#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আরশাদ ও আনিকার বিয়ে উপলক্ষে আজ পুরো পাটোয়ারী বাড়ি সেজে উঠেছে নতুন রূপে। চারিদিকে আলোক সজ্জায় সজ্জিত এই বাড়িতে চারিদিকে আজ খুশির আমেজ। তবে সবথেকে বেশি খুশি বোধহয় গুলশেনারা বেগম। কারণ অবশেষে তিনি তার পছন্দের মেয়েকে নাত-বৌ করে আনতে পেরেছেন। আরশাদ বরাবরের ন্যায় গম্ভীর মুখশ্রী করে আছে তাই তার উদ্দ্যেশ্য কি সেটা বোঝা বড্ড দায়। আনিকার বাবা আশিকুর চৌধুরী যদিও এই বিয়েটা নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নন আর তবুও নিজের মেয়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনিও মেনে নিয়েছেন এই বিয়েটা।
এত সবের মাঝে একজনের মন বেশ বেজার। পুরো বাড়ির এই এত আলোকসজ্জার মধ্যে যেন আমাবস্যার আঁধার নেমে এসেছে মালিনী পাটোয়ারীর মনে। আনিকার সাথে নিজের একমাত্র আদরের ছেলের বিয়েতে তিনি কিছুতেই স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। আর এজন্যই তার মনে খেলে যাচ্ছে এক বিরাট পরিকল্পনা।
এদিকে আনিকা ও আরশাদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলছে। আনিকার পরনে একটা হলুদ লেহেঙ্গা। আনিকা তো গায়ে হলুদ লাগিয়ে একটার পর একটা পিক তুলছে৷ আর নিজেই নিজের প্রশংসা করে বলছে,
“বাহ, কি সুন্দর লাগছে আমায়! আজ যদি আরহাম আমায় এভাবে দেখতো তো..”
বলেই চুপ হয়ে যায়। আনিকার মুখেও এবার আঁধার নেমে আসে। মনে পড়ে যায় সেই পাষাণ পুরুষের কথা। যার ভালোবাসার জন্য আজ সে এত বড় আত্মত্যাগ করছে। আনিকা অতীতের পাতায় ডুব দেয়। মনে করে নিজের আমেরিকায় কাটানো দিনগুলো। আরহামের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ কারের কথা মনে করে মৃদু হাসে মেয়েটা। মনে পড়ে যায়, কিভাবে আরহাম তাকে গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। তখন থেকেই ধনী বাবার একমাত্র দুলালী মেয়েটা আরহামকে নিজের মন দিয়ে বসে।
কতই না পাগলামী করেছে আরহামের জন্য। গুপ্তচর লাগিয়ে আরহামের সব বায়োডাটা বের করে এনেছে। নিজের আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে কতবার না দূর থেকে আরহামকে ফলো করেছে। এসব একদিন আরহামের নজরে আসে। আরহাম তখন আনিকাকে ধমক দিয়ে বলে তার থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু তখন যে অনেক দেরি হয়ে গেছিল, আনিকা যে ততদিনে গভীর ভাবে ডুবে গেছিল আরহামের প্রেমে। তাই তো ভীষণ জেদি ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়েটা আরহামের কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা চেয়েছিল। এমনকি তার পায়ে পড়তেও দ্বিধা করে নি। কিন্তু তবুও সেই পাষাণ পুরুষের মন গলে নি। সে ক্রমান্বয়ে ইগনোর করে গেছে আনিকাকে। কিন্তু আনিকাও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। সেও চিনে জোকের মতো আরহামের পেছনে পড়ে ছিল। তবে এসব কিছুর মাঝে হঠাৎ একদিন ঘটে যায় এক অদ্ভুত ঘটনা। আরহাম নিজে থেকে আনিকাকে ডেকে পাঠায় এবং তার সাথে কথা বলতে চায়। আনিকা তো যেন হাতের কাছে আকাশের চাঁদ পেয়ে যায়। সাথে সাথেই খুশি হয়ে দৌড়ে ছুটে যায় আরহামের কাছে। কিন্তু তার সমস্ত খুশি দুঃখে পরিবর্তিত হয় যখন আরহাম তাকে বলে, আনিকাকে আরহামের কথা মতো তার এক শত্রুর সাথে প্রেমের অভিনয় করে অতঃপর তাকে বিয়ে করে তার সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে তার পেছনে ছু/রি মা/র/তে হবে। এরপর আরহাম আনিকাকে গ্রহণ করবে। আনিকা তো প্রথমে কিছুতেই রাজি হতে চায়নি। কারণ সে শুধুই আরহামকে ভালোবাসে। কিন্তু আরহামও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় এছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই আনিকা বাধ্য হয়ে একসমত আরহামের প্রস্তাব মেনে নেয়। আর সেই প্রস্তাব অনুযায়ীই এখন কাজ করে চলেছে সে।
অতীতের এ সমস্ত কথা মনে করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আনিকা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“একজনকে ভালোবেসে নিজের সবকিছু বাজিতে লাগিয়েছি। একজনের খুশির জন্য নিজের সবটা বিলিয়ে দিতে চাইছি। আমার জীবনটাকে একটু সুন্দর করে দিও আল্লাহ! জানি আমি যা করছি তা অন্যায়। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না, এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই।”
★★★
মালিনী পাটোয়ারী সারাটা দিন অনেক উদ্বেগের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন। অবশেষে তিনি একটু দুপুরের দিকে সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার রুমে চলে এলেন। আসতে আসতে মনে করতে লাগলেন গতকাল রাতের ঘটনা। যখন তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো বাইরে বেরিয়ে চারিদিকে ধৃতিকে খুঁজে চলেছিলেন৷ এমন সময় তিনি ধৃতিকে খুঁজে পান। ধৃতি তাদের বাড়ি থেকে খুব বেশি একটা দূর যায়নি। মেইন রোডের পাশেই ফুটপাতে অসহায়ের মতো বসেছিল। মালিনী পাটোয়ারীকে দেখতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আন্টি! আপনি এসেছেন! বিশ্বাস করুন আমি কোন মিথ্যা কথা বলিনি। আমি সত্যিই ঐ আনিকা আর আরহামকে একসাথে কথা বলতে শুনেছি।’
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“আমিও তোমাকে বিশ্বাস করতে চাই ফুল। কিন্তু পরিস্থিতি যে আমাদের অনুকূলে নেই। কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া আমরা আনিকাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারব না। আবার ওকে একেবারে হালকা ভাবে নিয়ে যদি এই বিয়েটা আমি হতে দেই তাহলে আমার ছেলের জীবনটা যে একদম নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমি ভেবে নিয়েছি আমায় কি করতে হবে। তুমি শুধু আমার সঙ্গ দিও৷ এটা একটা মায়ের অনুরোধ। আমাকে তুমি ফিরিও না ফুল!”
“জ্বি, আন্টি। বলুন আপনি কি চান?”
এরপর তাদের মধ্যে কিছু কথোপকথন হয়। সব শুনে ধৃতি বলে,
“এসব আপনি কি বলছেন আন্টি! এটা কিভাবে সম্ভব?!”
মালিনী পাটোয়ারী অসহায় সুরে বলেন,
“এছাড়া যে আর কোন উপায় নেই।”
“কিন্তু..”
“আমি তোমার সামনে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি। দয়া করে আমায় ফিরিও না।”
ধৃতি আর কিছু বলে না।
অতীতের এই সমস্ত ভাবনা শেষে মালিনী পাটোয়ারী চিলেকোঠার দরজায় টোকা নাড়েন। একটু পর ধৃতি এসে দরজা খুলে দিতেই তিনি বলেন,
“মনে আছে তো..আমাদের কি করতে হবে?”
ধৃতি মাথা নাড়ায়।
★★
আনিকা বিয়ের সাজে সেজে বিয়ের আসরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। এমন সময় তার দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। আনিকা দরজাটা খুলে মালিনী পাটোয়ারীকে দেখে বলে,
“আন্টি আপনি!”
মালিনী পাটোয়ারী ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে বলেন,
“তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।”
“জ্বি, বলুন।”
“…”
★★
বিয়ের আসরে সবাই উপস্থিত হয়ে কনের জন্য অপেক্ষা করছে। আরশাদ আজ বরবেশে প্রস্তুত। তার পরণে একটা অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি ও পাজামা,মাথায় পাগড়ি।
আনিকার আসতে দেরি হওয়ায় সবাই বেশ চিন্তায় ছিল৷ গুলশেনারা বেগম বলেন,
“আনিকা দিদিভাই এখনো আসছে না কেন?! কি সমস্যা হলো?”
আরশাদ বিরক্তির সাথে বলল,
“দাদি, আর কত ওয়েট করব?”
“একটু দাড়াও দাদুভাই, আমি দেখছি আনিকা দিদিভাই কোথায়..”
বলে তিনি যেই না পা বাড়াতে যাবে এমন সময় মালিনী পাটোয়ারী তার সাথে বধূবেশে সজ্জিত আপাদমস্তক ঘোমটা পড়া একটা মেয়েকে সাথে নিয়ে এসে বললেন,
“আপনাকে কোথাও যেতে হবে না আম্মা! আপনি আপনার নাত-বৌকে নিয়ে এসেছি।”
মালিনী পাটোয়ারীর কথায় গুলশেনারা বেগম বলেন,
“তুমি আনিকাকে নিয়ে আসতে গেছিলা?”
“জ্বি।”
“এত দেরি হলো কেন আসতে?”
“আনিকার সাজতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
গুলশেনারা বেগম আনিকার দিকে খেয়াল করেন। লাল বেনারসি ও বাহারি গহনায় সজ্জিত মেয়েটির মুখে বড় একটা ঘোমটা। যার কারণে মুখটাই দেখা যাচ্ছে না। গুলশেনারা বেগম অবাক হয়ে বলেন,
“ও মুখে এত বড় ঘোমটা দিয়েছে কেন?”
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“ওর নাকি ইচ্ছা এভাবেই ঘোমটা দিয়ে বিয়ে করবে তারপর বিয়ের পর একেবারে সবাইকে মুখ দেখাবে!”
গুলশেনারা বেগম দ্বিগুণ অবাক স্বরে বলেন,
“এ আবার কেমন ধারা কথা!”
আশিকুর চৌধুরী বলেন,
“বিয়ের কার্যক্রম তাড়াতাড়ি শুরু করুন না। আমার মেয়ে যা চাইছে তাই হোক।”
গুলশেনারা বেগম আর বেশি ঘাটাঘাটি না করে বলেন,
“বেশ! তাহলে বৌমা তুমি আনিকা দিদিভাই আমার দাদুভাই এর পাশে এনে বসাও। আর কাজি সাহেব আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।”
মালিনী পাটোয়ারী শ্বাশুড়ির কথামতো আনিকাকে আরশাদের পাশে এনে বসায়। কাজি সাহেব বিয়ের কার্যক্রম শুরু করে দেন। কাজি সাহেব আনিকাকে উদ্দ্যেশ্যে করে বলেন,”বলো মা, কবুল..”
আনিকা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরশাদ কিছু একটা খেয়াল করে বলে,
“দাঁড়ান!”
বলেই সে একটানে আনিকার মাথার ঘোমটাটা তুলে ধরে। আর তাতে যা বেরিয়ে আসে তা দেখে উপস্থিত সবাই হতবম্ব।
আরশাদ নিজেও হতভম্ব স্বরে বলে,
“ধৃতি!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
(কিছুদিন থেকে ব্যস্ততার জন্য গল্প নিয়মিত আসেনি। আগামীকাল থেকে নিয়মিত আসবে ইনশাআল্লাহ)