অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৯৭.

0
58

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৯৭.

অধৈর্য হচ্ছে তমাল। ‘রুদ্র আমের’ নামটা শোনার পরপরই এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল সে। যখন তার বসের সামনে নিরুপায়, অসহায় হয়ে বসে থাকবে সুঠাম, সুদর্শন এই খু-নি। প্রশ্নবান আর রিমান্ডে ধরাসাই করে দেবে ওকে।
মানুষ সবসময়ই একটু বাড়িয়ে বলতে পছন্দ করে। রুদ্র সম্পর্কেও সেই ধারণা ছিল তমালের। যা যা শুনেছে তা বোধহয় কিছুটা এক্সাজিরেটেড। ভেবেছিল যতকিছুই হোক; যখন সমস্ত প্রমাণসহ ধরা পড়বে, তখন অসহায় হয়ে পড়বে রুদ্র। কিন্তু ইন্টারোগেশন রুমে এসে দেখল ভিন্ন এক রূপ। বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় এই ক্রি-মি-না-ল। তার নির্বিকারত্ব যেন উপহাস করছে বদ্ধ চার দেয়ালকে। গোটা ডিপার্টমেন্টকে। ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদকে। তুহিন কেন এর প্রতি এখনো এতো শান্ত, সেকথা বুঝতে পারছেনা তমাল। রুদ্রর বিরুদ্ধে পাকাপোক্ত সব প্রমাণই আছে। জানার দরকার কেবল ওর সেই সহকারির নাম। খুনগুলোর আসল কারণ। আর সেই গোপন তথ্য। যা না পেলেও রুদ্রর শাস্তির ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ফারাক পড়বেনা। কিন্তু বেঁচে যাবে অন্য অনেকে। দুজনের কারোরই মনোবৃত্তি বুঝতে না পেরে অসহায় হয়েই দাঁড়িয়ে রইল সহকারী তমাল।

লম্বা শ্বাস ফেলে তুহিন বলল, ‘ ইন্সপেক্টর আজিজের কাছ থেকে তোমার সম্পর্কে অনেককিছুই জেনেছি আমি। তোমার ফাইলগুলো কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে। অনেককিছু লেখা আছে; তোমাকে নিয়ে, রাশেদ আমেরকে নিয়ে, সোলার সিস্টেমকে নিয়ে। অনেকগুলো খু*নের সন্দেহ তোমার ওপরেই ছিল, কিন্তু কখনই কিছু প্রমাণ করা যায়নি। একটা সুতোও ছেড়ে আসোনি তুমি কোথাও। ব্রিলিয়ান্ট!’

মৃদু হাসল রুদ্র। ভ্রু কোঁচকালো তুহিন, ‘হাসছো যে?’

‘ আপনার বর্ণনায় থ্রিলার সিনেমার নায়ক মনে হলো নিজেকে।’

পাশ থেকে তমাল বলল, ‘ খলনায়কটা বেশি স্যুট করবে তোমার ওপর।’

এতক্ষণে তমালের দিকে তাকাল রুদ্র। ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ আমার মাথার অবস্থা এখন কেমন? ব্যথা কমেছে?’

মেজাজ খারাপ হল তমালের। মনে পড়ল শরষে ফুল দেখানো সেই পিস্তলের বাঁটের আঘাত। এখনো ছোট ব্যান্ডেজ আছে মাথায়। রাগে গজগজ করে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই চোখের ইশারায় থামিয়ে দিল তুহিন। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কিন্তু এই ব্রিলিয়ান্সি গত একমাস কোথায় ছিল রুদ্র? দশটা খু*নের প্রতিটা স্পটে তুমি প্রমাণ ফেলে এসেছো। যোগসূত্র রেখে এসছো। তুমি আমার হাতে না এলেও তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণ অনেক আগেই চলে এসেছিল আমার হাতে। কেনো?’

চেয়ারে হেলান দিল রুদ্র। কৌতুকস্বরে বলল, ‘বোধহয় ইন্সপেক্টরের চেয়ে আপনার ব্রেইন অনেক বেশি শার্প তাই।’

‘ সত্যিটা বলো।’

‘ মিথ্যে বলে আমার কাছ থেকে সত্যি শুনতে চাইছেন?’

‘ মিথ্যে?’

‘ প্রতিটা স্পটে আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাননি আপনি। কথাটা “কিছু স্পটে” হবে।’

কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছে রুদ্রর চোখে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল তুহিন। খানিকটা বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল রুদ্রকে। ইন্টারোগেশনের এক মাধ্যম। সন্দেহকে বাস্তবের মতো উপস্থাপন করে সাস্পেক্টের প্রতিক্রিয়া দেখা। কিন্তু সামনের মানুষটা রুদ্র আমের। এদিকে হাল ছাড়ার পাত্র নয় তুহিন নিজেও। বলল, ‘তারমানে সবগুলো খু*ন তুমি করোনি। দু একটা করেছে তোমার সহকারী। যার ব্লা*ড লক্ষ্মীবাজারের স্পটে পেয়েছিলাম আমি। রাইট?’

প্রশ্নের জবাব দিলোনা রুদ্র। ঠোঁটে মৃদু রহস্যময় হাসি, চোখে কৌতুক। ভ্রুজোড়া কুঁচকে উঠেছে তমালের। তুহিন শান্ত গলাতেই বলল, ‘ কে সে রুদ্র? যে তোমাকে সহযোগিতা করেছে?’

রুদ্র নিরুত্তর। এবার খানিকটা শক্ত গলায় তুহিন বলল, ‘ চুপ থেকে লাভ নেই রুদ্র। আমার সহকারীসহ বাকিরাও তোমার সঙ্গের সেই ব্যক্তিকে দেখেছে। হুসাইন আলীর ডেরা থেকে বের হওয়ার সময়।’

রুদ্র বলল, ‘যার কোন অফিশিয়াল প্রমাণ নেই আপনার কাছে। থাকবেও না। যতক্ষণ না আমি বয়ান দিচ্ছি। তার সম্পর্কে কিছুই বলব না আমি।’

‘ তাকে বাঁচিয়ে কী লাভ রুদ্র? তোমার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। যেটুকু প্রমাণ আছে তা তোমাকে ফাঁ*সির দড়িতে ঝোলানোর জন্যে যথেষ্ট।’

‘ ওর নাম বললে সে ফাঁসি আটকে যাবেনা। আপনার জন্যে ভালো এটাই হবে, আমার পেছনে সময় নষ্ট না করে পুলিশ কাস্টাটিতে পাঠিয়ে দিন।’

বলতে বলতে মৃদু কেঁশে উঠল রুদ্র। বুকে ব্যথা আছে। পরপর দুটো বু*লে*টের ধাক্কা প্রায় অবস কর‍ে দিয়েছে জায়গাটা। টনটন করছে একদম। শরীরের বিভিন্ন জায়গার ক্ষতের জ্বালাগুলো যেন বেড়েছে হঠাৎ।

তিনবছরের ক্যারিয়ারে ইন্টারোগেশন রুমে বহুবার এসেছে তুহিন আহমেদ। অনেককে ইন্টারোগেট করেছে। কিন্তু এবারের বিষয়টা ভিন্ন, সেকথা জানে তুহিন। তার সামনে যে বসে আছে, সে রুদ্র আমের। স্বাভাবিক ইন্টারোগেশন প্রক্রিয়া ওর ওপর খাটবেনা। শারীরিক টর্চারের কথা ভাবছেনা তুহিন। এই আসামিকে বোধহয় থার্ড ডিগ্রীও দোলাতে পারবেনা। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করাতে পারবেনা কেউ ওকে দিয়ে।
তমালের দিকে একপলক তাকাল তুহিন। ঘটনার মূল সত্য জানার জন্যে অধীর হয়ে আছে বেচারা। ছোট্ট শ্বাস ফেলে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে তুহিন বলল, ‘জানারযে খুব বেশি আগ্রহ আছে আমার সেটা ঠিক না। ইন্টারোগেট করাটা আমার কাজ, তাই করছি। কেইস সলভ করার জন্যে আমার তোমাকে ধরা দরকার ছিল। প্রমাণসহ। যা আমি করেছি। আর যেহুতু তুমি স্বীকার করছো যে দশটা খুনই তুমি করেছো। সেখানে আমার আর কিছু করার থাকেনা। কালকেই পুলিশ কাস্টাডিতে দেওয়া হবে তোমাকে। কিন্তু_’

‘ কিন্তু?’ ভ্রুকুটি করল রুদ্র।

‘ একটা প্রশ্ন জাগছে মনে। এতো ক্ষিপ্র হয়ে দশটা খু*ন করার কারণ কী? আরও একটা খু*ন করতে মরিয়া ছিলে তুমি। হ্যাঁ, আমাদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট ঘেঁটে, এবং নিজের সংগ্রহ করা তথ্য থেকে এটা জানতে পেরেছি তোমাদের তিনটে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। অনেক আগে থেকেই ছিল। যার ওপর ভিত্তি করে এসব খু*ন*খারাবি চলতো। কিন্তু সেখানে এরকম ক্ষিপ্রতা, বেপরোয়াভাব ছিলোনা। ব্যপারটা অনেকটা অতি ব্যক্তিগত আক্রোশের মতো। এতোটা আক্রোশ কেন? কুহুর রে*পের জন্যে? রাশেদ আমেরের মৃত্যুর জন্যে? তবে কী ইন্সপেক্টর আজিজের সন্দেহই ঠিক? খু*ন হয়েছিলেন রাশেদ আমের?’

এবারেও নিরুত্তর রুদ্র। তবে চোখের তীক্ষ্মতা কমে আসছে ধীরে ধীরে। পাশ থেকে তমাল বলল, ‘ কিন্তু সেসবতো আরও মাসতিনেক আগের ঘটনা। হঠাৎই এতোটা ডেস্পারেশন কীসের? ঠিক যেন ক্ষিপ্ত বাঘের মতোই তাড়া করেছিলে তুমি এদের। যাকে সামনে পেয়েছো তাকেই গিলেছো।’

রুদ্রর চোখের দিকে তাকাল তুহিন। সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে উঠছে সেই চোখ। তুহিনও কিছু একটা ভাবল। কিছু একটা খেলে গেল ওর মাথায়। তারপর বলল, ‘তোমার সঙ্গে একটা বিষয়ে আমার ভীষণ মিল রুদ্র। তুমিও ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছো, আমিও। দুজনেই বাবাকে হারিয়েছি। সেটা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর। তবে মায়ের ভালোবাসাটা তোমার চেয়ে অনেকটাই কম পেয়েছি আমি। মনেও নেই ওনাকে আমার। জন্মের কয়েকমাসের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন উনি।’

কথাটা বলে লম্বা শ্বাস ফেলল তুহিন। এতক্ষণে ভালোভাবে তুহিনের দিকে দৃষ্টিপাত করল রুদ্র। চেহারায় সেই নির্বিকারত্ব আর নেই। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে ফেলল। অনেকটা আনমনেই বলল, ‘ আট বছর! জীবনের আটটা বছর ওনাকে পেয়েছিলাম আমি।’

রুদ্রর মায়ের নাম ছিল তটিনী। রুদ্রর যতটা মনে পড়ে ভীষণ সুন্দরী ছিলেন ওর মা। রাশেদ আমেরের মতো তেজস্বী, সুদর্শন, সুঠাম পুরুষের সঙ্গে যেন এমন নারীকেই মানায়। ছোটবেলা থেকেই রুদ্রর সবচেয়ে প্রিয় নারী। রুদ্র যার কাছে ছিল রাজা। ছেলেবেলায় রাশেদকে খুব একটা কাছে পায়নি রুদ্র। সকালে বের হতেন, ফিরতেন বেশ রাতে। শৈশবের চমৎকার ঐ মুহূর্তগুলো কেটেছিল মায়ের কোলের কোমলতায়। ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন তটিনী। যা রুদ্র মুগ্ধ হয়ে দেখতো। হাজারটা প্রশ্ন করতো। ধৈর্য্য নিয়ে ছেলেকে তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন তটিনী। সমুধুর ছিল সেই কন্ঠস্বর। স্নিগ্ধ ছিল সেই বাণী। ঐ বাণী শুনে বড় হওয়া রাজার মনটাও ততটাই কোমল, স্নিগ্ধ তৈরী হচ্ছিল। দোলনায় একসঙ্গে দুলতে গল্প করা, ছুটে বেড়ানো রুদ্রর পেছন পেছন তটিনীরও সমানতালে ছোটা, প্রতিবেলা সযত্নে খাইয়ে দেওয়া, এমন অসংখ্য চমৎকার স্মৃতি মনে পড়ে রুদ্রর। সেই আটটা বছর যেন কোন সুখময় স্বপ্ন। যেখানে কোন জটিলতা নেই, ভাবনা নেই। আছে কেবল বেঁচে থাকার অপাড় আনন্দ।

তবে মাঝেমাঝেই মন খারাপ করে বসে থাকতেন তটিনী। খেলে ক্লান্ত হয়ে যখন রুদ্র এসে তাকে জড়িয়ে ধরতো। আশ্রয় খুঁজতো মায়ের উষ্ণ কোলে। তখন পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে তটিনী বলতেন, ‘তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা রাজা। তোকে যে অনেক বড় দায়িত্বের ভাড় নিতে হবে।’

ছোট্ট রুদ্র বুঝতোনা কোন দায়িত্বের কথা বলছে তার মা। শুধু আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো তাকে। ওর মাথায় চুমু খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন তটিনী।

একদিন রাতের কথা। রুদ্রকে ঘুম পাড়িয়ে রাশেদের অপেক্ষা করছিলেন তটিনী। কিন্তু রুদ্র সেদিন ঘুমায়নি। বকা থেকে বাঁচার জন্যে ঘুমের ভান করছিল মাত্র। অনেক বাচ্চারাই এটা করে।
রাশেদ এলেন। তটিনী খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে বললেন, উনি খেয়ে এসেছে। পরে আলতো হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে রাশেদ। মোলায়েম গলায় বলে, ‘তুমি খেয়েছো?’

‘ হ্যাঁ। রাজাকে খাওয়ানোর সময় খেয়ে নিয়েছি।’

স্ত্রীকে ছেড়ে ছেলের মাথায় হাত বুলায় রাশেদ। কপালে চুমু খায়। তটিনীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার লাগেজটা গুছিয়ে রেখো একটু।’

‘ কেন? যাবেন কোথাও?’

‘ দুবাই যাব। কাজ আছে।’

কিছুক্ষণের নীরবতা। কান্নামাখা গলায় তটিনী বলে ওঠে, ‘আমার আর আমার ছেলেটার কথা কী আপনি কোনদিন ভাববেন না?’

‘ বাবা মারা গেছেন দুবছর আগে। ভেতরকার পরিস্থিতি বোঝালেও বুঝবেনা তুমি। এ জগতে যত সহজে ঢোকা যায়, তত সহজে বের হওয়া যায়না। আমার সঙ্গে তোমাদেরও বিপদ বাড়বে তাতে। কিছুদিন সময় দাও আমাকে। একটু গুছিয়ে নেই। এরপর ছেড়ে দেব সব।’

‘ ততদিন আমি থাকবোতো?’

থমথমে নীরবতা নেমে আসে ঘরটাতে। রাশেদের গলায় ভেসে আসে, ‘ থাকবে। থাকতেই হবে। আমার জন্যে, রাজার জন্যে।’

বাবার বলা কথাটায় যেন একরাশ আবেগ মিশে ছিল। এরপর আবার সেই নীরবতা। পরের কথোপকথন মনে নেই রুদ্রর। ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধ হয়। তার কয়েকমাস পরে কুহুর জন্ম হল। সেদিন ভীষণ খুশি হয়েছিল রুদ্র। সারা বাড়িময় নেচে বেড়িয়েছে। চিৎকার করে বলেছে, ‘আমার বোন হয়েছে। আমার বোন হয়েছে।’
তখন অন্য এক রাশেদকে দেখেছিল রুদ্র। সদ্যজাত মেয়েটাকে কোলে নেওয়ার পর বাবার চোখের কোণের জলটুকু খেয়াল করতে ভোলেনি ও। কয়েকটা দিন যেন উৎসব লেগে ছিল আমের ভিলায়। কত আনন্দ! কত সুখ।

কিন্তু এরপরেই এলো সেই বিভিষিকাময় সকাল। সেদিন সকালে অতিরিক্ত আওয়াজে ঘুম ভাঙে রুদ্রর। ঘর থেকে বেরিয়ে এতো মানুষ দেখে বুঝতে পারেনা কিছুই। ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে যায় মাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু গিয়ে দেখে বিছানায় ঘুমিয়ে আছে ওর মা। ঠিক পাশেই স্থির হয়ে বসে আছেন রাশেদ আমের। জাফর, ইকবাল, ওর নতুন কাকি সবাই আছে। কাঁদছে। নতুন কাকি বুকে জড়িয়ে রেখেছে ছোট্ট কুহুকে। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা রুদ্র। দৌড়ে চলে যায় মায়ের কাছে। নিথর দেহটা ঝাঁকিয়ে অসহায়ভাবে ডাকে, ‘মা? মা?’

সাড়া দেয়না তটিনী। রুদ্র আরও ডাকে। কোনভাবেই সাড়া না পেয়ে কেঁদে ফেলে। ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলে, ‘মা আমার ক্ষিদে পেয়েছে, মা। আমার ক্ষিদে পেয়েছে। ওঠো মা!’

মুখ চেপে কাঁদেন জাফরের স্ত্রী। রুদ্রকে জানায় তার মা মৃত। মারা গেছেন উনি। জীবনের প্রথম ধাক্কার সম্মুখীন হয় আট বছরের সেই ছোট্ট শিশুটি। হতবাক চোখে তাকায় মায়ের মৃত শরীরের দিকে। মারা যাওয়া মানে জানে রুদ্র। মানুষকে মাটির ঘরে রেখে আসে। সেখান থেকে আর ফিরে আসেনা কেউ। অনেক ডাকলেও আসেনা। ওর মাও আর আসবেনা? কোনদিন আসবেনা? বেশি বেশি ডাকলেও আসবেনা? এই তথ্যটুকু রুদ্রর কোমল মনকে দুমড়েমুচড়ে দেয়। চারপাশটা ঘোলা লাগে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে অবোধ শিশুটি। ছুটে রাশেদের কাছে যায়। তাকে ঝাঁকিয়ে নালিশ জানায় কাকীর নামে। সে মিথ্যে বলছে। কিন্তু শক্ত পাথরের মতো বসে থাকেন রাশেদ। স্থির, অনুভূতিহীনচোখে তাকিয়ে থাকেন মৃত স্ত্রীর মুখটার দিকে। ঐসময় তার ভেতরে চলা তান্ডবের অনুমান ছিলোনা রুদ্রর, যা আজ আছে।
ঘুমন্ত ছোট্ট কুহুর ঘুম ভেঙ্গে যায় এতো আওয়াজে। চারপাশ কাঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। রুদ্র আরও জোরে কাঁদে। গিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে মৃত মায়ের শরীরের ওপর। দেখতে আসা মানুষজন, সার্ভেন্টস্, সকলের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। ছোট্ট এক শিশু আর এক সদ্যজাত বাচ্চার মা হারা হওয়ার আক্ষেপে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে আমের ভিলার ভবন। জাফর আর ইকবাল মিলে রুদ্রকে জোরপূর্বক সরায় তটিনীর ওপর থেকে।
সেদিন সকালে আমের ভিলা কম্পমান ছিল ছোট্ট কুহুর চিৎকার আর শিশু রুদ্রর ‘মা মা’ নামক আর্তনাদ ধ্বনিতে। হয়তো সেদিনই তৈরী হয়েছিল কোমল হাসিখুশি রাজার হিংস্র ভয়ংকর রুদ্র আমের হয়ে ওঠার যাত্রাপথ।

নীরব তুহিন। তমালও চুপ। রুদ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টেবিলে ওপর রাখা নিজের হাতের হ্যান্ডকাফটার দিকে। ছোটবেলায় মা মারা গেলেও, মা হারানোর অনুভূতিটা জানা নেই তুহিনের। ওর মা যখন মারা যায়, তখন এসব বোঝার জ্ঞান ওর ছিলোনা। যদি কিছু অনুভব করে থাকে সেটা মা ছাড়া বড় হওয়ার আক্ষেপ। সেই আক্ষেপটাই যেন হঠাৎ আকড়ে ধরল মনটাকে। ছোট্ট ঢোক গিলে লম্বা শ্বাস ফেলল। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তারপর?’

চোখ তুলে তাকাল রুদ্র। ‘ কী শুনতে চাইছেন?’

‘ রাজা থেকে রুদ্র আমের হওয়ার যাত্রা।’

মাথা দুলিয়ে হাসল রুদ্র। ঘাড়ের চোটটায় একটু টান লাগলেও পাত্তা দিলোনা। বলল, ‘ হাতে আজ কাজ নেই আপনার। তাইনা?’

তুহিনও হাসল, ‘ সত্যিই নেই। ধরে নাও টাইমপাস করছি। পুলিশ কাস্টেডিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থম মেরে বসে থাকতে তোমারও ভালো লাগবেনা বোধ হয়। একটু না হয় আড্ডা দেই?’

তমালের ভেতরের উত্তেজনা তিরতির করে বাড়ছে। ও বুঝতে পারছে তুহিন রুদ্রকে কনভিন্স করে ফেলছে সবটা বলার জন্যে। সে বলবে। নিশ্চয়ই বলবে। তুহিন আবার বলল, ‘তাছাড়াও, জানতে ইচ্ছে করছে। একজন বাবা কীকরে তার নিজের সন্তানকে ক্রিমিনাল তৈরী করতে পারে।’

চারপাশের অন্ধকারে একবার চোখ বুলালো রুদ্র। নগ্ন বাল্বটার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। বলল, ‘মা মারা যাওয়ার পর মাসখানেক সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। স্বাভাবিক বলতে যেমনটা হয় আরকি। শুরুর দিকে একটু বেশি কান্নাকাটি, যা ধীরে ধীরে কমে আসে। অতঃপর এক গুমোট ভাব। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা।’

‘ অস্বাভাবিক কখন হল?’

তটিনী মারা যাওয়ার মাসখানেক পরেই তুমুল এক পরিবর্তন ঘটে আমের ভিলায়। কোমল ছোঁয়ায় বড় হওয়া রুদ্র হঠাৎই দেখতে পায় নিদারুণ কঠোরতা। যার নেপথ্যে ছিলেন রাশেদ আমের। কঠিন এক বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলা হলো ওকে। রাজা বলে ডাকা বন্ধ হল আমের ভিলায়। খাইয়ে না দিলে যে রুদ্র খেতে পারতোনা, তাকে হঠাৎই নিজে নিজেই খেতে হল। শুরুতে ছোট কাকি খাইয়ে দিতে এলে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয় তাকে। যেকোন জায়গায় পরাজয় বস্তুটাকে হারাম করে দেওয়া হল ওর জন্যে। কোন প্রতিযোগিতায় পরাজিত হওয়া যাবেনা, কেউ একটা চ*ড় মারলে তাকে দুটো মেরে দিয়ে আসতে হবে। সেটা না পারলেই শাস্তি। সে শাস্তি দিতেন স্বয়ং রাশেদ। হাত-পাবেঁধে পেটানো, অতঃপর রুদ্রকে দিয়েই সেই বাঁধন খোলানো। কাঁদা যাবেনা! কোনকিছুর প্রতি থাকবেনা কোন মোহ। আর মোহ তৈরী হলেও সে জিনিসটা সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট করে ফেলতেন রাশেদ। এসব ক্ষেত্রে জাফর কিংবা ইকবাল দুজনেরই হস্তক্ষেপ ছিল সম্পূর্ণ নিষেধ।

একদিন বিকেলের ঘটনা। স্কুল থেকে ফিরে পোশাক বদলাচ্ছিল রুদ্র। গলায় ঝোলানো লকেটটা আটকে যায় বোতামের সঙ্গে। রুদ্র খেয়াল না করেই টান দেয়। ফলসরূপ ছিড়ে যায় চেইন। লকেটের চেইন ছিড়ে যাওয়াতেই ভীষণ মন খারাপ হয় রুদ্রর। কান্না পায়। নিজের কষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কেঁদেই ফেলে বেচারা। কিন্তু সেই কান্না পছন্দ হয়না রাশেদের। রুদ্রকে টেনে নিয়ে যায় স্টোররুমে। পরিত্যক্ত এক চেয়ারের পায়ার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধে। অতঃপর ওর সামনেই নিজ হাতে দিখণ্ডিত করে সেই লকেটটা। ভয়ংকর কষ্টে সেদিন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল রুদ্র। কাঁদেনি আর। শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তটিনীর মুখ। যিনি পরম মমতায় গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন এই লকেট। কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, ‘আমার রাজা।’
স্তম্ভিত রুদ্রর সামনে হাঁটুগেড়ে বসেছিলেন রাশেদ। কঠোর গলায় বলেছিলেন, ‘আমার দিকে তাকাও।’

রুদ্র তখনও ঘোরে ছিল। রাশেদ জোরে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তাকাও!’

কেঁপে ওঠে রুদ্র। তাকায় রাশেদের চোখের দিকে। রুদ্রর চোখে চোখ রেখে গম্ভীর গলায় রাশেদ বলেছিলেন, ‘জীবনে কখনও কোনকিছুকে এতোটা “প্রিয়” বানাবেনা, যতটা প্রিয় বানালে হারানোর ভয় থাকে। হারানোর ভয় মানেই দুর্বলতা। আর দুর্বলতার অপর নাম ধ্বংস।’

ছোট্ট রুদ্রর মস্তিষ্কে সেদিন রাশেদের কথাটা না ঢুকলেও ঢুকেছিল ধীরে ধীরে। এরপর উচ্ছ্বাস এলো। কাটতে থাকল বছর। একটা মারলে দুটো মারার শিক্ষা দিয়েছিলেন রাশেদ। কিন্তু তীব্র ক্ষোভে কেউ হাত ওঠালেই সেই হাত ভেঙ্গে দেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেল রুদ্রর। চোখের সামনে সব প্রিয় জিনিস নষ্ট হতে দেখার পর কোনকিছু প্রিয় লাগাটাই বন্ধ হয়ে গেল। যে চোখে সরলতার ছোঁয়া ছিল। আশেপাশের মানুষ সেই চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে কথা বলতেই ভয় পেতে শুরু করল। একটা পর্যায়ে গিয়ে আর শাসন করতে হলোনা রাশেদকে। রাজা নামক নরম কাদাকে রাশেদ রুদ্র নামক যে আকার দিয়েছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা শক্ত হল। রাশেদের কৌশল তাপ আর আগুনের কাজ করল। অভঙ্গুর হলো সেই আকার। রুদ্র ঠিক তেমনই তৈরী হয়েছিল, যেমনটা তৈরী করতে চেয়েছিলেন রাশেদ।

থেমে গেল রুদ্র। কিন্তু কৌতূহল দমাতে পারলনা তুহিন। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছুড়ল, ‘ সোলার সিস্টেমের সঙ্গে তোমার পরিচয় কীকরে ঘটল? এবং কবে?’

তমালও তাকিয়ে আছে। চোখে আগ্রহ। লম্বা শ্বাস ফেলল রুদ্র। বলল, ‘এসএসসি দেওয়ার আগ পর্যন্ত এমনটাই চলল। কিন্তু তারপর হঠাৎই একদিন বাবা জানালেন আমের ফাউন্ডেশনে আসলে ডোনেশনের আড়ালে, অবৈধভাবে চাঁদা তোলা হয়। মিল ফ্যাক্টরিগুলো অবৈধ অস্ত্র লেনদেনের একটা মাধ্যম মাত্র। শুধু তাই নয়; গোটা প্রসেসিংটাই খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় আমাকে এবং উচ্ছ্বাসকে।’

‘ অবাক হওনি?’

‘ না। কিছুটা বড় হতেই বুঝে গিয়েছিলাম বাবা যা করেন তা স্বাভাবিক কিছু নয়। তাই সবটা জেনে অবাক হইনি। তবে উচ্ছ্বাস বেশ চমকেছিল।’

মাথা দোলালো তুহিন, ‘তারমানে এসএসসির পরেই এ জগতে প্রবেশ করেছিলে তুমি?’

না বোধক মাথা নাড়ল রুদ্র, ‘শুধু কাজগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছিলো। অস্ত্র চালানো, পরিস্থিতি মোকাবেলা ইত্যাদি কিছু ট্রেনিং দিয়েছিলেন বাবা। কিছু শিখেছি নিজের তাগিদে। সরাসরি যুক্ত হইনি।’

‘ সরাসরি কবে হলে?’

‘ এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার ঠিক পরপরই।’

রুদ্র তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। ব্যবসা বিভাগ থেকে। সেবার খুলনা থেকে মাল এসেছিল। সেগুলো বরাবরের মতোই সিলেট অবধি পৌঁছনোর প্লান ছিল সোলার সিস্টেমের। প্রথমবারের মতো সেই মাল সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব রুদ্রর ঘাড়ে দিয়েছিল রাশেদ। বু*লে*ট আর ব*ন্দু*ক দুটোই ছিল। সেদিনের আগ পর্যন্ত বন্দুকগুলো আটার বস্তায় পুরে পাঠানো হতো। কিন্তু একাজ করতে গিয়ে আঠারো বছর বয়সী রুদ্রর মনে হল, এতে লস অনেকটাই। কারণ নিরাপত্তার জন্যে গোটা একটা বস্তায় খুব অল্পই মাল রাখা যায়। বাকিটা পূর্ণ করে রাখতে হয় আটায়। কিন্তু তারবদলে অন্যকিছু ব্যবহার হলে খরচ কমবে। চিন্তাটা মাথায় এলেও সেবার বস্তাতেই সাপ্লাই দেয় রুদ্র। সেটা দিতে গিয়েই বিরোধী এক গ্রুপের আক্রমণের স্বীকার হয় রুদ্র। টের পেয়েছিল তারা যে কোন রাশেদ তার অনভিজ্ঞ, অল্প বয়সী ছেলেকে পাঠিয়েছে। রুদ্রকে সতর্ক করেছিলেন রাশেদ। প্রস্তুত ছিল ও। ওর সঙ্গে থাকা লোক বাকিদের সামলেছে। রুদ্র তিনজনের মধ্যে দুজনকে পিছু হটালেও একজন ছিল অতিরিক্ত ক্ষিপ্র। রুদ্রর প্রাণ নিতে মরিয়া ছিল সে। মেজাজ খারাপ হয় রুদ্রর। মাথায় রক্ত উঠে যায়। ঘাড় চেপে ধরে সোজা বু*লে*ট পুরে দেয় মগজের মধ্যে। বিন্দুমাত্র হাত কাঁপেনা ওর। ওটাই ছিল রুদ্রর জীবনে করা প্রথম খু*ন। তবে আশ্চর্যের ব্যপার খু*নটা করে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হয়নি রুদ্রর। সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিল সে। তখন বুঝেছিল, ওর হৃদয়কে কী ভয়ংকর করে গড়েছেন রাশেদ আমের।

তুহিনের কপালে ভ্রুকুটি। তমালের মুখমণ্ডলও শান্ত। সচরাচর চলা সিনেমা বা থ্রিলার গল্পের মতো রুদ্রর এ জগতে আসার গল্পটা ট্রাজিক নয়। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে, ভীষণ কষ্ট পেয়ে কিংবা সংঘর্ষ করে আসার কোন ব্যপার নেই। বংশ পরম্পরায় খুব স্বাভাবিক পদার্পন। তবুও কোথাও যেন একটা ট্রাজিডির আমেজ অকারণেই পেল তমাল। তুহিনের কাছে লাগল কেবল ইন্টারেস্টিং। এখানে রুদ্র পরিস্থিতির স্বীকার না হলেও জন্মের স্বীকার অবশ্যই।
লম্বা শ্বাস ফেলল তুহিন। বলল, ‘ ব*ন্দু*কগুলো কম বাজেটে সাপ্লাইয়ের কী উপায় বের করেছিলে তুমি?’

‘ ছাপাখানা! বই কেটে ব*ন্দু*ক রাখার পরিকল্পনা আমারই ছিল।’

তুহিন চুপ থাকল কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ বলল, ‘বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি এই তীব্র ঘৃণার বিশেষ কোন কারণ ছিল?’

অনেকক্ষণ বাদে ঠোঁটে সেই কৌতুকপূর্ণ হাসি ফুটল রুদ্রর। বলল, ‘ এটা সিনেমা নয় অফিসার। ঘৃণাটা বাই ন্যাচার এসেছে। কোন কারণ ছিলনা।’

মাথা দোলালো তুহিন, ‘ আচ্ছা। জ্যোতির মুখে শুনেছি প্রিয়তা অর্থাৎ তোমার স্ত্রীর সঙ্গে হানিমুনে কক্সবাজার গিয়েছিলে তুমি। তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল সেসব দুর্ঘটনা। আমার জানামতে সোলার সিস্টেমের পতন। উনি বাইরের বিষয়টা জানে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ঘটনা কী ছিল? কী ঘটেছিল সেদিন?’

বলার একটা ধারা চলে এসেছে যেন রুদ্রর মধ্যে। অনেকটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতেই বলতে শুরু করল আবার।

*

ধোঁয়ায় কাঁশছে জ্যোতি। মাটির চুলায় রান্নার অভ্যেস নেই ওর। তবে কয়েকদিন টানা রান্না করায় খানিকটা রপ্ত করতে পেরেছে কৌশল। কিন্তু আজ বেশি ধোঁয়া উঠছে। দুপুরে কারো খাওয়া হয়নি এখনো। তাই দ্রুত হাত চালাচ্ছে। ধোঁয়ায় চোখে জল চলে এসছে। আঁচল দিয়ে মুছছিল এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে এলো নীরব। অস্থির গলায় বলল, ‘ জ্যোতি আপু! খারাপ খবর আছে।’

চুলার মুখ থেকে কাঠ দুটো টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়াল জ্যোতি। ভ্রুকুটি করে বলল, ‘ কী হয়েছে? তুমিতো বাজারে গিয়েছিলে। এতো অস্থির হয়েছো কেন?’

‘খারাপ খবর আছে, আপু।’

‘খারাপ খবর?’

‘ভাইয়াকে পুলিশ ধরে নিয়েছে।’

থম মেরে গেল জ্যোতি। তোলপাড় শুরু হলো বুকের মাঝে। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল নীরবের দিকে। নীরব তখনও হাফাচ্ছে। চোখেমুখে বিচলিত ভাব। রুদ্র ধরা পড়েছে! অর্থটা নীরব, জ্যোতি দুজনেরই জানা। নৃ*শংসভাবে পরপর দশটা খু*নের শাস্তি একটাই। ফাঁসি!
সশব্দে কিছু পরার আওয়াজে চমকে উঠল ওরা। দেখল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোপাচ্ছে কুহু। নিচে পরে আছে ধুয়ে আনা চাল আর চালের পাতিল। চাল ধুয়ে জ্যোতিকে দিতে আসছিল কুহু। এসেই শুনলো এই অঘটনের কথা। নীরব বাজারের ব্যাগগুলো রেখে ছুটে কুহুর কাছে গেলো। আলতো দুগালে হাত রেখে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি। রিল্যাক্স।’

কিন্তু সান্ত্বনাবাণীতে কাজ হলোনা। কুহুর নিঃশব্দ কান্না আরও বাড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল মাটিতে। নীরব হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরল কুহুকে। আলতো করে মাথায় হাত বুলালো। কী বলবে, কী বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারল না। অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল জ্যোতির দিকে। লম্বা ঢোক গিলল জ্যোতি। ভেতর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা কান্নাটুকু বহু কষ্টে গিলে নিল। এগিয়ে গিয়ে বসল ওদের পাশে। ক্রন্ধনরত কুহুর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ বোকার মতো কাঁদছিস কেন? তুই চিনিসনা তোর ভাইকে? কিচ্ছু হবেনা ওর। যতক্ষণ ও নিজে না চাইবে; কেউ ওর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। কোনভাবেই না।’

চোখভর্তি জল নিয়ে জ্যোতির দিকে তাকাল কুহু। ছলছলে চোখ নিয়ে মাথা দোলালো জ্যোতি। আনমনে বলল, ‘আমি জানি আমার রুদ্রকে।’

*

অনেকটা স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার তুহিন আহমেদ। কক্সবাজারে যাওয়ার পর থেকে ফ্যাক্টরিগুলো বেঁচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া পর্যন্ত ঘটা কাহিনীগুলো একপাক্ষিকভাবে কিছুটা জানলেও সবিস্তারে জানল আজ। জানার পর ভাষা হারিয়ে ফেলল ও। কিছুক্ষণের জন্যে গোটা আমের পরিবারটাকে একটা ক্রিমিনাল পরিবার নয় বরং মানব পরিবার হিসেবে কল্পনা করল। তা করতে গিয়েই বুকের ভেতর অদ্ভুত পীরন অনুভব করল ও। কিছু তমালের অবস্থাও তাই। এরা সন্ত্রাসী, কিন্তু তাই বলে এতোটা পৈশাচিকতা!

রুদ্রর মধ্যে ভাবান্তর নেই। কোন তাড়াও নেই। নির্বিকারভাবে বসে আছে ও। নিজেকে সামলাল তুহিন। মৃদু গলা ঝেড়ে বলল, ‘ তারপর? সত্যিই মিলস্, ছাপাখানা সব বেঁচে দিয়েছিলে তুমি?’

রুদ্র তুহিনের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বলল, ‘ফ্যাক্টরিগুলো ভিজিট করতে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই?’

‘ গিয়েছিলাম। কিন্তু সবগুলোই বন্ধ ছিল।’

‘ আশা করি উত্তর পেয়েছেন।’

রুদ্রর দিকে অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তুহিন। সামান্য মাথা দোলালো। পেয়েছে। আবার কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা নেমে এলো ইন্টারোগেশন রুমে। কিছু একটা ভাবছে তুহিন। অস্থির হচ্ছে তমাল।

পরবর্তী প্রশ্ন করছেনা কেন তার বস। তুহিন পরবর্তী প্রশ্নটা করল ঠিক দু’মিনিট পর, ‘রঞ্জু শেষবারের মতো বলেছিল যে ইকবাল নির্দোষ ছিল। যদি তাই হয় তবে কোথায় ছিল সে? দেখা হয়েছিল তোমাদের সঙ্গে আর ?’

রুদ্র ছোট করে জবাব দিল, ‘হয়েছিল।’

চমকে উঠল তুহিন। তমালও নড়েচড়ে বসল। কন্ঠে স্পষ্ট কৌতূহল ঢেলে তুহিন বলল, ‘ কোথায়? কবে?’

একপলক তুহিনের দিকে তাকাল রুদ্র। ছোট্ট এক নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল তুহিন।

অতীত~

একমগ কফি নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে প্রিয়তা। কড়া ব্লাক কফি। চুমুক দিতেই তিক্ত স্বাদে ছেয়ে গেল মুখটা। কপাল কুঁচকে তাকাল পশ্চিম আকাশে। সূর্য মাত্রই অস্ত গেছে। ঠান্ডা বাড়ছে। রুদ্রর একটা টিশার্ট পড়ে আছে ও। রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর কেউ বাড়িতে নেই। তারমধ্যে রুদ্রর গন্তব্য জানে প্রিয়তা। হুসাইন আলীর কাছে গেছে। প্রিয়তার কথামতো হুসাইন আলী প্রেশার ক্রিয়েট করবে রুদ্রর ওপর। হুমকি দেবে। ঠিক যেভাবে প্রিয়তা শিখিয়ে দিয়ে এসেছে, ঠিক সেভাবে। এরপর! সত্যিই সত্যিই সবটা ছাড়তে বাধ্য হবে রুদ্র। সবটা।
ধোঁয়া ওঠা মগটাতে আরও একবার চুমুক দিল প্রিয়তা। অস্থির লাগছে ওর। ভীষণ অস্থির। গতরাতে রুদ্রর প্রত্যাখ্যানের ক্ষতটা এখনো ভীষণ তাজা। রুদ্র তার প্রিয়কে দূরে সরিয়েছে! রুদ্র! আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টা স্বাভাবিক। এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে সবটা আগের মতো থাকবেনা। থাকার কথাটা। কিন্তু এসবের মধ্যে প্রিয়তার প্রতি রুদ্রর ভালোবাসাটা ফিকে হয়ে যাচ্ছেনাতো! কল্পণা মাত্রই সবার্ঙ্গ উষ্ণ হয়ে উঠল প্রিয়তার। নিঃশ্বাস ভারী ঠেকল। ঐ ভালোবাসা একবিন্দু কমলেও যে প্রিয়তা সহ্য করতে পারবেনা। কোনভাবেই না।

অস্থিরতা বাড়ে প্রিয়তার। প্রশস্ত রেলিংয়ে কফির মগটা রেখে রুমে যায়। রুমের দরজাটা লক করে দেয়। কাবার্ড থেকে নিজের ব্যাগটা বের করে। ব্যাগের মধ্যে হাত ঢোকাতেই বেরিয়ে আসল একটা ছোট্ট বক্স। দেখতে ফেসপাউডার বা মেকাপ জাতীয় কোন বক্সের মতোহ বক্সটা খুলতেই দেখা যায় দুটো সিগারেট। তারমধ্যে থেকে একটা তুলে নেয় প্রিয়তা। সবকিছু জায়গামতো রেখে বন্ধ করে দেয় কাবার্ড। বেডসাইড টেবিল থেকে রুদ্রর লাইটার আর অ‍্যাশট্রেটা নিয়ে আবার বারান্দার দিকে পা বাড়ায়।
বারান্দা দিয়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে কিনা একবার দেখে নিল প্রিয়তা। অতঃপর ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে অস্থির হাতে লাইটার দিয়ে জ্বালালো। প্রথমেই বেশ লম্বা এক টান দিল। চোখমুখ কুঁচকে আসে ওর। বিরক্ত লাগে সবকিছু। বিরক্তিকে আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে বেজে ওঠে ওর সেলফোনটা। তনুজার ফোন। সিগারেটে ছোট্ট একটা টান দিয়ে কলটা রিসিভ করে প্রিয়তা। গম্ভীর গলায় বলে, ‘কী হয়েছে?’

‘ ম্যাডাম! গোডাউনে আগুন লেগে গেছে।’ উত্তেজিত গলায় বলল প্রিয়তা।

আরও বেশি বিরক্ত হল প্রিয়তা। একগুঁয়ে গলায় বলল, ‘তো আমি কী করব? বাবা বা ভাইয়াকে বল।’

‘ ঐ ইকবাল লোকটাকে যে গোডাউনের বেসমেন্টে আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে ম্যাডাম।’

থমকাল প্রিয়তা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ ইকবাল ভাই কোথায়?’

তনুজা হাপানো গলায় জানাল, ‘ নেই ম্যাডাম। পালিয়েছে! আগুনটাও বোধ হয় ঐ লাগিয়েছে। লোকজন পিছু নিয়েছে ওর। ধরার চেষ্টা করছে।’

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। মুহূর্তেই পরিবর্তন ঘটল চোখজোড়ার। প্রিয়তা খুব শান্ত গলায় বলল, ‘ দরকার নেই।’

‘ কী!’ ন*গ্ন বিস্ময় নিয়ে বলল তনুজা।

‘ ধরার দরকার নেই। এমনভাবে তাড়া করতে বল যেন কোথাও দাঁড়ানোর সুযোগ না পায়। কোথায় যাচ্ছে শুধু সেটুকু ইনফর্ম করতে থাকো আমায়। বাকিটা আমি দেখছি।’

‘ কিন্তু ম্যাডাম…’

ঠোঁটে ধূর্ত এক হাসি ফোঁটালো প্রিয়তা। তনুজাকে থামিয়ে বলল, ‘ লোকে একটা কথা বলে তনুজা। আজরাইলকে নাকি আটকানো যায়না। সে চেষ্টা করাও বৃথা। আজরাইল এসে গেছে। অযথা চেষ্টা করে কী লাভ?’

ঢোক গিলল তনুজা। শেষ দুটো বাক্য কী ভয়ংকর সুরেইনা বলল এই ডাইনী! কল কেটে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখল প্রিয়তা। রেলিং এর ওপর হাতের ভর দিয়ে উবু হয়ে দাঁড়াল। চোখ ছোট ছোট করে দীর্ঘ টান দিল সিগারেটে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কী ভেবে আনমনেই হেসে উঠল!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here