প্রেমের_ধাঁরায় #পর্বঃ২ #লেখিকাঃদিশা_মনি

0
48

#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ধৃতি এলোমেলো ভাবে বসে আছে তার ঘরের মেঝেতে। গতকাল রাত থেকে সে ঠায় বসে আছে এই ঘরে। তার ভাবি অনেকবার এসে দরজায় নক করেছে কিন্তু ধৃতি দরজা খোলেনি। তার যে আর কাউকে নিজের এই মুখ দেখাতে ইচ্ছা করছে না। ধৃতির আজ ভীষণ করে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে কিন্তু চোখের জলও বুঝি তার সাথে বেঈমানী করছে।

রাত তখন ১ টা ছুঁইছু্ই, ধৃতি ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো। আত্ম**হ**ত্যা মহাপাপ এটা সে জানে। তাই তো জীবনের এত জঘন্য পর্যায়ে এসেও সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ধৃতি। বরং আলগোছে দাঁড়িয়ে পড়ে একবার চারিদিকে তাকালো। জানালার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল আঁধার আমাবস্যার রাত। ধৃতি মেকি হাসল। তার জীবনেও যে আজ এই আমাবস্যাই নেমে এসেছে। ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো ধৃতি। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে তার পর, তার ভাইয়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজাটা খোলাই ছিল। ধৃতি আস্তে করে চাপ দিয়ে দরজাটা খুলল। দরজা খুলেই দেখতে পেল তার ভাইয়ের সারা শরীরে ব্যান্ডেজ করা, অনেক কষ্টে ঘুমাচ্ছে বেচারা আর ধৃতির ভাবিও তার ভাইয়ের শিয়রে বসে ঘুমাচ্ছে। ধৃতি মলিন হেসে বলে, “তোমরা ভালো থেকো ভাইয়া-ভাবি, আমি যে এখন শুধু আর শুধু তোমাদের জীবনে অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই নই। একটা নোংরা, পাপীষ্ঠের স্পর্শে আজ আমি অভিশপ্ত। নিজের এই অভিশাপের ভাগীদার যে আমি তোমাদের বানাতে পারব না। তাই আমি আজ সবকিছু ছেড়ে, এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। জানি না, এরপর কোথায় যাব..কিন্তু এখানে থাকতেও চাই না আমি। তোমরা ভালো থেকো, আর আমাকে খুঁজো না। আমার ছায়াও যেন তোমাদের জীবনে আর না পড়ে এই প্রার্থনা করি।”

বলেই ধৃতি দরজাটা বন্ধ করে দেয়৷ অতঃপর বাড়ির মেইন ফটকের দিকে পা বাড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় বাড়ির মেইন ফটকে। বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। বাড়ির বাইরে এসে পিছন ফিরে আরো একবার দেখে নেয় তার আজীবনের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটিকে। বড্ড আবেগঘন হয়ে পড়ে ধৃতি। কিন্তু আজ যে আর পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই তো ধৃতি পা বাড়ায় সামনের দিকে। এক অজানা গন্তব্যের উদ্দ্যেশ্যে।

রাত গভীর হওয়ায় আশেপাশের পরিবেশ বেশ শুনশান। মেইন রোড দিয়ে মাঝে মধ্যে কয়েকটা গাড়ি শো শো করে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ধৃতি একদম খালি হাতে, সহায়-সম্বলহীন হয়ে হেঁটে চলেছে অনন্তযাত্রায়। আশেপাশের কোনকিছুই খেয়াল করছে না। শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত মেয়েটার জীবনে যে আর কোন চাওয়া পাওয়া বেঁচে নেই। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এখন সে শুধু আর শুধু নিজের মৃত্যুই চায়। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন ফুটপাত থেকে মেইন রোডে চলে আসে ধৃতি সেটা সে খেয়ালও করেনি। হঠাৎ করেই একটা গাড়ি সামনে চলে আসায় ধৃতি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই গাড়ির সংঘর্ষ বেঁধে যায়। ধৃতি ছিটকে পড়ে রাস্তায়। এরপর ধীরে ধীরে তার চোখে নেমে আসে আঁধার। জ্ঞান হারানোর পূর্বে সে আবছা আবছা এক পুরুষের অববয় দেখতে পায় নিজের চোখের সামনে। এরপর আর কোন কিছুই মনে নেই তার। কারণ সে ডুবে যায় অন্ধকারের এক রাজ্যে।

★★★
বিশাল এক অট্টালিকা সমান বাড়ির ডাইনিং রুমে বসে আছেন এক বৃদ্ধা মহিলা। তার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। বারবার দেয়ালে টাঙানো বিশাল এক ঘড়িতে সময় দেখছেন এবং নিজের দুশ্চিন্তার মাত্রা বাড়িয়ে চলেছেন। এরইমধ্যে এক মধ্যবয়সী পুরুষ তার সম্মুখে এসে বলল,
“আপনি এখন ঘুমাতে যান আম্মা, ও ফিরলে আমি আপনাকে জানিয়ে দেব।”

বৃদ্ধা রক্তিম চোখে তাকিয়ে বলে,
“আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না আশরাফ। আমার দাদুভাই না ফেরা পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না।”

এরইমধ্যে একজন মধ্যবয়সী নারী দৌঁড়ে দৌঁড়ে এসে বলেন,
“তোমরা কেউ আমার ছেলেটার খোঁজ পেলে? আমার যে খুব চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য। না জানি এত রাতে কোন বিপদে ফেঁসে গেল।”

আশরাফ পাটোয়ারী বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
‘তোমার ছেলে কোন কচি খোকা নয়, মালিনী। যে কোন বিপদে ফেঁসে যাবে৷ ও যথেষ্ট বড় হয়েছে। এই বয়সে যখন এত বড় একটা বিজনেস এত সুন্দর ভাবে পরিচালনা করতে পারছে তখন আমার মনে হয়না এত সহজে কোন বিপদে ফেঁসে যাওয়ার মতো ছেলে ও। তুমি আর আম্মা শুধু শুধু চিন্তা করে নিজেদের বিপি হাই করছ, আর কিছু না।’

বৃদ্ধা গুলশেনারা বেগম এইবার তেঁতে উঠে বললেন,
“চুপ করো আশরাফ, মায়েদের চিন্তা আর তুমি কি বুঝবে! যদি বুঝতে তাহলে তো হয়েই যেত। সারাটা জীবন তো তোমার জন্য কম ভোগান্তি পোহাতে হলো না আমায়। এই শেষ বয়সে এসেও তো একটু শান্তি নেই। আমার দাদুভাই তো কত দায়িত্ববান একটা ছেলে…তাই তো আমার চিন্তাড়া আরো বেশি হচ্ছে। নিশ্চয়ই ও কোন বিপদে পড়েছে নাহলে এত রাত অব্দি কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে বাইরে থাকত না। আমি বলছি, এখনই থানায় গিয়ে জিডি করো। আমার দাদুভাই এর কিছু হয়ে গেলে কিন্তু আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলব না। সবাইকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে এই বাড়ি থেকে বের করে দেব।”

নিজের মায়ের থেকে এহেন হুমকি পেয়ে নড়েচড়ে বসেন আশরাফ পাটোয়ারী। বলে ওঠেন,
“আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আম্মা। আমি দেখছি কি করা যায়।”

বলে তিনি যেই না বাড়ি থেকে বের হতে যাবেন এমন সময় ত্রস্ত পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করে বহুল কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি। নিজের দাদির নয়নের মনি, গোটা শহরের সবথেকে ধনাঢ্য ও চতুর ইয়াং বিজনেসম্যান “আরশাদ পাটোয়ারী” যে মাত্র ২৮ বছর বয়সে নিজের পারিবারির ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান “পাটোয়ারী বিজনেস লিমিটেড” কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে নিজের অনন্য দক্ষতার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, রূপের দিক দিয়েও বড়বড় নায়ক এবং সুপারস্টারদের টেক্কা দেবে সে। ৬ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট, ধবধবে ফর্সা, সিক্স প্যাক বডিওয়ালা, বলিষ্ঠদেহী এই পুরুষকে একবার দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাবে যে কেউ। তাই তো এই গোটা ঢাকা শহরের হার্টথ্রব সে।

আরশাদকে দেখামাত্রই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আশরাফ পাটোয়ারী। নিজের মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“এই তো এসে গেছে তোমার গুণধর নাতি, তোমাকে আর ওকে চিন্তা করতে হবে না।”

নিজের নাতির ফেরার কথা শুনেই উঠে দাঁড়ান গুলশেনারা বেগম। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরশাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন,
“তুমি এসেছ দাদুভাই! সারাটা রাত কোথায় ছিলে? তোমার চিন্তায় আমি দুচোখের পাতা এক করিনি। জানো কত চিন্তায় ছিলাম? তোমাকে তো ফোনেও পাওয়া যাচ্ছিল না। এতক্ষণে তোমায় দেখার পর একটু স্বস্তি পেলাম।”

আরশাদ গম্ভীর স্বরে বলে,
“আমাকে নিয়ে তোমাদের কাউকে এত চিন্তা করতে হবে না। আমি একদম ঠিক আছি। আই নিড রেস্ট।”

আশরাফ পাটোয়ারী রাগী স্বরে বলেন,
“এভাবে কথা বলছ কেন আরশাদ? ম্যানারস শেখো নি?”

গুলশেনারা বেগম উলটে নিজের ছেলেকে ধমক দিয়ে বলেন,
“একদম চুপ! আমার দাদুভাইয়ের সাথে এভাবে উঁচু স্বরে কথা বলার দুঃসাহস দেখাবে না দুবার। যখন ওকে ম্যানারস শেখানোর কথা ছিল তখন কোথায় ছিলে তুমি? এখন এসেছ শাসন করতে। দাদুভাই, তুমি নিজের রুমে যাও, রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। আমার যা শোনার আমি পরে শুনে নেব।”

আশরাফ পাটোয়ারী একদম চুপসে যান। মালিনী পাটোয়ারী হঠাৎ করে চমকে উঠে বলেন,
“তোমার পেছনে ওটা কে আরশাদ?”

মালিনী পাটোয়ারীর কথায় সবাই চমকে যায়। এতক্ষণে গুলশেনারা বেগমেরও নজরে যায় আরশাদের পেছনে কেউ একটা দাঁড়িয়ে আছে। আরশাদ তখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের পানে চেয়ে। গুলশেনারা বেগম বলেন,
“তাইতো! এই কে আছ আমার দাদুভাই এর পেছনে জলদি বেরিয়ে এসো।”

তার ধমকের চোটে ধীরে ধীরে আড়ষ্টতার সাথে আরশাদের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে একটি মেয়ে। যার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। গুলশেনারা বেগম থতমত খেয়ে যায়। জিজ্ঞেস করেন,
“এই মেয়ে, কে তুমি? আর দাদুভাইয়ের সাথে কি করছ?”

মেয়েটি কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখেমুখে ভয়। আরশাদ হঠাৎ করেই মেয়েটির হাত শক্ত করে ধরে বলে,
“ও কে,কোথা থেকে এসেছে এই কৈফিয়ত আমি কাউকে দেব না। এখন থেকে ও এই বাড়িতেই থাকবে এবং এটাই আমার শেষকথা।”

মেয়েটি এবার অবাক চোখে নিজের সামনে দাঁড়ানো সুদর্শন পুরুষের দিকে তাকায়। তার মনে খেলে যাচ্ছে নানা প্রশ্ন। সে অস্ফুটস্বরে বলে,
“আমার নাম ধৃতি…”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here