#বিষাক্তফুলের_আসক্তি পর্ব-০৪
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
আবার ফোন বেজে উঠলে স্কিনে তিতির নামটা দেখে পৈশাচিক হাসি ফোটে উঠলো লোকটার ঠোঁটের কোণে।
কেমন আছিস বোন ?
বিতৃষ্ণায় মুখ কুঁচকে গেলো তিতিরের। ঝাঁঝালো গলায় বললো, আপনার মুখে বোন শব্দটা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শব্দ মনে হচ্ছে। দয়া করে এমন পবিত্র একটা সম্পর্ক আপনার নোংরা মুখে নিয়ে অপবিত্র করবেন না।
তিতিরের কথায় উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো লোকটি, আচ্ছা নিলাম না এই শব্দ। তো কেমন কাটলো খান ভিলায় প্রথম রাত ?
ঘৃণায় কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এই লোকের সাথে কিন্তু তিতিরের আর কোনো পথ খোলা নেই।
আমার বোনু কোথায় ? আমি তো আপনার কথা অনুযায়ী সবকিছু করেছি। আমাদের দুই বোনের সমস্ত প্রোপার্টি এখন আপনাদের। তাজ স্যারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। এবার আমার বোনুকে ফিরিয়ে দিন।
সেটা তো এখনই সম্ভব নয় তিতিরপাখি।
তিতির এবার রেগে বলল, আর কত নিচে নামাবেন আমাকে ? নিজের বোন না হলেও আপনার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক। নিজের রক্তের সাথে আর কত বেইমানি করবেন।
বোন হয়ে ভাইয়ের এতটুকু কাজ করে দিতে পারছিস না ?
কে ভাই, আপনি ? আমার কোনো ভাই নেই। এই পৃথিবীতে আমার একটা বোন ছাড়া আর কেউ নেই। যেই বোনটাকেও আপনি কেড়ে নিয়েছেন আমার থেকে।
চিন্তা করিস না, পাখি যেখানে আছে ভালো আছে। তুই যতক্ষণ আমার কথা মতো চলবি ততক্ষণ পাখির গায়ে একটা ফুলের টোকাও পড়বে না তার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি তোকে।
আমার বোনুর সাথে কিছু করার কথা স্বপ্নেও ভাববেন না। এই তিতিরের একমাত্র দূর্বল জায়গা তার বোনু। সেখানে আঘাত করলে তার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হবে আমি কল্পনাটও করতে পারবেন না। যে বোনের জন্য তাজের মতো মানুষকে ধ্বংস করতে আমি দু’বার ভাবিনি, মৌ আপুর মতো মানুষের জীবন নষ্ট করেছি। সেখানে আপনাকে ধ্বংস করতে আমি দু সেকেন্ড সময় নিবো না। আহত বাঘিনীর আক্রমন কতটা ভয়ংকর হয় সেটা আপনার জানা আছে নিশ্চয়ই।
তুই যাদের এত মহান মনে করছিস তারা এতটাই মহান তো ? থাক সেসব, তুই আমার কথা মতো চল, আমি আমার কথা রাখবো। কাজ হয়ে গেলে অক্ষত অবস্থায় তোর বোনকে তোর কাছে পৌঁছে দিবো।
ফোন কেটে বেলকনিতে দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পড়লো তিতির। ফোনের স্কিনে পাখির হাসোজ্জল মুখটা ভাসছে। তিতির হাত বুলিয়ে দিলো বোনের মুখে। আজ পাঁচদিন হলো পাখিকে দেখে না তিতির। আপুনি বলে গলা জড়িয়ে ধরে না কেউ। বাবা-মা যখন খুন হয় তিতিরের বয়স তখন কেবল দশ বছর আর পাখি এক বছরের বাচ্চা। এক বছরের ছোট পাখিটাকে আগলে বড় করেছে তিতির। আপনজনের মুখোশধারী নরপিশাচদের থেকে লুকিয়ে রেখেছে দীর্ঘ পনেরোটি বছর। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি। যে প্রোপার্টির জন্য তার বাবা-মাকে খুন করা হয়েছে সেসব তো তিতির দিয়েই দিয়েছে। তারপরও কেনো এই নোংরা খেলায় নামিয়েছে তাকে।
তিতির বিড়বিড় করে বললো, তুই চিন্তা করিস না বোনু আমি তোর কিচ্ছু হতে দিবো না। মিস্টার চৌধুরী এবার বুঝবে কার সাথে খেলছে। একবার তোকে পেয়ে যাই। চৌধুরীদের পাপের শাস্তি দিয়ে তবেই তোকে নিয়ে দূরে চলে যাবো। বাবা-মায়ের খুনের প্রমাণ আমার কাছে থাকলেও কখনো সাহস হয়নি শাস্তি দেওয়ার। কিন্তু এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এদের শাস্তি না দিলে বারবার আমাদের জীবনে বিষাক্ত ছোবল দিবে। তবে যাওয়ার আগে স্যার আর মৌ আপুর জীবন গুছিয়ে দিয়ে যেতে হবে। আমি তাদের জীবনে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সব এলোমেলো করে দিয়েছি আবার আমিই সব ঠিক করে দিবো। একটু সময়ের প্রয়োজন শুধু।
নানা রকম চিন্তা করতে করতে একসময় বেলকনিতে ঘুমিয়ে পড়লো তিতির।
আজ পাঁচটি রাত ধরে ঘুম নেই তার চোখে। তাজের প্রতি তিতিরের ভালোবাসা অপ্রকাশিত। পাখির পর পৃথিবীতে এই একজনকে সে ভালোবেসেছে। কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি, কখনো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনি। তিতির তাজকে দেখতো তাজের থেকে লুকিয়ে। পাঁচদিন আগেই তাজ আর মৌয়ের বিয়ের কথা জানতে পারে। প্রথম একটু কষ্ট হলেও পরে নিজেকে সামলে নেয়। তাজ তার নয়, তাজ তার জীবনে একটা না ছোঁয়া স্বপ্ন। মৌকে তার ভালো লেগেছে তাজের স্ত্রী হিসাবে, মেয়েটা খুব ভালোবাসে তাজকে। এ নিয়ে বেশ খুশি হয়েছিলো তিতির। আগামী দশদিন বিয়ের জন্য তাজের অফিশিয়ালি কাজের চাপ কম তিতিরের উপর। বোনুকে অনেকটা সময় দিতে পারবে ভেবে খুশি মনে চকলেট, আইসক্রিম নিয়ে ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখে পুরো ফ্ল্যাট এলোমেলো হয়ে পরে আছে। পাখিকে দেখাশোনা করা মেয়েটাও উধাও। পুরো ফ্ল্যাট খোঁজে পাখির অস্তিত্ব না পেয়ে ভয় পেয়ে যায় তিতির। কী করবে বুঝে উঠার আগেই ফোন বেজে উঠে। বার কয়েক রিং হবার পর তিতিরের হুঁশ ফিরে। ফোনটা ছিলো মিস্টার চৌধুরীর, তখন থেকে তিতির তার হাতের পুতুল।
৫.
মৌ দরজাটা খোল মা।
উঠে গিয়ে দরজা খোলার মতো শক্তি মৌয়ের অবশিষ্ট নেই। গতরাতে কতটা সময় বাথটবে ডুবে ছিলো সে হিসাব নেই তার কাছে। প্রচন্ড শীত অনুভব হতেই উঠে এসে কোনোরকমে চেঞ্জ করে বেডে শুয়েছে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে। অনেকটা সময় ডাকাডাকি করার পরও মৌয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো মৌয়ের মা রেহেনা খন্দকার। স্বামীকে ডেকে এনে চাবি দিয়ে রুমের লক খুললেন। মেয়েকে শুয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও কাছে গিয়ে আঁতকে গেলেন। শীতে কাঁপছে মেয়েটা, কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলেন।
স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, জ্বরে তো শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
মহিবুল রহমান ব্যস্ত গলায় বললো, তুমি ওর কাছে বসো আমি ডাক্তারকে ফোন দিচ্ছি।
মিতা মিতা কোথায় তুই ?
ড্রয়িংরুম থেকে আওয়াজ আসতেই মৌয়ের বাবা-মা একে অপরের দিকে তাকালো। এত সকালে কে এসেছে বুঝতে পারছে না।
রেহেনা মহিবুলের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি গিয়ে দেখো কে এসেছে।
মহিবুল বের হয়ে গেলো রুম থেকে। রেহেনা ওয়াশরুমে গেলেন পানি আনতে, মাথায় পানি দেওয়ার জন্য। ওয়াশরুমের ফ্লোরে ভেজা বেনারসি দেখে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। এক বালতি পানি নিয়ে রুমে এসে মেয়ের মাথায় পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন।
আন্টি মিতার জ্বর এলো কীভাবে ?
পেছন থেকে আওয়াজ আসতেই রেহেনা ঘুরে তাকালেন দরজার দিকে। দরজার সামনে রায়হান দাঁড়িয়ে আছে। রেহেনার অনুমতির অপেক্ষা না করে রুমে চলে এলো রায়হান।
রেহেনা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, মেয়েটার উপর দিয়ে যা গেলো। বেঁচে আছে এতেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।
রায়হান মৌয়ের ড্রয়ারে ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজতে খুঁজতে রেহেনার কথা শুনে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, যা গেলো বলতে ?
রেহেনা কিছু না বলে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। রায়হান উত্তর না পেয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে মৌয়ের কাছে গেলো। বক্সে প্রয়োজনীয় সব পেয়েও গেলো। থার্মোমিটার মুখে পুরে দিলো জ্বর মাপার জন্য।
রেহেনা শান্ত গলায় বললো, তুই দেশে ফিরলি কবে ?
সকাল ছয়টায় ল্যান্ড করেছি। সেখানে থেকে সোজা মিতার সাথে দেখা করতে এলাম।
থার্মোমিটার বের করে দেখলো ১০৩° জ্বর।
আন্টি জ্বর তো অনেক৷ তুমি এক কাজ করো মাথায় পানি দিয়ে শরীরও মুছিয়ে দাও। আমি কিছু মেডিসিন নিয়ে আসছি, খাবারের পর খাইয়ে দিও।
তুই তোর আঙ্কেলকে দে, সে নিয়ে আসবে। তুইও ফ্রেশ হয়ে আয় ব্রেকফাস্ট করবি। মেয়েটার এই অবস্থা, তুই আজ এখানে থাক।
রায়হান কিছুটা সময় চিন্তা করে বললো, ঠিক আছে।
রেহেনা ওয়াশরুমে চলে গেলো মৌয়ের শরীর মুছে দেওয়ার জন্য পানি আনতে। রায়হান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৌয়ের শুকনো মুখটার দিকে। তাজ, মৌ আর রায়হান তিনজনই ছোটবেলার বন্ধু। মৌ আর রায়হান ডাক্তার হলেও তাজ আলাদা হয়ে গেছে তাদের থেকে। এক মাসের জন্য দেশের বাইরে ছিলো রায়হান। আজই দেশে ফিরেছে তাই গতকালের কিছুই জানা নেই তার। অজানা কারণে মৌ আর তাজ নিজেদের বিয়ের খবর সবচেয়ে কাছের বন্ধুকেই জানায়নি। তাজ জানাতে চাইলেও মৌ বাঁধা দিয়েছে।
রেহেনা এসে রায়হানকে একইভাবে বসে থাকতে দেখে বললো, কী হলো এখনো বসে আছিস কেনো ? গেস্ট রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়। মেডিসিন তোর আঙ্কেলকে আনতে বলে যা।
রায়হান মৌয়ের দিকে একবার তাকিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। রেহেনা মৌয়ের শরীর মুছে দিতে লাগলো।
৬.
ফোনের রিংটোনে ঘুম ভেঙে গেলো তাজের। ফোন রিসিভ করে ওপাশের কথা শুনে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। নতুন যে মুভির জন্য সাইন করেছিলো সেটা ক্যান্সেল করতে চাইছে পরিচালক। তাজের সাথে কাজ করতে চায় না সে। তার সাথে একপ্রকার ঝামেলা করে ফোন রেখে দিলো তাজ। থম মেরে বসে আছে বেডে। এটা তো হওয়ারই ছিলো, কেবল শুরু তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার। সকাল সকাল এমন একটা নিউজে সারা শরীর রাগে ফেটে যাচ্ছে তাজের। রেগে সোফার দিকে তাকিয়ে তিতিরকে দেখতে পেলো না। আশেপাশে খোঁজে না পেয়ে বেড থেকে নেমে বেলকনির দিকে গেলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমানো মলিন মুখটা দেখে মায়া হলো না তাজের। তিতিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে গাল চেপে ধরলো।
চমকে উঠলো তিতির, সামনে তাকিয়ে তাজকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।
রাগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, তোকে যদি এখন খুন করতে পারতাম তাহলে হয়তো একটু শান্তি হতো আমার। তোকে যেই শাস্তি দেই না কেনো কম হয়ে যাবে।
তিতির কিছু না বুঝে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। তাজের চোখে তার জন্য তীব্র ঘৃণা হৃদয় ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনই গরগর করে সব সত্যি বলে দিয়ে তাজ আর মৌয়ের জীবন থেকে সরে যেতে। তিতিরের মনে হচ্ছে সে তাজ আর মৌয়ের জীবনের সূর্য গ্রহণ।
তাজ ছেড়ে দিলো তিতিরকে,বসে পড়লো মেঝেতে।
তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই যত টাকার বিনিময়ে এসব করছিস তার থেকে কয়েকগুণ বেশি টাকা আমি তোকে দিবো। তবু এই নোংরা খেলাটা বন্ধ কর।
তিতির এবারও চুপ, যেনো সে কথা বলতে শিখেনি।
একবার আমি সত্যিটা জানতে পারি। তোকে নিজের হাতে খুন করে সবকিছুর বদলা নিবো আমি।
ফ্রেশ হয়ে আসছি তারপর হসপিটালে যাবো। তোর সব মিথ্যে সকলের সামনে আসলে এমনই সব স্বীকার করতে বাধ্য হবি।
তাজ চলে যেতেই দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো তিতির। তার জানা আছে তাজ তাকে যেখানেই নিয়ে যাক রিপোর্ট একই আসবে। শহরের প্রত্যেকটা হসপিটালে শয়তানটার লোক আছে। তারা হসপিটালে যাওয়ার সাথে সাথে তার কাছে খবর পৌঁছে যাবে।
তিতির বললো, না এভাবে বসে থাকলে হবে না। বোনুকে খুঁজতে হবে৷ একমাত্র বোনুকে খোঁজে পেলেই এই খেলা শেষ করা যাবে। আচ্ছা আমি কী মৌ আপুর কাছে যাবো একবার ? মৌ আপুর কাছে গেলেও সে সব জেনে যাবে ? একবার চেষ্টা তো করে দেখি। তুমি চিন্তা করো না আপু, আমি যেমন ভেসে আসা মেঘের মতো তোমাদের জীবনে উড়ে এসেছি, ঠিক সেভাবেই উড়ে চলেও যাবো। একবার শুধু আমার বোনুকে পেয়ে যাই।
চলবে,,,