#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬৮. (প্রথমাংশ)
○
চারদিন টানা বৃষ্টি। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। পথঘাট কাঁদায় মাখা। করতোয়া নদীর পানি উঠে এসে দিনাজপুরে বন্যা আসবে এবার বুঝি! দেশের দুর্যোগের সাথে প্রকৃতির দুর্যোগ যোগ হলে জমে যাবে দুর্যোগের খেলাটা।
বৃষ্টির ছিটা আসছে। মুর্শিদা আটা মাখা হাতে জানালাটা আঁটকে দিলেন। জয়নব লাফিয়ে উঠল, “আম্মা এইরকম কইরো না তো। বইয়ের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছি, এই সময়ই জানালা আটকাইতে হইলো তোমার?ʼʼ
-“চুপ্প! থাপড়াইয়ে দাঁত ফেলে দেব। ধিঙি মেয়ে। এই তোর বুদ্ধিসুদ্ধি হবি না?ʼʼ
-“বুদ্ধি তো আছেই আমার।ʼʼ
-“বুদ্ধির চোটে আমার ঘরবাড়ি ভরে আছে। মুখে মুখে তর্ক? আটা হাতে করে জানালা আটকাইতে আইছি, আর তুমি এইখানে বসে থাকার পরেও হুশ হয় না? বইয়ে কী পড়িস সারাদিন? দ্যাশ জাহান্নাম হয়ে গেছে, আর… তুই বইয়ে কি দেখিস?ʼʼ
জয়নব উঠে বসল। আর তর্ক করল না। মেঘের জন্য দুপুরটাকে বিকেলের মতো লাগছে। জানালা আটকে দেওয়ায় ঘর পুরো অন্ধকার হয়ে গেল।
তার শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু বাজারের সব দোকান ছাই হয়ে গেছে। মানুষের পেটে ভাত নেই, শাড়ি কী জিনিস!
আপাতত বইটা রেখে দিলো। আম্মা গেলে আবার নিয়ে বসা যাবে। কিন্তু মুর্শিদা গেলেন না। উনি বসলেন জয়নবের পাশে। মেয়ের চুল খুলে এলিয়ে দিলেন পিঠে।
-“আম্মা তোমার হাতে আটা। আটা লাগাইয়ো না চুলে।ʼʼ
-“শুকায়ে গেছে আটা। চুলে লাগবে নাকি?ʼʼ
বিলি কেটে দিতে লাগলেন চুলে। জয়নব ঘাঁড় পেছনে হেলিয়ে বসে রইল। বিশাল বিশাল চুল তার। নারকেলের তেল প্রায় আধপোয়া করে একেবারেই লাগে তার চুলে। জয়নবের বয়স এখন আঠারো। তার আকদ হয়ে আছে দুই বছর হলো। কিন্তু এই নারকীয় পরিস্থিতিতে জলিল আমির অনুষ্ঠান সারতে পারছিলেন না। আমির বাড়ির মেয়ের বিয়ে পানসে ভাবে দেয়া যায় না। গাঁয়ের লোক ওই দুটো দিন আমির বাড়িতে পেট ভরে খাবার হকদার।
জাভেদ জয়নবের এক বছরের ছোট। জামিল আর জয়নাল জমজ। তাদের ছোট জেবা। তার বয়স তেরো। সব পিঠাপিঠি। জামিল ঘুমাচ্ছে এই অসময়। জেবাও গিয়ে মেজো ভাইয়ের পাশে শুয়ে পড়েছে। সারারাত চিন্তায় ঘুম আসার জো নেই।
মুর্শিদা কেমন উদাস স্বরে বললেন, “আমাদের মনেহয় আমির নিবাস ছেড়ে দেওয়া লাগবে রে, জয়নব!ʼʼ
জয়নব একবার তাকায় মায়ের দিকে। এরপর ঘরে বাঁধানো পঞ্জিকার দিকে তাকায়। আজ বঙ্গাব্দ ১৩৭৮ এর বৈশাখের ১৩ তারিখ। খ্রিস্টাব্দ ১৯৭১ এর ২৬-ই এপ্রিল।
-“জাভেদরে ক্যান পাঠাইলা, আম্মা? আব্বা তো বলছিল, সুযোগ পাইলে নিজেই আসবে দেখা করতে।ʼʼ
ধুক করে উঠল মুর্শিদার বুকটা। তিনি ভুলে থাকতে চাইছেন সব। বললেন, “বলবি না তোর বাপের কথা। মরণের পথে ভাসায়ে রেখে উনি গেছেন যুদ্ধ করতে।ʼʼ
সন্ধ্যার পর জয়নাল এলো ভিজতে ভিজতে, “আম্মা। কিছু খাবার-দাবার আছে নাকি?ʼʼ
তার সাথে তিনজন জোয়ান জোয়ান ব্যাটাছেলে। মুর্শিদা আৎকে উঠে শুধান, “এরা কারা রে, জয়নাল? ক্যান আনছিস বাসায় তুলে? তুই কি পাগল হইছিস? ক্যান আসছে ওরা?ʼʼ
-“আম্মা, বিপ্লবী ওরা, বিপ্লবী। আমারে বলছে, বন্দুক চালাইতে দিবে, শেখাবে। কিন্তু ওরা কয়দিন কিছু খায় নাই। বন্দুক চালাইতে ম্যালা শক্তি লাগে, আম্মা। আগে সবাইরে কিছু খাইতে দ্যান।ʼʼ
মুর্শিদা কান মলে ধরলেন জয়নালের, “জানোয়ার। বন্দুক চালানো শিখে কী করবি? তোর বাপ-চাচারা ওইসব জানে, আজ আমারে সবাইরে বাণের জলের ভাসায়ে গেছে মিলিটারি মারতে, তোর বড় ভাই গেছে, আবার তুই..ʼʼ
-“আম্মা ছাড়েন ছাড়েন। ও আম্মা, শোনেন না!ʼʼ উত্তেজনায় জয়নালের গলা ধরে এলো, “ওরা বলতেছে আব্বা আর ভাইরে নাকি আটকায়ে রাখছে শয়তানরা। এরা আমারে সাহায্য করবে দূইজনরে ছাড়ায়ে আনতে। আম্মা, আব্বারে ছাড়ায়ে আনতে আমারে বন্দুক চালানো শেখাই লাগবে। দ্যান খাইতে। জলদি দ্যান। উত্তেজনায় কথা জড়াচ্ছিল জয়নালের।ʼʼ
মুর্শিদার হাত-পা কাঁপতে লাগল। তিনি হায় হায় করা শুরু করলেন। তার শরীর অবশ লাগছে। যে ভয় তিনি পাচ্ছিলেন, তা ঘটে গেছে। বন্দি হয়ে গেছে তার স্বামী ছেলে।
জয়নব জেবাকে ডেকে তুলল। জেবা হুড়মুড়িয়ে উঠে বলে, “কী হইছে আপা? কী হইছে? মিলিটারি আসছে? আগুন দিছে বাড়িতে?ʼʼ
“চুপ। চুপ কর। এই নে তোয়ালে। দৌড়ে গিয়ে তোর খালেদ ভাইরে ডেকে আনবি।ʼʼ
ঠোঁট চেপে হেসে উঠল জেবা, “ক্যান আপা? খালেদ ভাইরে খুব দেখতে মন চাইতেছে নাকি?ʼʼ
-“এক চড় মারব, বেয়াদব। যা বলছি কর।ʼʼ
জেবা তোয়ালে মাথায় দিয়ে সদর দরজার বারান্দায় উঠল। হ্যারিকেনের আলো ধরল জয়নব, “জলদি যা না রে।ʼʼ
-“যাচ্ছি যাচ্ছি। এত জলদি কী? না দেখে থাকতে পারো না?ʼʼ
-“খুব পেকেছিস? এমন মারব না!ʼʼ
একবার পেছন ফিরে দুষ্টু হাসে জেবা বোনের দিকে চেয়ে। সন্ধ্যার আঁধারে বেরিয়ে যায় বৃষ্টির ভেতর হবু দুলাভাইকে ডাকতে। আংটি বদল হয়ে আছে জয়নব আপার খালেদ ভাইয়ের সাথে। খালেদ ভাইটা খুব ভালো।
মুর্শিদার হাত চলছে না। তিনি জয়নবকে বললেন, “তোর ছোট চাচি আর দাদিরে ডাক তো। আমার কেমন ভয় ভয় করতেছে। ওই লোকগুলারে খাইতে দিক ওরা এসে।ʼʼ
লোকগুলোকে জয়নব খেতে দিলো। লজ্জায় হাত পা ভেঙে আসছে তার। ভয়ও করছে। জেবা নিশ্চয়ই গিয়ে গল্প জুড়েছে খালেদের বোনের সাথে। জয়নব ভেবে রাখল, ফিরলে পিঠের ওপর দুম দুম করে দুটো কিল বসাবে।
তিনজন খেলো। এরপর জয়নালকে নিয়ে চলে গেল জলিল আমির ও জাভেদের খোঁজে। বাপ-ভাইকে আঁটকে রাখা হয়েছে। নিশ্চয়ই অত্যাচার করা হচ্ছে! জয়নালের শরীরের রক্ত টগবগ করছে। জাভেদ ভাই আর আব্বার গায়ের সবটুকু যন্ত্রণা সে ওই জানোয়ার মিলিটারিদের দেবে। পণ করল মনে মনে। ওদের হাড্ডি ভেঙে এনে আমির বাড়ির ফটকে ঝোলাবে সে।
যাবার আগে একবার দৌড়ে জয়নবের কাছে এলো, “আপা, আমি যাচ্ছি। রামদা-টা বের করে দে তো। জলদি দে।ʼʼ
জয়নব অসহায়ের মতো বলে, “তুই-ও যাচ্ছিস? বাড়িতে কে থাকবে রে?ʼʼ
জয়নালের চোখে অগ্নিঝরা উত্তেজনা, সে বলল, “খালেদ ভাই আসতেছে তো। শোন আপা, পিছু পিছু আয়। ফটক আটকে যা। কণ্ঠ না চিনলে খুলবি না। বাড়িতে আগুন লাগানোর ভয় দেখাইলেও না, খবরদার। আব্বা, চাচারা বিপ্লব করছে। আমাদের বিপদ কিন্তু বেশি। আব্বা, চাচার খোঁজে আসবে ওরা।ʼʼ
জয়নব একবার পিছু ডাকে। জয়নাল বিরক্ত হয়, “সময় আছে নাকি? আবার ডাকিস ক্যান? ফিরে আসতেছিই তো আমি।ʼʼ
ঝারি মারল, অথচ পারল না যেতে। আবার ফিরে আসলো, “কী হইছে?ʼʼ
জয়নব কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে জলন্ত চোখে, জয়নালের গালে হাত বোলায়, দৃঢ় স্বরে বলে, “আব্বা আর জাভেদরে না নিয়ে ফিরবি না। দরকার পড়লে ওই পশুগুলার বুক ঝাজরা করে ফেলবি। যা, জলদি যা জয়নাল। যদি তোর শরীরে আঘাত লাগে, তার দ্বিগুন দিয়ে আসবি। জয় বাংলা।ʼʼ
জয়নালের বুক ফুলে ওঠে, দৃঢ়তার হাসি হেসে বোনের দিকে চেয়ে হাত মুঠো করে ধরে মাথার ওপর তুলে বলে, “জয় বাংলা। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।ʼʼ
মুর্শিদাকে বলে, “আম্মা চিন্তা কইরো না। কোন শুয়োরের বাচ্চা আব্বারে ধরছে, দেখব আমি। আমি আব্বা আর ভাইরে না নিয়ে ফিরব না। ইনশাআল্লাহ।ʼʼ
মুর্শিদা কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, “আমার বুক খালি করিস না রে জয়নাল। আমি তোরে হাশরে বাঁধাবো বলে দিলাম। আমার জয়নালরে ফিরায়ে নিয়ে আসবি আমার কাছে, কথা দিয়ে যা।ʼʼ
লুঙ্গিতে কাছা মারতে মারতে অন্ধকারে বেরিয়ে যায় জয়নাল আমির অচেনা লোকগুলোর সাথে।
মাঝরাত হয়। খালেদ আসেনি। জেবাও ফেরেনি। জয়নাল অথবা জলিল আমির বা জাভেদ কেউ আসেনি। জয়নব নামাজ পড়ে আম্মার সাথে। দাদির ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে ছোটচাচির এই ঘরে আসার কথা। জামিল শুধু পায়চারী করছে। মুর্শিদা জোর করে জামিলকে তিনটে রুটি খেতে দিলেন। কোনোমতো ঠেকিয়ে রেখেছেন ওকে বাইরে যাওয়া থেকে। তারপর থেকে ফুঁসছে, ছটফট করছে ঘরের ভেতর।
গোটা পাড়া প্রায় খালি হয়ে গেছে। যে যার মতো নিরাপদের খোঁজে গেছে। খবর এসেছিল দিনাজপুরের এদিকে মিলিটারি হামলা হবে দু একদিনের মাঝেই।
শুনশান চারদিক। শুধু বৃষ্টির শব্দ। অবরুদ্ধ এক দুর্যোগের রাত। পৃথিবীর কোথাও যেন প্রাণ নেই, আলো নেই, আছে শুধু বর্বরদের ভারী বুটের গটগট আওয়াজ আর হাতের অস্ত্র থেকে ছুটে যাওয়া বুলেটের ঝংকারধ্বনি। ঝরছে রক্তের বৃষ্টি, লাল টকটকে বৃষ্টির পানির দানা ঝমঝম করে ঝরছে। সেই ঝমঝম রব ছাপিয়েও যেন কানে ছুটে আসে মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, গুলির আওয়াজ আর নিঃশব্দ নৃশংসতার ভোঁতা গোঙানি।
আমির নিবাসের ফটকে বিকট আওয়াজ হলো। ফটকটা কি কেউ ভেঙে ফেলল? মুর্শিদা কাঁদছেন। কিন্তু মুখটা শক্ত। সময় যত যাচ্ছে, বুকের উত্তাপ বাড়ছে। তার ছেলেরা কেন বাড়ি ফেরেনি। স্বামী কেন এসে দরজা খটখটায়নি? বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে।
জয়নব নিঃশ্বাস আঁটকে থাকল ক্ষণকাল। এরপর দৌড়ে বড় বারান্দা গলি পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। দুটো বটি আর লোহার শিক নিলো। ফিরতে গিয়ে আবার ঘুরে পাটার ওপর থেকে শিলটা নিয়ে ঘরে এলো। মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলো শিলটা। নিজের হাতে রাখল বটি, অপর হাতে শিক।
শব্দ শুনে জামিল খাওয়া ছেড়ে উঠে গেছে। এক দৌড়ে দোতলার সিড়ি ভেঙে উঠোনের কোণ থেকে শাবল তুলে নিলো সে। ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছেকিন্তু কেউ তো নেই! অন্ধকারে চোখ ঘোলা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝেমাঝে। জামিল ফটকের সামনের দিকে গেল। আমির নিবাসের লোহার ফটক গাছের গুড়ি দিয়ে ভাঙা হয়েছে। দু ভাগ হয়ে আছে দু’দিকে।
জয়নব দোতলার বারান্দায় দাঁড়ায়। অস্থির হাতে কোমড়ে শাড়ির আচল বাঁধে। জামিলকে দেখার চেষ্টা করে। খট করে আওয়াজ ভেসে এলো। জয়নব সতর্ক হয়। কিন্তু এরপর কিছুক্ষণ নিষ্ঠুর স্তব্ধতা। তা ভাঙল ছোটচাচির প্রকৃতি-চেড়া চিৎকার দিয়ে। জয়নবের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। এক দৌড়ে নিচে নেমে সদরঘরের বাইরে পা বাড়ায়। মুর্শিদা পিছু নিলেন।
ছোটচাচির ঘর সদর ঘরের পরে পাকা উঠান পেরিয়ে ছোট বাংলোতে। তার দরজা আটকানো। ছোটচাচি পাগলের মতো মিনতি করছেন কারও কাছে। দুটো থাপ্পরও খেলেন বোধহয়।
জামিল তখন বিশাল শাবল নিয়ে এসে দাঁড়াল। শরীরে যেন কিছু ভর করেছে তার। শাবলের কয়েক আঘাতে শাল কাঠের দরজা ভেঙে খণ্ড-খণ্ড হয়ে গেল। গা কেঁপে ওঠা দৃশ্য।
কিন্তু জয়নবের গা কাঁপল। পরমূহুর্তে পা তার পরপরই হাত চলল। ছোটচাচির শরীরের ওপর চেপে থাকা দুটো জানোয়ারকে জয়নব বটির দুই কোপ মারল। একজনের মাথা আলাদা হয়ে ঝুলে পড়ল ঘাঁড়ের সাথে, আরেকজনের কাধ থেকে ডান হাতটা আলাদা হয়ে গেল। ছোটচাচির নগ্ন শরীর। ব্লাউজের ছোট্ট এক টুকরো হাতার কাছে দেখা যাচ্ছে কেবল। পেটিকোটটা ছিড়ে খণ্ড খণ্ড। শরীরে আর কিছু নেই।
জামিল মুখে হাত চেপে নগ্ন চাচির ওপর থেকে নজর ফিরিয়ে শাবল শক্ত করে ধরে। পশু দুটোর ওপর শাবল চালায় দক্ষ হাতে। মাঠে মাটি কুপিয়ে অভ্যস্ত হাত জামিল আমিরের। মাটির মতোই যত্ন করে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে দেহদুটো।
মুর্শিদা ডুকরে উঠলেন। ছোটচাচির দুধের বাচ্চা মাসুমকে আঁছড়ে ফেলা হয়েছে। তখনই বোধহয় ছোটচাচি চিৎকারটা অত জোরে করেছেন, যে পুরো বাড়িতে আওয়াজ গেছে। মেঝেতে তার রক্তাক্ত দেহটা পড়ে আছে। জয়নব একটানে বিছানার চাদর তুলে ছোটচাচির শরীরের ওপর বিছিয়ে দেয়। চাচি বোধহয় জ্ঞান হারালেন। কিন্তু দাদি কই?
আর্তনাদের সময় পাওয়া গেল না। দোতলায় সারি সারি পায়ের আওয়াজ। ব্যাপারটার পরিস্কার হলো এবার। ফটক ভেঙে ঢুকে একদল ছোটচাচির কাছে এসেছে। আর পেছনের রাস্তা দিয়ে আরেক দল দোতলায় উঠে অন্দরে ঢুকে পড়েছে। কাউকে দোতলার অন্দরে না পেয়ে নেমে আসছে।
জামিল চিৎকার করে বলে, “আপা, আগে আসিস না। ওখানেই থাক।ʼʼ
মুর্শিদা ছোট জা-কে রেখে শাশুড়িকে খুঁজলেন। অন্ধকার। হারিকেনটা পড়ে ভেঙে গেছে।
ওরা মোট সাতজন। জামিল দুটোকে আঘাত করতে পারল। মরল না একটাও। এরপর তাকে ধরে ফেলা হলো। শাবলটা কেড়ে নেয়া হলো আগে। প্রথম ছুরির আঘাতটা জামিলের মেরুদণ্ডের ডান পাশে লাগল। জয়নব বটি নিয়ে এগিয়ে এসে কোপটা ঠিক ছুরিওয়ালার হাতের ওপর বসায়। হাতটা কেটে পড়ে গেল না। ঝুলে রইল চামড়ার সাথে।
এরপর! তিনজনের হাতে বন্দি হলো জয়নব। তার সামনে জামিলের দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করা হলো। মুর্শিদার তলপেটে একটা লাত্থি মারা হলে মুর্শিদা চিৎকার করে লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে।
জামিল শেষবার আম্মাকে ডাকল কয়েকবার। আম্মা হুশ হারিয়েছে। কাঁদার সুযোগটাও পেল না আম্মা জামিলের জন্য। জয়নব গলা চিড়ে কাঁদছিল। জামিল আর নড়ছে না। বৃষ্টির ছিটে আসা পানির সাথে ওর গরম রক্ত তিরতির করে ধুয়ে চলে যাচ্ছে। জামিল শুয়ে আছে।
দুজন জয়নবকে চেপে ধরে রাখল। দুজন উঠে গেল আবারও দোতলায়। জয়নব নিচে দাঁড়িয়ে শুনতে পায়, লোহার বাক্স ভাঙা হচ্ছে। লুটপাট হচ্ছে আমির নিবাস।
জয়নব তখনও একবার ফটকের পানে চায়। আব্বা আসবে না? জাভেদ কোথায়? বাঘটা এখন থাকলে কী করতো এদের? খালিদ এলো না। জয়নবের অভিমান হয়। লোকটার সাথে দেখা হলো না জয়নবের। জয়নব কি আর ফিরবে আমির নিবাসে? ফেরার কথা তো নেই! লোকটার সাথে দেখাই হলো না!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]