শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_35
#Writer_NOVA
— নুবা!
আমার নামের বিকৃত উচ্চারণ শুনে কপাল কুঁচকে ইফাতের দিকে তাকালাম। দিলো রে দিলো, এই নেংটি ইদুর শেষ পর্যন্ত আমার নামটারও মান-ইজ্জ্বত মেরে দিলো। আমি রাগী চোখে একবার ইফাতের দিকে তাকাতেই ইফাত আবার মুখ কুচোমুচো করে ডাকলো,
— নুবা, ও নুবা, আমার নুবা।
আমি ইফাতের দিকে কটমট করে তাকিয়ে নিজের কপালে জোরে একটা চাপড় মারলাম। নোবা বললেও একটা কথা ছিলো। তা না করে নুবা😑।আম্মু খুব শখ করে শিশুদের নামের বই থেকে আমার নাম রেখেছিলো নোভা। এটা একটা বিদেশি নাম। যার অর্থ নক্ষত্র। আম্মুর ধারণা ছিলো আমি নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করবে। কিন্তু এখন তার ভাষ্যমতে আমি নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করাতো দূরেই থাক তারার মতো মিটমিটও করি না। আরেকটা নাম আছে আমার। যেটার সংক্ষিপ্ত হলো রাই। এই নামে আমায় খুব কম মানুষই ডাকে।
কিন্তু আজকে ইফাত আমার নামের পুরো দফারফা করে দিলো৷ আমি ওর দিকে খাইয়া ফালামু লুক দিয়ে হাতের ইশারায় সামনে আসতে বললাম। ও মাথা নাড়িয়ে বললো,
— আসবো না। এখন আসলে তুমি আমাকে মারবে।
— না আসলে আরো বেশি মারবো। জলদী এদিকে আয়। আমার এই নতুন নাম তুই পেলি কোথায়?
— আমি বানাইছি।
— তা আকিকা দিছিস? আমার নাম রাখছিস নতুন করে আর আকিকা দিবি না? তুই এদিকে আয়। তোর সাথে আমার কথা আছে। বিচ্ছু পোলা। আমার নামটাকে পুরো মান-সম্মান শেষ করে দিলো।
ইফাত দাঁত কেলিয়ে আবারো মাথা নাড়ালো। আমি উঠে ওর দিকে যাওয়ার আগেই দৌড়ে পালালো। তখুনি খট করে ওয়াসরুমের দরজা খুলে গেল। ইফাতের দাদী বের হতেই আমি ভুবন ভুলানো এক হাসি দিয়ে তাকে লম্বা সালাম দিলাম।
— আসসালামু আলাইকুম দাদী। কেমন আছেন?
— আরে বড় নাতির বউ যে।ওয়া লাইকুমুস সালাম। আল্লাহ রাখছে ভালোই। তুমি কেমন আছো?
— আল্লাহর রহমত এবং আপনাদের দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ। তা আপনার শরীর ভালো আছে তো?
— আছে কোনরকম। হঠাৎ আমার কাছে?
— আমি হঠাৎ হঠাৎই আসি। হুট করে এসে কাউকে চমকে দিতে আমার ভালোই লাগে। আন্টি বললো আপনার শরীরটা নাকি ভালো না তাই আপনাকে দেখতে এলাম।
উনি একটু হেসে ওয়ারড্রবের ওপর থেকে পানের বাটা নিয়ে খাটে বসলেন। আমার আবার একটা গুণ আছে। এটাকে ভালো গুণই বলে। গুণটা হলো যে যেরকম তার সাথে আমি সেরকম ভাবে মিশতে পারি। তার মনের মতো হয়ে খুব কম সময়ে তার মন জয় করার ক্ষমতা আমার আছে।যদি আমি চাই তাহলে। নয়তো না। এই যে ধরুন তেল মারানো মানুষের সাথে তার মন মতো চলতে পারবো। কিপ্টের সাথে থেকে কিপ্টামি করতে পারবো। শুচিবাই মানুষের সাথে তার মন মতো চলে তার মন জয় করতে পারবো। ইফাতের দাদী নিজের প্রশংসা শুনতে ভীষণ পছন্দ করে। সুতরাং এখন তার প্রচুর প্রশংসা করে তাকে ফুলিয়ে আমার কাজ হাতাতে হবে।
উনি মনোযোগ দিয়ে পান সাজাচ্ছে। আমি কিছুটা থেমে তাকে বললাম,
— দাদী একটা পান দিয়েন তো। তবে জর্দা দিয়েন না। জিহ্বা পুড়ে যায় আমার। চুন সামান্য পরিমাণ। আপনার হাতের পান আমার ভীষণ পছন্দ। একবার মুখে দিলে শেষ হয়ে গেলেও মনে হয় এখনো মুখে লেগে আছে। আমি অনেকের হাতের পান খেয়েছি কিন্তু আপনার হাতের সাজানো পানের মতো আজ অব্দি কারোটা এত স্বাদ লাগেনি।
আহা, আমার তোষামোদে উনি একেবারে ফুলে ঢোল হয়ে গেলো। দ্রুত একটা পান সাজিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে খুশি খুশি মনে বললো,
— প্রতম (প্রথম) দুইবার পিক ফালায় দিবা। ঐগুলার মধ্যে বিষ থাকে। পরেরগুলো দেখবা চাবাইতে চাবাইতে মিঠা লাগে। তখন গিইলা ফালাইয়ো।
আমি বিসমিল্লাহ বলে দু চোখ বুজে পান মুখে পুরলাম। আজকে আমার খাওয়া বন্ধ। পান খেলে গালের মাংস ছিলে যায়। তবে মুখে হাসি হাসি ভাব বজায় রেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বললাম,
— আহা কি স্বাদ! কতদিন পর এতো স্বাদের পান খেলাম। লাভ ইউ দাদী।
— লাভ ইউ টু বউ।
লাভ ইউ টু শুনতেই চোখ উল্টিয়ে দরজার দিকে তাকাতে দেখলাম ইফাত মুচকি হেসে উঁকি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আর লাভ ইউ টু সেই বলেছে। আমি ঠোঁট কামড়ে রাগী ভঙ্গিতে ওকে বললাম,
— তোর লাভ ইউ টু বের করতাছি। দাঁড়া তুই।
আবার ছুটে পালালো। ওর কান্ড দেখে আমি ও দাদী দুজনে একসাথে হেসে উঠলাম। আমি বেশি দেরী করতে চাইছি না। সরাসরি কাজের কথায় ঢুকতে চাচ্ছি।বুড়িকে দেখে দিব্যি সুস্থ মনে হচ্ছে। আর উনি নাকি অসুস্থ। আমিই ঠিক ধরেছিলাম। উনি অসুস্থ হওয়ার ভান করছে। কিছুটা নরম সুরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি হয়েছে আপনার দাদী? হঠাৎ অসুস্থ যে।
— আর বইলো না।প্রেশারে মাথা ঘুরায়।খাঁড়ায় (দাঁড়ায়) থাকতে পারি না।
আমি ব্যস্ত হওয়ার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম,
— ও আল্লাহ বলেন কি? মাথায় তেল দিছেন?
— না, মাথায় একটু পানি দিয়ে আসলাম।
— আপনার মাথা ঘুরায় আর আপনি তেল দেননি। এটা কোন কথা। তেলের বোতল কোথায়? দিন আমি আপনার মাথায় তেল দিয়ে দেই। এতে মাথাটা একটু ঠান্ডা লাগবে।
— আরে লাগবো না। তুমি বসো।
— কোন কথা শুনছি না আপনার।
💖💖💖
আমি দ্রুত ওয়ারড্রবের ওপর থেকে তেলের বোতল এনে জোর করে উনার মাথায় দিয়ে দিতে শুরু করলাম। এখন তেল দিয়ে দিবো আর নরম সুরে তাকে যদি পারি ডিটারজেন্ট ছাড়া ধুয়ে দিবো। নয়তো তাকে পটাবো। উনি মুখে বিরক্তি দেখালেও মনে মনে যে খুশি তা তার কথায় বুঝতে পারছি। মুখে বিরক্তি ভাব রেখে বললো,
— দেখ তো নাতনির কান্ড। এত করে বললাম দিতে না। তবুও শুনলো না।
— কোন কথা বলেন না তো। তা দাদী আপনি জুয়ান (যৌবন) কালে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর ছিলেন তাই না?নয়তো দাদা কি আর এমনি এমনি রুপসীর পাগল হয়েছে?
দাদী লাজুক হেসে তার শৈশব, কৈশোরেের গল্প জুড়ে দিলো। আমিও এটা ওটা জিজ্ঞেস করে তার কথা শোনার আগ্রহ প্রকাশ করছি। বৃদ্ধারা কারো সাথে গল্প করতে ভীষণ পছন্দ করে।একজনকে পেলেই তার সাথে নানা গল্প জুড়ে দেয়। আমি ধীরে ধীরে তেল দিতে দিতে তার অনেক কথা শুনলাম। তারপর আমি আমার কথা শুরু করলাম,
— দাদী, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি কিছু কথা বলি।
— হ্যাঁ বল।
— আন্টি আট মাসের প্রেগন্যান্ট। তার এখন ফুল রেস্টে থাকার কথা। আল্লাহ না করুক একটা অঘটন ঘটে গেলেই বাচ্চা ও মায়ের দুজনের ক্ষতি। আপনার হয়তো কিছু না। কারণ আন্টির কিছু হলে আপনি আপনার ছেলেকে আরেকটা বিয়ে করাবেন। এক বউ গেলে আরেক বউ পাবেন।কিন্তু ইফাত,সিফাত কিন্তু নিজের মা কে হারাবে। তারা কিন্তু নিজের মা পাবে না। আজকাল খবরে দেখা যায় নিজের সন্তানকেই দুচোখে দেখতে পারে না। তাহলে সতিনের ছেলেকে কি করে নিজের ছেলে ভাববে বলুন তো? উনি এই পেট নিয়েও সারা ঘরের কাজ করে। আপনি একটু উঁকি মেরে দেখতেও যান না। এটা কি ঠিক বলুন?
উনি চুপ করে আমার কথা শুনছেন। কোন উত্তর দিলেন না। আমি আবারো বললাম,
— হ্যাঁ আন্টি গরীবের মেয়ে। কিন্তু উনার মনটা আপনাদের থেকেও অনেক বড়। অন্ততপক্ষে আপনাদের মতো নিচু মন-মানসিকতার নয়। উনি আপনাদেরকে নিজের বাবা-মা ভাবে। যদি আপনাদেরকে বাবা-মা না ভাবতো তাহলে আপনাদের সংসারে নিত্যদিন ঝগড়া, অশান্তি লাগতো। উনি কিন্তু সব মুখ বুজে সহ্য করে নেয়। সংসারে কোন ঝামেলা করেন না। উনার মতো ছেলের বউ সবাই পায় না দাদী। খুব ভালো মনের মানুষ। যদি খারাপ হতো তাহলে আপনার ছেলের কানে আপনাদের নামে বিষ দিয়ে এতদিনে আলাদা হয়ে যেতো। কিন্তু সে সবসময় আপনার ভালোর কথা চিন্তা করে। দাদার ভালোর কথা চিন্তা করে। তাহলে আপনার কি উচিত না উনাকে এই সময় একটু সাহায্য করা। ঘরের কাজগুলো তো বুয়াই করে। যেদিন বুয়া না আসে সেদিন না হয় আপনি একটু কষ্ট করে কাজগুলো করে দিলেন। এতে তো আপনাদের শাশুড়ী, বউয়ের সম্পর্ক মজবুত হবে। আর তো মাত্র ১ মাস। তারপর বাচ্চা হওয়ার কয়েকমাস অব্দি আপনি সংসারের হালটা ধরে রাখুন। এতে তো বাচ্চা, মা দুজন সুস্থ থাকবে। উনার প্রতি এখন বাড়তি খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু আপনি তো বাড়তি খেয়াল দূরেই থাক স্বাভাবিক খেয়ালটাই রাখছেন না। আজ যদি আন্টির বদলে আপনার মেয়ে হতো তাহলে কি এতো অবহেলা করতে পারতেন? উনাকে না হয় নিজের মেয়ে হিসেবে এতটুকু খেয়াল করুন। বউকে নিজের মেয়ে ভাবতে এতো কষ্ট কেন আপনাদের মতো শাশুড়ীদের?
উনার উত্তরের পরোয়ানা না করে আমি একটু থেমে আবার বলতে লাগলাম,
— আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার সময় প্রেগন্যান্ট থাকতেও ধান,পাট নিয়ে সংসার করেছেন। তাহলে আপনার ছেলের বউ এতটুকু করে কেন সংসার চালাতে পারবে না? আপনাদের সময় আর এখনকার সময় আকাশ পাতাল তফাৎ। পুরনো বিষয় ধরে বসে থাকলে তো হবে না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। এখনো সময় আছে উনার প্রতি একটু যত্নশীল হোন। সে তো আপনাদের একটু কেয়ারই চাইছে। টাকা-পয়সা তো নয়। সারাদিন প্রেগন্যান্ট অবস্থায় সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। আপনাদের খেয়াল রাখছে।ছেলে দুটোকে মানুষ করছে। এটাও কি কম? আর কষ্টগুলো কেন করছে সে? আপনাদের বংশধর আনতেই তো? নাকি অন্য কোন কারণে? আজ আপনি থাকতে উনি নিজে এক বালতি জামা-কাপড় ধুয়েছে। এতে তো উনার পেটে নিশ্চয়ই চাপ পরেছে।যা বাচ্চার জন্য ক্ষতিকারক। উনি এই বালতি নিয়ে ছাদে যেতে চেয়েছিলো। আমি দেখায় রক্ষা। সিঁড়িতে যদি স্লিপ কেটে কোন বিপদ ঘটতো তাহলে কি হতো ভেবেছেন আপনি?নিজেকে প্রশ্ন করেন তো আজ অব্দি কতটুকু একজন আদর্শ শাশুড়ী হতে পেরেছেন? এই প্রশ্নটা নিজেকে নিজে করবেন।শেষ একটা কথাই বলবো দাদী। থাকতে মূল্য দিন। হারিয়ে গেলে কেঁদেও লাভ হবে না।
কথাগুলো বলে আর থাকলাম না। দ্রুত উঠে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। দাদী এখনো চুপ করে বসে আছে। তার ভেতরে একটা তোলপাড় সৃষ্টি করে দিয়েছি। রুম থেকে বের হতেই দেখলাম আন্টি ওড়নায় মুখ গুঁজে কাঁদছে। নিশ্চয়ই আমার সব কথা শুনেছে। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে দরজা খুলে বের হলাম। তবে বের হওয়ার আগে দাদীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।কৌতুহলবশত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি আন্টিকে ডাকছে।
— ছোট বউ, ও ছোট বউ। কোথায় তুমি?
অপরপাশ থেকে আন্টির গাল শুনলাম,
— জ্বি মা বলুন।
— শুনো ছোট বউ, আজ দুপুরে কি রান্না করবো বলো তো? তোমার রান্নাঘরে যাওয়ার কোন দরকার নেই।
আজ থেকে সংসার আমি সামলাবো। তুমি বরং একটু রেস্ট নাও।
— কিন্তু মা আপনার তো শরীর ভালো না। আপনি একা এতকিছু পারবেন না।
— বেশি কথা বলো না তো। তোমাকে রেস্ট নিতে বলছি তাই নিবা। কি কি করতে হবে বলো। আমি সব করে নিচ্ছি। সংসার নিয়ে তোমার আর ভাবতে হবে না। এখন থেকে সব আমি দেখবো। তুমি কি সকালে খেয়েছো? না খেলে কিন্তু এখন তোমার খবর আছে। একদম আমার দিদিভাইকে না খেয়ে কষ্ট দিবে না।
চোখ দুটো আপনাআপনি পানিতে ভিজে গেলো। না আমি সফল হয়েছি। এটাই অনেক বড় পাওয়া। কথাগুলো যে এত দ্রুত তার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে তা আমি ভাবতেই পারিনি।পেছন ঘুরে যাওয়ার আগে কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। তাকিয়ে দেখি আন্টি কান্না মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো কান্না করতে লাগলো। তবে আমি জানি এই কান্না কষ্টের নয়। বরং তার আনন্দের। বড় কিছু পাওয়ার আনন্দ। উনি কয়েক মিনিট পর আমার মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে ভেতরে চলে গেল। আমি কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে থেকে বাসার দরজার দিকে গিয়ে একটুর জন্য ধাক্কা খেলাম না। তার আগেই কেউ আমাকে কোমড় পেচিয়ে জড়িয়ে ধরে ফেললো।
— আরে আস্তে! চোখ কোনদিকে রেখে হাঁটো টিডি পোকা?
দুজন মুখোমুখি হয়ে আছি। তাকিয়ে দেখি এনজিও সংস্থা।এখন দুজনেই পুরো চোখাচোখি। আজকেও তার সাথে আমার ড্রেস ম্যাচিং হয়ে গেছে। দুজনেই কালো। আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে তার হাত আমার কোমড় থেকে সরালাম। তারপর কটমট চোখে তার দিকে একটা রাগী লুক দিয়ে দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেলাম। একটু সুযোগ পেলেই আমার কাছে আসার ধান্দা। বদমাশ বেডা কোথাকার!
#চলবে
আজকের পর্ব অনেকের কাছে ছোট লাগবে। কিন্তু এখানে ১৬০০+ শব্দ আছে।