#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধৃতি নিজের নামটা বলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময় তার সামনে দাঁড়ানো শক্তপোক্ত পুরুষটা রাগী গলায় চিৎকার করে বলল,
“এই মেয়ে, তোমায় আমি বলেছি কাউকে কৈফিয়ত দিতে? তাহলে কেন দিলে?”
এত হুংকারে বেচারা ধৃতি চমকে ওঠে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বলে,
“দুঃখিত..আসলে আমি…”
গুলশেনারা বেগম বলেন,
“এত রেগে যাচ্ছ কেন, দাদুভাই? আমরা তো মেয়েটার পরিচয়ই জানতে চাচ্ছি।”
আরশাদ চিরায়ত স্বভাবে নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল,
“আমি যখন বলেছি ও কাউকে কৈফিয়ত দেবে না, তার মানে ও কাউকেই কৈফিয়ত দিবে না৷ এটাই আমার শেষ কথা।”
আশরাফ পাটোয়ারী বলে উঠলেন,
“তুমি বললেই তো আর হলো না আরশাদ। এভাবে বলা নেই, কওয়া নেই। হুট করে একটা চালচুলোহীন মেয়েকে এ বাড়িতে এনে তুললে..আবার এখন বলছ তাকে এখানে আশ্রয়ও দেবে! তা বলি, বাড়িটাকে কি সরাইখানা পেয়েছ নাকি তুমি?”
আরশাদ কোন কিছু না বলে রক্তিম চোখে চেয়ে রয়। অবস্থা বেগতিক দেখে গুলশেনারা বেগম বলেন,
“তুমি চুপ করো আশরাফ! আমার দাদুভাই যখন কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন ভেবেচিন্তেই নিয়েছে। দাদুভাই যখন বলেছে এই মেয়েটা এই বাড়িতে থাকবে তার মানে ও এই বাড়িতেই থাকবে। এ নিয়ে আমিও আর কোন কথা শুনতে চাইনা। বৌমা, তুমি এই মেয়েটাকে নিয়ে স্টোররুমটা দেখিয়ে দিয়ে এসো৷ ও নাহয় ওখানেই থাকবে।”
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“কিন্তু আম্মা, স্টোর রুমটা তো অনেক ময়লা..ওখানে কি ভাবে থাকবে?”
“তোমাকে যেটা বলছি সেটাই করো। প্রয়োজনে এই মেয়ে নিজের থাকার যায়গায়টা পরিস্কার করে নিবে। কি মেয়ে, পারবে না?”
ধৃতি মাথা দুলিয়ে বোঝায় সে পারবে। গুলশেনারা বেগম এবার তার নাতিকে জিজ্ঞেস করেন,
“তোমার এতে কোন আপত্তি নেই তো?”
আরশাদ এই প্রসঙ্গ পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়ে বলে,
“আমার মাথাটা ভীষণ ধরেছে। আই নি’ড সাম রিফ্রেশমেন্ট। আমি নিজের রুমে যাচ্ছি। আমার রুমে ব্ল্যাক কফি পাঠিয়ে দিও।”
বলেই সে গটগট পায়ে হেটে পা বাঁড়ায় সামনের পানে। পেছনে রেখে যায় ধৃতিকে। ধৃতি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মালিনী তাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘এই মেয়ে, তুমি আমার সাথে এসো। তোমাকে আমি স্টোররুমটা দেখিয়ে দিচ্ছি।’
ধৃতি হালকা মাথা নাড়িয়ে মালিনী পাটোয়ারীর সাথে সাথে যেতে থাকেন। তারা যেতেই আশরাফ পাটোয়ারী নিজের মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“এটা কি ঠিক হলো আম্মা? আরশাদ বলল আর আপনি এভাবে কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই একটা মেয়েকে এবাড়িতে ঠাঁই দিয়ে দিলেন! এত সহজে কি মেয়েটাকে বিশ্বাস করা ঠিক হলো? যদি এই মেয়ে কোন স্পাই হয় তখন? যদি কোন খারাপ মতলব নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে?”
গুলশেনারা বেগম লাঠিতে ভড় দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন,
“আমাকে এত কাঁচা খেলোয়াড় ভেবো না আশরাফ। তুমি কি ভেবেছ? এই মেয়ের ব্যাপারে আমি কোন খোঁজ খবর নেব না? আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যেই এর সব বায়োডাটা আমি জোগাড় করে ফেলব। তারপর সন্দেহজনক কিছু পেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। আপাতত দাদুভাইকে শান্ত করার জন্য কিছু বললাম না।”
“দেখেন,যা ভালো মনে করেন। আমি তো বুঝতে পারি না আপনি আপনার নাতিকে এত অন্ধের মতো সাপোর্ট কেন করেন। ও যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে?
” সেটা যদি তুমি বুঝতে তাহলে তো হয়েই যেত। আরশাদ দাদুভাই হলো আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তোমার মতো কাচা খেলোয়াড় নয় ও। তোমার উপর দায়িত্ব দিলে তো আজ আমার বিজনেসটার ১২ টা বেজে যেত। সেখানে দেখো আমার দাদুভাই বিজনেস টাকে কি সুন্দর দাঁড় করিয়েছে। তো আমি ওকে মূল্যায়ন করব না তো কি তোমার মতো মাকাল ফলকে মূল্যায়ন করব? জীবনে কি দিয়েছ আমায়? সারাটা জীবন তো শুধু ভোগান্তিই দিয়ে গেলে।”
নিজের মায়ের এমন কাঠ কাঠ কথায় চুপসে যান আশরাফ পাটোয়ারী। অপমানে তার মাথা হেট হয়ে যায়। তবে তিনি এখন কিছু না বললেও সব অপমান মনে রাখছেন। সময় হলে ঠিকই সব অপমানের দাঁত ভাঙা জবাব দেবার অপেক্ষায় আছেন!
★★★
মালিনী পাটোয়ারী ধৃতিকে নিয়ে যেতে যেতে বলেন,
“তোমার নামটা এত কঠিন কেন গো মেয়ে, আমি তো উচ্চারণই করতে পারছেন না।”
ধৃতি মুচকি হেসে বলে,
“আপনি চাইলে আমাকে কোন সহজ নামেও ডাকতে পারেন যেই ডাকটা আপনার কাছে সহজ হবে।”
মালিনী পাটোয়ারী কিছুক্ষণ ভেবে বলেন,
“কি নামে ডাকে যায় তোমায়? উম..”
মালিনী পাটোয়ারী ধৃতিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলেন,
“মাশাল্লাহ , একদম ফুলের মতো নিষ্পাপ তুমি…তোমাকে বরং আমি ফুল বলেই ডাকি কি বলো?”
ধৃতির হাসিমুখে হঠাৎ আঁধার নেমে আসে। মনে পড়ে যায় অতীতের কিছু ভয়াবহ স্মৃতি। সে আর কিছু বলতেই পারে না। এদিকে ধৃতিকে চুপ দেখে মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
‘এই মেয়ে, কিছু বলছ না কেন? নামটা কি পছন্দ হয়নি?’
ধৃতি তার ভাবনা থেকে বেরিয়ে সামান্য হেসে বলে,
“পছন্দ হবে না কেন? খুব পছন্দ হয়েছে।আপনি আমায় ফুল বলেই ডাকিয়েন।”
মালিনী পাটোয়ারী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
“বেশ, তোমাকে তাহলে আজ থেকে ফুল বলেই ডাকব। তা একটা প্রশ্ন করব তোমায়?”
“জ্বি, করুন।”
“তোমার সাথে আমার ছেলের দেখা হলো কিভাবে?”
ধৃতি মালিনী পাটোয়ারীর সাথে কথা বলেই বুঝতে পেরেছে ইনি বেশ মাটির মানুষ। মনে কোন প্যাচগোচ নেই। তাই তো নির্দ্বিধায় বলল,
“আসলে আপনার ছেলের গাড়ির সাথে আমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল আর তারপর…”
মালিনী পাটোয়ারী খানিকটা ভয় পেয়ে আতকে উঠে বলেন,
“সেকি! এক্সিডেন্ট। এজন্যই তোমার মাথায় ব্যান্ডেজ! কি করে হলো বলো তো?”
“আসলে দোষটা আমারই। আমিই আপনার ছেলের গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলাম।”
“একটু দেখেশুনে চলাফেরা করবে তো..যদি কোন বড় বিপদ হয়ে যেত। তো যাইহোক..আরশাদ হঠাৎ তোমায় এখানে কেন নিয়ে এলো? তোমার বাড়ির লোককে খবর দাওনি?”
ধৃতির এবার মনে পড়ে যায় তার জ্ঞান ফেরার পরবর্তী মুহুর্তটা। যখন আরশাদ তার সাথে দেখা করতে এসেছিল। তাকে বিশাল বড় ধমক দিয়েছিল এভাবে তার গাড়ির সামনে চলে আসার জন্য। ধৃতি সব গালমন্দ চুপচাপ হজম করেছে কারণ দোষ তারই ছিল। এরপর যখন আরশাদ তার পরিবার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল তখন ধৃতি উত্তর দিয়েছিল তার পরিবার বলতে কেউ নেই। সে এই দুনিয়ায় একদম একা।
তখনই আরশাদ কিছু না বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেছিল। এরপর ধৃতির রিলিজের টাইম আসতেই আরশাদ ধৃতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একপ্রকার জোরপূর্বক নিজের সাথে করে নিয়ে আসে এবং বলে,
“যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হচ্ছ, ততক্ষণ তোমাকে আমার জিম্মাতেই থাকতে হবে। আফটার অল, এখন তুমি আমার রেসপনসেবলিটি। দূর্ঘটনা হোক আর যাইহোক, আমার মাধ্যমেই তোমার ক্ষতি হয়েছে।”
এসব কথাই ভাবছিল ধৃতি এমন সময় মালিনী বেগম বলেন,
“এই তো এসে গেছি স্টোরররুমে। এই যে দেখতে পারছ কালো দরজাটা ওটাই স্টোররুম। কিন্তু এটা তো অনেকদিন থেকে ময়লায় স্তূপ জমে আছে। তুমি এখানে কিভাবে থাকবে?”
ধৃতি কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে চলে আসল পাটোয়ারী বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড কুলসুম। কুলসুমকে দেখে মালিনী পাটোয়ারী অবাক স্বরে বললেন,
“কিরে! তুই এখানে কি করছিস?”
কুলসুম পান চিবোতে চিবোতে বলল,
“ছোট সাহেবই তো আমাক এইখানে পাঠাইলেন। কইলেন, ঘর ঝাড়ু দিতে। তাবই তো আইলাম।”
“আচ্ছা, যা তুই ঘরটা ঝাড়ু দে। ভালোই তো। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে তো ফুল কিছু করতেও পারত না।”
নিজের জন্য সবার এমন চিন্তা দেখে অবাক হয় ধৃতি। বিশেষ করে আরশাদ পাটোয়ারী নামক লোকটার এত উদারতা তার মনে কেমন জানি অনুভূতি তৈরি করছ। আজকালকার যুগে কে একটা আগন্তুকের জন্য এমন করে?!
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨