প্রেমসুধা
সাইয়্যারা_খান
পর্বঃ৪২
আকাশে আজ অর্ধচন্দ্র’র দেখা মিললো। অর্ধ বলাটা অবশ্য ভুল। একদমই ঠিক নয় কারণ চাঁদটা অর্ধেক থেকেও যেন কম। মোটা একখানা দাগের মতো দেখতে। মেঘের আড়াল হওয়া থেকে নিজেকে কোনমতে বাঁচিয়ে স্ব গর্বে সে তাতিয়ে বেড়াচ্ছে। দ্যুতি ছাড়াচ্ছে চারপাশ জুড়ে যেন তার রুপের ঝলকে ফিঁকে পরে যাচ্ছে সকলে। বড়ই দাপট দেখাচ্ছে আজ চাঁদটা। তৌসিফ দূর আকাশে চাঁদের পানে তাকিয়ে হাসলো বাঁকা ভাবে। তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠলো,
— তোর থেকে আমার শ্যামাঙ্গিনী অধিক সুন্দরী।
চাঁদটা যেন ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে তৌসিফ’কে বলে উঠলো অনেকিছু যার শ্রোতা একমাত্রই তৌসিফ নিজে তাই তো একা একাই বলতে লাগলো,
— তোকে সকলে দেখে। নিজেদের বাসনা নিবারন করে কিন্তু আমার চাঁদ শুধু আমার আকাশে উঠে। সে বিলুপ্তও আমার আকাশেই হয়।
শরৎ বাতাস চারদিকে। এই সময়টাতে ঠান্ডাও লাগছে বেশ। পাতলা এক সাদা শার্ট তৌসিফে’র পরণে সাথে সাদা ঢোলা এক প্যান্ট। বুকের কাছের বোতাম দুটো খোলা থাকায় তাকে বেশ দেখাচ্ছে। তৌসিফ আপাতত বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তার ভেতরের প্রেমিক সত্তার আজ ঘুম ভেঙেছে বহু বছর পর। পৌষ’কে নিয়ে আজ সে সদ্য জাগ্রত প্রেমটাকে নিয়ে এই চন্দ্র বিলাস করবে।
শব্দ হতেই তৌসিফ বুঝলো পৌষ বেরিয়েছে। হাত, মুখ ধুয়ে একদম ফ্রেশ হয়ে এসেছে ও। চুলগুলো একত্রিত করে ঢোলা এক ঝুঁটি করে পিঠে দিয়ে রাখলো। বিছানায় রাখা সাদা ওরনাটা মাথায় দিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। তৌসিফ বাইরে থেকেই তা অবলোকন করে হাসলো মৃদু। কাকে খুঁজে তার তোতাপাখি? নিশ্চিত তৌসিফ’কে। উত্তরটা যেন তৌসিফে’র মস্তিষ্ক খুব ঝটপট করে দিলো। পৌষ ডাক দিলো,
— আপনি কি বারান্দায়?
জবাব এলো না। পৌষ’র রাগ হলো। এই ব্যাটা হয়েছে এক খাটাস। এই যে পৌষ তখন একটু ফোনটা হাতে তুলেছিলো কাউকে কল দিতে। তৌসিফ কল লাগাতে দিলো না। ফোন কেড়ে নিয়ে সে ঠেলেঠুলে পৌষ’কে ঢুকালো ওয়াশরুমে। সোজাসাপটা বলেও দিলো গম্ভীর কণ্ঠে যাতে পৌষ কাপড় বদলে গোলাপি রঙের কুর্তিটা পরে। পৌষ ভাবলো হায় কপাল ওর জামাইটার কি হলো? মানুষটার মুখটা কেন হুতুম প্যাঁচার মতো দেখায়? কেলেঙ্কারি বুঝি কিছু হলো? কিন্তু কই? এই লোকের বিনা কারণে করা হুমরি তুমড়ি সব। এখন পাত্তা নেই।
পৌষ এবার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো। বিনা কারণেই এক দুই গুনলো দশ পর্যন্ত অতঃপর জোরে গলা ফাটিয়ে ডাকলো,
— অ্যাই মামাতো ভাই! কই আপনি? আমার জামাই কই? দেখেছেন তাকে?
এই ডাক না হলেও এক কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছে। তৌসিফ যেন তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকলো। পৌষ’র ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। ও যেন চাইছিলোই তৌসিফ এভাবে আসুক। মেয়েটা চালাক হয়েছে বটে। তার চালাকি ধরে ফেললো তৌসিফ অতি সহজে।
বিড়াল পায়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো পৌষ’র পানে। পৌষ বাড়িয়ে দেয়া হাতটার মাঝে নিজের হাতটা অনতিবিলম্বে দিয়ে দিলো। মুহূর্তেই ছোট খাটো হাতটার কবজি আটকা পরলো খসখসা বড় পাঞ্জার মাঝে। অল্প টান লাগতেই পৌষ উঠে দাঁড়ালো। তৌসিফ হাটছে, পৌষ ওর পিছু পিছু পা বাড়াচ্ছে। দরজা পর্যন্ত যেতেই পৌষ জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাচ্ছি?
— বাইরে।
— হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো জানি কিন্তু এত রাতে!
— তাতে কি? জামাই এর সাথে যাচ্ছো।
— তো?
— তো মানে?
— জামাই হলো দ্যা মোস্ট এভার রিস্ক জোন। যখন তখন এর মতলব খারাপ হয়ে যেতে পারে। ভরসা নেই।
— তাই নাকি?
— আবার জিগায়।
তৌসিফ ফিরে তাকালো একপল অতঃপর মৃদু হেসে উঠলো। পৌষ যেন মড়মড় করে ভেঙে গেলো। একদম গুড়িয়ে গেলো। তার শরীর যেন চলা বন্ধ করলো। লোকটার হাসি। হায়! পৌষ না ম’রেই যায় এই হাসি দেখে। এক পুরুষের প্রেমে রোজ নিয়ম করে তিন বেলা হাবুডুবু খায় পৌষ। আজও বাদ গেলো না।
ভাবনায় ডুবে থাকা পৌষ কখন যে নিচে পৌঁছালো তা যেন খেয়াল ই করে নি। বাড়ীর সামনে থাকা ঘাট পাড়ে ওদের বর্তমান অবস্থান। পৌষ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো যখন তৌসিফের শাহাদাত আঙুল তাক করা স্থানে তাকালো।
এই ঘাটটা টাইলস করা। একদম ই নিজস্ব তবে পুরাতন কিন্তু এখন দেখলেই মনে হয় হয়তো সৌন্দর্যের জন্য করা কিন্তু পৌষ শুনেছিলো এটা তৌসিফে’র বাপ-দাদার আমলে করা ঘাট। বহু ঘটনা এই ঘাট ঘিরে। এই ঘাট পাড়ে আসার দরুন তৌসিফ ও কতটাই না বাজে ব্যবহার করলো ওর সাথে। ঘাটের সিঁড়ি গুলোর সাইডে মরিচা বাতি জ্বালানো। বেশ দেখাচ্ছে এটা। সাউডের ফাউন্টেনও কদাচিৎ ছাড়তে দেখেছে পৌষ আজ তাও দেখলো। ঠিক পাড়ে একটা নৌকা রাখা।
এতদিন কচুরি দিয়ে ভরে থাকলেও আজ কচুরিপানা নেই। তৌসিফ পরিষ্কার করিয়েছে। হাত ধরে ধরে পৌষ’কে সিঁড়ি দিয়ে নামালো তৌসিফ। নিজের হাত দিয়ে ওকে শক্ত করে ধরে বললো,
— সোজা নৌকায় পা রাখো। মাথার দিকে পা রেখো না নৌকা তাহলে সরে যাবে।
পৌষ’র হাসি পেলো। ওকে কি না শিখায় কিভাবে নৌকায় উঠতে হয়? পা ঝট করে নৌকায় উঠে উল্টো হাত বাড়ালো তৌসিফে’র জন্য। তৌসিফ হেসে ফেললো তবে হাতটাও ধরলো। বৈঠা হাতে তুলে নৌকাটা আনলো অন্য কিনারায়। বড় কড়ই গাছটার সাথে নৌকা বেঁধে তৌসিফ আবার নৌকায় উঠলো। পৌষ তখন জামাই ভুলে সুন্দর প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত। তৌসিফ এগিয়ে এসে পাশ ঘেঁষে বসলো। ঠান্ডা এক বাতাস বইছে তখন। নৌকাটা এদিক ওদিক হেলেদুলে যাওয়াতে পানিতে অল্প অল্প শব্দ হচ্ছে। পৌষ উচ্ছাস প্রকাশ করলো,
— এসব…. এসব অন্নেক সুন্দর। আমি কখনো ভাবি নি এভাবে দেখব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তৌসিফ পৌষ’র দিকেই ফিরে ছিলো। পেছন দিক থেকে পৌষ’র পিঠ ঠেকলো তৌসিফে’র বুকে। শক্ত বুকটার উষ্ণতা টের পেয়ে লোভী মনটা আন্দোলিত হলো। মাথা এলিয়ে দিয়ে শরীর ছেড়ে দিলো পৌষ। দুই হাতে তাকে আগলে নিলো তৌসিফ। পা মেলে দিয়ে নিজের জায়গা মজবুদ করলো পৌষ।
চোখ উল্টে তৌসিফ’কে দেখে নিলো একপল অতঃপর ক্ষীণ শব্দ করে জিজ্ঞেস করে,
— কথা বলুন।
— কি বলব?
— কিছু একটা।
— তোতাপাখির বুলির কাছে হারা মানা এক প্রেমিক পুরুষ আমি। শুনতেই ভালো লাগছে। কথা থামিও না পৌষরাত। বলে যাও। আজ শুনি।
পৌষ’র চোখ দুটো ভরে উঠলো। এত মায়া মায়া কেন লোকটা? কেন তার পৌষ’কে এতটা প্রাধান্য দিতে হবে? আজ পর্যন্ত কেউ তো দেয় নি। কেউ ওকে কোনদিন পরামর্শ করতে ডাকে নি অথচ এই মানুষটা এত পরিপাটি হওয়া সত্ত্বেও পৌষ’কে জিজ্ঞেস করে হাত ঘড়িটা সহ পরবে। এত ভালোবাসার যোগ্য তো পৌষ?
পৌষ ঝট করে উঠলো। ঝাপিয়ে পরলো তৌসিফে’র বুকে। কেঁদে ফেললো মেয়েটা। তৌসিফ ওর মাথায় হাত রাখলো। ভরসার জায়গা সরুপ সে আছে তা বুঝালো। পৌষ আরেকটু শক্ত করে বুকে ঠাই নিলো। নৌকাটা কাত হলো একটু। পৌষ নাক টেনে টেনে বললো,
— এত কেন ভালোবাসেন?
— তাহলে কি কম বাসব?
— মে’রে না ফেলব?
— আর কত? ম’রেই তো আছি। তোমার মাঝে।
চাঁদের প্রতিবিম্ব তখন স্পষ্ট পানির মাঝে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে আবারও উপহাস করে তৌসিফ। চাঁদ নিজেই লজ্জা পেলো যেন এবার। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে নিলো নিজ অস্তিত্ব।
এহেন গহীন মুহূর্তে তৌসিফ গলায় এক ঢল প্রেম নিয়ে ডাকলো,
— পৌষরাত।
— হুউ।
ছোট একটা ঢোক গিললো তৌসিফ। এই প্রথম সে চাইবে কিছু। সঙ্কোচই লাগছে যেন। তৌসিফ দেনামোনা না করে সরস গলায় আবেদন করলো,
— আমাদের মাঝে একটুকরো চাঁদ এলে কি খুব খারাপ হয়ে যাবে পৌষরাত?
অবুঝ পৌষ জিজ্ঞেস করলো,
— মানে?
— আমি নিজের পরিবার বড় করতে চাই পৌষরাত। এই যেমন তুমি, আমি আর আমাদের অস্তিত্ব।
পৌষ পাথর বনে গেলো। চোখ তুলে এক পলক তাকিয়ে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। দু’জন ই চুপচাপ। রা নেই কারো মুখে। মাঝেমধ্যে শুধু ভারী নিশ্বাস শুনা গেলো। হয়তো মান্যতার অথবা অমান্যতার।
#চলবে….