#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধৃতি আজ আবারো রাস্তায় হেটে বেড়াচ্ছে অসহায় পথিক হয়ে। জীবন নিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত সে। ধৃতির কাছে আজ মনে হচ্ছে তার জীবনের আদৌতে কোন মূল্যই নেই। এক পথহারা পথিকের মতো আজ তার অবস্থা। যার যাওয়ার কোন যায়গা নেই আর না আছে কোন গন্তব্য। ধৃতি অসহায় মুখ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“হে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, আমাকে আপনি এ কি পরীক্ষার মধ্যে ফেললেন? এর থেকে উত্তরণের কি কোন উপায় নেই? আমার জীবন কি এই অন্ধকারেই নিমজ্জিত থাকবে?”
ধৃতির মনোবল আর একটুও অটুট নেই। তবুও সে আশা রাখতে চায়। আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে চায়। কারণ সে জানে,দিনশেষে সত্যেরই জয় হয়। জুলুমকারীরা কখনো জয়ী হয় না। পরাজিত তাদের হতেই হয়।
★★
গুলশেনারা বেগম আনিকা ও আরশাদের বিয়ে নিয়ে আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। বিশেষ করে ধৃতির ঘটনাটার পর। গুলশেনারা বেগম বললেন,
“আমার আর কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না। ঐ আরহাম শান্ত চুপ করে বসে থাকার ছেলে নয়। আমি নিশ্চিন্ত ও আমাদের পরিবারের ক্ষতি করার জন্য নিশ্চয়ই কোন পরিকল্পনা করবে। তাই আমি আর ঝুঁকি নিতে রাজি নই। আনিকা দিদিভাই, তুমি তোমার বাবার সাথে কথা বলো। আগামীকালই আমি তোমার আর আরশাদ দাদুভাই এর বিয়ের ব্যবস্থা করব।”
গুলশেনারা বেগম এর মুখে এহেন কথা শুনে আরশাদ ও মালিনী পাটোয়ারী দুজনেই অবাক হয়। মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“এটা একটু বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে আম্মা। এভাবে কিভাবে..”
“আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা। কালই আরশাদ আর আনিকার বিয়ে হবে এটাই আমার শেষ কথা।”
আরশাদ বলে,
“এটা সত্যিই তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে দাদি। ঐ আরহাম শান্তকে আমি সামলে নেব। তুমি এতটা চিন্তা করো না।”
গুলশেনারা বেগম অসহায় সুরে বলেন,
“না, দাদুভাই। আমি চাই কালকেই তোমাদের বিয়েটা হোক। এত চিন্তা নিয়ে আমি বাঁচতে পারছি না। ঐ আরহাম আমার মনে এমন ভয় সৃষ্টি করেছে যে আমার মনে হয় যেকোন মুহুর্তে আমার যা কিছু হয়ে যাবে। তাই এটাই মনে করো আমার শেষ ইচ্ছা। তুমি দয়া করে আমার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করো দাদুভাই। এ ছাড়া আমার আর কোন চাওয়া নেই। আমি তোমার সামনে হাত জোড় করছি।”
নিজের দাদির মুখে এমন কথা শুনে আরশাদ অনেক বেশি অসহায় বোধ করে। তার শক্ত ব্যক্তিত্বও দাদির এই অনুরোধের সামনে টলে গেল। কারণ আরশাদ কখনো তার দাদিকে এমন অসহায় অবস্থায় দেখে নি। তাই আরহাম বলে উঠলো,
“তুমি যা চাও তাই হবে দাদি। তুমি যখন চাইছ, আমার সাথে আনিকার বিয়ে কাল হবে। তখন কালই আমাদের বিয়ে হবে।”
গুলশেনারা বেগম স্বস্তি লাভ করেন। আনিকাও খুশি হয়। কারণ তার উদ্দ্যেশ্য সফল হতে চলেছে। একবার আরশাদকে বিয়ে করতে পারলেই সে নিজের আসল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবে। আরশাদের কাছাকাছি এসে তার ধ্বংসের কারণ হতে পারবে। আর এভাবেই আরশাদকে ধ্বংস নিজের ভালোবাসার মানুষ অর্থ্যাৎ আরহাম শান্তকে খুশি করবে সে। এজন্যই আনিকার চোখে দেখা গেল খুশির ঝিলিক। এদিকে এত কিছুর মাঝে মালিনী পাটোয়ারী ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছেন। তার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে যা হচ্ছে তা একদম ঠিক হচ্ছে না। ধৃতির বলা কথাগুলোই বাজছে তার কানে। মালিনী পাটোয়ারীর কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে, ধৃতি মিথ্যা কিছু বলে নি৷ কারণ ধৃতি যখন আনিকার বিরুদ্ধে কথা গুলো বলছিল তখন তিনি তার চোখে এক দৃঢ় আত্মবিশ্বাস দেখেছেন। সাধারণ যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন তার চোখে এমন আত্মবিশ্বাস থাকার কথা না। তার থেকেও বড় কথা, তিনি এই ক’দিনে ধৃতিকে যতটুকু চিনেছেন তাতে তার মনে হয় না, ধৃতি আরশাদের জন্য ক্ষতিকর। বরং তার মনে হয়েছে ধৃতি সত্যিই আরশাদের ভালো চায়। কিন্তু সব প্রমাণও তো ধৃতির বিরুদ্ধে তাই তিনি কিছু করতেও পারছেন না। আর এখন গুলশেনারা বেগম যেভাবে তাড়াহুড়ো করে আরশাদ ও আনিকার বিয়ে দিতে চাইছেন সেটাও তার কাছে ভালো ঠেকছে না। কারণ যদি আনিকা সত্যিই খারাপ হয় তাহলে তো এই বিয়ে তার ছেলে আরশাদের জীবনে অশান্তি নিয়ে আসবে। যেমনটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। তাই তিনি ভেবে চলেছেন এই মুহুর্তে কি করা উচিৎ।
★★
তখন মধ্যরাত, মালিনী পাটোয়ারী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে সারা বাড়িময় পায়চারি করে চলেছিলেন। এমন সময় তিনি হঠাৎ কোন শব্দ শুনতে পান। শব্দ অনুসরণ করে ছাদে যেতেই তিনি এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যের সাক্ষী হন। তিনি দেখতে পান আনিকা ফোনে কারো সাথে কথা বলছে আর হেসে হেসে বলে,
“সব কিছু আমাদের প্ল্যান মাফিকই আগাচ্ছে। যেমনটা চেয়েছিলাম তেমনটাই হচ্ছে। কালকে বিয়েটা হওয়ার পরই.. ”
হঠাৎ করে আনিকার নজর যায় মালিনী পাটোয়ারীর দিকে। তাই সে চুপ হয়ে যায়। ফোনটা রেখে দিয়ে উদ্বিগ্ন সুরে বলে,
“আন্টি, আপনি? কোন দরকার ছিল কি?”
মালিনী পাটোয়ারী গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করেন,
“তুমি কার সাথে কথা বলছিলে আনিকা?”
আনিকা আমতা আমতা করে বলে,
“একটা বন্ধুর সাথে আমার আর আরশাদের বিয়ে নিয়ে কথা বলছিলাম। ”
মালিনী পাটোয়ারীর কেন জানি আনিকার কথা কে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না। কারণ তিনি অন্য কিছুই শুনেছেন। এই মুহুর্তে তার ধৃতির বলা কথা মনে পড়ায় তিনি উদ্বিগ্ন হন এবং দ্রুত নিজের রুমে আসেন। রুমে এসে ভাবতে থাকেন,
“এখন আমার কি করা উচিৎ? নিজের ছেলেকে কোন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তো ঠেলে দিতে পারব না। কিন্তু আম্মা আনিকাকে যা বিশ্বাস করে তাতে তো উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া আনিকাকে অবিশ্বাস করবেন না। আর আমিও এমন কিছু শুনিনি যা আনিকাকে দোষী সাব্যস্ত করবে। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আনিকার মনে কিছু চলছে। নাহ, আমার আরশাদকে সবটা জানাতে হবে।”
বলেই তিনি আরশাদের রুমের দিকে যান। আরশাদের রুমের সামনে গিয়ে দরজা নক করার পর বলেন,
“আরশাদ, দরজা খোলো। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”
আরশাদ দরজা খুলে বলে,
“আম্মু, তুমি। কিছু বলবে?”
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“আসলে..”
এমন সময় গুলশেনারা বেগম এসে বলেন,
“তোমার কি কোন আক্কেল নেই বৌমা? ছেলেটার কাল বিয়ে আর ওকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিচ্ছ না! এই রাত-বিরেতে বিরক্ত করার কি মানে?”
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“আমার আসলে কিছু জরুরি কথা ছিল।”
“কি কথা?”
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আনিকা মেয়েটার মাঝে কোন গণ্ডগোল আছে..আসলে ওকে আজ ফোনে কিছু অদ্ভুতভাবে কথা বলতে শুনেছি..”
গুলশেনারা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“জানতাম, এমন কিছুই হবে। ঐ ধৃতি মেয়েটা যে তোমার ব্রেইনওয়াশ করেছে তা আমি বেশ ভালোই বুঝেছিলাম। তা বলো তো দেখি এমন কি শুনেছ যা শুনে মনে হয়েছে যে আনিকা দিদিভাই এর উদ্দ্যেশ্য খারাপ।”
“সেরকম কিছু তো না কিন্তু..”
“তাহলে আর কোন কিন্তু নয়..যখন কোন প্রমাণ নেই তখন শুধু শুধু আনিকা দিদিভাই এর দিকে আঙুল তোলা বন্ধ করো। ওকে আমি অনেক আগে থেকে চিনি। আনিকা দিদিভাই কেন ঐ আরহাম শান্তর সাথে হাত মেলাবে? ওর কি কোন কিছুর অভাব? ওর তো এতে কোন স্বার্থ নেই। আর আনিকা দিদিভাই এর বাবার ঐ আরহাম এর থেকে অনেক বেশি সম্পত্তি আছে। তাই এসব আসে বাজ কথা ভেব না।”
মালিনী পাটোয়ারী এর পর আর কিছু বলতে পারেন না। তবুও তিনি আশা নিয়ে আরশাদ এর দিকে তাকান। আরশাদ বলে,
“আমি ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে দেখছি। তোমরা নিজেদের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”
বলেই সে দরজা লাগিয়ে দেয়। মালিনী পাটোয়ারী একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলেন,
“না, কারো ভরসায় থাকলে হবে না। আমার ছেলের জন্য যা করার আমাকেই করতে হবে। আর এজন্য আমায় একজন্যই সাহায্য করতে পারে। আর সে হলো—ফুল! এবার আমি ফুলের সাহায্য নিয়েই যা করার করব!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨