অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৭৪. (প্রথমাংশ)

0
2

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭৪. (প্রথমাংশ)

সেদিন রাত দেড়টার দিকে কামরুল মরে গেল। দোলন সাহেব ওদেরকে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। এমপির কানে তিনজনের অবস্থার খবর দেননি।

জয় ঘুমে অচেতন। তার ফোন বাজছে। অন্তূ দ্রুত ফোনটা সাইলেন্ট করল যাতে ঘুম না ভাঙে। আস্তে আস্তে জয়ের পাশ থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে কল রিসিভ করে চুপ করে রইল।

দোলন সাহেব ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, হারামজাদা! তোর বউ এবার তোর জানের কাল হবে। মরবি তুই। নিশ্চিত জেনে রাখ, ব্যাটা। আর তুই মরলে তোর খয়রাতে আমি চরাম চরাম করে ঢোল বাজাবো।

অন্তূ দোলন সাহেবের কণ্ঠ চিনে ধীর আওয়াজে সালাম দিলো, “আসসালামুআলাইকুম, স্যার।ʼʼ

-“ওও! মুসিবতের বেডি, তুমিই ধরছো কল! তোমার পতি কই?ʼʼ

-“কী হয়েছে, স্যার?ʼʼ

দোলন সাহেব দীর্ঘশ্বাস টেনে খুব রিল্যাক্সে বললেন, “কী হয়নি, তা জিজ্ঞেস করো। যা হয়েছে অত বলার এনার্জি নেই। সকালে কোর্ট আছে। এনার্জি লস করতে পারব না।ʼʼ

-“আমার আন্দাজ বলছে, ওদের তিনজনের কেউ একজন জাহান্নামে পৌঁছে গেছে।ʼʼ

দোলন সাহেব অন্তূর বিচক্ষণতার প্রশংসা ছেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “এবার একটু ভয় পাও, মেয়ে! পথ সহজ না। তুমি ওদের কাল হতে গিয়ে তোমার নিজের কাল হবে। তোমাকে বাচাবে কে?ʼʼ

-“আমি তো বলিনি সহজ, স্যার। শিকার করতে গেলে জঙ্গলের ডাল-পালায় চামড়া ছিলার ভয় পেলে চলে না। কখনও বা শিকারের বিষদাঁতও সহ্য করতে হয়। কিন্তু তা বলে তীরের তাক নড়চড় করতে নেই।ʼʼ

দোলন সাহেব বললেন, “তুমি কি দক্ষ শিকারী?ʼʼ

-“না স্যার। আমি শিকারী নই। আমি হলাম শিকার, পরে সুযোগসন্ধানী।ʼʼ

-“তোমার বলির পাঠা কই?ʼʼ

-“ঘুমাচ্ছে। আপনার কাছে দুটো কথা জানার ছিল।ʼʼ

-“আমার হাতে এখন একটা সিগারেট। যেটা শেষের দিকে। যতক্ষণ ওটা টানবো, ততক্ষণ তোমার কথা বলার সুযোগ পাবে। আর আমি তোমার কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নই। মনে রেখো।ʼʼ

অন্তূ মলিন হাসল। মাথা ঘুরে উঠল। বারান্দার মেঝেতে হেলান দিয়ে বসে অন্তূ বলে, “আপনি শুধু ওই বাচ্চাগুলোকে মুক্ত করতে আমায় একটু সহায়তা করবেন তো, স্যার?ʼʼ

-“ওই শুধু ওইটুকুই। বেশি আশা রেখো না যেন। জয় আমির অথবা হামজাকে আঘাত করতে তুমি আমার কাছে একটুও সাহায্য পাবে না। উল্টো বলি হতে পারো। কারণ আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী না।

-“মুরসালীনের মহানের সঙ্গে কথা হয়েছে তো আপনার?ʼʼ

-“জয় আজকাল ভুল বেশি করছে। আগে করতো না। সেদিন আমাকে মুরসালীনের কাছে একা ফেলে চলে এলো। আমি কি ওকে সতর্ক করব, তোমার থেকে দূরে থাকতে?ʼʼ

অন্তূ হাসল, “করতে পারেন। মানলে ওর ভালো। না মানলে কী আর করার! সেটার সম্ভাবনাই বেশি।ʼʼ

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দোলন সাহেব, “হুউ! যা করবে তাড়াতাড়ি। তোমার মরণের ঘন্টা বাজবে, আমি সেই অপেক্ষায়। যুবতী বয়সেই মরে যাবে তুমি, খুব আফসোসের ব্যাপার। যতদিন হামজা না ফিরছে মিথ্যা আমি বলব এমপির কাছে। তারপর?ʼʼ

জয় ঘুমের মাঝে কেশে উঠল। অন্তূ সজাগ হলো। কল কেটে ভাবীর নম্বর তুলে কল করল। কলটা রিসিভ করলেন রাবেয়া, নাক পরিষ্কার করে সালাম দিয়ে বললেন, “কে?ʼʼ

-“ঘুমাওনি?ʼʼ

-“অন্তূ?ʼʼ

-“ভালো আছো, আম্মু?ʼʼ

রাবেয়ার ভারী নিশ্বাস শোনা গেল। বেশ ক’টা মাস অন্তূকে দেখেননি। উপচে আসা কান্নাটা লুকিয়ে নিতে খুব বেগ পেতে হলো উনার। অন্তূ জানে, রাবেয়া জায়নামাজে বসা। তাহাজ্জুদের সালাম ফিরিয়ে চোখ মুছে কল রিসিভ করেছেন।

রাবেয়া কেমন করে যেন জিজ্ঞেস করলেন, “বেঁচে আছিস তো, অন্তূ?ʼʼ

অন্তূ হাসে। চোখজোড়া জ্বলে উঠল তার। জানালার গ্রিল ভেদ করে আকাশের দিকে তাকায়। অন্তূরা কাঁদে না। আমজাদ সাহেবের নিষেধ আছে। তাই অন্তূ নিজেকে সামলে জানায়, “আমি মরব না, আম্মু। আমি মরব না।ʼʼ

রাবেয়া কথা বলতে পারছিলেন না। কাঁদলে অন্তূ রেগে যেতে পারে। তাই কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে বললেন, “জয়ের কাছে ফোনটা ধরায়ে দে তো, অন্তূ। একটু কথা বলব।ʼʼ

-“কী কথা বলবে?ʼʼ

-“ওর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে। ওর সাহস কত হইছে রে? ওর না মা নাই! ওর কি কলজেও নাই? তোরে কেমন রাখছে, ওরে জিগাইতাম। ওরে বলতাম, তেইশ বছর আগে একটা মেয়ে জন্মাইছিলাম আমি। ওরে বলতাম, আমি একটা ছেলেও জন্মাইছিলাম। ওই দুইটার খোঁজ আছে ওর কাছে। একটু দে ওর কাছে।ʼʼ

অন্তূ ডাকে, “আম্মু?ʼʼ

রাবেয়া কথা বলতে পারলেন না। অন্তূও কিছু বলতে চেয়ে জিহ্বার আগা থেকে গিলে ফেলে। কথাটা আম্মুকে জানাতে তার ছটফটানি লেগে আসে। কিন্তু বলা হলো না। অন্তূ শক্ত করে ঢোক গিলে নিজেকে সামলায়, প্রসঙ্গ বদলায়, “ভাবীর এখন কী অবস্থা, আম্মু?ʼʼ

-“সামনের মাসের শেষের দিকে তারিখ দিছে ডাক্তার। তুই আসবি না, অন্তূ? দেখতে আসবি না?ʼʼ

অন্তূ নিশ্চুপ। আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি পড়ল কোলের ওপর। আস্তে কোরে বলল, “আসব, আম্মু। ভাবীর ডেলিভারী ডেইটের আগেই অসব। আমি না আসলে হয়?ʼʼ শেষে বিরবির করে অন্তূ, “বেঁচে থাকলে আসব আমি, আম্মু। বেঁচে থাকলে আসব।ʼʼ

রাবেয়া ডাকলেন, “অন্তূ!ʼʼ

অন্তূর বুকের ভেতর ধুক করে উঠল। এই ডাকটা সাধারণ ডাক ছিল না। মাতৃত্বের ডাক। এই ডাকে মায়েরা ছেলেদের কাছে নিজেকে তুলে ধরেন। রাবেয়ার তো ছেলেটা নেই। অন্তূ রাবেয়ার হাতদুটো ধরে বলেছিল শেষবার, ‘অন্তূ তাদেরকে সব ফিরিয়ে দেবে। ভবিষ্যতটা কাধে নেবে।ʼ সেই দাবীতেই রাবেয়া ডাকলেন আজ অন্তূকে।

-“তোর ভাবীর বাড়ির লোকজন আমার আর তোর ভাবীরে আর বইতে পারতেছে না, অন্তূ। আমি বাড়ি যাইতে চাইলে নিয়ে যাবি, অন্তূ? আমি আর এইখানে থাকব না। চোখ বুজলেই তোর আব্বু আসে। আমারে বাড়ি যাইতে বলে। তুই আমাকে নিয়ে যা, অন্তূ।ʼʼ

বড় অবুঝ আবদার রাবেয়ার! অন্তূ চোখের সামনে দেখল বেয়ান বাড়িতে সরল রাবেয়ার অবহেলিত জীবন“টা। ছেলে নেই, স্বামী নেই, ঘরদোর পরের। রাবেয়া মাসের পর দিন কাটাচ্ছে। এর দায় কার?

বাকি রাতটা বারান্দায় বসে আব্বুর সাথে কথা বলে কাটলো অন্তূর। ভোরের আলো আধো আধো ফোটার সময় রুমে ফিরল। তুলনামূলক ভালো লাগছে শরীর। গরমের ভোর।

জয় অভ্যাস হলো উপুড় হয়ে শোয়া। খালি পিঠটা দেখা যায়। তাতে ট্যাট্টুর মতো ছেপে আছে অসংখ্য এবরো-থেবরো দাগ। লুঙ্গিটা উঠে আছে হাঁটুরও অনেকটা ওপরে। কালো কুচকুচে পশমে ভরা ঠ্যাঙের ওপর এক দলা ধরা মাংস নেই। গর্তের মতো দেবে আছে লম্বা ক্ষত। বাহুতে দাগ। কোথাও বা মাংস ঠেলে উঠেছে ক্ষত ভরাট হয়ে। কোথাও কালশিটে পড়া খাবলা ধরা মারের ছাপ। দেখে মনে হয় এখনও রক্ত জমাটবদ্ধ হয়ে চামড়ার নিচে জমে আছে। যখন-তখন টিউমার ও ক্যান্সার হওয়াটাই স্বাভাবিক।

গোসল দিয়ে এসে অন্তূ নামাজে বসল। মোনাজাতে মালিকের কাছে হাত তুলতেই হু হু করে কেঁদে ফেলল আজ সে। সে বহুদিন রবের কাছে কাঁদেনি। নিজের কলঙ্কিত হাতদুটো রবের কাছে তুলে ধরতে অন্তূর বড় লজ্জা লাগছিল। এই হাতে সে প্রাণ নিয়েছে, যে হাতে সে আইনের কলম ধরতে চেয়েছিল। অপরাধীর শাস্তি দেবার হক কি অন্তূর আছে? সেটা কি খু”‘ন নয়? খুন কুফরী! আর কুফরীর গুনাহ্ কি আল্লাহ পাক ক্ষমা করবেন? তার আর জয়-হামজার মাঝে পার্থক্য রইল কি! জীবন তাকে কোন পথে পরিচালনা করছে!?

তুলি নামাজে বসেছিল। তরুর মৃত্যুর পর সে নিথর হয়ে গেছে। কোয়েলের সাথে আচরণ খারাপ হয়ে গেছে। রুম থেকে বের হয় না। অন্তূ প্রতিবেলা খাবার না দিয়ে গেলে না খেয়েই চলে। কোয়েলের যাবতীয় যত্ন রিমিই করে। রিমি কোয়েলের মা হয়ে গেছে।

অন্তূ গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল। তুলি সালাম ফিরিয়ে বলল, “তুমি গিয়ে আরাম করো’গে। রান্না আমি করে নেব আজ।ʼʼ

অন্তূ কিছুক্ষণ তুলির সুশ্রী মুখখানা দেখে বলল, “এভাবে কতদিন?ʼʼ

-‌‌“কীভাবে, আরমিণ? যার জীবনে আচমকা দুঃখ আসে, সে নাহয় আবার দুঃখ কাটিয়ে সুখ পাবার আশা রাখতে পারে। কিন্তু যার জন্মই দুঃখের খাতিরে সে কেন বৃথা আশা রাখবে সুখের? এটা আমার অবৈধ বাপের বাড়ি বলে তোমরা কি তাড়িয়ে দেবে, আমায়?ʼʼ

অন্তূ বিছানা ছেড়ে তুলির গা ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়ল। তুলির একখানা হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে বলল, “আপনার অবৈধ বাপের বাড়ি। আমি কে এ বাড়ির? আমার কী পরিচয় আছে?ʼʼ

-“হিসেবে তুমি এ বাড়ির বউ। এটাই জয়ের বাড়ি। ও কথা বলবে না।ʼʼ

অন্তূ হাসল, “আপনার-আমার নিজেদের একটা করে সংসার হলেও পারতো। কিন্তু নারী হিসেবে আল্লাহর বোধহয় আমাদেরকে পছন্দ হয়নি।ʼʼ

তুলি অন্তূর মুখে দিকে তাকায়, “তুমি জয়কে ছেড়ে দেবে, আরমিণ?ʼʼ

-“আপনার কথা শুনি। কোয়েলকে কীভাবে মানুষ করবেন ভেবেছেন?ʼʼ

-“তুমি নিয়ে নাও।ʼʼ

অন্তূ তাকাল। তুলি বলল, “আমি সত্যি বলছি আরমিণ। ওকে আমার আর ভালো লাগে না। আমার আর এই দুনিয়ার কিছুই ভালো লাগে না। আমি কে, আমি কেন, আমি কী?—এই প্রশ্ন আমাকে পাগল করে তোলে। তোমার কাছে আছে এই প্রশ্নের উত্তর?ʼʼ

-“আপনি একজন নারী। আপনি একজন মা। এত বড় দুটো শক্তিশালী পরিচয় থাকতেও এই সংকোচ কেন?ʼʼ

তুলি তাচ্ছিল্য করে হাসে, “আমি অবৈধ সন্তান, আমি ধর্ষিতা, আমি বিধবা, আমি আশ্রিতা। আরও নাও বড় বড় পরিচয়। এগুলো বললে না কেন?ʼʼ

-“আমি যে দুটো বলেছি, সেগুলো এক পাল্লায় রাখুন আর এগুলো এক পাল্লায় রাখুন, দেখবেন ওই পাল্লার ভার অসীম ছাড়িয়েছে।ʼʼ

-“তুমি মেয়ে রোজ রোজ আমায় মিছে সান্ত্বণা দিও না। নিজের কথা ভাবো একটুও?ʼʼ

-“আপনি কোয়েল ও নিজের একটা ব্যবস্থা ভাবুন। এখানের দিন ফুরিয়ে এসেছে আপনার।ʼʼ

তুলি যেন চমকে উঠল, “কেন? তোমরা কি সত্যিই আমায় বের করে দেবে?ʼʼ

অন্তূ শক্ত করে তুলির হাতখানা নিজের মুঠোয় আঁটলো, “কেউ আপনাকে বের করবে না, বরং কেউ থাকবে না আপনাকে এখানে আশ্রয় দেবার জন্য।ʼʼ

-“কোথায় যাবে? কী বলছো তুমি? কী করছো তোমরা?ʼʼ

-“আমরা কারা? জানি না। কিন্তু ধরুন এই বাড়িটা ভাঙার জন্য একজন দিনমজুর দরকার, আমি সেই দিনমজুর।ʼʼ

তুলি একটু আৎকে উঠল। বিস্ময় ও হতবিহ্বলতায় কিছু উচ্চারণ করতে পারল না। অন্তূ বলল, “আমি আপনার কাছে আজ এমন কিছু চাইতে এসেছি যা আপনার মন ভাঙতে পারে, মায়ার বাঁধতে পারে। কিন্তু আজ আপনি আমায় ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।ʼʼ

-“কী চাইতে এসেছ, আরমিণ?ʼʼ

-“ভয় পাবেন না। আবেগ আপনাকে ভয় পেতে বলবে, কিন্তু বাস্তবতার কাছে আবেগ এক মুঠো ছাই। আপনি যে মুখে হামজাকে ছোট থেকে ভাই ডেকে এসেছেন, সেই মুখে আপনি তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেন।ʼʼ

তুলি যেন গেড়ে বসল, “কী বলছো তুমি?ʼʼ

-“বড় বড় কাজে এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে হয়। আপনার সন্তানের পিতাকে সে ভাই হিসেবে মেরে হয়ত ভালোই করেছে, কিন্তু সে আরও এমন অনেক সন্তানের জন্য নরকের দেবতা। যার জন্য আপনার স্বামীর মৃত্যু হবে তার হাটু ভেঙে পড়ার প্রথম ধাপ। বোনের মুখে ভাইয়ের বিরুদ্ধে নিজের স্বামীর হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী বড় কার্যকর।ʼʼ

তুলি ভাষাহীন চোখে চেয়ে রইল। অন্তূ বাম হাতের মুঠোয় রাখা চাবি নিয়ে তুলিকে নিয়ে একবার বড়ঘরে গেল। তুলির বমি ঠেলে আসে, চোখ ফুঁড়ে আসে সেখানকার দৃশ্য দেখে। বস্তার মতো নিথর পড়ে আছে এককেটা ছোট ছোট দেহ। তার মাঝে রক্তাক্ত কয়েকটি যুবক ফজরের নামাজ আদায় করছে।

সেখান থেকে বেরিয়ে অন্তূ শুধু একটাই কথা বলল, “ওদের মায়ের কোল ভরিয়ে দিতে আপনার একটা সাক্ষী আমার চাই। এরপর আমি এই লড়াইয়ে আমি বাঁচতে পারি, তো আপনার ভারটুকুও আমার।ʼʼ

অন্তূ রিমির ঘরে আর গেল না। সে জানে রিমি এখন নিস্তেজ শরীরে বিছানায় পড়ে নীরবে কাঁদছে। অন্তূর চোখে বড় বেঁধে এই দৃশ্য। রিমি তার এই বয়সের একজন সরল-বিশ্বস্ত বান্ধবী কিনা!

বাথরুমে যদি দশটা লুঙ্গিও জমা হয়, তা কখনও নিজের হাতে ধুয়ে দেয় না জয়। দরকার পড়লে নতুন কিনে এনে পরে। চারটা লুঙ্গি জমে ছিল। অন্তূ সেগুলো ধুয়ে ছাদে গিয়ে মেলে দিয়ে এলো। একটু ভালোমতোন দেখল বাড়ির গোটা আশপাশটা। পাহারা নেহাত কম বসায়নি হামজা।

বেলা একটু বাড়লে একসাথে দুটো বমির ওষুধ খেয়ে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। এককাপ সুন্দর চা বানিয়ে নিয়ে গিয়ে জয়কে ডাকল, বেলা নয়টা বাজে। উঠবেন নাকি পানিটানি ঢেলে দেব গায়ে?

জয় গালি ঝারার জন্যই বোধহয় আধো চোখ খুলেছিল। কিন্তু গালি এলো না মুখে। অন্তূ চুল আঁচড়াচ্ছে। কোমড় সমান চুল। খুব সামান্য কুঁকড়ানো। দেখতে আরও বেশি সুন্দর লাগে। অন্তূ এক পর্যায়ে চুলটা পিঠ থেকে তুলে সামনে আগলে নিয়ে আচড়াতে লাগল। হাতের চিকন চুরিখানা চিকচিক করে উঠল অন্তূর। বেরিয়ে এলো গলার চেইন। জয় চোখ বুজে ফেলে এ পর্যায়ে।

জয়ের কাছে মনে হলো এটাকে অপার্থিব এক সকাল বলে। এই সকালের মায়ায় যদি জয় আমির পড়ে, দোষটা একটুও জয় আমিরের নয়। কিন্তু ধ্বংসাত্বক ক্ষতিটা জয় আমিরেরই। এই মায়ার প্রশ্নও তার জন্য সর্বোচ্চ ক্ষতিকর। দূর্বলতার ঠাঁইকেই সাধারণ ভাষায় মায়া বলে।

জয়ের চোখের পর্দায় ভেসে উঠল–অন্তূ যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, স্বামী হিসেবে তার এখন কর্তব্য অন্তূর ওই চুল সরানো খোলা কাধে একটা চুমু খাওয়া। কিন্তু সে যে স্বামী হবার আগে আসামী!

জয় উঠে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি বাঁধে। ঘড়িতে সবে সাড়ে সাতটা। তার বউ একটা বাটপারী করেছে। এর শাস্তি কীভাবে দেয়া যায়?

অন্তূ সে সময় বলে উঠল, “কী খাবেন?ʼʼ

-“তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করতেছ?ʼʼ

-“আমি বুঝতে পারছিলাম না কী রান্না করা যায়। আপনি যা খাবেন তা শুনলে একটা আইডিয়া পাওয়া যেত।ʼʼ

জয় এমন ভাব করে হেঁটে এসে অন্তূকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে গা ঘেঁষে আয়নার সামনে দাঁড়াল, যেন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে এলোমেলো চুল ঠিক করতে খুব ব্যস্ত।

ঘন ফেঞ্চকাট ঝাকড়া চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “বিরিয়ানী রাঁধো।ʼʼ আড়চোখে অন্তূকে দেখল আয়নার ভেতরে।

অন্তূ আয়নায় জয়কে লক্ষ করে বলে, “পছন্দ?ʼʼ

জয় এবার অন্তূর দিকে ঘাঁড় কাত করে, “হলে কী?ʼʼ

-“আমারও পছন্দ।ʼʼ

জয় যেন একটুখানি থমকায়। আরেকটু গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। তাকিয়ে থাকে। কিছু সময় পর হেসে ফেলে অন্তূর কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে, “পছন্দ চেঞ্জ করে ফেলো, ঘরওয়ালি। নয়ত ভালো মানুষদের সমাজে বদনাম হয়ে যাবে জয় আমিরের পছন্দমতো একটা নিজের পছন্দ রাখার দায়ে। তোমার জয় আমির ভালো না।ʼʼ

অন্তূ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে, “তার নামে বদনাম হয়েই এই নাম পেয়েছি। বদনামের ওপর বদনাম দৃশ্যমান হয় না।ʼʼ

জয় মাথা নিচু করে হেসে বিরবির করে, “আমার নামটাই এক জলন্ত বদনাম! কী বলেন, উকিল মহোদয়া!ʼʼ

-“আমি তো বিরিয়ানী রান্না তেমন পারি না। মানে আম্মু করতো, আমি…ʼʼ

অন্তূ সরে দাঁড়ায়। এই সকল মুহুর্তে জয়কে আপাত বিরহ দিয়ে তার চাপা আহত মুখখানা বড় প্রশান্তি দেয়।

-“রান্না-বান্না, স্বামীর যত্ন, সংসার সামলানো শেখার বয়সে উকালতি আর তদন্ত শিখলে তোমার সুয়ামীর কপাল এরমই হবে, সিস্টার! তোমার সুয়ামীর জন্য দুক্কু পেলুম।ʼʼ

অন্তূ হেসে ফেলল। জয়ের মনে হলো দেয়ালে মাথা টুকে হাসপাতালে চলে যেতে। এরকম একখানা অভাবনীয় সকাল পাবার কথা সে অজ্ঞান হয়েও ভাবে না। আজ তার সাথে উল্টাপাল্টা ব্যাপার ঘটছে।

অন্তূ জয়কে চারবার মুদির দোকানে পাঠালো বিভিন্ন মশলা-পাতি ইত্যাদি আনতে। তার কুকুরগুলোকে রুটি খাওয়াতে একটু দেরি হলো শেষবার। বকতে বকতে দোতলায় উঠল। আটবার উঠানামা করতে হয়েছে সিঁড়ি দিয়ে।

অন্তূ বলল, “কোয়েলের দুধ ফুরিয়ে গেছে।ʼʼ

-“মাথার ওপর তুলে এক আছাড় মারব এইবার কোয়েলরেও, তোমারেও!ʼʼ

-“তো আমি যাই? দুধ নিয়ে আসি?ʼʼ

-“বের হয়ে দেখ্!ʼʼ

-“আজ হবো।ʼʼ

-“কীয়েহ্! আবার কন, শুনি নাই!ʼʼ

অন্তূ সরল নজরে তাকায়। জয় এক মুহুর্তের জন্য ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। অন্তূর এই মারপ্যাচটা খাটছিল খুব জয়ের ওপর। কখনও নমনীয়তা না দেখানো অন্তূ হঠাৎ-ই এই চূড়ান্ত সময়ে কোমলতা প্রদর্শন করায় জয়ের চাতুর্যও হতবিহ্বল হয়ে পড়ছিল।

-“আমি আজ ভার্সিটি যেতে চাই। আপনার অনুমতি আছে?ʼʼ

জয় যেন ভুল শুনল। কিছুক্ষণ অনড় দাঁড়িয়ে থেকে চোখ ফেরালো, “আমার অনুমতি চাই, তোমার?ʼʼ

-“আপনার অনুমতি থাকলে আমি আজ ভার্সিটিতে যাব। সেমিস্টার শেষের দিকে। এটেন্ডেন্স থাকা চাই।ʼʼ

জয় ঢোক গিলে একটু সময় নিয়ে বলল, “আমি নামিয়ে দেব।ʼʼ

অন্তূ একটুও আপত্তি করল না, “আপনি কোথায় যাবেন?ʼʼ

-“জেলখানায়।ʼʼ

অন্তূ মশলা কষানোর চামচ নাড়া দিতে দিতে কষা মশলা ছুটে এসে অন্তূর বাম গালে লাগল। মুখের নরম ত্বক জ্বলে উঠতেই অন্তূ ছিটকে দাঁড়ায়। জয় যেন উড়ে এসে অন্তূর মুখটা অধিকারে নেয়, ট্যাপ ছেড়ে হাতের মুঠোয় পানি নিয়ে ক্ষততে দেয়। কিন্তু মুখের সংবেদনশীল ত্বকে ঠিক ফোসকা পড়া কালো দাগ উঠে এলো। ততক্ষণে মশলা পুড়ে ধোঁয়া উঠে গেছে। সেই গন্ধে অন্তূর চোখ-মুখ উল্টে এলো। জয় দ্রুত অন্তূর মুখ ও মাথাটা অনিয়ন্ত্রিত হাতেই যেন নিজের চওড়া বুকটার সাথে চেপে ধরে। ধরে রাখে ওভাবেই। জয়ের লম্বা কাষ্ঠল শরীরটার তুলনায় অন্তূ মেয়ে হিসেবে লম্বা হয়েও খাটো।

একহাতে গ্যাস অফ করে অন্তূর চুলে হাত রাখে জয়, আলতো চাপে বুকের কাছে অন্তূর মুখটা চেপে নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। অন্তূর অস্থির, অসুস্থ নিঃশ্বাস জয়ের বুকে ছুটে পড়ে। আলতো হাতে বারবার অন্তূর চুলে হাত বোলায়। এই জয়কে চেনা যায় না। জয় নিজেও চিনতে ভুল করে এই জয়টাকে। এই জয় জয় আমিরের ধ্বংসের প্রতিনিধি।

অন্তূ টের পায় জয়ের হৃৎপিণ্ডে আন্দোলন চলছে। দ্রিম দ্রিম করে হৃদকপাটিকা খুলছে, রক্ত বইয়ে দিয়ে আবার তার চেয়ে দ্রুত ও জোরে আঁটকে যাচ্ছে। অন্তূ একপেশে হাসে আলতো। এরকম বুকের কাঁপুনি অন্তূও টের পেয়েছিল। হাত-পা থরথর করে কেঁপেছিল। যেদিন তার ঘরে জয়ের অবৈধ বিচরণ প্রমাণিত হচ্ছিল ভরা সমাজে। হৃদযন্ত্রের এই উত্তাল তান্ডব একই রকম, শুধু শর্ত আলাদা।

জয় আস্তে কোরে জিজ্ঞেস করে, “বমি করবে? বাথরুমে নিয়ে যাব?ʼʼ

-“না। এখন আর বমি পাচ্ছে না।ʼʼ

অন্তূ এক প্রকার সূক্ষ্ণ অবহেলায় জয়কে সরিয়ে দিয়ে সরে আসে। তারপর জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সূক্ষ্ণ একটা আহত ভাব লক্ষ করে।

জয় অন্তূর মুখের ছোট্ট ক্ষততে গভীরভাবে একটা চুমু খায়। বেশ কিছুক্ষণ ঠোঁট সরায় না। সামান্য একটু জিহ্বার আগাও ছুঁয়ে যায় অন্তূর মসৃণ গালটা। জয় যেন শুষে নিশ্চিহ্ন করতে চায় অন্তূর গালের দাগটিকে।

মুখ তুলে আঙুল নেড়ে ঘষে সেখানে, শব্দহীন হেসে বলে, “এই গালে আমার ঠোঁট ততটা সময় স্থায়ি হবে না, যতটা সময় এই দাগ। পোড়ার দাগ ওঠে না। আমার কি এই দাগের ওপর হিংসা করা উচিত, ঘরওয়ালি?ʼʼ

অন্তূ মাথা নাড়ে, “আপনি কি পোড়ার দাগ নন আমার জীবনে? আপনি জলন্ত অগ্নিকুন্ড, আমি সেই আগুনে পুড়ে কালো-কয়লা হওয়া জ্বালানি-খড়ি।ʼʼ

জয় অন্তূর বাহুটা এতক্ষণ চেপে ধরে নিজের শরীরটাকে অবলম্বনের খুঁটি হিসেবে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। দূর্বল শরীর। এবার অন্তূকে রান্নাঘরের মেঝেতে বসালো।

জয় নিজেও মেঝের ওপর ঠেসে বসে আস্তে কোরে দেয়ালের সাথে হেলান দিলো। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে অন্তূর দিকে ঘাঁড় কাত করে বলল,

-“আমাকে তুমি অগ্নিকুন্ড বলো। অথচ আমি উত্তাল সমুদ্র। এবং পানিকে শাসন করা যায় না, ঘরওয়ালি। আর না যায় তার গতিবিধি পরিবর্তন করা। বড়জোর তুমিই উল্টো তার প্রবাহে ভেসে যাবে। সব হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমার ধ্বংসাবশেষটুকুও ভেসে যাবে নিরুদ্দেশ পানির উন্মত্ত প্রবাহের সাথে।ʼʼ

অন্তূ স্লান হেসে সামান্য কাধ ঝাঁকাল, “মানছি।ʼʼ

জয় যেন অবাক হয়ে তাকায়। তার চোখে প্রশ্ন, ‘তুমি! আমার কথা মানছো?ʼ

অন্তূর হাসি কমে আসে, ভাবুক চোখে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলে, “ধ্বংস হয়ে যাব, বলছেন? তার মানে ধ্বংস হবার এখনও বাকি অনেকটাই, হ্যাঁ!?ʼʼ

জয় এবার আর অন্তূর অসুস্থতা মানল না। আরেকটু সরে গিয়ে বসল। একটা চুরুট ধরিয়ে তাতে লম্বা টান দিয়ে মুখ-চোখ ভরে এক পাঁজা ধোঁয়া ছেড়ে হাসল, “আমি হেরে যাব একবার তোমার কাছে। তাতে পস্তাবে তুমি।ʼʼ

-“আপনি হেরে গেলে পস্তাব?ʼʼ

জয় ধোঁয়া গিলে দু’পাশে মাথা নাড়ল, “সেদিন আমার মতো ওভাবে হেরে যেতে না পেরে পস্তাবে।ʼʼ অন্তূর চোখে চেয়ে চোখ মারল, “হার-জিত আপেক্ষিক, ঘরওয়ালি। তুমি তো আর্টসের স্টুডেন্ট! আপেক্ষিকতা বোঝো?ʼʼ

-“বুঝি।ʼʼ

জয় একপেশে ঠোঁটে হাসে, “দৃশ্যমান পরাজয় কখনও চূড়ান্ত বিজয় কারও জন্য। এবং জিতে যাওয়াটা হেরে যাওয়া পথের প্রবেশদ্বার মাত্র।ʼʼ

-“কখনও কখনও জেনেবুঝে হেরে যায় মানুষ। কখন জানেন?ʼʼ

-“হু?ʼʼ

-“যখন মানুষের সামনে একটাই পথ থাকে—বেঁচে থাকলে হেরে যাও নয়ত তুমি মরে যাও! মৃত্যু আপনার মতো দায়বদ্ধতাহীন মানুষের জন্য। আমার কিছু দায় আছে।ʼʼ

-“আমি দায়বদ্ধ হলে মেরে ফেলবে?ʼʼ

অন্তূ শুধু হাসল। মনে মনে বলে উঠল, ‘আমি বলছি, আপনি দায়বদ্ধ হবার পরেও মরণই হবে আপনার একমাত্র মুক্তির পথ। আমি আপনাকে দায়বদ্ধ করে তুলব, এবং যেকোনো শর্তে বাঁচিয়ে রাখব। প্রতিক্ষণে জীবিত করে আবার মেরে ফেলব।’

জয় অন্তূকে আর রাঁধতেই দিলো না। মেঝেতে বসিয়ে রেখে নতুন করে মশলা কষিয়ে রান্না শুরু করল। পিকনিকে বিরিয়ানী রেঁধে অভিজ্ঞ হাত তার। অন্তূ মেঝেতে বসে বসে দেখল গলায় গামছা ঝুলিয়ে, লুঙ্গি পরে একদম পেশাগত বাবুর্চির মতো রান্না করছে জয়। বিরিয়ানীর গন্ধে সকাল সকাল দোতলা মেখে উঠল। রাধতে রাধতে আবার গলা ছেড়ে গান ধরল,

মাইয়ার পেছন ছাইড়া দিয়া মন্টু হইয়াছি
পাপের জন্য গঙ্গা জলে ডুব দিয়াছি
সবকিছু ছাইড়া আমি সাধু হইয়াছি….
প্রেমে আগুন লাগাইছি ও প্রেমের বিদায় জানাইছি…. প্রেমের গুষ্টি মেরেছি…
বাংলা মাল ছাইড়া হাতে শরবত নিয়াছি
বৈরাগ দিয়া কপালেতে তিলক লাগাইছি…

অন্তূ রিমির কাছে গিয়ে বলল, “আপনার বোরকাটা দিন, রিমি!ʼʼ

রিমি অবাক হলো, “আপনি বোরকা পরবেন, আরমিণ?ʼʼ

-“পরব।ʼʼ

জয় তৈরি হয়ে ওয়ার্কশপে নেমে গিয়েছিল। অনেকগুলো দিন পর গায়ে বোরকা চড়াতে গিয়ে অন্তূর ভেতরে পাগলাটে বিভ্রম তৈরি হলো। সে দেখল, আব্বু গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তূর হুড়মুড় করে বোরকা পরে দৌড়ে গিয়ে আব্বুর হাতখানা চেপে ধরবে, রাস্তা পার হবে, ভার্সিটির গেটে নেমে বলবে, “ছাতা খোলো। খুব রোদ আব্বু। প্রেশার বাড়বে কিন্তু।ʼʼ

আমজাদ সাহেব গম্ভীর মুখে বলবেন, “রোদে ভিটামিন ডি থাকে। প্রেশার বাড়ে কে বলেছে তোকে? একা যাবার চেষ্টা করিস না। আমি আসব নিতে।ʼʼ

আজ বাইরে জয় আমির দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন প্রথমবার অন্তূ জয় আমিরের জন্য বোরকা পরে তৈরি হলো।

জয়ের নজর পড়তেই তার চঞ্চল চোখদুটো থমকে স্থির হলো। জয় দেখতে পায় এক জুনিয়র বোকা-বাঘিনীকে। যে কালো বোরকায় আবৃত, সুন্দর চোখদুটোয় তেজ, ধীর-স্থির বেপাত্তা চলন। জয়কে এড়িয়ে চলে যাচ্ছে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দিকে। জয়ের ভেতরে জেদ উঠল, জয় কূটিল হাসে, মেয়েটাকে রোজ ডাকে, জ্বালাতন করার চেষ্টা করে। মিছেমিছি চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে। এটা তো সেই আরমিণ! তার ঘরওয়ালির আসার কথা ছিল না! জয়ের বুকের ভেতর কেমন একটা লাগে। মস্তিষ্কে যে চাপ সে বইছে আজ তিনটা দিন, তা একত্র হয়ে জয়কে গলা টিপে ধরে।

একটাবারও জিজ্ঞেস করে না, বোরকা কেন পরেছ হঠাৎ-ই? জিহ্বা সরে না জয়ের।

দুজন অনেকটা পথ হাঁটে আজ। রাস্তায় লোকে আলোচনায় বসে যায়। নোংরামি করে ধরা খেয়ে বিয়ে করা বউ সাবেক ভিপি জয় আমিরের। মেয়েটার লজ্জা শরম নেই। আবার পর্দা করে! এসব হলো ভন্ড।

জয় চুপচাপ হেঁটে যায়। দেহটাকে শূন্য লাগে তার। হামজা কেন আসছে না? বোঝাপড়া বাকি। এত হিসেব জয় এই সীমিত জীবনে কীভাবে মেলাবে জয়? পরিণতিহীন এক অনিশ্চিত পরিণতির পথটা এমন এলোমেলো লাগে কেন আজকাল?

রিক্সাওয়ালা জয়কে দেখে দাঁত বের করে হাসে, “তুমার কাছে কইলাম কম ভাড়া নিতাম না, মামা। বেশি ভাড়া দেওন লাগব আমারে।ʼʼ

-“বেশি ভাড়া তুমার শ্যাটার ভিতর ভরে দেব, মামা। আমি একজন বেকার লোক। না জানি তুমি কইবা ভাড়া লাগতো না, ওঠেন, এক্কেরে জাহান্নাম পর্যন্ত নামায়ে দিয়ে আসি।ʼʼ

-“না। তুমি বড়লোকের ব্যাটা। বেশি ভাড়া না দিলে আমি রিক্সা টান দিমু না মানে দিমু না।ʼʼ

–“এই শালা, ট্যাকা কি গাছের ছাল না ভ্যাড়ার বাল? দে তোর রিক্সা দে। আমি চালায়ে যাই বিনামূল্যে। দেহ্।ʼʼ

-“লন। আপনেই যান গা। ন্যায্য ভাড়া না পাইলে আমি চালাইতাম না রিক্সা।ʼʼ

জয় রিক্সায় চড়ে বসল। আবার নেমে পড়ল, “নাহ্, মান ইজ্জত এমনিই নাই, তারপর আবার… তুই চালা। সাড়ে দুই ট্যাকা বেশি দেবোনি। চল যাই গা। ওঠো, ঘরওয়ালি!ʼʼ

অন্তূ ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢোকার পর থেকে যতক্ষণ দেখা গেল জয় একদৃষ্টে দেখল অন্তূ শহীদ মিনার চত্বর পেরিয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এরকম এক সকালে এই মেয়েটিকে এই রূপেই প্রথমবার দেখেছিল সে।

জয়ের রিক্সা ঘিরে ধরল ছাত্র-ছাত্রী, জুনিয়রেরা। চোখ ফেরাতে হলো জয়ের।

অন্তূ সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ঢুকে প্রফেসর মনোয়ারা রেহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে ভার্সিটির পেছনের পথ দিয়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। গাড়ি আসবে, তাকে তুলে নিতে।

চলবে….

[আজ একটা আজাইরা পর্ব লিখেছি মনে হচ্ছে। ভুলত্রুটি বহুত আছে। ক্ষমা করবেন। আর একটু মানিয়ে নেবেন। আগামী পর্ব খুব শীঘ্রই আসতে পারে কারণ লেখা আছে। শুধু এডিটিংটা করে ফেলতে পারলেই দিয়ে দেব।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here