অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৮৮.
বর্তমান~
নিজের বসার ঘরের বড় সোফায় বসে আছেন শাফায়াত হোসেইন। ল্যাপটপে মগ্ন। দশ মিনিট হলো তুহিন এসেছে তার বাড়িতে। বসে আছে সিঙ্গেল সোফাটায়। এখনো কাজের কথা পাড়েনি শওকত। এসে থেকেই ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে তুহিনকে। আজ কেবিনে নয়, বরং নিজের বাড়ির ড্রয়িংরুমেই ওকে ডেকে নিয়েছেন শাফায়াত। কারণটা জানা নেই তুহিনের। সাভারের সেই নার্সের সম্ভাব্য ঠিকানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখনই কল করে বসেন ডিজি। জরুরি ডাক পাঠায় তার বাড়িতে। অবাক হয়েছিল তুহিন। তবে এইটুকু বুঝতে পারছে, জরুরি কিছু বলার আছে তার। বিষয়টা বোধহয় আনঅফিসিয়াল কিছু। সারাঘরে অস্বস্তিকর নীরবতা। সামনে রাখা দু কাপ কফিও ঠান্ডা হওয়ার পথে। হাতে নেওয়ার মানসিকতা পাচ্ছেনা তুহিন। অস্থির লাগছেব
আরও পাঁচমিনিট তুহিনের ধৈর্যের পরীক্ষা নিলেন শাফায়াত। অবশেষে ল্যাপটপ থেকে চোখ তুললেন। একহাতে নিজের চশমাটা ঠিক করে, অপরহাতে তুলে নিলেন কফির মগ। একটা চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিয়ে বললেন, ‘রুদ্রর কোন খোঁজ এখনো পাওনি। তাইতো?’
মেরুদণ্ড সোজা করে বসল তুহিন। স্পষ্ট গলায় বলল, ‘না স্যার, এখনো পাইনি। তবে_’
‘ তবে, কিন্তু, এখন এসব বলে লাভ নেই। শান মীর্জা এখনো ওর কাছে বন্দি। এবং তোমার উপস্থিতিতে, তোমার চোখের সামনে দিয়েই ওকে তুলে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে রুদ্র আমের। ইতিমধ্যে আটটা খুন করে ফেলেছে সে। হয়তো এতক্ষণে মেরেও ফেলেছে। যা কিছু হতে পারে। সেদিন তোমাকে ভরসা করে, গোটা অপারেশানের দায়িত্ব দিয়েছিলাম তোমার কাঁধে। তুমিও বড়মুখ করে নিজেই লীড করার অনুরোধ করেছিলে আমাকে। কিন্তু প্রথমবার হতাশ করেছো তুমি আমাকে। ব্যর্থ হয়েছো। ওপরমহল থেকে কী ভয়ানক চাপ আসছে ধারণা নেই তোমার। জবাবদিহি করতে হচ্ছে আমাকে। এতোটা কেয়ারলেসনেস তোমার কাছ থেকে অন্তত আশা করিনি।’
রুক্ষ স্বরে কথাগুলো বলে থামলেন শাফায়াত। মেজাজ খারাপ হল তুহিনের। ব্যর্থতার ঘা যেন আরও দগদগে হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। বলল, ‘আ’ম ট্রায়িং মাই বেস্ট স্যার।’
শাফায়াত মাথা নেড়ে বললেন, ‘আই ডোন্ট থিংক সো। তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই খুন-গুলোর গোড়া অবধি পৌঁছনোর। খু-নিকে খুঁজে বের করার এবং পরপর ঘটে চলা এই হ-ত্যা-কাণ্ড বন্ধ করার। কিন্তু আমার পাওয়া ইনফরমেশান অন্যকিছু বলছে তুহিন।’
‘ অন্যকিছু বলতে?’ ভ্রুকুটি করল তুহিন।
‘ আমি জেনেছি, খু-নির চেয়ে বেশি খু-নির ব্যাক্তিগত এবং পারিবারিক অতীতের বিস্তারিত জানতে তুমি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছো। যেগুলো কেইসের সঙ্গে রিলেটেডও না। এসব আলতু-ফালতু কাহিনী শুনে সময় নষ্ট করছো। এতোদিন তাও মানা গেছে, কারণ খু-নির পরিচয় তুমি জানতে না। তাই অতীতে ঘটা ঘটনা থেকে ধারণা নিচ্ছিলে বর্তমানের কেইসটার সাথে কানেক্ট করার জন্যে। কিন্তু এখনতো তুমি জানো খু-নি কে। তোমার সম্পূর্ণ ফোকাস তাকে ধরায় থাকাটা উচিত নয় কী?’
‘ আমার ফোকাস সেদিকেই আছে স্যার।’
‘ না নেই! সোলার সিস্টেম, ব্লাক হোল, ডার্ক নাইটের সম্পূর্ণ অতীত জানা, তাদের সঙ্গে জড়িত সকল ব্যবসায়ী এবং এমপি-মন্ত্রীদের নিয়ে রিসার্চ করাতেই তোমার ফোকাসটা বেশি দেখতে পাচ্ছি আমি। ইদানিং বেশ কিছু নামিদামি লোকেদের নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করছো তুমি। যার কোন দরকারই নেই। এই মুহূর্তে খু-নিকে ধরাই তোমার প্রধান টার্গেট। অর্থাৎ রুদ্রকে ধরা। সে কাজটা হয়ে গেলেই আশা করছি তুমি থেমে যাবে। এবং শান মীর্জার কোনরকম ক্ষতি হওয়ার আগে রুদ্র আমেরকে আমরা আমাদের কাস্টাডিতে দেখতে চাই। গট ইট?’
তুহিন নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শাফায়াতের দিকে। গায়ে লাগল কথাগুলো। কিন্তু মুখে বলল, ‘ইয়েস স্যার। কিন্তু এখানেও কিছু কম্প্লিকেশান আছে। ব্যপারগুলো এতোটা সহজ নয় যতটা মনে হচ্ছে স্যার!’
‘ যেমন?’
‘ যেমন লক্ষ্মীবাজার ঘটে যাওয়া খুনটাতে খু-নির যে ব্লা-ড পাওয়া গিয়েছিল সেটা রুদ্রর ছিলোনা। কারণ রাশেদ আমেরের সঙ্গে সেই ব্লা-ডের ডিএনএ ম্যাচ করেনি। এরপর, সাভারে যেদিন হাসপাতাল থেকে শানকে কিডন্যাপ করা হয়, সেদিন রুদ্রর সঙ্গে কেউ না কেউ অবশ্যই ছিল। সেদিনের গোটা পরিকল্পনাটা একা এক্সিকিউট করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। সুতরাং প্রশ্ন থেকেই যায়, রুদ্র খু-নি হলেও সবগুলো খু-ন ওর দ্বারা ঘটেছে কি-না। ওর সঙ্গীই বা কে। এছাড়াও, প্রথম যেদিন আমরা আমের ভিলায় প্রবেশ করি, ডার্ক নাইটেরই একজন সন্ত্রাসী কিছু একটা খুঁজছিল সেখানে। এবং ধরা পড়ে যাওয়ায় সা-য়া-না-ইড গিলে সু-ই-সা-ইড অবধি করল। কী এমন জিনিস স্যার? যেটার কথা ফাঁস হলে ওদের বিপদ বাড়বে? যার জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত দলের লোকজন? এবং সেটা খুঁজতে আমের ভিলাতেই এলো? এর কানেকশন যে বর্তমানে হয়ে চলা খু-নগুলোর সঙ্গে আছে সেটাতো স্পষ্ট স্যার!’
কপালে পড়া ভাজ আরও গাঢ় হল শাফায়াতের। তুহিন আরও বলল, ‘আরও অবাক করা ব্যপার কী জানেন স্যার? রুদ্র আমের স্ত্রী অন্য কেউ নয়; শওকত মীর্জারই একমাত্র মেয়ে। রাণী মীর্জা। কল্পনা করতে পারছেন?’
চকিতে তাকালেন শাফায়াত। সমগ্র মুখজুড়ে হতভম্ব ভাব স্পষ্ট। তুহিন মৃদু হেসে বলল, ‘অভ্যন্তরের ঘটনাগুলো আরও ভয়ংকর স্যার। যা হয়তো আমাদের কল্পনারও অতীত। আর একজন ইনভেস্টিগেটর হিসেবে এমন গভীরতার গন্ধ পেয়েও থেমে যাওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব না। স্যরি স্যার!’
শাফায়াত হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর আস্তে করে খুলে ফেললেন চোখের চশমাটা। ধীরেসুস্থে ওটা টেবিলে রেখে বললেন, ‘ব্যপারগুলোযে কম্প্লিকেটেড সেটা আমিও জানি তুহিন। তোমার তোলা পয়েন্টগুলোও যথার্থ। কিন্তু এটাও সত্যি যে উপযুক্ত প্রমাণের কাছ থেকে অনেকটাই দূরে আমরা। আর তুমি যাদের পেছনে লাগতে চাইছো তারা সাধারণ কেউ নয়। আর প্রমাণ ছাড়া এ বিষয়ে একটা কদম ফেলাটাও গোটা ডিপার্টমেন্টের জন্যে হুমকিসরূপ।’
তুহিন লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘সেটা আমিও জানি স্যার। এই কেইস সম্পর্কিত; অর্থাৎ রুদ্রকে ধরা ছাড়া অন্যকোন কাছে আমি আপাতত ডিপার্টমেন্টকে আপাতত জড়াবোনা। আমার বাকি কাজ পুরোটাই আনঅফিসিয়াল হবে, যতক্ষণ না কোন উপযুক্ত প্রমাণ পাচ্ছি।’
আর গম্ভীর হলো শাফায়াত হোসাইনের চোখমুখ। থমথমে গলায় বললেন, ‘এতে কিন্তু তোমার বিপদ আরও বাড়বে তুহিন। জাস্ট একটা ভুল তোমার চাকরি নিয়ে টান দেবে। আর এতে শুধু চাকরি নয়, তোমার প্রাণও যেতে পারে।’
শাফায়াতের চোখে চোখ রাখল তুহিন। আত্মবিশ্বাসপূর্ণ হাসি হেসে বলল, ‘প্রাণের মায়া থাকলে গোয়েন্দাগিরিকে প্রফেশান হিসেবে বেছে নিতাম না স্যার। আমি জানি আমি কী করছি এবং এর পরিণতি কী কী হতে পারে। যেকোন পরিণতির জন্যে আমি প্রস্তুত স্যার। কিন্তু এর শেষ না দেখে আমি থামছিনা। তবে আমি আপনাকে প্রমিস করছি স্যার। রুদ্র আমের ধরা পড়বে। এবং সেটা খুব শীঘ্রই।’
লম্বা শ্বাস ফেললেন শাফায়াত। পুনরায় চশমাটা চোখে পড়তে পড়তে বললেন, ‘ আই হোপ সো। দেখো তুহিন, তোমাকে শুধুমাত্র আমি আমার ডিপার্টমেন্টের একজন ইনভেস্টিগেটর হিসেবে দেখিনা। আমার ছেলের মতো দেখি। তাই এই আনঅফিসিয়াল মিটিংটা করলাম। দেয়্যার হ্যাজ আ থিন লাইন বিটউইন টেকিং রিস্ক এন্ড স্টুপিডিটি। আই হোপ ইউ উইল রিমেম্বার দ্যাট।’
‘ ডেফিনেটলি স্যার।’
তুহিনের আত্মবিশ্বাসপূর্ণ জবাবে মনেমনে গর্বিত হাসলেন শাফায়াত। কফির মগে দু চুমুক দিয়ে, ডিজির অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে এলো তুহিন।
এই আনঅফিসিয়াল মিটিংয়ের কারণটা উপলব্ধি করতে পারছে তুহিন। নিশ্চয়ই ওপর থেকে চাপ এসেছে শাফায়াতের ওপর। সতর্ক করা হয়েছে। সরাসরি বলতে পারেনি ডিজি। তাই ইশারা-ইঙ্গিতে সাবধান করে দিলেন আজ। স্নেহের বশবর্তী হয়েই বোধহয় এককাজ করলেন তিনি।
তুহিনের কর্মকাণ্ড পছন্দ হচ্ছেনা অনেকেরই। না হওয়ারই কথা। স্বার্থে ঘা লাগবে যে! হঠাৎ কদিন হল তুহিনের ফোনেও বারংবার হু-মকি কল, মেসেজ আসছে। খু-নের হু-মকিও এসেছে। অর্থ একটাই, যেকোন মূল্যে ওকে থামাতে চাইছে ওরা। ভয় পাচ্ছে, এর শেষ অবধিনা পৌঁছে যায় তুহিন। এতে ভয়ানক ধস নামবে অনৈতিকতার বাজারে! কিন্তু ওরা জানেনা। মাঝপথে শুকিয়ে যাওয়ার মতো নদী তুহিন নয়, বরং সমুদ্রে মিশে লক্ষ্য পূরণ করাই তার ধর্ম।
–
নিজের অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে চলেছে শওকত মীর্জা। বিকেলের আবছা কুয়াশার সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়া অদ্ভুত দৃশ্যপট সৃষ্টি করেছে তার চারপাশে। কপালে পড়া চিন্তার রেখা গভীর থেকে গভীরতম হয়ে চলেছে। পরপর পাঁচটা সিগারেট শেষ করে ফেলেছে সে। অথচ না চিন্তা কমছে, আর না অস্থিরতা। কমবে কীকরে? চারদিকে অন্ধকার দেখছে সে এখন। সদ্য ভাইটা মারা গেল। তার একমাত্র ভাই। ছোটবেলা থেকেই যে ছিল তার অন্যতম সঙ্গী। তার চিৎকার শুনেছে শওকত, বাঁচার আকুতি শুনেছে। কিন্তু কিচ্ছু করতে পারেনি। বাঁচাতে পারেনি নিজের ভাইকে। আর এখন তার একমাত্র ছেলে। তার শেষ সম্বল। তার প্রাণও এখন রুদ্র আমেরের হাতে বন্দি। না জানি কী ভয়ানক অত্যাচার করছে জানোয়ারটা তার ছেলের ওপর। কতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখবে তাও জানেনা। কিচ্ছু করতে পারছেনা সে। ইদানিং ভেতর থেকেই কেউ একজন সব বলে দিচ্ছে রুদ্রকে। কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সব। তাও রাজনৈতিক দলের কেউ। এমনকি ব্যক্তিগত নাম্বারটাও! ভাবা যায়! তারওপর ঐ পেনড্রাইভটাই অর্ধেক আটকে রেখেছে শওকতকে। যারফলে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগও করতে পারবেনা সে এখন। নির্বাচনের এতো কাছে এসে সবটা কেঁচিয়ে দিতে পারবেনা সে। কোনভাবেই না।
অন্যদিকে ঐ তুহিন আহমেদ! ঐ ছোকরাকেও থামাতে হবে এবার। কথা বলেছে নিজের পার্টনারদের সাথে। ছেলেটা বেশিই উড়ছে। কেঁচো খুড়তে এসে কেউটে বের করার ধান্দায় আছে ও। কেউটের সন্ধ্যান পাওয়ার আগেই থামাতে হবে তুহিনকে। টাকা, পয়সা, হুমকি দিয়ে ঐ ছেলেকে থামানো যাবেনা একদিন কথা বলেই বুঝে গেছে শওকত। থামানোর আর একটাই উপায় অবশিষ্ট আছে। মৃত্যু! সেসব নিয়ে তাকে ভাবতে হবেনা যদিও। বাকিরাই করে দেবে কাজটা।
কিন্তু শান! দম বন্ধ হয়ে এলো শওকতের। দাঁতে দাঁত চেপে আকড়ে ধরল নিজের কাঠের পা টা। যা করার তাকেই করতে হবে। নিজের ছেলেকেও ছাড়িয়ে আনবে আর ঐ রুদ্র আমেরকেও জাহান্নামে পাঠাবে। এখন শুধু রুদ্রর একটা কলের অপেক্ষা!
নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ল শওকতের। কোনদিনও মেয়ের প্রতি আহামরি টান অনুভব করেনি শওকত। ভালোবাসাও ছিলোনা। কিন্তু কিছু একটা ছিলো, সেটাও অস্বীকার করার জায়গা নেই। শত হলেও তার নিজেরই র-ক্ত ছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছয় নম্বর সিগারেট জ্বা-লালো শওকত। দু টান দিতে না দিতেই বেজে উঠল তার সেলফোন। মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে ফোনটা বের করল শওকত। আননোন নাম্বার। শওকত ধারণা করল এটা রুদ্রর কল। তাই সময় নষ্ট না করে শীঘ্রই রিসিভ করল। তার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে ওপাশ থেকে ভেসে এলো রুদ্রর কন্ঠস্বর, ‘ভালো আছো মীর্জা?’
দাঁতে দাঁত পিষল শওকত, ‘মশকরা করছো?’
হেসে উঠল রুদ্র, ‘আপনার কাছ থেকেই শিখেছি। অনূভুতিটা দারুণ তাইনা? যখন আশেপাশে কেউ থাকেনা। কাউকে বিশ্বাস করা যায়না। যখন কেউ দুর্বলতাটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেে? দমবন্ধ লাগছে নিশ্চয়ই?’
শওকত রাগে হিসহিসিয়ে বলল, ‘তোমাকে খু-ন করব আমি!’
গম্ভীর হল রুদ্র। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘লা-শকে খু-ন করা যায়না মীর্জা! তবে জীবিত মানুষকে করাই যায়!’
কথাটা বলে নিজের সামনে পড়ে থাকা র-ক্তা-ক্ত শানের দিকে তাকালো রুদ্র। যার হাত, পা, মুখ বেঁধে বিদ্ধস্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছে ও। হুংকার দিয়ে উঠল শওকত, ‘খবরদার রুদ্র! আমার শান কোথায়? কথা বলব আমি ওর সাথে।’
‘ সুযোগ একবারই দিয়েছিলাম। কোটা শেষ।’
‘ প্রমাণ কী যে তুমি এখনো ওকে বাঁচিয়ে রেখেছো?’
‘ আমি কথার খেলাপ করিনা মীর্জা। কথা দিয়েছিলাম, তোমার চোখের সামনেই তোমার ছেলেকে মারব। ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আজ রাত ঠিক আটটায় চলে এসো। একা। এক মিনিটও যদি দেরী হয়; ছেলের মৃ-ত্যু সচোক্ষে দেখার সৌভাগ্য হবেনা তোমার। কেবল লা-শটা পাবে।’
‘ আসব।’
‘ গুড! আরেকটা কথা মনে করিয়ে দেই তোমাকে। জিনিসটা কিন্তু এখনো আমার হাতেই আছে। তাই পুলিশকে জানিয়ে কিংবা নিয়ে আসার চেষ্টাও করোনা। আমি ধরা পড়লে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা কিন্তু তোমার হবে। সেটা তুমিও জানো। আর হ্যাঁ! অবশ্যই একা আসবে।’
কন্ঠস্বর শীতল হলেও স্পষ্ট হুমকির আভাস পেল শওকত। শক্ত কন্ঠে বলল, ‘মনে থাকবে।’
কল কেটে দিল রুদ্র। কানে ফোন ধরেই কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শওকত। অতঃপর আস্তে করে নামিয়ে রাখল ফোনটা। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। জ্বলন্ত সিগারেটটাই মুচড়ে ফেলে দিল নিচে। সেসময় ফোনে মেসেজ রিংটোন বেজে উঠল। রুদ্র ঠিকানার সম্পূর্ণ ডিটেইলস পাঠিয়ে দিয়েছে তার ফোনে। সীমাহীন রাগে কেঁপে উঠল শওকতের সমগ্র শরীর। ফোনটা ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল। সেই ট্রেনের ঘটনার পর থেকেই, ঐ একটা ছেলে তার সমগ্র জীবন জ্বা-লিয়ে পু-ড়িয়ে দিল। শানের জন্যে বুকটা হাহাকার করে উঠল তার।
‘তোর মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে আসব স্ক্রাউন্ডেল!’
–
‘ আমি জানিনা উনি কোথায় গেছেন।’
শক্ত চোখে মেয়েটার দিকে তাকাল তুহিন আহমেদ। মেয়েটার নাম সীমা। ঐ দুইজন নকল নার্সের মধ্যে সেও একজন। সাভারের পুরোনো বাড়ি থেকে খোঁজ নিয়ে যে সম্ভাব্য ঠিকানা পেয়েছিল; সেখানেই পাওয়া গেছে মেয়েটাকে। ওদের দেখেই পালাচ্ছিল মেয়েটা। কিন্তু তুহিন নিজের সঙ্গে দুজন মহিলা কন্সটেবল নিয়ে এসেছিল। যেহুতু একজন মেয়েকে ধরতে যাচ্ছে। তারাই ধরে ফেলে সীমাকে। প্রথমে কিছুই স্বীকার করতে চাইছিল না। কন্সটেবল দুজন কষিয়ে কয়েকটা মারতেই ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করে।
তুহিন কন্সটেবলের দিকে তাকাতেই ঠাটিয়ে আরও এক চ-ড় পড়ে সীমার গালে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সীমা। বলে, ‘আমি সত্যি বলছি স্যার। আমাকে কিছুই বলেনি।’
তুহিন সীমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলল, ‘অজ্ঞান বডিটা হাসপাতাল থেকে বের করে নিতে সাহায্য করলেন। অথচ জানেন না কোথায় নিয়ে গেছে?’
‘ না।’
আরও একবার নাদুসনুদুস কন্সটেবল মহিলার দিকে ইশারা করল তুহিন। সীমার চুলের মুঠি ধরে আরও কয়েকটা মা-রল সে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সীমা। বলল, ‘স্যার বিশ্বাস করুন আমি সত্যি বলছি। আমাদের শুধু বলা হয়েছিল ঐ বডিটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে। এই পর্যন্তই এসেছিল আমাদের সাথে। এরপর! এরপর রুদ্র ভাই তার জীপ দিয়ে ঐ লোকটাকে নিয়ে চলে গেছে।’
ভ্রু কোঁচকালো তুহিন, ‘ জীপ নিয়ে চলে গেছে? এ পর্যন্ত আসল কীকরে তবে?’
‘ অ্যাম্বুলেন্স! অ্যাম্বুলেন্সে করেই এই অবধি এসেছিলাম আমরা।’
চোখ বন্ধ করে আফসোসের শ্বাস ফেলল তুহিন। এইজন্যই ওর তৈরী করা সার্কেল পেরিয়ে যেতে পেরেছিল রুদ্র! বোকামি হয়ে গেছে! কিন্তু একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করা চারটিখানি কথা না। কীকরে করল এটা? ওসব নিয়ে ভেবে মাথা নষ্ট করল না তুহিন। বলল, ‘ কোথায় যেতে পারে ও? কোন ধারণা আছে?’
সীমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘নেই স্যার! সত্যিই বলছি।’
মহিলা কন্সটেবল দুজনকে ইশারা করল তুহিন। তারা দুজন এসে ধরে ওঠালো সীমাকে। তুহিন বলল, ‘একে নিয়ে ভালোভাবে জেরা করো। ওর সেই সঙ্গীর খোঁজ আরও যা যা তথ্য এর পেটে আছে বের করার জন্যে যা যা করতে হয় করো। যেকোন মূল্যে যাতে সবটা উগলে দেয়।’
সীমা আকুতিমিনতি করল, ‘ স্যার আমাকে ছেড়ে দিন স্যার। আমি আর কখনও করব না এসব প্লিজ স্যার।’
কিন্তু সুস্বাস্থের অধিকারী দুই নারী কনস্টেবল টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল তাকে।
ঘুনে ধরা চৌকিটায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন। উঁবু হয়ে দুহাতে চেপে ধরল নিজের মুখ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হল। সাতটা বাজে। আরও একটা দিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু রুদ্র এখনো ওর ধরাছোঁয়ার বাইরে। আজ আমের পরিবারের বাকিদের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু ডিজির হঠাৎ কলের কারণে সেটাও হলোনা। তমালকে পাঠিয়েছে শওকত মীর্জার ওপর নজর রাখার জন্যে। আজ সারাদিন যাবত সেটাই করছে তমাল। ফোন ট্রাক করেনি। কারণ শওকত মীর্জা কখনই তার ব্যক্তিগত নাম্বার প্রকাশ করবেন না। তবে ওর বিশ্বাস রুদ্র আসবে তার কাছে, নয়তো ডেকে পাঠাবে তাকে। দুটোতেই তুহিনের লাভ। রুদ্র অবধি পৌঁছনোর এখন এটাই শেষ এবং একমাত্র উপায়। কিন্তু তমালের কাছ থেকেও কোন খবর আসছেনা এখানো।
আরও একটা দিন নষ্ট হল। হতাশ বোধ করল তুহিন। সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। অস্থির লাগছে ভীষণ। প্রিয়তার আসল সত্যিটা মাথায় আসতেই সর্বাঙ্গ কেমন করে উঠছে ওর। রুদ্র কীকরে হজম করেছিল এই সত্যি? কতটা কঠিন ছিল সেই মুহূর্তটা? কতটা নিষ্ঠুর ছিল সেই সময়?
তুহিনের ইরার কথাটাই মাথায় এলো এই মুহূর্তে। আজ আর কোনকিছু ভাবল না তুহিন। ফোন বের করে সোজা কল করে ফেলল ইরার নাম্বারে। রিং হলো। বাজ অনেকক্ষণ। কিন্তু ধরল না কেউ। ভ্রুকুটি করল তুহিন। আবার কল করল। এবারও বাজতে বাজতে কেটে গেল। ধরল না কেউ। তৃতীয়বার কল করল তুহিন। কিন্তু এবার কে-টে দিল কলটা। ফোনের স্ক্রিনে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল তুহিন। বুকের ভেতর কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। নিঃশ্বাস ভারী হল।
তখনই বেজে উঠল তুহিনের ফোন। ইরার কল ভেবে চমকে উঠেছিল তুহিন। কিন্তু কলটা তমালের ছিল। মুহুর্তেই সবকিছু ভুলে কলটা রিসিভ করল তুহিন। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘ বলো তমাল।’
‘ স্যার, শওকত মীর্জা তার গাড়ি নিয়ে সাভারের রাস্তায় ঢুকেছেন। মেইনরোড ছেড়ে ভেতরের দিকে যাচ্ছেন উনি। আমার ধারণা, রুদ্রর কাছেই যাচ্ছে সে।’
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল তুহিন, ‘গুড! ফলো করো! আমি ওদিকেই আছি। লোকেশন অন রাখো। তোমার লোকেশন ট্রাক করব আমি।’
‘ ওকে স্যার।’
‘ শোন! হেডলাইট অফ রেখে যথেষ্ট দূর থেকে ফলো করো। কোনভাবেই যাতে টের না পায়। লোক আছেতো তোমার সাথে?’
‘ জি স্যার। পাঁচজন আছি আমরা।’
‘ গ্রেট! বেস্ট অফ লাক!’
ফোন কেটে দ্রুত বেরিয়ে এলো তুহিন। গাড়িতে উঠে বসল। ট্রাক করে দেখে নিল তমালের বর্তমান অবস্থান। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিল। মনে মনে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে নিল তুহিন। হোলস্টারে হাত দিয়ে চেক করে নিল নিজের বে-রে-টা। আজ কোনভাবেই হাতছাড়া করা যাবেনা রুদ্রকে। বলতে গেলে এটাই শেষ সুযোগ। যেকরেই হোক কাজে লাগাতে হবে তুহিনকে।
তমালের লোকেশন ফলো করেই গাড়ি ছোটাচ্ছে তুহিন। হঠাৎ লক্ষ্য করল একটা গাড়ি ফলো করে চলেছে ওকে। অনেকক্ষণ যাবত। সত্যিই ফলো করছে কি-না পরীক্ষা করেছিল ও। ফলাফল এসেছে, হ্যাঁ। ফলো করছে তারা। অপেক্ষা করছে কোন নির্জন জায়গায় তুহিনকে একা পাওয়ার। মোবাইল স্ক্রিনে একবার তমালের লোকেশন দেখে নিয়ে বিড়বিড় করল, ‘শীট!’
কাছে চলে আসছে গাড়িটা। মনে মনে প্রমাদ গুনলো তুহিন। এদেরকেও এখনই আসতে হলো!
#চলবে…