প্রেমসুধা
সাইয়্যারা_খান
পর্বঃ৪৩
অতি সাধারণ এক শয্যায় বসা সোহা। ওর কাছে মনে হচ্ছে দুনিয়াটা হয়তো বড্ড কঠিন হয়ে গেলো। এই রুমে এসি নেই। মাথার উপর জিএফসির একটা ফ্যান ঘুরছে। ঘুরছে বললেও ভুল হবে। এই ফ্যান শুধু পাখা গুলো গোল গোল ঘুরাচ্ছে। বাতাস আসছে না বললেই চলে। বাইরে খুবই অল্পস্বল্প কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ বিয়েতে মানুষ থাকবে না এটাই তো স্বাভাবিক। সোহা অবশ্য বোকা বনে এখনও বসে আছে। মেহেদী নামক পুরুষকে এখনও চিনে না সে। মিনু’র জন্য মনটা খারাপ হচ্ছে। রাগ হচ্ছে তৌসিফে’র উপর। এ এক এলোমেলো অনুভূতি যার কোন কিণারা নেই। সাতার না জানা সোহা যেন মাঝ সমুদ্রে এসে পরলো। পরলো না তাকে ফেলা হলো। তৌসিফ তালুকদার ফেললো তাকে শুধু মাত্র তার স্বার্থে আঘাত লেগেছে বলে। সোহা জানে চাইলেই ভালো ঘরে ওকে তৌসিফ বিয়ে দিতে পারতো কিন্তু সে সেটা করে নি। সে ইচ্ছে করে কোন এক ফকিরের গলায় ঝুলালো তাকে। যেই ফকির মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা কাবিন করেছে। তাও কি না আরো কম করতে চেয়েছিলো।
কারো পায়ের শব্দ কানে আসতেই সোহা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সাদা একটা টিশার্ট আর কালো টাউজার পরা মেহেদী ঢুকলো রুমে। বেশ চিন্তিত তার মুখখানা। এসেই ভদ্র ভাবে সালাম জানালো সোহা’কে। উত্তর সোহা দিলো না বা দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। মেহেদী সংকোচ বোধ করলো তবুও জিজ্ঞেস করলো,
— আপনি খেয়েছেন সোহা? খাবার নিয়ে আসি?
সোহা উত্তর করলো না। হতাশ মেহেদী বেরিয়ে গেলো। ফিরে এলো মিনিট দশ পর। হাতে একটা প্লেট। ডিম ভাজার ঘ্রাণ আসছে। সোহারও ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু খাবে না ও। মেহেদী’কে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে নিজেই ডিমটা ভেজে এনেছে। সোহা’র একদম সামনে প্লেট রেখে মেহেদী বললো,
— খেয়ে নিন সোহা। আপনার ক্ষুধা লেগেছে আমি জানি। সারাদিন খান নি।
এতক্ষণে মুখ খুললো সোহা,
— গরম লাগছে আমার মেহেদী। আপনাদের বাসায় এসি নেই।
মেহেদী যেন লজ্জা পেলো। তারাতাড়ি উঠে আগে ফ্যানের পাওয়ার বাড়ালো অতঃপর সোহা’কে দেখে নিয়ে বললো,
— আগে ফ্রেশ হলে ভালো লাগতো আপনার।
— আপনাদের ওয়াশরুম তো দেখছি না।
মেহেদী সঙ্কোচ বোধ করলো। বললো,
— আসলে ওয়াশরুম দুটো। মা-বাবা বৃদ্ধ মানুষ তাদের রুমে একটা, আরেকটা কমন ওয়াশরুম। ওটাই আমি ব্যবহার করি।
সোহা যেন আকাশ থেকে ছিঁটকে পৃথিবীর বুকে পরলো। কমন ওয়াশরুম! সেটা কি না তার ব্যবহার করতে হবে? রাগে মুখটা যেন লাল হয়ে এলো ওর। ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
— বউ যদি ঠিকঠাক পালতেই না পারেন তাহলে বিয়ে কেন করলেন?
মেহেদী অবাক চোখে তাকালো। এত সুন্দর মেয়ে অথচ কণ্ঠ কতটা তীক্ষ্ণ। মেহেদী বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো,
— ভাই তো জানতেন সোহা। আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন?
সোহা দমে গেলো। সামনের জনের দোষ নেই কোন তা তার জানা। মানুষটার দিকে তাকিয়ে বেশি উচ্চবাক্যও করা সম্ভব হচ্ছে না তার। কোনমতে সোহা বললো,
— ড্রেস চেঞ্জ করব।
— ইয়াহ শিওর।
বলে মেহেদী উঠে দাঁড়ালো। নিজেই সোহার এক সেট ড্রেস বের করে দিলো। সোহা’র দিকে তাকিয়ে বললো,
— চলুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
মেহেদী’র পিছু পিছু পা বাড়ালো সোহা। অনাকাঙ্ক্ষিত এক জীবনে জড়িয়ে গেলো ও মেহেদী’র সাথে। ছোটখাটো এক ওয়াশরুম। হাই কমোডও নেই। অসহায় সোহা কোনমতে শরীরে পানি ঢেলে গোসল সারলো। চোখ দিয়ে পানি গড়ালো তার। এর কারণ অবশ্য তার জানা নেই। কুর্তি সেটটা পরে বের হতেই দেখলো দরজায় মেহেদী দাঁড়িয়ে। অবাক হলো সোহা। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার ছিলো না। সোহা’কে রুমে খেতে দিয়ে বাইরে দিয়ে দরজা আটকে মেহেদী বেরুলো। ফিরে এলো আধ ঘন্টা পর। হাতে এক বালতি। টাউজারটা হাটু পর্যন্ত গুটানো। টিশার্ট ভিজেছে কিছুটা। সোহা’কে অবাক করে দিয়ে বারান্দায় সোহা’র কাপড়গুলো মেলে দিলো মেহেদী।
সোহা হা করে তাকিয়ে রইলো। কাপড় তো সারাজীবন এভাবেই ফেলে আসে। বুয়া আছে তারা ধুঁয়ে দেয় তবে আজ কি হলো? মেহেদীদের কি বুয়া নেই? মেহেদী কেন সব ধুঁয়ে দিলো? শত হলেও সোহা একজন মেয়ে তার লজ্জা লাগলো। জানলে হয়তো নিজেই ধুঁয়ে দিতো তবুও অন্তত বাসর রাতে স্বামী’কে দিয়ে এসব করাতো না। অহংকারী সোহা হঠাৎ ই যেন নরম হলো। মেহেদী হাসি মুখে এগিয়ে এলো। ওয়ারড্রব থেকে একটা টিশার্ট বের করে পরণেরটা খুলে ওটা পরে নিলো। ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো সোহা। কি যেন হলো ওর। নিজেই খাটে রাখা সাদা ভেজা টিশার্টটা বারান্দায় মেলে দিয়ে এলো।
আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো মেহেদী। এত বড় লোক বাড়ীর মেয়ে তার টিশার্ট মেলে দিয়ে এলো?
সোহা ফিরতেই মেহেদী নরম স্বরে বললো,
— বসো।
সোহা পা তুলে বিছানায় বসতেই মেহেদী ওর সম্মুখে বসলো। বেশ সরল গলায় বললো,
— আমি খুব ছোট এবং স্বাভাবিক একজন মানুষ সোহা। জানোই তো শিক্ষকতা করি। স্যালারি হাই না আবার লো ও না। মা-বাবা আর আমি এই তো সংসার। তাদের খরচপাতি আর বাকিটা সংসারে দিয়ে সুন্দর চলে যায় আমার। আমরা এক কথায় নিম্ন মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চমধ্যবিত্ত। মাঝেমধ্যে সংসারে টান পরে যখন বাড়তি খরচটা বেশি হয়। এই যে দেখো মাসের শেষ দিকে বিয়ে করলাম। বিরাট এক খরচ গেলো। কিছু না করতেও এই পর্যন্ত লাখ টাকার কাছাকাছি ভাঙা হলো।
সোহা অবাক। কি চাপা মারছে? লাখ টাকা কোথায় খরচ করলো? সোহা’কে অবাক করে দিয়ে মেহেদী পঞ্চাশ হাজার টাকা ওর হাতে দিয়ে বললো,
— তোমার মোহরানা এটা। শোধ করে দিলাম। এই যে আমাকে দেখছো, আমার কাছে আর মাত্র পাঁচশত টাকা আছে। ঝাঁকি দিলেও আর পরবে না। এটা দিয়ে আগামী চারদিন চলতে হবে। স্যালারি পেতে চারদিন বাকি আছে।
সোহা অবাক হলো। মেহেদীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎই বলে উঠলো,
— টাকাটা লাগবে না।
— গরীব হতে পারি তাই বলে কি বউয়ের হক মা’রব?
— লাগবে না আমার।
— আমারও লাগবে না।
— এই না বললেন টাকা নেই?
— আছে তো টাকা। পাঁচশত টাকা আছে।
— ওটা টাকা?
মেহেদী হাসলো। বললো,
— এই পাঁচশত টাকা তোমার স্বামী কোন এককালে টানা মাসের পর মাস সকালে নাস্তা না খেয়ে জমাতো।
সোহা’র আচমকা খেয়াল হলো ওর শিকর কোথায়? মেহেদী’র থেকেও নীচু তার পরিবার। সোহা কতকাল না খেয়ে থেকেছে সকালে কই তাকে তো কেউ পাঁচশত টাকা দিতো না। মায়ের কাছে কত ভাত চাইতো। মাও দিতো না। বাবা তো ফিরেও তাকাতো না। কত ছলেবলেই না মা তৌসিফে’র বাবা’র গলায় ঝুলিয়ে দিলো ওকে। অল্প পানির মাছের মতো সোহাও বেশি পানতে এসে লাফাতে লাগলো। তৌসিফে’র সম্পত্তি ভোগ করতে লাগলো।
আচমকাই সোহা’র হাতে স্পর্শ হওয়াতে ওর ধ্যান ভাঙলো। মেহেদী তাকিয়ে ওর পানে। সোহা তাকালো ওর চোখের দিকে। চোখের যে ব্যাখা করার ক্ষমতা তা বোধহয় মুখের নেই। মেহেদী’র চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
সর্বদা লোভে মুড়ে থাকা সোহা আজ যেন নিজের খোলস ত্যাগ করলো। হঠাৎই ওর মন চাইলো শুধু মাত্র কারো বউ হতে। এই যে সম্মুখে বসা মেহেদী যাকে সোহা ঠিকঠাক ভাবে চিনেও না তাকে হঠাৎ করেই আপন মনে হলো। মেহেদী’র ধরা হাতটার উপর নিজের হাত রাখলো সোহা। চোখের দিকে গাঢ় চাহনি দিলো। বিপরীতে মেহেদী হাসলো। আশ্চর্য! এই ছেলে এভাবে কেন হাসে? তার হাসি দেখে হঠাৎ করেই সোহা’র মনে হলো তার জীবনে হয়তো কোন পূর্ণ্য ছিলো তাই এই হাসি দেখার তৌফিক হলো তার।
______________________
রাত পেরিয়ে সকাল হওয়ার ভাবখানা। আকাশের বুক চিরে সূর্য উঁকি দিবে দিবে। চারদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দিনে ঠান্ডা নেই অথচ ভোরের দিকে প্রকৃতি এমন ভাব দেখায় যেন ডিসেম্বরের শীত এসেছে। ঘোলা ঘোলা পরিবেশে পাখির দল কিচিরমিচির করে যাচ্ছে একটানা।
তালুকদার বাড়ী এখন নীরবতায় ঘেরা।
তৌসিফে’র বুকে গুটিশুটি দিয়ে ঘুমাচ্ছে পৌষ। রাতে আড়াইটার দিকে আজ ক্ষুধা লেগেছিলো ওর। খেলো একটু অতঃপর হঠাৎ পেট ব্যথায় কুঁকড়ে শুয়ে পরলো। তৌসিফ এত উঠাতে চাইলো লাভ হলো না। মেয়েটা কথা শুনলোই না। অগত্যা তৌসিফ ওকে বুকে নিয়ে ঘুমালো। মান্থলি ডেটও তো না তাহলে কেন পেট ব্যথা হলো তৌসিফ বুঝলো না। ডক্টর দেখাতে হবে এটা ভেবেই চোখ বুজেছিলো।
সূর্যটা যখন উদয় হলো তখন সকাল আটটা বাইশ। আজ একটু দেড়ী করেই উঠেছে সে। আলসেমি ঝাড়তে ঝাড়তে দুপুর হতেই খা খা রোদ উঠে যাবে। এটাই হচ্ছে এখন। তৌসিফে’র ঘুম হালকা হলো। চোখ খুলে আগে বুকে থাকা বউ’কে চুমু দিলো। সে এখনও ঘুমে কাঁদা। ওকে বিছানায় রেখেই নিজে উঠে গেলো। ফ্রেশ হয়ে একেবারে জিম সুট পরে আরেকবার পৌষ’কে দেখে নিলো। কাঁথার নিচে পৌষ’র পেটে হাত দিয়ে একটু হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে এসিটা অফ করে ফ্যান ছেড়ে রাখলো শুধু। ঠান্ডায় একদম গুটিয়ে আছে। নিজের প্রোটিন শেইক নিয়ে দরজা আটকে তৌসিফ বেরিয়ে গেলো।
তৌসিফ বাড়ী ফিরলো ঠিক দুই ঘন্টা পর। ভেবেছিলো বউকে ঘুমন্তই পাবে কিন্তু তা হয় নি। পৌষ রান্না ঘরে নাস্তা বানাচ্ছে। একপাশে মিনু দাঁড়িয়ে। তার মনটা খারাপ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তৌসিফ সোজা রুমে ঢুকে গোসল সেরে আসলো। রান্নাঘরে ঢুকে হঠাৎ পেছন থেকে পৌষ’কে জড়িয়ে ধরা মাত্রই পৌষ একদিকে যেমন চমকালো ঠিক তেমন ভাবেই চমকালো উপস্থিত বুয়ারা৷ মুখ চেপে তারা বেরিয়ে গেলো এদিকে পৌষ খেঁকিয়ে উঠলো,
— জানটা গলায় চলে এসেছিলো। লজ্জা লাগলো না আপনার? ছাড়ুন।
তৌসিফ নিজের ভেজা গুলো ঝেড়ে দিলো পৌষ’র মুখে। লহু স্বরে বললো,
— গুড মর্নিং হানি।
— আপনার হানি রুটি দিয়ে খান আপনি। কেমন লাগে? তারা সবাই হাসছিলো।
— হাসুক।
— লজ্জা লাগে তো।
— লাগুক।
— উমম। খাবেন। চলুন।
পৌষ’কে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম তৌসিফ হাতে হাতে পৌষ’কে সাহায্য করলো। টেবিলে খেতে বসেই মিনু’কে ডাকলো পৌষ। ওদের সাথেই বসালো। মিনু মাথা নিচু করে খেতে খেতেই ডাকলো,
— মামা?
তৌসিফ তাকাতেই মিনু বললো,
— আমি কি আপার কাছে যাব না?
তৌসিফ খাওয়ায় মন দিলো। বললো,
— পরে দেখা যাবে।
পৌষ বুঝলো না তৌসিফ কি ভাবছে বা কি চাইছে। খেতে খেতে শুধু বললো,
— আজ আমাকে কি আপনি ড্রপ করবেন?
— না৷ আজ কাজ আছে। আর তুমি আজ বাসায় থাকো। তোমায় নিয়ে বেরুব আমি।
#চলবে……
[ এটা আর বেশিদিন চলবে না। অতি শিঘ্রই ইতি টানা হবে]