অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৫০.

0
84

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৫০.

সকাল সাড়ে নটা বাজে। বেশ ঠান্ডা পড়লেও রােদ ঝলমল করছে আকাশে। কুয়াশার বালাই নেই আজ। উত্তরা কফি এক্সপ্রেসের সামনে এসে দাঁড়াল তুহিন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সাইনবোর্ডটা একবার দেখে নিল তুহিন। দু সেকেন্ড ইতস্তত করে ঢুকে গেল ভেতরে।
এক্সপ্রেসের ভেতরেই বসে আছে ইরা। তুহিনের অপেক্ষা করছে। আজ সকালে ইরা নিজেই কল করে ডেকেছে
ওকে। তুহিনও মনেমনে এটাই চাইছিল। ইরার সাথে নিরিবিরে বসে কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু নিজের ইগোর কারণে কয়েকবার কল করতে গিয়েও করেনি। দুটো শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে এগিয়ে গেল তুহিন। ইরার টেবিলে গিয়ে; ওর অপজিটে চেয়ার টেনে বসল। ইরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। সেটা দেখে চোখ সরিয়ে ফেলল তুহিন। অজানা কারণেই ইরার সাথে চোখ মেলাতে অস্বস্তি হচ্ছে ওর। নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে ওয়েটারকে ডােকে দু কাপ কফি অর্ডার করল।
কিছুক্ষণ কেটে গেল নীরবতার মধ্যেই। তুহিন কিছু
বলছে না। কেবল তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। এদিকে ইরার চোখ সরছেনা তুহিনের থেকে। আসার পর থেকেই অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। এক দৃষ্টিতে। যা তুহিনের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরমধ্যে কফিও চলে এলো। তুহিন ইরার দিকে একপলক তাকিয়ে ইতস্তত করে নিল কাপটা। দীর্ঘসময় পরে তুহিনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের দিকে কাপটা টেনে নিল ইরা। বলল, ‘ধন্যবাদ। তােমার এতাে ব্যস্ততার মাঝে আমার জন্যে খানিকটা সময় বের করতে পেরেছো।’

তুহিন থমকাল। খানিকটা ইতস্তত করল। অতঃপর গলা ঝেড়ে বলল, ‘পরশু রাতের বিহেভিয়ারের জন্যে
আম স্যরি। আই রিয়েলি ডিডেন্ট মিন হােয়াট আই
সেইড।’

ইরা হেসে ফেলল। তাচ্ছিল্যের হাসি। বলল, ‘ত্রিশ
ঘন্টারও বেশি সময় পড়ে তোমার সেটা রিয়ালাইজ
হলাে? আর সেটাও তখন যখন আমি নিজে তােমাকে
ডাকলাম। যাক, তাও ভালো!’

‘ইরা আমি ভীষণ প্রেশারে ছিলাম তখন। আর এখন আমার চলমান কেইসটাও এতোটা ভাইটাল জায়গায় আছে,এক মিনিটও স্বস্তিতে বসতে পারছিনা। তাই_’

‘তাই? এতােটাই প্রেশারে ছিলে যে গোটা একটা দিনে
আমাকে কল একটাবার কল দিয়ে এইটুকু জিজ্ঞেস করার সময় পেলেনা যে আমার কী হয়েছিল? কেন কল করেছিলাম।’

‘স্যরি। আসলে আমার মাথায় ছিলোনা ঐ ব্যপারটা।
এক্সট্রেইমলি সরি।’

‘সেই! মনেতো থাকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। কিন্তু আমিতোে
টেকেন ফর গ্যারান্টেড। তাইনা?’

তুহিনের মেজাজ খারাপ হলো এবার। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল, ‘ওভার রিঅ্যাক্ট হচ্ছেনা? স্যরি বলছিতো।’

ইরা তুহিনের চোখে চোখ রেখে হাসল। দু সেকেন্ড
তাকিয়ে থেকে ব্যথিত কন্ঠে বলল, ‘কাল আমার
জন্মদিন ছিল তুহিন।’

তুহিন কিছুক্ষণের জন্যে বোকা বনে গেল। দ্রুত ফোনটা
অন করে তারিখটা দেখে বুঝল, ইরা সত্যি
বলছে। কাল জন্মদিন ছিল মেয়েটার। এখন আফসোস
হচ্ছে তুহিনের। জন্মদিনের দিনটাতেই মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিল? আরেকটু ধৈর্য্য ধরা যেতোনা কী! হালকা গলা ঝেড়ে তুহিন কিছু বলতেই যাচ্ছিল। ইরা থামিয়ে দিল ওকে। বলল, ‘তােমার মনে থাকবেই সেই আশা আমি করিনা তুহিন। এতো প্রেশার, কাজের মধ্যে অনেক সময় খাওয়ার কথাও মনে থাকেনা তোমার। জন্মদিন কীকরে মনে থাকবে? আমি জাস্ট কাল কল করে তােমাকে একটু কাছে চেয়েছিলাম। ঐ মুহুর্তেই হতে হতো সেটা না। যখন তুমি ফ্রি হবে, তখনই। আধ ঘন্টার জন্যে হলেও কালকের দিনের কিছুটা সময় তােমার সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তোমার তাে আমার একটা লাইন শােনারও সময় হলোনা। ব্যপারটাতো অন্যকিছুও হতে পারতো। আমার কোন বিপদ হতে পারতো। আরও খারাপ কিছু ঘটতে পারতো। এতাে উদাসীনতা তুহিন? এতােটাই আনইমপর্টেন্ট আমি তােমার কাছে?’

তুহিন নরম গলায় বলল, ‘ইরা আমি সত্যিই স্যরি। আমার মনে_’

এবারও তুহিনকে থামিয়ে দিল ইরা ‘তােমার আমায় তখনই মনে পরে তুহিন, যখন তােমার কোন কাজ থাকেনা। যখন তামার কাছে করার কিছু থাকেনা। আমি তোমার অবসরের বিনোদন মাত্র। তাইনা?’

বলতে বলতে কেঁদে ফেলল ইরা। তুহিন ধমক দিয়ে বলল, ‘ইরা!’

ইরা হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে বলল, ‘ধমকালে
সত্যিটা বদলে যাবেনা। তােমার কাছে সবার আগে
তােমার কাজ, তুমি, তোমার কলিগস্। সবকিছুর পর
যখন তুমি একা হয়ে যাও। সেই একাকিত্ব ঘোেচাতেই
ব্যবহার করছো তুমি আমাকে।’

তুহিনের প্রচন্ড রাগ লাগলেও অনেক কন্ঠে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ‘ আমার লাইফস্টাইলটাই এরকম ইরা। তুমি সবটা জেনেই আমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে।’

ইরা কঠোর গলায় বলল, ‘কিন্তু এরকম লাইফস্টাইলে
আমি মানিয়ে নিতে পারছি না। নট এনি মাের। অনেক
হয়েছে তুহিনে। শুধুমাত্র কারো ফ্রি টাইমের রিফ্রেশমেন্ট
হয়ে থাকতে পারব না আমি। তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবার।’

“ফ্রি টাইমের রিষ্রেশমেন্ট” কথাটা ভীষণভাবে গায়ে
লাগল তুহিনের। নিজের রাগ সামলে রাখতে পারল না
আর। ইরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কখনই তােমাকে জোর করে আটকে রাখিনি ইরা। যখন তােমাকে প্রপোজ করেছিলাম তখন শুধু বলেছিলাম “আই লাভ ইউ”। একবারও তােমাকে বলিনি আমার সঙ্গে রিলেশনে জড়াও বা “সে ইয়েস”। সেটা তােমার চয়েজ ছিল। আর এই তিনবছরও আমি কখনও তােমাকে আটকে রাখার চেষ্টা করিনি। আজও
করবোনা।’

ইরা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তুহিনের দিকে। ও
ভেবেছিল তুহিন বলবে “চলো, বিয়ে করে ফেলি।
সারাদিন না হােক দিনশেষে তো একসঙ্গে থাকতে
পারব। সারাদিনের ব্যস্ততার পর বিশ্রামটুকুতো তোমাকে বুকে নিয়ে নিতে পারব।” কিন্তু ও এরকম কিছু বলবে ইরা স্বপ্নেও ভাবেনি। তারমানে তুহিন চায় আলাদা হতে। এই সম্পর্কে ও আর থাকতে চায়না। এতোদিন বলার কোন সুযােগ পাচ্ছিল না। আর আজ সুযোগ পেয়েই বলে দিলো! মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ইরা। বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হলাে। দম আটকে আসল। কিন্তু বাইরে দিয়ে নিজেকে শক্ত রেখে বলল, ‘ সাে ইউ ওয়ান্ট ব্রেক আপ?’

তুহিন হতভম্ব হয়ে গেল। ইরা কত ইজিলি বলে ফেলল ব্রেক আপের কথা! ও যেতে দিতে চাইলেই যেতে হবে? নাকি সত্যি সত্যিই যাওয়ার জন্যে ছটফট করছে ইরা? ক্লান্ত হয়ে উঠেছে তুহিনের এই জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে। তবে তাই হোক। কথাগুলাে ভেবে চোয়াল শক্ত হয়ে এলোে তুহিনের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আপ টু ইউ।’

পুরাে দুনিয়াটাই যেন দুলে উঠল ইরার। ও আশা করছিল তুহিন বলবে “এক থা্পড় মারব আারেকবার ব্রেকআপের কথা চিন্তা করলে। বেয়াদব মেয়ে!” কিন্তু তুহিনের কিছুই যায় আসেনা। ভুলটা ওরই ছিল। তুহিনের উদাসীনতাকে ও তুহিনের ন্যাচার ভাবতাে। ভাবতো তুহিন এক্সপ্রেস পারেনা কিন্তু প্রচন্ড ভালোবাসে ওকে। কিন্তু ওর ধারণাক ভুল প্রমাণিত করল তুহিন। অনেক কষ্ট নিজের চোখের জল আটকালাে ইরা। ঘনঘন দুটো শ্বাস নিয়ে বলল, ‘ওকে, লেটস ডু ইট।’

তুহিন তাকিয়ে রইল ইরার দিকে। শান্ত স্বরে বলল, ‘আর ইউ শিওর?’

ইরা শক্ত গলায় বলল, ‘ ডেফিনেইটলি।’

তুহিন কিছু বলল না। ইরা বিল দেওয়ার জন্য নিজের
পার্সে হাত দিতে গেলে তুহিন বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ আমি
দেখছি।’

ইরা আপত্তি জানালোে না। পার্সটা হাতে নিয়ে উঠে
দাঁড়াল। তুহিনের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল, ‘ভালাে থেকো। এন্ড আই উইশ তােমার লাইফে আমার চেয়েও অনেক ভালো একটা মেয়ে আসুক। যে তােমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালো রাখবে।’

তুহিনের ভীষণভাবে বলতে ইচ্ছে করল, তোমার চেয়ে বেশি ভালো আমাকে কেউ রাখতে পারবেনা ইরাবতী। কিন্তু এবারও কিছু বলল না। ইরাও দাঁড়ালো না আর। দ্রুত পায়ে বের গেল কফি হাউজ থেকে। তুহিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিল মিটিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।

অফিসে গিয়ে সরাসরি ডিজির রুমের দিকে পা বাড়াল
তুহিন। দরজার কাছে গিয়ে বলল, ‘ মেই আই কাম ইন,
স্যার?’

ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলেন শাফায়াত হােসেইন।
তুহিনকে দখে সন্তুষ্টির হাসি হাসলেন। ল্যাপটপটা বন্ধ
করতে করতে বললেন, ‘ কাম ইন মাই বয়।’

তুহিন ভেতরে আসল। শাফায়াত হাতের ইশারায় বসতে
বললেন ওকে। তুহিন বসল। শাফায়াত বললেন, ‘ ভালো
হয়েছে এসেছাে। তােমাকে ডেকে পাঠাতাম আমি। আমি
জানতাম তুমি আমাকে নিরাশ করবে না। খু-নি অবধি
তুমি পৌঁছেই ছাড়বে। এন্ড আমি ঠিক ছিলাম। ভেরী
প্রাউড অফ ইউ। রুদ্রর ছবি প্রত্যেকটা নিউজ পেপারে,
সংবাদ মাধ্যমে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। দেশের বাইরে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ ওর। আর দেশেও বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবেনা। অনেক বছর যাবত ওকে বাগে পাওয়ার জন্যে ছটফট করছিল কয়েকটা ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু প্রমাণের ছিটেফোটাও খুঁজে পায়নি কেউ। সেই অসাধ্য সাধন তোমার দ্বারা হয়েছে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের দ্বারা হয়েছে। অবশেষে আমরা সফল! এবার শীঘ্রই ধরা পড়ছে সে।’

‘সবটা এতাটাও সহজ হবেনা স্যার। ও রুদ্র আমের।’

‘মানে?

তুহিন বলল, ‘নাথিং স্যার। শান মীর্জার ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। রুদ্র সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি তাতে শানকে জীবিত থাকতে দেবেনা ও।’

‘সে বিষয় চিন্তা করাোনা। ওর ওপর চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখা হচ্ছে।’

‘ আর প্রতিটা চেকপােস্ট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রিসোের্টে রুদ্র ছবি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করত হবে স্যার।’

‘ হ্যাঁ। আমি বলেছি। কাজ শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।’

তুহিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইতস্তত করে বলল, ‘আরেকটা কথা ছিল, স্যার।’

শাফায়াত হাসলেন। হেসে বললেন, ‘এতো ইতস্তত
করছাে কেন? বলে ফেলো।’

‘স্যার, আমি জেনেছি সোলার সিস্টেম অর্থাৎ রাশেদ
আমেরের সেই প্রজেক্টটা ঠিক কী ছিল। আর সে কী করতে চাইছিল।’

তুহিনের কথায় চমকে উঠলেন শাফায়াত। হতভম্ব গলায় বললেন, ‘হােয়াট?’

‘ইয়েস স্যার। ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তােলা,
মানি লন্ডরিং ছাড়াও রাশেদ আমেরের প্রধান ব্যবসা
ছিল অ-স্ত্রপাচার। বাইরের থেকে গমের বস্তায় করে
বুলেট আসতো আমের মিলসে। সেই বুলেটই আটার
প্যাকেটে করে সারা দেশে সাপ্লাই করতো দ্য সোলার
সিস্টেম। একই ভাবে বিভিন্ন পিস্তল এবং বেআইনি
অস্ত্রশস্ত্র চোরাচালানের মাধ্যমে বাইরে থেকে এনে বই,
বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটে করে দেশের বিখ্যাত অস্ত্রব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতো। শুধু
সােলার সিস্টেম নয় ডার্ক নাইট, ব্লাক হোলও এর সঙ্গে
যুক্ত ছিল। ডার্ক নাইট কোন একসময় সোলার সিস্টেমের পার্টনার ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কিছু ঝামেলার কারণে তাদের ব্যবসায়ীক বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। আর এরপর থেকে এই তিন দলের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো। সে অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু সমস্যা তখনই হয় যখন সােলার সিস্টেমের কাছে বারবার ব্লাক হোল আর ডার্কে নাইট মার খাচ্ছিল। আর সেই ম-রার ওপর খা-ড়ার ঘা হিসেবে দুবছর আগে রাশেদ আমের বেশ নামিদামি কয়েকটা দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরিকল্পনা করে। আগামী পাঁচ বছর ঐসব দল শুধুমাত্র সােলার সিস্টেমের কাছেই অস্ত্র পাচার করবে। তারা রাজিও হয়েছিল কারণ রাশেদ আমেরের অফার করা এমাউন্ট ছিলো লোভনীয়। বোকা না হলে এমন অফার কেউ ছাড়বেনা। কিন্তু সেই এমাউন্ট ম্যানেজ করতেই সোলার সিস্টেমকে অনেক খাটতে হয়েছে। প্রাণ গেছে অনেক সদস্যের আই মিন ক্রি-মি-নালের এবং এই প্রজেক্টা সফলভাবে দখল করাই রাশেদ আমেরের সেই সিক্রেট প্রজেক্ট।’

শাফায়াত হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে।
তুহিন বলে চলেছে, ‘ আর এটা জেনেই মাথায়
একপ্রকার বাজ পড়েছিল বাকি দুই গ্রুপের। কারণ
সবচেয়ে বেস্ট কোয়ালিটি ঐসব দলই দিতো। আর
ওখান থেকে সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে পেটে লাথি
পড়া। তারওপর সেই অ-স্ত্রগুলোর নিয়মিত ক্রেতা হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল দেশের অন্যতম কুখ্যাত অস্ত্রব্যবসায়ী হুসাইন আলী।’

‘ ওয়েট ওয়েট! হুসাইন আলী! যার নামে অলরেডি কয়েকটা রিপোর্ট পড়ে আছে আমাদের ফাইলে!’

‘ইয়েস স্যার।’

শাফায়াত অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘গড!’

তুহিন বলে চলেছে, ‘অর্থাৎ মানসম্মত অ-স্ত্র বেচা এবং কেনা দুটো রাস্তাই অলমোহ্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দলগুলোর। সবকিছু শেষ হয় যেতো ওদের। আর সেটা হওয়া থেকে আটকানোর জন্যেই ওরা সব করতে পারতাে। সব। হিংস্রতার চরমে যেতেও ওরা রাজী ছিল। এন্ড আই গেইস ওরা গিয়েছিল।’

শাফায়াত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ এগুলো তুমি
কীকরে জানলে?’

‘স্যার আমি পরপর দুবার গিয়েছিলাম আমের ভিলায়।
প্রথমদিন একটা ডায়েরি ছাড়া বিশেষ কিছু না পেলেও
পরেরবার গিয়ে বুকসেল্ফের পেছনে রাখা একটা
ব্রিফকেস পেয়েছিলাম। লক ছিল। ফরচুনেটলি রাশেদ
আমেরের ডায়েরি ঘেঁটে নাম্বার পেয়ে যাই আমি।
ব্রিফকেসটা খুলে কিছু পেপারস্ পাই। সেখানে স্পষ্ট
করে না হলেও এই প্রজেকটের বিষয়ে অনেক
ইনফরমেশন ছিল। এরপর আমাদের অন্যসব গােয়েন্দা
আর পুলিশের দেওয়া রিপোর্ট মিলিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার
করে নিত সমস্যা হয়নি আমার। আর মজার ব্যপার
হলাে এসব খু-নে যেসব বুলেট পাওয়া গেছে ওগুলো ঐ
পেপারে থাকা বেআইনি বু-লেটের সঙ্গে মিলে গেছে।’

‘সাপ্লাই ঠিক কারা দিতো বা রাশেদ আমেরের থেকে
কারা কিনতোে এ বিষয়ে কোন ধারণা?

‘কারা কারা কিনতো সেটা মোটামুটি জানা গেলেও সাপ্লাই করা দিতো সে ব্যপারে স্পষ্ট করে কিছুই জানা
যায়নি। তবে একটা ব্যপার আমার মাথায় চলছে স্যার।’

‘কী?’

তুহিন জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মনে মনে কথাগুলো
একবার গুছিয়ে নিল। এরপর বলতে শুরু করল, ‘তিনটে গ্রুপই বহুবছর ধরে এধরণের বেআইনি কারবার করে চলেছে। কিন্তু ওদের কারো বিরুদ্ধে একটা এভিডেন্স জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। দলের অনেক ছোট ছােট চুনােপুটিকে ধরা গেলেও দলের মাথা একদম অক্ষত ছিল। কীকরে স্যার? পেছনে বড় কান হাত না থাকলে। এটা সম্ভব?’

‘মানে?

‘মানে, আপনার মনে হচ্ছেনা স্যার, আমাদের কিছু
গণ্যমান্য নেতা মন্ত্রীদের অর্থসম্পদ একটু বেশিই দ্রুত
বাড়ছে? কাগজ বলে সবকিছু লিগ্যাল। কিন্তু আমাদের
চোখতাে আন্যকিছু বলছে স্যার। ব্যপারটা অনেকটা
আঙুল ফুলে গলাগাছ টাইপ না?’

নিজের চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন শাফায়াত। দীর্ঘ
এক নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি জানি তুমি কী
বােঝাতে চাইছাে। কিন্তু শুধু দেখলে, শুনলে, বুঝলেই
হয়না। আন্যদেরও দেখাতে হয়, শোনাত হয়, বোঝাতে
হয়। যেটা সবচেয়ে কঠিন। তােমার কেইস মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে তুহিন। শুধু রুদ্রর ধরা পড়ার অপেক্ষা।
আমার মনে হয় তোমার এখানেই থেমে যাওয়া উচিত। জানি কথাটা আনপ্রফেশনাল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ স্নেহ করি আমি। সেই স্নেহের জায়গা থেকেই বলছি।’

তুহিন মাথা নিচু করে হাসল। তারপর শাফায়াতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাস্তায় যখন হাঁটা শুরু করেছি রাস্তার শেষটা দেখে তবেই থামবো স্যার। অফিশিয়ালি যদি অনুমতি না পাই। আমাকে আনঅফিশিয়াलि কাজটা করতে হবে। এখন আসব স্যার?’

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলেন শাফায়াত। তুহিন বেরিয়ে
গেল। শাফায়াত তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। এই ছেলেটা খুব শান্ত, কিন্তু খুব জেদি। সে জানে। কিন্তু এই জেদের কারণে ওকে বড় কিছু মাথায় কোপের মুখে না পড়তে হয়!

নিজের কেবিনে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসল তুহিন। মানসিকডাবে ভীষণ ক্লান্ত আজ ও। কেইসটা মাটামুটি সল্ভ হওয়াতে ওর এখন রিল্যাক্স হওয়ার কথা ছিল। শান্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এবারে অস্থিরতার পরিমাণই বেশি। এই কেইসটা জীবনেও ভুলবে না ও। কারণ এই কেইসের কাজ করতে গিয়েই ও ওর ইরাবতীকে হারিয়েছে। ইরার সঙ্গে কাটানো কিছু সুন্দের সুন্দর মুহূর্ত মনে করার চেষ্টা করল তুহিন। একসঙ্গে কাটানাে স্পেশাল খুব বেশি মুহূর্ত পেলোনা স্মৃতির পাতা ঘেঁটে। হাতে গোনা কয়েকটাই পেল। তবে যা পেলো সবগুলোই খুব সুন্দর, ভালোবাসার।

‘স্যার আসব?’

তমালের কন্ঠস্বর শুনে চোখ খুলে তাকাল তুহিন। সােজা
হয়ে বসে বলল, ‘ এসাে। কোন খবর? রুদ্রকে পাওয়া গেছে?’

তমাল ভেতরে ঢুকে বলল, ‘না স্যার। মোস্ট ওয়ান্টেড
ক্রিমিনাল ও এখন। বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে
না। কিন্তু আরেকটা খবর আছে।’

‘কী খবর?’

‘সিঙ্গাপুর থেকে খবর নেওয়া হয়েছে স্যার। জাফর
আমেরের বউ বাচ্চার ব্যপারে। খবর বলছে ওরা মৃত স্যার।মা-র্ডা-র হয়েছে।

তুহিন চমকে উঠল। তমাল বলল, ‘তারচেয়েও অবাক
করার ব্যপার আছে স্যার। খু-নগুলো প্রায় আড়াই বছর
আগেই হয়েছে।’

‘হােয়াট?’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল তুহিন।

‘আরও একটা খবর আছে, স্যার।’

তুহিন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তমালের দিকে। তমাল বলল,’ জ্যোতিকে দেখা গেছে স্যার। একটা ঔষধের দোকানে। কিন্তু ধরতে পারেনি। তার আগেই ভীড়ে মিশে গিয়েছে। ওর কোলে একটা বাচ্চা ছিল স্যার। দেখে নাকি মনে হয়েছে কয়েকদিন আগেই জন্মেছে।’

তুহিন খানিকটা চিন্তা করে বলল, ‘ঔষধ যখন ওখান থেকে নিয়েছে। তারমানে আশেপাশেই কোথাও থাকছে ও। যত দ্রুত সম্ভব খোঁজ করো। দরকারে জায়গাটা চোষে ফেলো। আই ওয়ান্ট হার।’

‘ওকে স্যার।’

তমাল বেরিয়ে গেল। দুই হাত মাথার ওপরে তুল চেয়ারে
হেলান দিল তুহিন। জাফর আমেরের বউ-বাচ্চা বেঁচেই
নেই! কে মারল ওদের? ওর ভাবনাই তবে ঠিক? কিন্তু জ্যোতি কেন পালিয়ে বেরাচ্ছে? আর কোলে ছোট বাচ্চাটা কে ছিল। কার বাচ্চা ওটা? অন্যদিকে আরেকটা কথা খেলছে তুহিনের মাথায়। রুদ্র কোথাও ছদ্মবেশ নিয়েছে, কোথাও নেয়নি। আর ও চাইলেই জাল কার্ডগুলো তৈরী করতে ছদ্মবেশেই যেতে পারতা। পুলিশ যে ঐখান অবধি পৌঁছে যাবে সেটা বুঝত না পারার মতো বোকাতা রুদ্র না। কিন্তু ও সেটা করেনি। কেন? শায়লার সামনেও ও ছদ্মবেশে যেতে পারতো। তাও যায়নি। প্রথমে না ভাবলেও এখন বিষয়গুলো ভাবাচ্ছে রুদ্রকে। এগুলো কী সত্যিই রুদ্রর ভুল ছিল? নাকি ও জেনেশুনেই বিভিন্ন জায়গায় এই টুকরো টুকরো প্রমাণগুলো রেখে গেছে? কিন্তু এরকম কেন করবে রুদ্র। কী উদ্দেশ্যে? এতােগুলো প্রশ্নের কোনটারই উত্তর নেই তুহিনের কাছে। এসব প্রশ্নের উত্তর জ্যোতি আর রুদ্রই দিতে পারব ওকে। এই মুহূর্তে শুধু একটা কাজই করতে পারে তুহিন। অপেক্ষা! রুদ্র আর জ্যোতির ধরা পড়ার অপেক্ষা! অস্বস্তিকর এক দীর্ঘ অপেক্ষা!

!

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

(প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি)

[ * অবশেষে শেষ হলো প্রথম অধ্যায়। রুদ্র কী আদোও ধরা দেবে তুহিনের হাতে? কেন করছে সে এতােগুলো খু-ন? প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা নাকি অন্যকিছু? আমের ভিলার বাকিদের কী হলো? কোথায় এখন তারা? কেন পালিয়ে বেরাচ্ছে সকলের অলক্ষ্যে? এতো বেআইনি কারবারের মাথাদের মুখোশ খুলতে পারবে তুৃহিন? পারলেও সেটা কীকরে? এগুলাে সবই পরবর্তী অধ্যায়ে স্পষ্ট হবে। শীঘ্রই দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হবে। ততক্ষণ ধৈর্য্য ধরুন।

* যারা যারা এতোদিন উপন্যাসটা পড়েছেন আশা করছি সকলেই রেসপন্স আর গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আর উপন্যাস সম্পর্কে নিজের মনোভাব প্রকাশ আলোেচনা সমালােচনা করতে 💞 অনি’র মায়ামহল 💒💞 গ্রুপে যুক্ত হতে পারেন। আশা করছি ভালো লাগবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here