#পূর্ণিমাতিথিপর্ব-২২
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি হয়তো বাবা হওয়ার অনুভূতি। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না কেউ একজন আদো আদো গলায় আমাকে বাবা বলে ডাকবে। আমার হাত ধরে হাঁটবে। আমি আমার জীবনের সেরা আনন্দটা পেয়ে গেছি। আমার স্বপ্ন পুরণ হবার পরও হয়তো এতোটা আনন্দ হয়নি আজকে যতটা আনন্দ হচ্ছে। আমি বাবা হবো আমার কতো দায়িত্ব। সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে। শুন তোকে আর রিয়াকে নিয়ে আমি আগামীকাল শপিংয়ে যাব রুনা আর বাচ্চার জন্য যা লাগবে সবকিছু কি…..
হঠাৎ করে কানে একটা আর্তনাদ ভেসে এলো। গাড়ির চাকার শব্দ শোনা গেলো। তারপর তারপর সবকিছু নিরব। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। ফোন কেটে গেছে তবুও রুদ্র হ্যালো হ্যালো করছে। রুদ্র অস্থির হয়ে বলে ওঠে,
ইলান এভাবে চিৎকার কেনো করলো? আর ফোনই বা কেনো কেটে দিয়েছে? ওর কিছু হয়নি তো?
আপনি প্লিজ শান্ত হন। ইলান ভাইয়ার কিছু হবে না। চলুন ইলান ভাইয়া যেখানে আছে সেখানে যাই। আপনি জানেন তো ইলান ভাইয়া কোথায় আছে?
রুদ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
__________________
রুদ্র ব্রিজের রেলিং ঘেষে বসে আছে। রুদ্র যেনো পাথর হয়ে গেছে। অনিমেষ তাকিয়ে আছে অদূরে পড়ে থাকা ইলান ভাইয়ার ফোনটার দিকে। এক্সিডেন্টের খবর শুনেই পুলিশ চলে এসেছিল। পুলিশ ধারণা করছে যে, ইলান ভাইয়া ব্রিজ থেকে পানিতে পড়ে গেছে। এই নদীতে পড়ে যাওয়ার পর বেঁচে থাকা অসম্ভব।
আমিও রুদ্রের পাশ ঘেষে বসে আছি। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না ইলান ভাইয়া আর নেই। কিছুক্ষণ আগেও কতোটা হাসিখুসি ছিল। মুহূর্তের মাঝেই সেই ব্যক্তিটা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আমিই মানতে পারছি না সেখানে রুনা আপু কীভাবে মেনে নিবে। আজকে জানতে পেরেছে রুনা আপু মা হতে চলেছে। আজকেই স্বামীর মৃত্যুর খবর কীভাবে নিবে?
হঠাৎই রুদ্রের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্কিনের নামটা দেখেই কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আসছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। রুনা আপু ইলান ভাইয়ার মৃত্যুর শক নিতে পারবে? কান্না আটকিয়ে ফোনটা রিসিভ করি।
আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে হাসিখুসি একটা কন্ঠ ভেসে আসে,
রিয়া কেমন আছো? তোমাকে একটা গুড নিউজ দেওয়ার আছে। আমি মা হতে চলেছি আর তুমি ফুফি। এবার কিন্তু তোমার পালা। কবে আমাদের গুড নিউজ শুনাবে?
মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। রুনা আপু নিজের সন্তান আসার খবর শুনে কতোটা খুশি। ইলান ভাইয়ার মৃত্যুর খবর শোনার পর কী হাসিখুসিটা থাকবে? আমি কিছুতেই ইলান ভাইয়ার মৃত্যুর খবর রুনা আপুকে বলতে পারব না। খট করে ফোনটা কেটে দিলাম।
__________________
নিস্তব্ধ পরিবেশে ভেসে আছে কিছু মানুষের কান্নার শব্দ। ইলান ভাইয়ার মৃত্যুর খবরটা কারো বিশ্বাসই হচ্ছে না। সবার চোখেই জল। ইলান ভাইয়ার জন্য সবাই কাঁদতে বাধ্য। কারণ তিনি এমনই একজন মানুষ। মুহূর্তের মাঝেই সবাইকে আপন করে নিতে পারে। সবাইকে হাসিখুসিতে মাতিয়ে রাখতে উনিই একাই যথেষ্ট।
রুদ্র পাথরের মতো সিঁড়ি বসে আছেন। কাঁদতে কাঁদতে হয়তো চোখের জল শুকিয়ে গেছে। সারা রাস্তা এক ফোটাও কাঁদেননি। এই বাসায় আসার পরই ইলান ভাইয়ার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছিলেন। এমন একটা কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ যে এভাবে কাঁদতে পারে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। প্রিয়জন হারানোর ব্যথা হয়তো পাথরের মতো মনকেও গলিয়ে দেয়।
রুনা আপু খবরটা শোনার পর পরই ঙ্গান হারিয়েছে। এখনো ঙ্গান ফিরেনি। ইলান ভাইয়ার আম্মুও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উনার এক কথা নিজের ছেলেটাকে শেষ দেখা দেখতে পারলাম না। ইলান ভাইয়ার বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। ইলান ভাইয়ার পরিবার বলতে রুনা আপু আর উনার মা।
হঠাৎই রুদ্র সিঁড়ে থেকে ওঠে দাঁড়ায়। হেঁটে সোজা বাইরে চলে গেলেন। আমিও উনার পিছু পিছু গেলাম। এই মুহূর্তে উনাকে একা ছাড়া একদমি ঠিক না। উনি সোজা গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। আমি পিছন থেকে কতো ডাকলাম। কিন্তু উনি শুনলেনই না।
____________
মৃত্যু একটা চিরন্তন সত্য। মৃত্যু সবার জন্যই অবধারিত। সবাইকেই একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। ইলান ভাইয়া আমাদের মাঝে নেই আজকে দুই দিন হলো। গ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে আজকে মরলে কালকে তিনদিন। সত্যিই চোখের পলকে দুই দিন হয়ে গেলো। ঐদিন রুদ্র ঐভাবে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর রুদ্র আর বাসায় ফিরেনি। আমি ঐদিন মামুনি আর আংকেলের সাথে বাসায় ফিরে এসেছিলাম। এই দুইদিনের মাঝে বেশ কয়েক বার ঐ বাসায় গিয়েছি। রুনা আপুর দিকে তাকানো যায় না। কারো সাথে কথা বলে না। শুধু নিষ্প্রভ তাকিয়ে থাকে।
এই দুই দিনে রুদ্রকে আমি আর মামুনি হাজারটা কল দিয়েছি। কিন্তু রুদ্র রিসিভ করেনি। টেনশনে যখন আমরা অস্থির হয়ে ওঠেছিলাম ঠিক তখনি রুদ্রের এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলে রুদ্র তার কাছে আছে। রুদ্র একদম ঠিক আছে। নিজেকে সামলে নিলে উনাকে বাসায় পাঠিয়ে দিবেন। উনি ঠিক আছেন শুনে আমরা সবাই সস্থির নিশ্বাস ফেলি।
__________
দুই দিন ধরে কোচিংয়ে যাওয়া হয় না। আগামীকাল থেকে কোচিংয়ে যেতে হবে। ত্রয়ীর কাছ থেকে পড়া জেনে পড়তে বসেছিলাম। ঠিক তখনি উনি বাসায় ফিরে আসেন। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে যান। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বেলকনিতে চলে গেলেন। আমিও খাতা কলম রেখে উনার পিছু পিছু আসি। উনি বেলকিনেতে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও উনার পাশে বসে পড়ি।
উনি আমার দিকে এক পলকও তাকাননি। দুই দিনেই নিজের কি অবস্থা করেছেন উনি। চোখ, মুখ শুকিয়ে গেছে। ঠিক মতো যে খাওয়া দাওয়া করেননি সেটা উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এগুলো উনার নির্ঘুম রাত কাটানোর সাক্ষী। আমি উনার কাদে হাত রাখতেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন। কান্না মিশ্রিত গলায় বলেন,
তুমি হয়তো ভাবতেই পারছো না এই দুই দিন আমার কীভাবে কেটেছে। যাকে ছাড়া আমার এক সেকেন্ড চলতো না। আর আজ দুই দিন হলো আমি তাকে ছেড়ে আছি। আমার এখনোও বিশ্বাস হচ্ছে না ইলান নেই। ও আমার সাথে কীভাবে করতে পারলো? আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো। আমি পারছি না ওকে ছাড়া থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ইলান বলেছিলো তো ওর ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবে। বিয়েতে ও আর আমি কাপল ডান্স করবো। বুড়ো বয়সে সকালে এক সাথে হাঁটতে বের হবো। টংয়ের দোকানে বসে চা খাবো। ও ওর কথা রাখেনি। ছোটবেলা থেকে আমরা দুজন তো একসাথেই ছিলাম। আমাদের শৈশব কৈশর সব এক সাথে কেটেছে। আমরা দুজন যা করেছি সব একসাথে। কিন্তু ও আজকে আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো।
আমি রুনার মুখের দিতে তাকাতে পারছি না। রুনার দিকে তাকালেই অপরাধবোধে তাড়া করে। ও যখন বলেছিল ইলানকে ফিরিয়ে আনার কথা নিজেকে তখন অক্ষম মনে হচ্ছিল। আমার তো সাধ্য নেই ইলানকে ফিরিয়ে আনার। আমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম না। অসহ্যকর এক অনুভূতি তাড়া করছিল ইচ্ছে করছিল নিজেকে শেষ করে দেই। দুজন কতো খুশি ছিল বাবা-মা হবে বলে। একটা এক্সিডেন্ট জীবন থেকে সকল সুখ, আনন্দ কেড়ে নিল। ও কতোটা খুশি ছিল।
চলবে……..