অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৭৫. (প্রথমাংশ)

0
1

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭৫. (প্রথমাংশ)

দোলন সাহেবের সঙ্গে অন্তূর প্রথম দেখা হয়েছিল তরুর মৃ’ত্যু’র দিন। তরুকে যখন শেষ গোসল করানোর শামিয়ানার নিচ দিয়ে গড়িয়ে আসা পানির সাথে রক্তের ধারা তিরতির করে গড়িয়ে আসছে।

অন্তূ ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারের পায়ার কাছে স্তব্ধ বসা। কিন্তু দোলন সাহেবের মনে হলো অন্তূর স্থির, ব্যথিত চোখে শুধু ব্যথা নেই। আছে এক জলন্ত অগ্নিকূপ, যার গভীরতায় জমা আছে ধ্বংসের ছাই! এই ধ্বংসের ভাগ মেয়েটির নিজেরও আছে! তবু তা কবুল, যখন শর্ত অপরপক্ষের ধ্বংসাত্বক পরিণতি!

তিনি গিয়ে অন্তূকে বললেন, “এক গ্লাস পানি খাওয়াও তো! নাহ্ ‘খাওয়াও’টা ঠিক হলো না, পান করাও! পানি খাওয়া যায় না।ʼʼ

অন্তূ উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, “বসুন। আমি পানি আনছি।ʼʼ

পানি নেই জগে। জয় সবটুকু পান করে বেরিয়ে গেছে। অন্তূ সসম্মানে পানি এনে দিলো। অন্তূর এই আদব-বিনয়টুকু তার চোখের আগুনের সাথে বেমানান। দোলন সাহেব অন্তূকে পরখ করে দেখতে দেখতে অল্প একটু পানি পান করলেন। বাঁকা হেসে খোঁচা মেরে বললেন, “তুমি সেই জয়ের সাথে অকাজে ধরা পড়া মেয়েটা না?ʼʼ

অন্তূ অসীম ধৈর্যের সাথে স্বাভাবিকভাবে বলেছিল, “জি, ই সেই মেয়ে।ʼʼ

দোলন সাহেব খুবই অবাক হয়েছিলেন অন্তূর প্রতিক্রিয়ায়। অগোচরে সামান্য হেসেছিলেন সেদিন।

এরপর পলাশের মৃত্যুর দিন দুয়েক পর ভার্সিটিতে আনসারি মোল্লা সাহেব এলেন। অন্তূকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, “তুমি জয় আমিরের বউ?ʼʼ

অন্তূ হ্যাঁ-না কিচ্ছু বলেনি। আবার জিজ্ঞেস করলেন উনি, “জবাব দেও না কেন? ভুল ধরিনি তো?ʼʼ

অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “আপনাদের পরিচয়?ʼʼ

আনসারি মোল্লার সাথে আরও তিনজন পুরুষ। কপালে তাদের নামাজের কড়া পড়া দাগ। প্যান্ট টাখনু অবধি গুটানো। অথচ দাড়ি ছাটা, পরনের পোশাক শার্ট-প্যান্ট। অন্তূর বিচক্ষণ মস্তিষ্ক সঙ্গে সঙ্গে একটা হিসেব কষে ফেলেছিল। সে কত শুনেছে, অমুকের ছেলে দাড়ি কেটে ফেলেছে, তমুকের ছেলে মাদ্রাসা থেকে জান নিয়ে পালিয়েছে….টুপি-দাড়ি থাকলেই কারাগারে পুড়ে দিয়ে রাস্তাঘাটের লোক কমাচ্ছে সরকার।

সেই জোয়ান পুরুষদের মাঝে একজন বলল, “গাড়িতে ওঠেন চুপচাপ। এটা আপনার জন্য মঙ্গলজনক হবে।ʼʼ

অন্তূকে সেদিনও সেই পুরোনো চটা ওঠা দেয়ালের বাড়িটাতে নেয়া হয়েছিল। বাড়িটা কার সে জানে না।

অন্তূ বুঝেছিল ওদের পরিকল্পনাটা। হামজা যেমন কিশোর ও মুরসালীনকে আটক রেখে এদেরকি শিকার করছে, ওরাও জয় আমিরের বউকে ধরে রেখে জয় আমিরের কাছে শর্ত রাখতে চেয়েছিল।

তা বুঝে অন্তূ বলল, “যদি আমার ধারণা সঠিক হয় তো আপনারা মুরসালীন মহানের শুভাকাঙ্ক্ষী? আপনারা কি আমাকে জিম্মি করতে চান?ʼʼ

অন্তূকে বলা হলো, “জিম্মি করব না, যদি তোমার স্বামী আর ভাসুরকে বাচ্চারা আর মুরসালীন মহানের মুক্তির জন্য মানাতে পারো। একটা নির্দিষ্ট সময় দিতে পারি তোমাকে। আর যদি কাজ না হয়, তাইলে তোমার পরিবার শেষ।ʼʼ

অন্তূ আলতো হেসে উঠেছিল, “ওরা যে আপনাদেরকে জঙ্গি বলে, এটা কি তাহলে ঠিক?ʼʼ

কেমন একটু থতমত খেলো ওরা। নিজেদের জাতের ওপর দাগ উঠে আসার উপক্রমে ওরা একটু লজ্জিত ও অপ্রস্তুত হয়ে উঠল। অন্তূর চালটা চট করে খেটে গেল।

আনসারি মোল্লা হাসলেন, “ওদের মনে হয়, তোমার তা মনে হয় না?ʼʼ

-“আমি পুরোটা না জেনে কাউকে বিচার করি না, না বুঝে কাউকে পাপী মানি না, না দেখে কোনো ধারণা রাখি না। তবে আমার আন্দাজশক্তি টুকটাক ভালো।ʼʼ

-“তাই নাকি?ʼʼ

-“আমি এবং আপনাদের পথটা অনেকটা এক দিকে যায়।ʼʼ

-“একদিকে যায়? তোমার পথ কোনদিকে যায়?ʼʼ

-“জয় আমির বলে, ‘তার এবং হামজার পথ এক, গন্তব্য আলাদা।ʼ চাইলে আপনাদের সঙ্গে আমি একটা সেরকম চুক্তিতে আসতে পারি।ʼʼ

আনসারী মোল্লা ভ্রু জড়িয়ে তাকালেন। খুব সতর্ক চোখে পরখ করলেন অন্তূকে। হাঁটুর বয়সী মেয়ে, নমনীয় অতি-সুশ্রী চেহারাখানা! অথচ কথার ধারে ছুরির ডগা ক্ষয়ে যাবার জো। ভাষা ও অর্থবোধক গভীরতায় ডুবে গেলে চলে।

সতর্ক কণ্ঠে বললেন, “কেমন চুক্তির কথা বলছো তুমি?ʼʼ

-“এই যে আপনারা বললেন আমার পরিবারের ক্ষতি করবেন আমি মানাতে না পারলে, নিশ্চিত জেনে রাখুন আমি মানাতে পারব না। তা বলে আপনারা কি আমার পরিবারের ক্ষতি করবেন? এটা তো আপনাদের উদ্দেশ্য নয়! বরং আপনারা মুক্তি চান। যেটা আমিও চাই। আর সাথে আরও কিছু। তো সেই চেষ্টা ও উদ্দেশ্যেই কিছু করা যাক!ʼʼ

বেশ কয়েকটি পুরুষ মুক্ত উৎসুক হয়ে চেয়ে রইল। অন্তূ বলল, “হামজা ও জয় আমিরের শেষটা আমি চাই। সেজন্য আপনারা চাইলে আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আর আমি আপনাদেরকে। আজ এই যে কথা হলো, এরপর আর কথা হবে না। পথ নেই।ʼʼ

-“তাহলে কীভাবে যোগাযোগ করব?ʼʼ

অন্তূ সব বুঝিয়ে দিলো, “ওদের ওয়ার্কশপে একটা লোহার আসবাব বানাতে দিন। যেমন ধরুন কোনো স্টিলের দরজা বা গ্রিল। স্বর্ণকার বা ওয়ার্কশপওয়ালারা পেশাগতভাবে ছ্যাঁচড়া হয়। রোজ তাগাদা করেও মাল পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে যখন কোনো বার্তা আমাকে দেবার থাকবে, সেদিন যাবেন তাগাদায়। একটু ঘ্যানঘ্যান করে আসবেন, খুব বেশি না। খুব বেশি করলে আবার দ্রুত বানিয়ে ফেলবে জিনিস। সেটা করলে চলবে না। হালকা একটু ঘ্যানঘ্যান করে কোনো এক ফাঁকে বার্তা লেখা কাগজ মুড়িয়ে দোতলার পূর্ব দিকের বেলকনিতে ছুঁড়ে মারবেন। সাবধানে। তার ডানপাশেল একতলায় কিন্তু একপাল পার্টির ছেলের বাস আছে। থার একটু নিশানা ভালো, দেখতে সাধারণ, এমন কেউ যাবেন। দেখতে যেন মোল্লা মোল্লা না লাগে। আর একটু চতুর হলে ভালো হয়। এছাড়া রাত তো রয়েছে!ʼʼ

সেখান থেকে সেদিন অন্তূ ভীষণ অস্থির হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। উত্তেজনা, ভয় ও বুকের ব্যথা একাকার হয়ে শরীরের প্রতিটা লোম শিরশির করছিল। সে কী থেকে কী করবে, না ভেবে পাওয়ার অস্থির মুহুর্তগুলোতে আনসারি মোল্লা যেন দূত হয়ে এসেছিলেন! অন্তূ এক বন্দিনী নারী, যার মস্তিষ্কে গিজগিজ করে পাটোয়ারী বাড়ির ধ্বংসের আঁকিবুকি, অথচ প্রয়োগক্ষেত্র ও সুযোগের অভাবে সেসব বোকামি ও ব্যর্থতা হিসেবে নিস্ফল হয়ে পড়ছিল। আনসারি মোল্লা সেই সুযোগটা পেশ করলেন অন্তূর সামনে।

অন্তূ বুঝেছিল, তার ও মুরসালীনের মনোভাব খুব মেলে। তারা দুজনই নির্দিষ্ট কোনো দলের প্রতি আকৃষ্ট নয়, শুধু তারা সমাজে চলমান অশান্ত পরিস্থিতির বদল দেখতে চায়।

পথ তৈরি হবার পর অন্তূর হাতে একমাত্র বাকি কাজ–জয় আমিরকে পুরোটা খুঁড়ে দেখা, দুনিয়ার প্রতি দাসত্ব নিয়ে আসা–যেটার নাম মায়া! অন্তূ জয় নামক কিতাবের সবটা না পড়ে কেবল শেষ পৃষ্ঠা পড়ে কোনো সিদ্ধান্তে এসে নিজেকে অবিবেচকের তালিকায় স্থান দিতে পারে না।

সেদিন অন্তূ গোসল করে ভীষণ কেঁদেছিল আল্লাহর কাছে, শুকরিয়া জ্ঞাপন ও আগামীর পথ সহজ করতে প্রার্থনা করেছিল।

তার পরদিনই আবারও একটা মোক্ষম দিন এলো। মুরসালীন মহানের মুখে তার নামের মতোই রাজনীতির মহান বিশ্লেষণ শোনা, আর দোলন সাহেবের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ!

অন্তূ সেদিন দোলন সাহেবকে আবিষ্কার করে ফেলেছিল মুরসালীন ও তাঁর কথপোকথনের মাঝেই। বড় দ্বিধান্বিত এক চরিত্র! তার কথাবার্তার ভেতরে লুকানো মনোভাব, আরামপ্রিয় শীতল-শান্ত চিত্ত, একেকটা প্রশ্ন, জবাব, মুখের জটিল ভঙ্গিমা, কথার মর্ম, শব্দহীন অর্থপূর্ণ হাসি… সব মিলিয়ে অন্তূ দোলন সাহেবের চোখেমুখে যে মুরসালীন মহানের জন্য যে সুপ্ত প্রশয় দেখেছিল, তা অন্তূর পথকে আরেকটু সুগম করল।

কিছু মানুষ থাকে যারা ভীষণ ছন্নছাড়া গোছের হন, এদেরকে দেখে কখনও কখনও মনে হয়, এরা বোধহয় নিজেকেও ভালোমতো বুঝতে পারে না। এরা সব বুঝে, জেনে, দেখেও বড় গা-ছাড়া! এদের ভেতরের সুপ্ত ইতিবাচক প্রশ্রয় খুঁজে বের করতে একটু টানাটানি করতে হয় বটে, তবে তা বের করতে পারলে এরা উপকারী, কিন্তু তা নিজের মুখে স্বীকার করতে নারাজ! দোলন সাহেব সেই গোছের মানুষ।

সেদিন বড়ঘরে ভালো ভোজ হয়েছিল। বাড়িতেও ভালো রান্না। দুপুর গড়িয়ে যাওয়া সময়। অটল মুরসালীনের সঙ্গে কথা বলে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবার সময় অন্তূ সবিনয়ে দাওয়াত করল দোলন সাহেবকে।

দোলন সাহেব ঝারি মারলেন একটা, “তোমার হাতে খাবার খাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। জয়কে বলেছিলাম বিয়ে করিস না। মেয়েলোক ভালো না। কী খাওয়ানোর জন্য এত তোষামুদৃ ডাকাডাকি?ʼʼ

বলতে বলতে উপরে উঠে এসে টেবিলে বসে পড়লেন। অন্তূ হাসল। সেদিন নিজে হাতে বসিয়ে খাইয়েছিল অন্তূ দোলন সাহেবকে। একমনে খাচ্ছিলেন দোলন সাহেব। অন্তূ আরও পরখ করে দেখছিল উনাকে।

দোলন সাহেব খেতে খেতেই বলে উঠলেন, “তোমার মতো জোচ্চর মেয়েরের চোখ ভয়ঙ্কর। বড় বড় সভ্যতা গিলে হজম করে ফেলতে পারে। আমি ভোলাভালা মানুষ। ওই চোখ দিয়ে আমাকে দেখো না।ʼʼ

-“সেই সভ্যতা যদি পাপের হয়, এখানে আপনার রায় কেমন, স্যার?ʼʼ

-“আমি উকিল, জজ না। রায় দেয়া আমার কাজ না।ʼʼ

-“প্রতিটা মানুষের ভেতরে নিজের জন্য একেকটি জজ থাকে। যার নাম বিবেক। আমি সেই জজের কাছে রায় চেয়েছি, স্যার!ʼʼ

-“আচ্ছা, আমি কি ব্যাটাছেলে মুরসালীনের উজবুক কথার দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে আবার তার মহিলা রূপের কাছে এসে ফাঁসলাম? আরাম করে খেতে দাও, নয়ত বলে দাও আমি খাচ্ছি এটা তোমার সহ্য হচ্ছে না, হাত ধুয়ে উঠে পড়ি।ʼʼ

অন্তূ হেসে ফেলল, “আমারও স্বপ্ন আপনার মতোন আইনজীবী হবার।ʼʼ

-“কথা এত জটিলভাবে বলবে না। তোমার বাক্য অপূর্ণ, তাতে বহুমুখী অর্থ প্রকাশ পায়। পরিষ্কার করে বলো, ছিল নাকি আছে?ʼʼ

অন্তূ প্রসঙ্গ বদলাতে আরেকটু ভাত জোর করে তুলে দিলো দোলন সাহেবের প্লেটে। সরল গলায় বলল, “স্যার আমি তো আপনার ছাত্রী-বয়সী হবো। স্যার, আপনার আইনে কি ওই নিষ্পাপ বাচ্চারা কোনোভাবে দোষী? এবং সেই দোষের শাস্তি ওই অবরুদ্ধ কুঠুরি হতে পারে?ʼʼ

-“কী বলতে চাচ্ছ কী তুমি?ʼʼ

অন্তূ বিনয়ের সাথে বলল, “স্যার, আমি প্রশ্ন করেছি মানে জবাব চাইছি। কিছু বলছি না। জবাব দিলে খুব খুশি হতাম।ʼʼ
দোলন সাহেব মাংসের হাড় চিবোতে চিবোতে অনেকক্ষণ ধরে অন্তূকে এ পর্যায়ে দেখেছিলেন সেদিন। তারপর বলেছিলেন, “তোমার উদ্দেশ্য আমি জানি না। কিন্তু মেয়ে তুমি জানো খুব কম। তুমি যে বিষয়াদি নিয়ে ভাবছো, তার সূত্রপাত শতাব্দী প্রাচীন। আজ-কালের দু একটা ঘটনা দিয়ে ইতিহাসকে প্রভাবিত করার চেষ্টা কোরো না। তুমি কিছুই জানো না, চারপাশ বোঝো না।ʼʼ

-“আমি জানি, স্যার। আমার সীমা আমি জানি। এবং আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমার নারীমন শুধুই ওই ছোট বাচ্চাগুলোর জানের মুক্তি চায়। আমি আর কিছুই জানি না, নাদান এক অবলা মেয়ে, স্যার। আর না এর বেশি জানতে চাই। কিন্তু ওই বাচ্চাগুলোর তো কোনো ইতিহাস নেই, ওরা তো শুধু নিষ্পাপ নির্যাতিত প্রাণ। এইটুকু জানা তো আমার সঠিক স্যার? আমি আর কিছু জানতে বা বুঝতে চাই না। জেনে করবোই বা কী?ʼʼ

এত অসহায়ত্ব বোধহয় অন্তূর কণ্ঠে কোনোদিনও ফুটে ওঠেনি। সেদিন সে এই চালে নিজের নারীকণ্ঠে যতটা অবলি, নিরীহপনা তুলে ধরেছিল। তা বোধহয় কাজও করেছিল দোলন সাহেবের গা-ছাড়া মেধাবী নরম মনের ওপর।

-“তুমি এসব আমাকে বলছো কেন? তোমার হাতে এত মজার খানা খেয়ে কি ঋণী হলাম? এখন তার বদলা চাইবে।ʼʼ
-“অনুরোধ, স্যার। এভাবে আমাকে ছোট করবেন না। আপনি আমার গুরুজন। আপনাকে খাওয়ানো আমার জন্য খুশির বিষয়। এতে কোনো উদ্দেশ্যপ্রবণতা নেই। আমি শুধু জানতে চাইছি, আপনার কি খারাপ লাগে না ওই বাচ্চাগুলোর জন্য? ওরা তো এই দলীয় দাঙ্গার অংশ নয়! পাপ না করা অবধি তো সৃষ্টিকর্তাও পাপ লেখেন না। ওরা কেন কষ্ট পাচ্ছে?ʼʼ

জয় গোসল সেরে হাউমাউ করে এসে খেতে বসার আগ অবধি এই কথাটুকুই হয়েছিল। অন্তূর জন্য এ ছিল এক শেষ প্রচেষ্টা। হয় দোলন সাহেব মেনে নিয়ে চেপে যাবেন, নয়ত সব বলে দিয়ে অন্তূর রাস্তা চিরকালের মতো ওখানেই বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু বড় বড় কাজে এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ হুটহাটই নিয়ে ফেলতে হয়। অন্তূ তা-ই করেছিল। আশ্চর্যজনকভাবে দোলন সাহেব তার ক’দিন পর মাঝরাতে ওইদিন বড়ঘরে আবার আসা অবধিও এসব কথা কাউকে বলেননি। অন্তূ নিজের দৃষ্টি ও আন্দাজশক্তির ওপর আরেকটু আশ্বস্ত হয়েছিল এতে। সে যে দোলন সাহেবের চোখে মুরসালীনের জন্যও প্রশ্রয় ও সহমর্মিতা দেখেছে, তাও বোধহয় দ্বিমুখী-চাপা আইনজীবী বদিউজ্জামান দোলন বুঝতে পারেননি।

আগেরদিন দুপুরে জয় বড়ঘরে যাবার সময় অন্তূ পিছু নিলো।

জয় কপাল জড়ায়, “আমার পেছনে কী? এপাড়ের মানুষদের ওপাড়ে কাজ নেই।ʼʼ

অন্তূ আবদার করে ওঠে, “আমাকেও ওপাড়ের মানুষই ধরে নিন। এতগুলো দিন ওপাড়ের মানুষের সাথে ঘর করে আর বিভেদ থাকতে আছে? এতিমগুলোকে দেখে আসি এই সাথে।ʼʼ

জয় একপেশে হাসে, “কখনও আমাকে দেখার জন্য তো এমন ব্যাকুল হওনি! এতিম তো আমিও!ʼʼ

জয়ের হাসিতে তাল মিলিয়ে অন্তূও এক গভীর হাসি হাসে, সরল গলায় বলে, “আপনাকে আমি এতিম হিসেবে পাইনি, জয় আমির। আসামী হিসেবে পেয়েছিলাম। আসামী এতিম হলে সে দায় কেন আমার?ʼʼ

জয় হেসে মাথা দুলায়, “ঠিক!ʼʼ

-“কেন যাবেন এখন ওখানে?ʼʼ

-“কথা শেষ হয় নাই জঙ্গি মুরসালীনের সাথে। ওর আরও কিছু বলার আছে।ʼʼ

রসিকতা ছেড়ে স্বল্প-সহজ জবাব দেয়া জয়কে অন্তূর নতুন লাগে। সে জয়কে গভীর চোখে দেখে কয়েক দণ্ড। জয় এখনও হাসে, কিন্তু সেই হাসি শুধু জয়ের ধারাবাহিতা বজায় রাখতে যেন! প্রাণখুলে হাসতে জয় বাঁধা পায় কোথাও। কিছু একটা তাড়া করছে আজ তিনটে দিন। এই হাসিতে চিরচেনা জয় নেই।

অন্তূ গিয়েই আব্দুল আহাদের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে ওর মাথাটা কোলে তুলে নেয়। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। চেতনা নেই বললেই চলে।

জয়কে দেখে মুরসালীন উঠে বসার চেষ্টা করল। কেশে উঠল কয়েকবার। কাশির চাপে নাক দিয়ে রক্ত উঠে এলো। তার সেই সুদর্শন পৌরুষ রূপ আর নেই, বিদ্রোহের ছাপও অসুস্থ, ক্ষত-বিক্ষত মুখের মলিনতায় ঢাকা পড়ে গেছে।

তবু মুরসালীন হাসল, “কী খবর রে?ʼʼ

জয় একটা মেশিনের সাথে এক হাঁটু খাড়া করে হেলান দিয়ে বসে। চুপচাপ কিছুক্ষণ দেখে মুরসালীনকে।

-“তোর বাপের অর্ডারে সেদিন আমির বাড়িতে হামলা হয় নাই, তাই তো? এ-ই তো বলতে চাস?ʼʼ

-“এছাড়া কিছু বলতে চাইলে বানাতে হবে। সত্যি বলতে এটাই।ʼʼ

জয় ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ে, “মোল্লারা কত নিষ্পাপ হয়!ʼʼ

-“মোল্লা কী? মানুষ জন্মালে কোনো না ধর্মের হয়েই জন্মায়। পরবর্তি জীবনে সেই ধর্ম পালন তার কর্তব্য! এতে কোনো দ্বিমত নেই। আর তা করলে যদি কেউ মোল্লা হয়, তো খারাপ কী? তুই বারবার ভুলে যাস আমি সৈয়দ বংশের হলে তুইও আমির বংশের বংশধর। তোর কি মনেহয় তোর পূর্বপুরুষেরা তোর আর তোর চাচার মতোন বেদুইন, নাস্তিক ছিল?ʼʼ

-“নাহ্! নাহ্ তো!ʼʼ

-“শুনেছি তোর দাদুভাই একজন মহৎ ধর্মপ্রাণ মাতব্বর ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মোল্লা মোল্লা করছিস কেন? ধর্ম মানুষকে সরল পথ দেখায়। এজন্য মানবজীবনে ধর্ম বারবার উঠে এলেও তা কখনও মানুষে-মানুষে বিভেদ করে না। আমি মোল্লা, তুই কী? মোল্লাটাই বা কী? আর কে বলেছে তোকে আমি মোল্লা? পারিবারিকভাবে আমাকে ধর্মশিক্ষা দেয়া হয়েছিল, কিন্তু আমি তা পালনই করতে পারিনি ঠিকমতো, তবু কিছু আছে, অন্তত তোর মতো বিপথে বোধহয় যাইনি। আমি কোনো দল বা সংগঠনের নই, জয়। আমি মুক্তিকামী। তাতে শতভাগ ধর্ম নেই।ʼʼ

জয় তাচ্ছিল্য করে বলে, “তো বলতেছিস, তোর পরিবার স্বাধীনতা বিরোধী ছিল না?ʼʼ

-“এ কথা আগেও হয়ে গেছে। বারবার একই প্রশ্ন করতে আসবি না।ʼʼ

-“আর আসব না। আজ বল।ʼʼ

মুরসালীন জয়ের দিকে তাকিয়ে কেমন অদ্ভূত হাসি হাসে। তারপর বলে, “আমার ধারণা, তারা স্বাধীনতা বিরোধী ছিল না, তারা মূলত এই তথাকথিত স্বাধীনতাবিরোধী ছিল। এক দেশের পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে আরেক দেশের গোলামি খাটা এই স্বাধীনতার বিরোধী ছিল। যে স্বাধীনতা অন্য দেশের শাসকদের থেকে মুক্ত করে নিজের দেশের শোষকদের হাতে দেশ সমর্পন করে, সেই স্বাধীনতার বিরোধী ছিল। এবং তোরা যেটাকে স্বাধীনতা বলিস, ওরা আসলেই সেই স্বাধীনতার বিরোধী ছিল। এটা অন্যায় হলে তারা অপরাধী, রাজাকার। এ কথা আমি রোজ স্বীকার করি।ʼʼ

জয় জিজ্ঞেস করে, “সেদিন যদি তোর বাপ আমির বাড়িতে আক্রমণ না করে, তাহলে কারা করেছিল?ʼʼ

-“না বললে মেরে ফেলবি?ʼʼ

-“কথা পেচাস না, মুরসালীন।ʼʼ

-“যে প্রশ্নটা তোর কমপক্ষে বিশ বছর আগে আমার আব্বাকে করা উচিত ছিল, তা এতকিছুর পর আজ এই শেষ বেলায় সব ধ্বংসের মহাক্ষণে দাঁড়িয়ে আমাকে করছিস, তার জবাব দেবার ইচ্ছে আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না, জয়। কী করি বলতো?ʼʼ

জয় অনেকক্ষণ মুরসালীনের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। পরে নজর ঝুঁকিয়ে বলল, “এতদিন ভিতরে প্রশ্নটা আসে নাই। কারণ উত্তরটা আমি নিশ্চিত জানতাম। আজ সেই নিশ্চিত জানা উত্তরে একটু অনিশ্চয়তা আসছে, তা দূর করতে আসছি। ভণিতা করিস না। বল। আর কোনোদিন জিজ্ঞেস করব না।ʼʼ

মুরসালীন আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করে, হাত-পা যেন ব্যথায় মুরসালীনের সঙ্গ ছাড়তে চাইছে। কোনোরকম হেলান দিয়ে বসে কাশতে কাশতে বলে, “তোর সেই নিশ্চিত জানা অবাস্তব উত্তরের ওপর এই সামান্য অনিশ্চয়তাটুকু আনতে আমার পরিবারসহ আরও অনেকের বহুত কঠিন মূল্য চুকাতে হয়েছে। তোর ভুলভাল বিশ্বাসেরও কত দাম, জয়! তা টলাতে কত রক্ত, কত চোখের পানি, কত হাহাকার ঢালতে হয়েছে! সেই সাথে তোর ধ্বংস তো আছেই! বড় লোকদের ব্যাপারই আলাদা, বল!?ʼʼ

জয় হাতের তালু দিয়ে মুখ থেকে মাথার চুল অবধি সাপটে নিয়ে ঘাঁড়ে ঠেকায়। ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, “কেন মারা হলো আমির পরিবারকে?ʼʼ

মুরসালীন একটু তীব্র গলায় জানায়, “তোর বাপ জনাব জাভেদ আমির সাহেব বামপন্থী রাজনীতিকে সমর্থন করতেন।ʼʼ

জয় যেন কথা বলতে ভুলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে কোরে শুধু উচ্চারণ করে সে, “কমিউনিস্ট!?ʼʼ

মুরসালীন মাথা নেড়ে সায় দেয়, “কমিউনিস্ট! যুদ্ধের পর তোর বাপ-চাচা দুই ভাই দুই পথে পা বাড়িয়েছে। তোর চাচা গেছিল ত্রাসে, আর কলেজ জীবন থেকেই তোর বাপ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিল। যখন তোর বাপ মরেছে, একজন সক্রিয় ‘কমরেডʼ হিসেবে মরেছে। এরপর আশা করি বাকিটা তোকে আর ‘অ আ’ এর মতো ধরে ধরে বোঝাতে হবে না!ʼʼ

জয়ের মাথাটা একটুখানি চক্কর মেরে উঠেছিল বোধহয় সেসময়! চোখদুটো বুজল সে। আমির নিবাসে ঘটে যাওয়া সেই মৃত্যু-অনুষ্ঠানের পর থেকে বিশটা বছর ধরে সে যা পুষেছে ভেতরে, তার প্রেক্ষিতে যা যা তার সঙ্গে হয়েছের সে যা যা করেছে, জীবনের এ পর্যায়ে যেই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে —সবটা একবার বৃত্তের মতো ঘুরে এক বিন্দুতে স্থির হলো; জয় আমিরের এই জীবনটা ভুল ও বৃথা। মুরসালীন বহুবার বলেছে।

চলবে…
[আগামীকাল ঠিক সন্ধ্যায় এর বর্ধিতাংশ পেয়ে যাবেন। ওটুকু একসাথে দিতে চাইলাম, কিন্তু ছয় হাজার শব্দ পার হয়ে যাচ্ছিল। শব্দ বেশি ফেসবুকে সমস্য হয়। তাই দুই ভাগ করলাম।🙁
সামথিং হ্যাজ স্পেশাল আই থিংক! গ্যেস করতে পারেন কী! যাহোক, ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here