#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধৃতি যখন হতবাক ও ভীত চোখে আরহাম শান্তর দিকে তাকিয়ে ছিল তখন আরহাম তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছিল না৷ বরং ধৃতিকে চেনে না এমন ভাব করে তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে গিয়ে সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“বিনা দাওয়াতে চলে এলাম৷ নিজের ছোট ভাইয়ের নতুন জীবনের সাক্ষী হতে।”
গুলশেনারা বেগম ক্ষেপে উঠে বললেন,
“তুমি কোন সাহসে এই বাড়িতে পা রেখেছ? আশরাফ…তুমি যদি এসবের পেছনে থাকো তাহলে কিন্তু ভালো হবে না৷ কি ভেবেছ টা কি তুমি? এক্ষুনি বের করে দিতে বলো ওকে নাহলে কিন্তু আমি ছাড়ব না।”
আশরাফ মনে মনে বলে,
“একদিন আমার ছেলে ঠিকই এই বাড়িতে পূর্ণ অধিকার নিয়ে আসবে। আমি সেদিনেরই অপেক্ষায় আছি। কিন্তু আপাতত যদি পরিস্থিতি সামলাতে হয় তাহলে আমায় একটু কঠোর হতেই হবে।”
এই মনোভাব নিয়ে সে এগিয়ে এসে আরহামকে উদ্দ্যেশ্য করে বেশ শান্ত ভাবে বলে,
“আরহাম, তুমি এখান থেকে চলে যাও। আমি চাই না আজকের দিনে কোন অশান্তি হোক।”
আরহাম নিজের বাবার অনুরোধকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলে,
“আজ আমাকে কেউ এখান থেকে দূর করতে পারবে না। আমি যে উদ্দ্যেশ্যে এখানে এসেছি তা পূরণ করেই ছাড়ব।”
বলেই সে সামনে এগোয়। আশিকুর চৌধুরী ও আনিকা দুজনেই অবাক চোখে তাকিয়ে। আরহাম শান্ত সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনারা অনেকেই হয়তো আমাকে চেনেন না আর না চেনাটাই স্বাভাবিক কারণ আমায় পরিচয় এতদিন কাউকে দেয়া হয়নি। নিজের পিতৃপরিচয়, বংশপরিচয় থাকতেও সমাজে এতগুলো দিন আমার সেই পরিচয় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু আজ আমি আপনাদের সবাইকে আমার পরিচয় দেবো। আর সব প্রমাণ সহ। যারপর আর কেউ আমার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারবে না।”
গুলশেনারা বেগম এর শরীরে ঘাম ছুটে যায়। এতদিন ধরে যেই সত্যগুলো তিনি সমাজের চোখে লুকিয়ে রেখেছিলেন, নিজের বংশ, আভিজাত্যের অহংকারে যেই সত্য তিনি চাপা দিয়ে রেখেছিলেন আজ তা সবার সামনে আসার দ্বারপ্রান্তে। আজ যদি এমনটা হয় তাহলে এতদিন ধরে তার তিল তিল করে গড়ে তোলা সব সম্মান ধুলোয় মিশে আছে। এটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। তাই তো আশরাফ পাটোয়ারীকে হুমকি দিয়ে বলেন,
“ঐ ছেলেকে থামাও বলছি..নাহলে কিন্তু আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। আমার পরিবারের সম্মান ও গৌরবের উপর কোন আঘাত আমি সহ্য করবো না।”
আশরাফ পাটোয়ারী অসহায় হয়ে আরহাম শান্তর সামনে গিয়ে হাতজোড় করে বলেন,
“আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, প্লিজ থেমে যাও। এটা সঠিক সময় নয়।”
অন্যদিকে ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছেন মালিনী পাটোয়ারী। বিবাহিত জীবনে সুখের দেখা তিনি এমনিও পান নি। এক ধনাঢ্য বনেদি পরিবারের মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ায় শৈশব,কৈশোর যতোটা আনন্দের ছিল তারুণ্য ও যৌবন ছিল ততোটাই কষ্টের। যদিও তার সারাটা জীবন কেটেছে আভিজাত্য ও স্বচ্ছলতায় কিন্তু টাকাই কি সব সুখ এনে দেয়? যদি সম্পর্কগুলোই থাকে এলোমেলো।
এদিকে অদম্য আরহাম শান্ত সবার সামনে বলতে শুরু করে,
“আমি আরহাম শান্ত, বিজনেস ওয়াল্ডে এই নামেই পরিচিত আমি। তবে আমার অন্য একটা নাম আছে। যেটা আমার পরিচয় বহন করে। আর সেই নামটা হলো আরহাম পাটোয়ারী শান্ত। নামটা শুনে হয়তো অনেকেই অবাক হয়ে যাবেন কিন্তু এটাই আমার আসল নাম।”
গুলশেনারা বেগম উত্তেজিত হয়ে বলেন,
“ওখানেই থেমে যাও। সামনে আর একটা শব্দও বলবে না।”
কে শোনে কার কথা। আরহাম শান্ত নিজের মতো করে বলতে থাকে,
“আমি এই পাটোয়ারী পরিবারের বড় ছেলে। হুম, অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য। তবে আমি মালিনী পাটোয়ারীর সন্তান নই। আমার মা হলেন আশরাফ পাটোয়ারীর প্রথম স্ত্রী নয়না পাটোয়ারী। যিনি ছিলেন এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ রমনী। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে পড়াশোনা করার সময় আমার মায়ের সাথে আশরাফ পাটোয়ারীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা একে অপরকে ভালোবাসেন এবং একসাথে সংসার করতে চান। কিন্তু ধন সম্পত্তি ও বংশমর্যাদার দম্ভে অন্ধ গুলশেনারা বেগম কখনো এটা মানতে চান নি যে, তার একমাত্র পুত্রের স্ত্রী একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হবেন। তাই তিনি তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ান। আমার নানু-নানা এবং মাকে হুমকি ধমকি দিতে থাকেন। কিন্তু নিজের ছেলেকে নিয়ন্ত্রণের কোন চেষ্টা করেন নি এই মহিলা। এরপর তো তিনি এমন কিছু করেন যা..যা আমি বলতেও পারছি না এই মুহুর্তে। তবে তার এসব কার্যক্রমে কোন লাভ হয়না। আশরাফ পাটোয়ারী ঠিকই আমার মাকে গোপনে বিয়ে করে সংসার পাতেন। কিন্তু এই সত্য গুলশেনারা বেগমের কাছে প্রকাশিত হতেও বেশি সময় লাগে না। এসব জানার পর দাম্ভিক মহিলা আরো বেশি ক্ষেপে ওঠেন। তিনি আশরাফ পাটোয়ারীকে ডেকে হুমকি,ধমকি দেন যে তিনি যদি আমার মাকে ত্যাগ না করেন তাহলে ভালো হবে না। তিনি সরাসরি বলে দেন, আশরাফ পাটোয়ারীকে আমার মা নয়নাকে ত্যাগ করে ওনার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। নাহলে উনি ওনার ছেলে আশরাফ পাটোয়ারীকে নিজের সমস্ত সম্পদ থেকে বঞ্চিত করবেন। আশরাফ পাটোয়ারী যতোই আমার মাকে ভালোবাসার কথা বলুক না কেন, সেই ভালোবাসা কখনো সম্পদের প্রতি ভালোবাসার থেকে বেশি ছিল না। আর তাই তো নিজের মায়ের এহেন কথা শোনার পর তিনি দুবারও ভাবেন নি আমার মাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত পুনবিবেচনা করার কথা। বরং যখনই গুলশেনারা বেগম ওনাকে এই হুমকি দেন তিনি সাথে সাথেই আমার মাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যান। আমার মা, সেদিন প্রথম জানতে পেরছিল যে আমি তার পেটে আছি..প্রথম বার মাতৃত্বের স্বাদ অন্বেষণের খুশি উপভোগ করতে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু সেই খুশির সংবাদ শোনার আগেই ঐ পাষণ্ড লোকটা আমার মাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন নিজের মায়ের শর্তমতো এবার তিনি তার মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবেন। আমার মা ওনার পা ধরে অনেক অনুরোধ করে কিন্তু ওনার চোখে তখন ছিল সম্পত্তির লোভ যা ঠুনকো ভালোবাসার কাছে কিছুই ছিল না। তাই তিনি এরপর আমার মাকে ছেড়ে নিজের মায়ের পছন্দমতো মেয়ে মালিনী পাটোয়ারীকে বিয়ে করে নেন। যদিও খাতায় কলমে আমার মায়ের সাথে ওনার ডিভোর্স হয় নি কিন্তু উনি একটিবার আমার মায়ের খোঁজ নেন নি। কারণ তার মধ্যে ভয় ছিল যদি এতে করে গুলশেনারা বেগম তাকে তার সম্পত্তি থেকে বিতারিত করেন। এরইমধ্যে আমার মা কঠিন জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যায় একা একা। সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক সব প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে আমায় জন্ম দেন। একা হাতে একজন সিঙ্গেল মাদার হয়ে আমার খেয়াল রাখতে থাকেন। ধীরে ধীরে মায়ের সহচর্যে বড় হতে থাকি আমি এবং তার সব কষ্টও অনুধাবন করতে পারি। ওদিকে আশরাফ পাটোয়ারীর দ্বিতীয় স্ত্রী মালিনী পাটোয়ারীর ঘরেও ততদিনে তাদের সন্তান মানে আরশাদের আগমন ঘটে। এরপর গুলশেনারা বেগম যখন আরশাদকে অতিরিক্ত আদর ও তার প্রতি অতিরিক্ত খেয়াল রাখেন তখন আশরাফ পাটোয়ারীর মনে শংকা জন্ম নেন। যেই সম্পদের লোভে তিনি আমার মাকে ত্যাগ করেছিলেন তার কাছে মনে হয় সেই সম্পদের কানাকড়িও তিনি ভোগ করতে পারবেন না। কারণ ততদিন পর্যন্ত পাটোয়ারী এন্টারপ্রাইজ এর দখল ছিল গুলশেনারা বেগম এর কাছে এবং তার পরবর্তী অংশীদার হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন আরশাদকে। যা আশরাফ পাটোয়ারীর মনে শংকা সৃষ্টি করে এবং তিনি তখন এই দোটানা থেকে আবার আমার মায়ের সাথে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নেন।কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছিল আমার মা অতিরিক্ত হারভাঙা খাটুনি ও পরিশ্রম সাথে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে ততদিনে টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো গুনছিল ”
বলতে বলতেই আরহামের চোখে জল চলে আসে। এদিকে মালিনী পাটোয়ারীও চূড়ান্ত পর্যায়ের হতবাক৷ তাহলে কি তিনি এতদিন শুধু শুধুই নয়না নামক সেই রমনীকে ভুল বুঝে সবসময় তাকে অভিশাপ দিয়ে গেল। অথচ তার জীবনের কঠিন সময়গুলোর জন্য নয়নাকে দোষ দিলেও আজ সে বুঝতে পারছে পরোক্ষভাবে তিনিই নয়নার জীবন নষ্ট করেছেন!
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨