#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধৃতি আরহামের যাওয়ার পানে তাকায় ক্রোধিত চোখে৷ এই লোকটা তার জীবন পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। অথচ তার চোখে অনুশোচনার লেশমাত্র নেই৷ ধৃতির কাছে এই মুহুর্তে আরহামকে দুনিয়ার সবথেকে জঘন্য মানুষ মনে হলো। ধৃতি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
‘এই লোকটা আমার জীবন পুরো নষ্ট করে দিয়েছে। ওনার জন্য আমি আজ আমার পরিবার থেকে বিছিন্ন। এই কোকটা আমার জীবনে অন্ধকার নিয়ে এসেছে। আমি জীবনে আর দ্বিতীয় বার ওনার ছায়াও মারাতে চাইনা। তার জন্য যদি আমার এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় তো আমি সেটাও করতে রাজি আছি।’
বলেই ধৃতি একটা দীর্ঘ শ্বাস বলে। এদিকে আরশাদ উপস্থিত সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আশা করি, আপনাদের যা ড্রামা দেখার তা দেখা হয়ে গেছে। তাহলে এখন আপনারা আসতে পারেন।”
আরশাদের মুখ থেকে এমন অপমানজনক কথা শুনে উপস্থিত সবাই এক এক করে চলে যেতে থাকে। সবাই চলে যাবার পর আশিকুর চৌধুরী বলে উঠলেন,
“আজ যা কিছু হয়ে গেল তারপর তো আপনাদের সাথে আত্মীয়তা করব কিনা এই সিদ্ধান্ত আমার পুনঃবিবেচনা করতে হবে। আফটার অল, সোসাইটিতে আমাদের একটা রেসপেক্ট আছে। আর আজ যা হলো তাতে মনে হয়না, আপনারা আর সম্মান বলে কিছু অবশিষ্ট আছে।”
গুলশেনারা বেগম বুকে হাত দিয়ে ঢোলে পড়েন আরশাদের উপর। আরশাদ নিজের দাদিকে সামলে নেয়। গুলশেনারা বেগম বিড়বিড় করে বলেন,
“এটা কি হলো দাদুভাই? আমার এত দিন ধরে জমানো সম্মান, প্রতিপত্তি, মর্যাদা এক মুহুর্তে ধ্বংস করে দিল ঐ ছেলে। আমি এটা মেনে নিতে পারছি না।”
“তুমি শান্ত হও দাদি, কিচ্ছু খারাপ হয়নি।”
এরইমধ্যে আনিকা এগিয়ে এসে নিজের বাবার কথায় প্রতিবাদ করে বলে,
“বিয়ে যদি আমায় করতেই হয় তাহলে আমি শুধু আরশাদকেই করব। নাহলে আর কাউকে নয়।”
আশিকুর চৌধুরী ক্রোধিত স্বরে বলেন,
“এতকিছুর পরেও তুমি এই কথা বলছ?”
“হ্যাঁ, বলছি। কারণ আমার কাছে এসব সো কলড সোশ্যাল রেসপেক্টের থেকে আমার ভালোবাসা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
আশিকুর চৌধুরী আর কিছু বলতে পারেন না। স্তিমিত স্বরে বলেন,
“দেখো, যা ভালো মনে করো। ছোটবেলা থেকে তোমার কোন ইচ্ছা আমি অপূর্ণ রাখিনি, এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না।”
আরশাদ হঠাৎ করে ক্রোধিত দৃষ্টিতে নিজের বাবা আশরাফ পাটোয়ারীর দিকে তাকায়। অতঃপর প্রবল ঘৃণা নিয়ে বলে ওঠে,
“এটাই তো চেয়েছিলেন আপনি, তাইনা? এইজন্যই নিজের প্রথম পক্ষের ছেলেকে ডেকে এসব ড্রামা করলেন।”
আশরাফ পাটোয়ারী জবাবে বলেন,
“এসব তুমি কি বলছ আরশাদ? আমি মোটেও এমন কিছু চাইনি।”
গুলশেনারা বেগম গুটি গুটি পায়ে লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে সবার সামনে ঠাস করে থা*প্পড় মা*রেন আশরাফ পাটোয়ারীকে। অতঃপর বলেন,
“চুপ। আর একটাও মিথ্যা কথা না। তোমার জন্য অনেক ভুগেছি আমি আর না। তোমাকে একটা শেষ সুযোগ দিয়েছিলাম তুমি সেটারও মর্যাদা রক্ষা করতে পারো নি। এবার আমি তোমাকে আর কোন দ্বিতীয় সুযোগ দেব না। এবার তুমি ভালোয় ভালোয় এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও আর নয়তো ঘাড় ধরে বের করে দেব।”
আশরাফ পাটোয়ারী হতবাক স্বরে বলে ওঠেন,
“আম্মা! এসব কি বলছেন আপনি? আমি আপনার ছেলে হই..আপবি আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে বলছেন!”
গুলশেনারা বেগমের কঠোর মনোভাবের কোন পরিবর্তন হয় না। আরশাদও নিজের দাদির সাথে তালে তাল মিলিয়ে বলেন,
“দাদি যা বলছে তাই করুন মিঃআশরাফ। বের হয়ে যান এই বাড়ি থেকে। আপনি এই বাড়িতে থাকার অধিকার হারিয়েছেন।”
“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমি এই বাড়ির ছেলে। আমাকে এখান থেকে এভাবে বের করতে পারো না তোমরা।”
গুলশেনারা বেগম ক্রোধিত স্বরে বলেন,
“আমি কি পারি আর কি পারি না, সেই সম্পর্কে মনে হয় তোমার কোন ধারণা নেই। ভালো চাইলে এক্ষুনি বের হও।”
অবস্থা বেগতিক দেখে আশরাফ পাটোয়ারী নিজের স্ত্রী মালিনী পাটোয়ারীর কাছে গিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলেন,
“তুমি অন্তত কিছু বলো।”
“আমি কি বলব? আপনি কি আমার কিছু বলার মতো মুখ রেখেছেন? আমার প্রতি যা করেছেন তার জন্য যদিওবা আপনাকে ক্ষমা করি কিন্তু আপনি নয়নার সাথে যা করেছেন তার জন্য আপনাকে আমি ক্ষমা করব না। আপনার চরিত্র যে এত খারাপ তা আজ আমি প্রথম জানলাম। আপনাকে নিজের স্বামী ভাবতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। ছি! মানুষ এত নিচু মানসিকতার হয়।”
আশরাফ পাটোয়ারী বুঝতে পারেন এযাত্রায় তাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। তার থেকে ভালো মান সম্মান হাতে নিয়ে চুপচাপ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া। তাই তিনি নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। অতঃপর নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এসে সবার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“আমি তাহলে চলে যাচ্ছি চিরতরে। তবে একসময় তোমরা ঠিকই পস্তাবা এর জন্য।”
কেউ ফিরেও তাকায় না আশরাফ পাটোয়ারীর দিকে। তিনি মলিন মুখে অসহায়ের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।
★★★
রাত তখন আরো গভীর হয়ে ভয়াবহ আঁধার নেমেছে। ধৃতি প্রস্তুত এক নতুন যাত্রা শুরুর জন্য। কিছুদিন আগে এরকমই এক রাতে অজানা গন্তব্যে পা বাড়িয়েছিল সে। আজ আবারো ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। সেদিন রাতে ধৃতি যখন নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল তখন সে জানতও না তার ভবিষ্যৎ কি হবে। কোথায় আশ্রয় পাবে। আজকের পরিস্থিতিও অনেকটা একই রকম। তবে যেতে যে তাকে হবেই। কারণ আরহাম শান্ত নামক এই অশুভ ছায়া আবার তার জীবনে পড়ুক এটা সে চায়না। এটা রোধ করার জন্য যা করতে হয় সে করবে।
তাই তো কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ পাটোয়ারী বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল ধৃতি। আশরাফ পাটোয়ারীর বাড়ি ত্যাগের পর মালিনী পাটোয়ারী ঘরে দুয়ার এটে বসে আছেন। যতই হোক, স্বামীই তো। তাই মুখে যাই বলুক তার জন্য একটু হলেও টান থাকবে। তাই অনেকটা নির্বিঘ্নেই বের হতে পারল ধৃতি। কারণ মালিনী পাটোয়ারী ছাড়া এ বাড়িতে তার খোঁজ নেয়ার মতো আর কেউ নেই।
পাটোয়ারী বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুদূর আসার পর ধৃতি একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করল। একটা ছায়ামূর্তিকে লুকিয়ে একটা গলিতে ঢুকতে লাগল। এখানে ধৃতির অবাক হবার মূল কারণ তার যতদূর মনে হচ্ছে এই ছায়ামূর্তিটাও পাটোয়ারী বাড়ি থেকেই বের হয়েছে। ধৃতির কাছে বিষয়টা সন্দেহজনক লাগে। তাই সে ছায়ামূর্তিকে চুপচাপ অনুসরণ করতে থাকে৷ কিছুদূর যাওয়ার পর ধৃতি আবারো তার জীবনের সবথেকে ঘৃণ্য ব্যক্তিটির মুখোমুখি হয়। আরহাম শান্ত! এই নামটা যেন তার পিছুই ছাড়ছে না। গলির একদম শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত ছায়ামূর্তির সাথে কথা বলছে আরহাম শান্ত। আরহাম শান্তর সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটির পুরো মুখ আবৃত হুডি ও মাস্ক দ্বারা। তাই ধৃতি তাকে চিনতে পারছিল না। সে লুকিয়ে তাদের কথোপকথন শুনতে থাকে। হঠাৎ তার কানে আরহামের কিছু কথা আসে। আরহাম বলছিল,
“তুমি একদম সঠিক পথেই আগাচ্ছ। এভাবে চলতে থাকলে আমি ঐ আরশাদ পাটোয়ারীর সর্বনাশ ডেকে আনতে পারবো এবং আমার উদ্দ্যেশ্য সফল হবে।”
ধৃতি অবাক স্বরে বলে,
“তার মানে এনারা আরশাদ সাহেবের ক্ষতি করার পরিকল্পনা করছেন।”
আরহাম আরো বলে,
“তুমি যেভাবে আরশাদের আপন সেজে ওর পিঠে ছু/রি মা/রার প্ল্যান করছ তা অবশ্যই কাজে দেবে। এভাবেই ওর বিশ্বাস জিতে নাও। তারপরই তো মোক্ষম চালটা দেব। দুনিয়া থেকে ঐ আরশাদকে একদম সরিয়ে দেব। মে/রে ফেলবো ওকে।”
ধৃতি আরহামের কথা শুনে বলে,
“কে এই অদ্ভুত ছায়ামূর্তি যে আরশাদ সাহেবকে পিছন থেকে ছু/রি মা/রতে চাইছে?! আমাকে জানতেই হবে। আরশাদ সাহেব আমার অনেক উপকার করেছেন। ওনার কোন ক্ষতি আমি অন্তত হতে দেব না।”
এরইমধ্যে ছায়ামূর্তি তার মাস্ক খুলে যার ফলে তার মুখ দৃশ্যমান হয় ধৃতির সামনে। ধৃতি হতবাক স্বরে বলে ওঠে,
“তার মানে ইনিই আরশাদ সাহেবের ক্ষতি করতে চাইছেন! আমাকে আরশাদ সাহেবকে সবটা জানাতেই হবে যে ওনাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করছে ওনারই আপনজন!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨