#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আরশাদ চেয়ে ছিল ধৃতির পানে। এদিকে ধৃতির দৃষ্টি পাটোয়ারী বাড়ির আড়ম্বরপূর্ণ আলোকসজ্জায়। আশরাফ পাটোয়ারী আরশাদের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“আনিকা কত সুন্দর নাচছে, তুমিও ওর সঙ্গ দাও।”
আরশাদ ধৃতির থেকে চোখ ফিরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
“আমি ডান্স করতে ইন্টারেস্টেড নই।”
আনিকা এতে কিছুটা অপমানিত বোধ করল কিন্তু কোন কড়া প্রতিক্রিয়া দেখালো না৷ গুলশেনারা বেগম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললেন,
“এসব নাচগান পরে অনেক করা যাবে। আমার দাদুভাই কত ঝড়-ঝাক্কি সামনে এলো ওকে একটু সময় দাও তোমরা। তো যাইহোক, আপাতত আমরা এনগেজমেন্টের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু করি তারপর নাহয় অন্য কিছু ভাবা যাবে।”
আশিকুর চৌধুরীও গুলশেনারা বেগমের সাথে সহমত প্রকাশ করে বলেন,
“একদম ঠিক বলেছেন আপনি। এখন আপাতত এনগেজমেন্টটা সেরে রাখা যাক। তারপর বাকি অনুষ্ঠানের জন্য তো সারাটা দিন পরে আছেই।”
গুলশেনারা বেগম আরশাদের কাছে এসে তার কানে ফিসফিস করে বলে,
“আশা করি, তুমি কোন সিনক্রিয়েট করবে না দাদুভাই। কারণ তুমিও জানো, আমাদের বিজনেসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই বিয়েটা হওয়া ঠিক কতোটা দরকার। তুমি একজন খাঁটি বিজনেসম্যান। তাই আশা করি, তোমার সিদ্ধান্তে আমি হতাশ হবো না। সবার নজর তোমাদের এই এনগেজমেন্টকে ঘিরে। তাই তুমি সবদিক বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিও। এই নাও, তোমার হাতে এই ডায়মন্ড রিং ধরিয়ে দিয়ে গেলাম। এরপর বাকিটা তোমার উপর। আমি জানি, তোমার উপর জোর করে কিছু চাপাতে চাইলে তুমি সেটা মানতে চাও না। তবে এখানে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। তুমি বিবেক দিয়ে চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্তটাই নিও।”
বলেই তিনি দূরে সরে আসেন। আরশাদ তখনো গম্ভীর মুখে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। একচুলও নড়ছে না। গুলশেনারা বেগম এবার খানিকটা ভয় পেয়ে গেলেন। তাহলে কি তার পরিকল্পনা সফল হবে না? কিন্তু তাহলে যে সেটা তার এবং পাটোয়ারী এন্টারপ্রাইজ এর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। আরশাদকে দেখে মনে হচ্ছিল না সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে মনে মনে, সেই সিদ্ধান্তেই অটল আছে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা ঠিক কি, এটাই এখন সবথেকে বড় প্রশ্ন।
আরশাদ চোয়াল শক্ত করে সামনের দিকে এগোতে থাকে। তার ভাবভঙ্গি দেখে গুলশেনারা বেগম ভয় পেয়ে যান। তাহলে কি তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো? আরশাদ কি তাহলে এবার তার স্বভাবসুলভ ভাবেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হওয়া এই এনগেজমেন্টটা ভেঙে ফেলবে? তার বেশ ভয় জাগল মনে। গাম ছুটতে লাগল বেগালামহীন ভাবে। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে আরশাদ আনিকার সামনে গেল। অতঃপর আনিকাকে ইশারা করলো হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য। আনিকা যেন এই মুহুর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল। খুশি মনে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো আরশাদের দিকে। আরশাদ আর কোন দিকে না তাকিয়ে আংটি পড়িয়ে দিলো আনিকার হাতে। আনিকা ভীষণ খুশি হলো এতে করে। তার চোখ চকচক করে উঠল। অতঃপর অনিকাও একটি রিং বের করে পড়িয়ে দিলো আরশাদকে। ব্যস, এখানেই সমাপ্ত ঘটে গেলো তাদের আংটি বদল অনুষ্ঠানের। আংটি বদল মিটে যেতেই আরশাদ আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সেই স্থানে। গটগট পায়ে হেঁটে রওনা দিলো তার কক্ষের দিকে। আরশাদকে এভাবে শীতল আচরণ করতে দেখে যদিওবা গুলশেনারা বেগম খুব একটা খুশি হলেন না তবে এনগেজমেন্টটা যে ঠিকভাবে সম্পন্ন হলো এতেই তিনি স্বস্তি খুঁজে পেলেন যেন। হাফ ছেড়ে বললেন,
“যাইহোক, এনগেজমেন্ট টা তো ঠিকঠাক হলো। বাকিটা আমি ম্যানেজ করছি।”
এই ভাবনা থেকেই তিনি সম্মুখ পানে এসে বললেন,
“আসলে আমার দাদুভাই অনেক বেশি টায়ার্ড তাই এভাবে চলে গেল। আপনারা কেউ কিছু মনে করবেন না।”
উপস্থিত কেউই যদিওবা বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নেন নি তবুও এটা নিয়ে খুব বেশি চাপানউতর হলো না। সবাই যে যার মতো বিজনেস সংক্রান্ত আলাপে মগ্ন হলেন। এদিকে নিজের হাতের অনামিকা আঙুলে শোভা পাওয়া আংটিটার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
“অবশেষে আমার উদ্দ্যেশ্য পূরণের পথে!”
এরই মধ্যে মালিনী পাটোয়ারীর নজর যায় ধৃতির দিকে। তিনি ধৃতির কাছে গিয়ে বলেন,
“ফুল! তুমি এখানে?! ওহ, ভালো কথা। তুমি তো মনে হয় সকাল থেকে কিছু খাওনি। উফ, এই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় তো সকাল থেকে এত ব্যস্ত ছিলাম যে তোমার খোঁজও নিতে পারি নি। চলো, তোমায় খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
ধৃতি বলে,
“আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হতে হবে না, আন্টি। আমি খেয়ে নেব।”
এদিকে, আনিকা চারিদিকে দেখছিল। হঠাৎ করেই তার নজর যায় ধৃতির দিকে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মেয়েকে দেখে আনিকা এগিয়ে এসে বলে,
“এই মেয়েটা কে?”
মালিনী পাটোয়ারী বলতে চান,
“ও তো ফুল..”
কিন্তু মালিনী পাটোয়ারী নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারেন না। তার পূর্বেই গুলশেনারা বেগম এগিয়ে এসে বলেন,
“আরে ও তো আমাদের বাড়ির নতুন কাজের মেয়ে। তুমি হঠাৎ ওর খোঁজ নিতে যাচ্ছ কেন আনিকা? তুমি এদিকে এসো..আজ তোমার জীবনে কত স্পেশাল একটা দিন। এনজয় করো।”
এভাবে “কাজের লোক” ট্যাগ গায়ে লাগায় ধৃতির খানিকটা বিব্রত বোধ হয়। ধৃতি গভীর চিন্তায় মগ্ন নয়, ছোটবেলা থেকে তো বেশ স্বচ্ছল জীবনযাপনই করেছে সে। তার বাবার কাপড়ের দোকান ছিল, বাবার মৃত্যুর পর ধৃতির ভাই সেই কাপড়ের দোকানের ব্যবসার হাল ধরে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। যার ফলে কখনো আর্থিক ভাবে তাদের খারাপ অবস্থায় পড়তে হয়নি। কিন্তু আজ..আজ কিনা তাকে এভাবে অন্য এক জনের বাড়িতে এসে কাজের লোকের তকমা সইতে হচ্ছে! ভাবনার ইতি টানল ধৃতি। নিজের উপরেই তার হাসি পেল। কাজের লোক না হলেও সে তো এখানে আশ্রিতই। আশ্রিতও নিশ্চয়ই কোন সম্মানজনক অবস্থা নয়?! আজ শুধুমাত্র ভাগ্যের ফেরে তাকে এই দিন দেখতে হচ্ছে। ধৃতির চোখের কোণে জল। খুবই সুচতুর ভাবে সেই জল মুছে ফেলল সে।
আনিকা হঠাৎ বলে উঠল,
“ও যদি এই বাড়ির কাজের লোকই হয় তাহলে বাড়িতে যখন এত বড় অনুষ্ঠান হচ্ছে তখন ও এমন ভাবে সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন? ওর কি কোন দায়-দায়িত্ব নেই? ওকে কোন কাজ করতে বলুন। এখানে এত গেস্ট আছে..তাদের মধ্যে ড্রিংকসও তো সার্ভ করতে পারে।”
গুলশেনারা বেগম বলে,
“তাই তো! এই মেয়ে আনিকা কি বলল শুনলে না! ও কিন্তু এই বাড়ির হবু মালকিন তাই ও যা বলছে তাই করো। যাও, গেস্টদের মাঝে ড্রিংকস সার্ভ করো।”
ধৃতির ইচ্ছা করছিল বুক ফাটিয়ে চিৎকার করতে। কিন্তু সে তা করল না। চুপচাপ এগিয়ে এসে সবার মধ্যে ড্রিংকস বিতরণ করতে লাগল। মালিনী পাটোয়ারীর খুব খারাপ লাগল এই দৃশ্য দেখে। কিন্তু তারও যে হাত-পা বাঁধা তাই চুপচাপই রইলেন। আশরাফ পাটোয়ারী এই দৃশ্য দেখে যেন স্বতি পেলেন। মনে মনে বললেন,
“আরশাদের খুব আদিখ্যেতা ছিল না এই মেয়েকে নিয়ে! একদম ঠিক হয়েছে। এবার বুঝুক মজা।”
ধৃতি এসব কাজে একদমই পটু ছিল না। তাই তো অসাবধানবশত হঠাৎ করেই হোচট খেয়ে তার হাত থেকে সবগুলো ড্রিংকস এর গ্লাস পড়ে গেলো। এতে করে গুলশেনারা বেগম বলে উঠলেন,
“হায় হায় রে! এই মেয়ে তো দেখছি একটা সামান্য কাজও করতে পারে না। কত দামী দামী গ্লাসগুলো ভেঙে দিল।”
আনিকা রেগে বললো,
“এই মেয়ে! কি করলে এটা? ভাঙা গ্লাসগুলো পরিস্কার করো। কারো পায়ে লাগলে আর রক্ষে থাকবে না।”
ধৃতি ছলছল নয়নে ফ্লোরে বসে ভাঙা গ্লাসগুলো তুলতে লাগল৷ হঠাৎ করেই খেয়াল করলো তার সামনে কেউ এসে দাঁড়ানো, যার পা দৃশ্যমান হচ্ছে তার আঁখিযুগলে। সেই আগন্তুক বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠল,
“বাড়িতে এত বড় অনুষ্ঠান অথচ বাড়ির বড় ছেলেকেই কেউ জানালে না! ইটস নট ফেয়ার।”
ধৃতি পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেল কন্ঠস্বরটা শুনে! এই যে তার সেই চেনা কন্ঠস্বর। যেই কন্ঠস্বরটা এক রাতেই ধ্বংস করে দিয়েছে তার ফুলের মতো সাজানো জীবন। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেল। মনে নানান আশংকা নিয়ে কাপা কাপা শরীরে উপরের দিকে তাকাতেই বড় একটা ধাক্কা খেল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,”আরহাম শান্ত…”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨