্তূকে, “এই এই আপনে পিস্তল নামান। নইলে এক মুহুর্তের মইধ্যে গলাডা দুইভাগ কইরালামু, কইলাম। আর লাভ অইবো না। পিস্তল নামান, ছাইড়া দিতাছি।ʼʼ

-“প্রথমত তুই মরবি তো এমনিতেও, আর এই পিস্তলের গুলিতেই। দ্বিতীয়ত, তোর ছুরির চেয়ে আমার পিস্তলের গুলি দ্রুত চলবে। আর শুয়োরের বাচ্চা, তৃতীয়ত, যদি ওকে মারিসও, তার পরের মুহুর্তে হলেও তুইও মরবি। লাভ কী? ছেড়ে দে ওকে। ছাড়!ʼʼ

গোটা ঘরে প্রতিধ্বনিত হয় অন্তূর ‘ছাড়ʼ কথার গর্জনটা।জয় চুপচাপ তাকিয়ে দেখে এই অন্তূকে। মাথার ওড়না পড়ে গেছে, খেয়াল নেই। চুলের বড় খোঁপাটা অগোছালো। জয়ের যেন ভেতরে অস্বস্তি হয়। একসময় যে মেয়েটার মুখ দেখেনি কেউ কখনও, তাকে সে কোথায় নামিয়ে এনেছে! অন্তূর শরীর ঘেমে গেছে, চোখদুটো লাল। নাকের পাটা শক্ত। জয় অপেক্ষা করে অঘটনের। এইটুকুই বাকি ছিল–অস্ত্র হাতে ওঠেনি আজকের আগে অন্তূর হাতে। আজ সেটুকুও হয়ে গেল। বাকিটা সে জানে অন্তূকে।

আজ জয় ভাবে এক মুহুর্ত। সেদিন অন্তূ পলাশকে মারতে ছুরি হাতে নিতে পারেনি। পিছিয়ে এসে জয়কে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কেন? সেদিন পেছনে এবং সাথে, পক্ষে দাঁড়ানো জয় ছিল, তাই? আপাতপক্ষে আজ জয় নেই তার সাথে। আজ সে একা। এই অবরুদ্ধ এক নিশীথে বড়ঘরে তার পক্ষে কেউ নেই, তাই কি সে একাই মোকাবেলা করতে যথেষ্ট, সচেষ্ট? তাহলে হিসেবটা কী দাঁড়াল? হামজা কি ঠিকই বলে?

নারী কারও অবলম্বনে যেমন দূর্বল, তেমনই একবার কেবল সে সেই অবলম্বিত খুঁটিহীন হয়ে পড়লে একাই সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্বক! তাহলে কি নারীর তৈরি অনিষ্ট সঙ্গহীন নারী থেকেই সৃষ্টি হয়? নারী তার পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গ পেলে ভীষণ নারীসুলভ, একা হয়ে পড়লে অসীম সর্বনাশা!

কামরুলের মুখ শুকিয়ে যায়। বাচ্চাটাকে ছাড়তে চাইলেও ছাড়তে পারে না। কেউ অন্তূকে গিয়ে ধরতেও পারে না।মাঝখানে জয় আমির দাঁড়িয়ে।

কামরুলের মনে হয় ছেলেটাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে জয় আমিরের বউ তাকে গুলি করবে না। এই আশায় কামরুল একটা ভুল করল— সে ছুরিটাকে শক্ত করে চাপল বাচ্চার গলায়। কচি চামড়ায় চিড় লাগে ছুরির ধারের। বাচ্চাটা কেমন করুণ সুরে মিনতি করে কেঁদে ওঠে হু হু করে।

আবারও ভোঁতা গুলি চলার আওয়াজ। গুলিটা লাগে না কামরুলের গায়ে। ডান হাতের বাহুর আড়াই ইঞ্চি ফাঁক গলিয়ে পেছনে এক লৌহখণ্ডে ঠেকে। কিন্তু পরমুহুর্তেই আবারও। কামরুলের নসিব খারাপ। তার মস্তিষ্ক তাকে সরে যাবার নির্দেশ দেবার আগেই পরের গুলিটা তার বক্ষপিঞ্জরের নিচে একদম কিনারায় লাগল। অন্তূর হাত খুবই কাঁচা। আর দুই ইঞ্চি হলেই এটাও মিস যেত। গেল না।

কামরুল ধপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। কিছুক্ষণ জ্ঞানও রইল। রক্তের ঝিরঝিরে স্রোত নামলো মেঝেতে। গলাকাটা মুরগীর মতো ছটফট করল কিছুক্ষণ দেহটা। আর বেশিক্ষণ চেতনা রাখতে পারল না কামরুলর দেহ।

পরের দেহটা রবিউলের। আলগোছে পড়ে গেল। বিকট আওয়াজ বের হলো মুখ দিয়ে। তারপর আরেকটা গুলি চলল। সেটা শূন্যে লাগল। কিন্ত পরের গুলিটা বাপ্পী মণ্ডলের ঠ্যাঙ ফুঁড়ে চলে যায়। বাপ্পী গা শিউরে ওঠা স্বরে কোঁকিয়ে উঠে বসে পড়ে। ঠ্যাংয়ের হাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে বুলেট এপার-ওপার হয়ে। ফাঁক হয়ে গেছে হাড়ের জোড়াইতে। তার আর্তনাদ কঠিন হলো। কানে সহ্য করা যাচ্ছিল না।

অন্তূর হাত অবশ হয়ে আসে। পিস্তলটা পড়ে যায় হাত থেকে। হাতে আর জোর নেই, হাত নাড়ানোর শক্তি নেই। স্নায়ু কাজ করছে না দুই হাতের। ঘরটা নিস্তব্ধ। তিনটা দেহ লুটিয়ে আছে মেঝেতে। বাপ্পী তখনও চেতনায় আছে, করুণ আর্তনাদে ঘরটা নরকের কক্ষ হয়ে উঠল। দোলন সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন। খুবই নাটকীয় দৃশ্য, ট্র্যাজেডি নাটক যেন। অথচ লোকে জানে না জীবনের চেয়ে বেশি নাটকীয়তা নাটকে থাকে না।

জয় আস্তে কোরে বসে আবার লোহার খণ্ডের ওপর। মুরসালীন চোখ বুজে হেলান দেয় দেয়ালের সাথে। তার শরীর ঝিমিয়ে আসছে। জয়কেও দেখতে ক্লান্ত লাগে। খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে ঝিম ধরে সে।

চলবে…

[ছয়দিন পর লিখতে বসেছি। এক ঘন্টার মধ্যে লেখা শেষ করেছি। ভুলত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। আমার এই জঘন্য রাইটিং ব্লক আর ব্যস্ততা জীবনে কাটলে তবে পরবর্তিতে চলমান লিখব, অথবা না। বাকিটা মাথায় গিজগিজ করে, লেখার জন্য হাত কাঁদে, কিন্তু লিখতে পারি না। মনে হয় আমি যেভাবে সাজিয়ে ছিলাম অবরুদ্ধ নিশীথকে, এই রাইটিং ব্লকের অভিশাপে সেভাবে আর লেখা হবে না। মনমতো শব্দ সাজাতে পারব না। শুধু কাহিনিটুকুই কোনোমতো লিখে যাব। এই কঠিন যন্ত্রণা আর ভাল্লাগে,না। মাথা ফেটে যায়।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here