প্রেমসুধা সাইয়্যারা_খান পর্বঃ৪৪

0
2

প্রেমসুধা
সাইয়্যারা_খান
পর্বঃ৪৪

বিশাল বড় মলে তৌসিফে’র সাথে ঘুরঘুর করছে পৌষ। এটা সেটা করতে করতে ভালোই শপিং করা হয়েছে তাদের। অবশেষে পৌষ’কে নিয়ে গোল্ডের শপে ঢুকে তৌসিফ। পৌষ বড় বড় চোখে এদিক ওদিক দেখছে। তৌসিফ নিজের এক হাতের মুঠোয় শক্ত করে পৌষ’র হাতটা ধরে আছে। মেয়েটা যেই পরিমাণ ছটফট করে না জানি কখন হাত ছাড়িয়ে কোথায় চলে যায়। গোল্ডের শপে ঢুকা মাত্রই ম্যানেজার নিজে বেরিয়ে এলো। তৌসিফ সহ পৌষ’কে বসতে দিয়ে স্যার স্যার, ম্যাম ম্যাম করতে করতে ব্যাটা রীতিমতো মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। পৌষ অবাক হলো বটে। তৌসিফে’র কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,

— এই লোক এত কেন লাফাচ্ছে? ব্যাটার মতলব ভালো না। চলুন বেরিয়ে যাই।

তৌসিফ এক পলক তাকালো। শান্ত স্বরে বললো,

— একটু বসো।

ম্যানেজার সেই মুহূর্তেই বলে উঠলো,

— স্যার কফি? ম্যাম কি নিবেন?

পৌষ এমন একটা চাহনি দিলো যে ম্যানেজার ভরকে গেলো। বেচারা একটু বিব্রত হলো। ভুল কিছু হলো কি না ভাবতে ভাবতেই পৌষ চিমটি কাটে তৌসিফে’র হাতে। তৌসিফ সহজ ভাবেই তাকালো। পৌষ চোরা দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,

— শুনুন আপনি বড়লোক হতেই পারেন তাই বলে এদিক ওদিক টাকা ঢালবেন? আমি দিব এসব আকাজ কুকাজ করতে আপনাকে? আমার জামাই এর কত কষ্টের টাকা। চলুন এখান থেকে।

— একটু বসো হানি। একটু কাজ আছে।

গোল গোল চোখে তাকিয়ে পৌষ বললো,

— কাজ আছে? আমি ভাবলাম আপনি কিছু কেনাকাটা করবেন।

— হ্যাঁ করব তো।

পৌষ ফিসফিস করে বললো,

— জানেন যেসব দোকানে খাতির বেশি দেখায় সেসব দোকানেই কালা মাল থাকে। চলুন উঠুন। ভোলাভালা জামাই আমার কিচ্ছু বুঝে না।

কপাল কুঁচকে সবটা শুনলো তৌসিফ। এই মুহুর্তে ওর পেট ফেটে হাসি পেলো তবে নিজের স্টাটাস বজায় রাখতে তা করা সম্ভব হলো না। চোয়াল শক্ত করে এদিক ওদিক নাড়ালো তৌসিফ। কোনমতে ধামা-চাপা দিলো উপচে পরা হাসি। এক হাতে পৌষ’র গাল টানলো আড়ালে। বললো,

— তুমি একটা কিউট কিটি হানি।

পৌষ ফুঁসলো। খেঁকিয়ে উঠলো,

— কিহ? বিলাই! আপনি আমাকে বিলাই বললেন?

তৌসিফ অবাক। কখন বললো সে বিলাই। মাথায় যেন রিকল হলো ওর। “কিটি” শব্দটা তার বউ মেনে নিতে পারে নি। তৌসিফ ওর আঙুলের ভাজে আঙুল ডুবিয়ে বললো,

— আদর করে ডাকলাম। বাই দ্যা ওয়ে ইউ আর মাই কিটি। ডিডেন্ট ইউ সি মাই চেস্ট?

দাঁত কিড়মিড় করতে থাকা পৌষ দমালো নিজেকে। লজ্জায় গাল দুটো রসগোল্লা বা চমচমের আকার ধারণ করলো বুঝি? হাত দিয়ে গাল দুটো ধরে শ্বাস টানলো পৌষ। মিনমিন করে বললো,

— পাখি, বিলাই, হানি সব ডাকা শেষ। কবে জানি কু*ত্তাই ডেকে বসেন আমাকে। আপনার কোন ভরসা নেই।

তৌসিফ চমকালো। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বউটার মুখ এত চলে। মন চায় ঠাটিয়ে এক চুমু দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিতে যা আপাতত করা সম্ভব না। ম্যানেজার কফি হাতে ফিরে এলো। তৌসিফ অবশ্য কফি নিলো কিন্তু পৌষ সে প্রচন্ড মুড নিয়ে আছে। তৌসিফ তুলে দিলো তো নিলো। মনে মনে হাসে তৌসিফ। কপালে নিজ ইচ্ছাই জুটিয়েছে একটা ও। একদম একের বউ। এর তুলনা হয় না।
তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— পিসটা আনা হয়েছে?

ম্যানেজার বেয়াক্কেলের মতো হাসলেন। জানালেন,

— জ্বি স্যার। এখন শো করব?

— ইয়াহ্।

মুহুর্তেই অতি সুন্দর একটা গোল্ডের এঙ্কেল পিস ওদের চোখের সামনে দেখানো হলো। পৌষ হা হয়ে গেলো। এত সুন্দর পায়েল ও কখনো দেখে নি। চোখ দুটি যেন সোনালী আলোর ঝলকানিতে ভরে যাচ্ছে। তৌসিফ হাতে তুলে নিলো সেটা। সোজা হাঁটু গেড়ে বসে পরালো পৌষ’র পায়ে। থমকে থাকা পৌষ অবশ্য বুঝে উঠতে পারলো না। যখনই বুঝলো ততক্ষণে পেমেন্ট দিলো তৌসিফ। মুখটা হা হয়ে এলো পৌষ’র যখন শুনলো লাখ টাকার উপরে স্বর্ণ তার পায়ে। ঠাই বসে রইলো পৌষ। মান ইজ্জতের কথা ভাবছে বলেই চুপ আছে নাহলে এতক্ষণে তৌসিফ’কে কোলে তুলে পালাতো এখান থেকে। এত লাখ টাকা দিয়ে নাকি পায়ের পায়েল কিনে মানুষ? পৌষ কত সুন্দর বিশ টাকা করে কিনে। ভার্সিটির সামনেই বসে। টানা মাসখানেক রং থাকে। শুধু পানি লাগলেই রংটা উঠে যায়। প্রতি মাসে নিত্য নতুন কালেকশন পরা যায় কিন্তু এখন কি না এই লাখ টাকা পায়ে নিয়ে ঘুরবে। পৌষ পারলে এটা গলায় পরবে। সবাইকে বলবে নতুন গলার সেট। হ্যাঁ, এটাই করবে পৌষ। ভাবতে ভাবতে ঢকঢক করে কফি গিলে নিলো। এতেও ওর আত্মা শান্তি পেলো না। এত টাকার জিনিস কিনলো খরচ তো করাবেই পৌষ তাই তো বললো,

— কফিটা ভালো ছিলো। আরেকটু হবে?

ম্যানেজার জ্বি জ্বি বলে ছুটলো এদিকে তৌসিফ হা করে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ের মতলব বুঝতে ওর এক সেকেন্ডও লাগে নি। এত দিনে যদি এই চেনাটাই না চিনলো তাহলে আর কিসের জামাই সে?
তবে আরেকটা কথা ভেবে চাপা হাসলো ও। কফি আসতেই এসির ভেতর বসে রয়েসয়ে খেলো পৌষ। তৌসিফ পাশেই কারো সাথে কথা সারছে। ফাঁকে ফাঁকে বউয়ের দিকে নজর দিচ্ছে। পৌষ টিস্যু চাইতেই ম্যানেজার বক্স সহ দিলো। একাধারে চার-পাঁচটা টেনে নিলো পৌষ। মুখ হাত মুছে পুণরায় চার-পাঁচটা টানলো। তৌসিফে’র মন চাইলো একটু গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে যা কোন ভাবেই সম্ভব হলো না।

কথা শেষ হতেই তৌসিফ বললো,

— কফি আরো খাবে নাকি চলবে?

— দিবে আরো?

— তুমি খাবে আরো?

— দিলে খাব তো।

— রাতে পরে নিজেও ঘুমাবে না আমাকেও ঘুমাতে দিবে না। চলো। আর টাকা উসুল করতে হবে না।

— এই এই আপনি কিভাবে বুঝলেন?

তৌসিফ বিদায় জানিয়ে হাঁটা দিলো। পাশ থেকে তৌসিফ বললো,

— যেই খরচ তুমি উসুল করতে চাইলে সেই দোকান তোমার নিজের বিয়ে করা আপন জামাই এর।
সমস্যা নেই যদিও। টিস্যু আর কফি দিয়ে তো উসুল হলোই।

ফাঁটা চোখে তাকিয়ে জোরে “কিহ” করে উঠলো পৌষ। ওর গলাটা এতটাই জোরে ছিলো যে আশেপাশে থাকা তিন চার জন তাকালো ওর দিকে। তৌসিফ চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই চুপসে গেলো পৌষ। মিনমিন করে বললো,

— টাকা দিলেন কেন তাহলে?

— কারণ এখন এর সমান ভাগ অন্য জন পায়।

— কে?

— তৌসিফ তালুকদারের বউ।

পৌষ’র মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কেন জানি ওর মনে হলো তৌসিফ পৌষ’র না বরং তার পূর্বের বউর কথা বলছে। তৌসিফ ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,

— তোতাপাখির মুখ বন্ধ কেন?

পৌষ কথা বললো না। হাত ছাড়াতে চাইতেই তৌসিফ আরো শক্ত করে ধরলো। একটু সাইডে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে?

— বাসায় যাব।

— খাবে চলো। তার আগে বলো হঠাৎ কি হলো?

পৌষ পলক ঝাপটালো চোখের পানি লুকাতে। তৌসিফ এটা দেখেই যেন উত্তেজিত হচ্ছে। নিজের কাছে টেনে নিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করে,

— কি হয়েছে পৌষরাত? হঠাৎ কি….

— আপনার প্রথম বউয়ের সাথে এখনও যোগাযোগ আছে আপনার?

তৌসিফ ধরে রাখা পৌষ’কে ছাড়লো। বেশ স্বাভাবিক ভাবে বললো,

— না নেই।

— মিথ্যা কেন বলেন?

— ওহ কাম অন হানি, তুমিও জানি তোমাকে মিথ্যা বলার মতো অতটাও খারাপ দিন আমার আসে নি।

— তাহলে যে বললেন এটা আপনার বউয়ের।

তৌসিফ এতক্ষণে ধরতে পারলো মূল ব্যাপার। পৌষ’র হাত ধরে হেসে দিয়ে বললো,

— চলো। খাবে এখন। রাতে দেখাব তোমাকে আমার বউ কে।

_______________

মল থেকে খেয়েদেয়ে তৌসিফ গাড়ি বাড়ীর দিকে না ঘুরিয়ে ঘুরালো অন্য পথে। পৌষ গাড়িতে বসে একটা এরাবিয়ান রোল খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে তৌসিফের মুখে দিচ্ছে। তৌসিফ চুপচাপ খেতে খেতে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। গাড়িটা থামলো একটা ব্রিজে। নীরব জায়গা। তৌসিফ বের হয়ে হাত বাড়িয়ে পৌষ’কেও বের করলো। মুখটা মুছে দিয়ে বললো,

— চলো।

— এখানে কি?

— আসো।

তৌসিফ ওকে নিজের বুকে পুরে নিলো পেছন থেকে। ব্রিজে বাতাস বইছে। অপর পাশে কাশফুল ফুটে আছে। চোখ বুজে শ্বাস নিলো। আফসোস নিয়ে বললো,

— এবার কাশফুল দেখা হলো মাত্র। সব শেষ।

— ঐ যে আছে তো।

— হুম।

— মন খারাপ?

— না তো।

— গিফ্ট পেয়ে খুশি হলে না?

— হয়েছি কিন্তু….

— কিন্তু?

— এসব ভালো লাগে না আমার। এসবে সুখ নেই। এই যে আমার পা থেকে নাক আপনি সোনায়, হিরায় মুড়িয়ে রেখেছেন আমার দম বন্ধ দম বন্ধ লাগে। এর থেকে কাঁচের চুড়ি ভালো লাগে। বিশ টাকার পায়েল ভালো লাগে। এগুলোতে ভয় লাগে।

— ভয়?

— হারিয়ে যদি যায়?

— গেলে যাবে।

— তাও।

তৌসিফ ওকে নিজের দিকে ঘুরালো। এক গুচ্ছ কাশফুল এগিয়ে দিতেই পৌষ’র চোখ মুখে খুশি ফুটে উঠলো। দুই হাতে ফুল নিয়ে উচ্ছাসিত গলায় বললো,

— থাংকু থাংকু। এত্তো গুলো ভালোবাসা আপনাকে। আমার জামাই কত্তো ভালো। ইস্ট অর ওয়েস্ট পৌষ’র মামাতো ভাই ইজ বেস্ট। উপস সরি জামাই ইজ বেস্ট।

তৌসিফ ওর মুখের এহেন খুশি দেখে অবাক হলো। একটু আগের দামী উপহার ও ওর মুখে এই দ্যুতি ছড়াতে পারে নি যা দামহীনা ফুল পারলো।
তৌসিফ ওকে জড়িয়ে ধরলো। অতি আদুরে গলায় বললো,

— সারাজীবন এমন থেকো পৌষরাত। আমার থেকে। প্রচুর কথা বলো। ন্যাকামো করো। আমাকে যা খুশি বলবে। আমার ভালো লাগে। তোমার করা সব ভালোলাগে আমার। আমার চারপাশ এভাবে খুশিতে ভরিয়ে দিও পৌষরাত।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here