#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_11
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আবরাজের থেকে হুমকি পেয়ে মোটেই দমে যায় না নিঝুম। বরং সেও নিজের বলিষ্ঠতা বজায় রেখে বলে,”আমি আপনার হাতের পুতুল নই৷ ভাববেন না,আমি আপনার কথা মতো চলব। আমার যা ভালো মনে হবে আমি তাই করবো।”
আবরাজ এবার ভীষণ ক্রোধে নিঝুমের পাসপোর্ট, ভিসাগুলো নিজের পকেট থেকে বের করে বলে,”এখান থেকে ফিরে যাওয়ার কোন উপায় তোমার হাতে নেই। আমি যতদিন চাইব ততদিন তোমায় এখানেই থাকতে হবে।”
এলা আবরাজের তীব্র বিরোধিতা করে বলে,”এটা তুমি একদম ঠিক করছ না। তুমি রীতিমতো নিঝুমের উপর জুলুম করছ।”
আবরাজ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,”যদি তোমাদের তাই মনে হয় তাহলে তাই। কিন্তু আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি।”
বলেই আবরাজ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এলা নিঝুমের দিকে তাকায়। নিঝুমের চোখে অসহায়ত্ব বলতে কিছু নেই। বরং সে আরো বলিষ্ঠ কন্ঠে বলে,”বেশ, আমিও দেখব উনি এভাবে আর কতদিন আমায় আটকে রাখতে পারেন। উনি যদি বুনো ওল হন তাহলে আমিও বাঘা তেঁতুল। নিজের স্বার্থে এতটুকু ছাড়ও আমি দেব না। উনি বারবার আমায় লোভী, প্রতারক সহ আরো নানান তিক্ত ভাষায় আক্রমণ করেছেন। এবার আমি এটাই প্রমাণ করে দেব যে, আমি কোন লোভী বা প্রতারক নই।”
এলা নিঝুমের কাঁধে হাত রেখে বলে,”দ্যাটস দা স্পিরিট। আমি চাই তুমি জয়ী হও।”
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আবরাজ রাতের দিকে অফিস থেকে জরুরি কাজ করে এপার্টমেন্টে ফেরে। তার আজ ভীষণ ক্ষুধা পাচ্ছিল। তাই তো ফিরেই মেইডের উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠে,”মিস জেরিন আমার ডিনারটা দিয়ে যান।”
বলেই আবরাজ ডাইনিং টেবিলে বসে তার ফাইল থেকে কিছু জরুরি ডকুমেন্টস বের করে দেখতে থাকে। এমন সময় কেউ তার সামনে বিভিন্ন রকম খাবার পরিবেশন করে।আবরাজ ভাবে এটা হয়তো তার বাড়ির মেইড মিস জেরিন। তাই সে জিজ্ঞেস করে,”ডিনারে কি করেছেন মিস জেরিন?”
বিপরীত দিক থেকে উত্তর আসে,”শুটকি ভর্তা এবং আলুর তরকারি।”
গলার স্বরটা শুনে চমকে ওঠে আবরাজ। ডকুমেন্টস থেকে চোখ সরিয়ে হতবাক নয়নে নিঝুমকে দেখে বলে,”তুমি!”
নিঝুম হালকা হেসে বলে,”হ্যাঁ, আমি। রাতের ডিনারটা আমিই করেছি। খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে।”
আবরাজ ভীষণ রাগান্বিত হয়ে বলে,”তুমি কেন রান্না করেছ? মিস জেরিন কোথায়? উনি কি আসেন নি?”
নিঝুম বলে,”মিস জেরিন এসেছিল কিন্তু আমি দায়িত্ব নিয়ে তাকে চলে যেতে বলেছি। আসলে কি বলুন তো, চ্যালেঞ্জ অনুযায়ী তো ৫ মাস আমাদের সংসার করতেই হবে। আর আমাদের বাঙালি নিয়ম অনুসারে সংসারে স্বামীরা তাদের স্ত্রীয়ের হাতে বানানো খাবারই খায়। সেই জন্যই তো আমি নিজের হাতে আপনার জন্য খাবার বানিয়েছি। খেয়ে দেখুন, কেমন লাগে।”
“হাউ ডেয়ার ইউ? তোমাকে এত বড় ওডাসিটি কে দিয়েছে যে তুমি আমার জন্য রান্না করো? তাও এসব টিপ্যিকাল বেঙ্গলি ডিস।”
“আপনি যেই অধিকারে আমার পাসপোর্ট, ভিসা সব নিয়ে রেখে আমায় জোর করে এখানে আটকে রেখেছেন, আমিও ঠিক সেই অধিকারেই আপনার জন্য এসব রান্না করেছি।”
“আমার সাথে ডাবল গেইম খেলতে চাইছ? আমি তোমায় ওয়ার্ন করছি এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।”
“হু ইভেন কেয়ার! আপনি যদি আমার সাথে জুলুম করতে পারেন তাহলে আমিও পারি!”
আবরাজ রেগে বলে,”তাই বলে তুমি আমায় শুটকি না কি যেন..ছি কি বাজে স্মেল আসছে…আমায় এখন এটা খেতে হবে?”
নিঝুম বলে,”খেয়েই দেখুন না, আমাদের সিলেটী স্পেশাল রান্না। একবার খেলে আঙুল চাটতে থাকবেন।”
“ইউ! না! আমি প্রয়োজনে খাবার অর্ডার করে খাবো তবু এসব শুটকি! ছি! এসব আমি খাবো না।”
নিঝুমও এবার হুংকার দিয়ে বলে,”খবরদার! ভুলেও খাবার অর্ডার করবেন না। নাহলে..”
“নাহলে কি করবে তুমি?”
“সেটা দেখতেই পাবেন। প্রয়োজনে আপনাকে নারী পাচার কেইসে ফাঁসিয়ে দেব! এখানকার আইন তো শুনেছি অনেক কড়া। আমি যদি এখানকার পুলিশকে গিয়ে বলি আপনি আমায় এখানে এনে আটকে রেখেছেন, আমার পাসপোর্ট, ভিসা সব কেড়ে নিয়ে রেখেছেন এর ফল কি হবে ভাবতে পারছেন?”
“তুমি কি আমায় হুমকি দিচ্ছ?”
“সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে তো আঙুল বাকাতেই হবে। তাছাড়া আপনিই আমার সাথে ৫ মাস সংসার করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। এখন সেই চ্যালেঞ্জে জিততে চাইলে আপনাকে তো এটা খেতেই হবে।”
আবরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”বেশ, যদি তাই হয় তাহলে প্রয়োজনে আমি এই বাজে খাবারটাও খেয়ে নেব।”
বলেই আবরাজ বসে পড়ে খাবার খেতে। চামচ দিয়ে ভাত তুলে খেতে থাকে। কারণ তার এসব খাবার খাওয়ার খুব একটা অভ্যাস নেই। কিন্তু একটু খেতেই আবরাজের ভালো লেগে যায়। যেই শুটকি দেখে সে নাক ছিটকাচ্ছিল এবং দূর্গন্ধযুক্ত ভেবেছিল সেই শুটকিই তার ভালো লেগে যায়। আর নিঝুমের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়। সে খাবার একদম আয়েশ করে খেতে থাকে। এসব দেখে নিঝুম মুচকি হেসে বলে,”কি মিললো তো আমার কথা? এখন তো ঠিকই চেটে চেটে খাচ্ছেন।”
আবরাজ খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”এটাকে নিজের বিজয় ভেবে ভুল করো না। আমি কখনো তোমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেব না। ৫ মাস পর তোমার হাতে ডিভোর্স পেপারস তুলে দেব।”
নিঝুমও বলিষ্ঠ স্বরে বলে,”এটাকে আমি নিজের বিজয় ভাবছিও না! আর আমি নিজেও সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি যেদিন আপনি আমায় ডিভোর্স দিবেন। তবে তার আগে আপনাকে অবশ্যই এটা স্বীকার করতে হবে যে, আমি কোন লোভী বা প্রতারক নই এবং এজন্য আমার সাথে করা সকল খারাপ ব্যবহারের জন্য আপনাকে ক্ষমাও চাইতে হবে। এটাই আমার চ্যালেঞ্জ।”
বলেই নিঝুম খাবারের প্লেট তুলে নিয়ে চলে যায়। আবরাজ নিঝুমের যাওয়ার পানেই তাকিয়ে থাকে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রাত তখন গভীর। কিন্তু নিঝুমের চোখে ঘুম নেই। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাই গ্লাসের বাইরের প্রকৃতিটা দেখছিল। বাইরে তুমুল হারে তুষারপাত হচ্ছে। পুরো রাস্তাঘাট তুষারে ছেয়ে গেছে। রাত ১০ টার দিকে সে নিউজে দেখেছে আগামী কয়েকদিন নাকি একটানা ভীষণ ভারী তুষারপাত চলবে। এজন্য আবরাজও ভীষণ চিন্তিত হয়ে রয়েছে। কারণ এমতাবস্থায় তাকে বাসা থেকেই অফিসের সব কার্য পরিচালনা করতে হবে। নিঝুম তুষারপাত দেখে বলছিল,”এই তুষারপাতের মতো আমার জীবনেও যেন এক ভারী দূর্যোগ চলছে। জীবনের কোন গতি আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আচ্ছা, আমি কি কখনো নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারব না? কখনো কি নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারবো না আমার যোগ্যতা কতটুকু? ছোটবেলা থেকে মেয়ে বলে বাবার কম গঞ্জনা তো সহ্য করিনি। এমনকি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেওয়ায় ছোট থেকে নিজের মাকেও কম অপমানিত হতে দেখিনি। তখনই তো আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম একদিন এসব কিছুর উচিৎ জবাব দেব। আমার এই কথা যে আমায় রাখতেই হবে। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। একজন মেয়ের কাছে তার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দুজন পুরুষ হলো তার বাবা এবারের স্বামী কিন্তু আমি যে এ দুই যায়গাতেই নিপীড়িত! কিন্তু আর নয়। এবার আমি সবাইকে দেখিয়ে দেব একজন নারীর শক্তি কতোটা। দেখিয়ে দেব যে, মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া কোন দূর্বলতা নয় আর না তো মেয়ে বলেই কাউকে অপমানিত করা যায়!”
অন্যদিকে, ঘরে একা শুয়ে থাকা আবরাজ কিছুতেই ঘুমাতে পারছিল না। নিঝুম নামের মেয়েটা হয়ে উঠেছে তার চিন্তার প্রধান কারণ। আবরাজ কিছুতেই মেয়েটাকে বাগে আনতে পারছে না। নিঝুমকে তার এখানে আনার উদ্দ্যেশ্যই তো ছিল তাকে নিজের আসল স্থানটা দেখিয়ে দেবার কিন্তু উলটে নিঝুমই তাকে নাস্তানাবুদ করছে। আবরাজ নিজেই নিজেকে বলে ওঠে,”নাহ! ঐ মেয়েটাকে নিয়ে আমি আর এত ভাবব না। ও আমার জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়। এই ৫ মাসে ওকে ওর মতো থাকতে দেব। ৫ মাস হয়ে যাবার পর ওর মুখে ডিভোর্স পেপারস ছুড়ে দিয়ে তারপর এই মিথ্যা সম্পর্কের ইতি টানব। এর থেকে বেশি কিছুই আর নয়।”
নিজেকে এমনটা বুঝিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও আবরাজের মনের দোলাচল দূর হয়না। কোন এক বিশেষ কারণে নিঝুমের ভাবনা তার মাথায় জেকে বসে৷ সে চাইলেও এই ভাবনা থেকে মুখ ফেরাতে পারে না।
to be continue…..