শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_55
#Writer_NOVA
পরেরদিন…..
শাড়ির দোকানে একের পর এক শাড়ি উল্টিয়ে যাচ্ছি। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বিয়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছি। দোকানদার শাড়ি দেখাতে দেখাতে পাগলপ্রায় অবস্থা।খালামণি,দাদী, আমি, তায়াং ভাইয়া ও এনাজ এসেছি বিয়ের শপিং করতে।আমি আসতে চাইনি, খালামণি জোর করে নিয়ে এসেছে। আর এনাজকে দাদী নানা কথা বলে আসতে বাধ্য করেছে। দাদীর ইচ্ছে তার বড় নাতীর বিয়ের শপিং নিজ চোখে দেখবে। এখন আমার দাদীর ওপর অনেক বেশি রাগ উঠছে। মনে হচ্ছে উনি এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে। এনাজ আসতে চাইনি ওকে নিয়ে আসার কি দরকার? এমনি ও ভেতরে পুরো ভেঙে গেছে তার মধ্যে নিজের চোখের সামনে এসব দেখলে ও কি ঠিক থাকবে? ওকে সামলাতে পরবর্তীতে আমাকে হিমশিম খেতে হবে। আমি এক দৃষ্টিতে শাড়ির স্তুপের দিকে তাকিয়ে আছি। খালামণি আমাকে ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এই নোভা, এই লাল খয়েরী রঙের বেনারসিটা কেমন লাগে?
— হুম ভালো।
— তাহলে কি এটাই নিবো?
— তোমাদের যেটা ভালো লাগে তাই নাও।
— আমাদের পছন্দেই যখন নিবো তাহলে তোকে কেন নিয়ে এসেছি? এই তায়াং, এনাজ দেখতো এই শাড়িটা কেমন? নোভাকে কি মানাবে?
আমি মলিন মুখে একবার তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি একবার আমার দিকে রেগে তাকিয়ে খালামণিকে বললো,
— তোমার যেটা ভালো লাগে সেটাই নাও। আমার কোন দ্বিধা নেই। শাড়ির বিষয় তোমরা মেয়েরাই ভালো বুঝবে।
খালামণি আফসোসের সুরে বললো,
— দেখো দেখি কান্ড! আমার যদি সব পছন্দ করতে হয় তাহলে দল বেঁধে এসে কি লাভ হলো? এনাজ বাবা তুই বল তো কোন শাড়িটায় আমাদের নোভাকে পুরো পুতুল বউ লাগবে?
এনাজ একবার আমার দিকে ছলছল চোখে তাকালো। পৃথিবীতে আমি এই প্রথম ছেলে দেখলাম যাকে কিনা তার ভালোবাসার মানুষের জন্য বিয়ের শাড়ি চয়েজ করতে বলা হচ্ছে। তার ভেতরটা নিশ্চয়ই জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। আমার দিকে দৃষ্টি রেখে চোখের কোণের পানি মুছে মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে খালামণিকে বললো,
— আন্টি ওকে একদম টকটকে লাল বেনারসিতে পুতুল বউয়ের মতো লাগবে। লাল শাড়িতে গোল্ডেন সুতোর কাজ পুরো ফুটে থাকবে। লাল শাড়ি মানেই হলো মেয়েদের অন্যরকম দূর্বলতা। আপনি দোকানদারকে লাল বেনারসি দেখাতে বলেন।
দাদী খুশিমনে বললো,
— এতক্ষণে আমার দুই নাম্বার জামাই একদম ঠিক কথা বলছে। বিয়ের শাড়ি লাল না হইলে আমার কাছে বউ মনে হয় না। তানভীরের মা লাল টকটকে শাড়ি দেখাইতে বলো। এনাজ শাড়ি পছন্দ করে দিবে।
আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে বিয়ে নিয়ে আমারও অন্য সব মেয়ের মতো অনেক জল্পনা, কল্পনা ছিলো। লাল বেনারসি আমারও ভীষণ পছন্দ। কিন্তু কে জানতো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে নিজের বিয়ের শপিংয়ে আসতে হবে। তাও অন্যের বউ সাজবো বলো। দোকানদার লালের মধ্যে অনেকগুলো বেনারসি বের করলো। খালামণি একটা টেনে নিয়ে আমার গায়ে জড়িয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— দেখ তো তায়াং এটা কেমন?
তায়াং ভাইয়া বিরক্তি সহকারে বললো,
— তোমরাই দেখো। আমার দেখার ইচ্ছে নেই।
কথাগুলো বলে গটগট পায়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো। খালামণি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
— যাক বাবা, এই ছেলের আবার কি হলো? এনাজ একটা শাড়ি পছন্দ করে দে তো।
এনাজ পুরো দোকানে চোখ বুলিয়ে দোকানদারকে আঙুল দিয়ে একটা লাল বেনারসি দেখিয়ে দিয়ে বললো,
— মামা, ঐ শাড়িটা নামান তো।
দোকানদার শাড়ি নামাতেই এনাজ নিজ হাতে সেটাকে মেলে আমার মাথায় ঘোমটার মতো করে দিয়ে দাদীকে বললো,
— দেখো তো দাদী এটা কেমন? পুরো পুতুল বউ লাগছে না? তায়াং-এর পুতুল বউ।
“তায়াং-এর পুতুল বউ ” শব্দটা শুনে আমি চমকে তার দিকে তাকালাম। উনি জোর করে হেসে আমাকে বললো,
— এই শাড়িটা পরলে তায়াং তোমার দিক থেকে চোখ সরাতেই পারবে না। অনেক সুন্দর লাগবে তোমাকে।
আমি করুন চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মুখ দিয়ে আজ কোন কথা বের হতে চাইছে না। ফ্যালফ্যাল করে এনাজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খালামণি, দাদী এগিয়ে এলো।দাদী আমার থুতনিতে হাত রেখে বললো,
— বাহ, এনাজ তোর চয়েজ আছে বলতেই হয়। কি সুন্দর লাগছে আমার নাতবউটাকে! একদম লাল টুকটুকে বউ। তানভীরের মা এটাই নিয়ে নাও।
এনাজ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
— দেখতে হবে তো পছন্দটা কার? নিজের জানে জিগার বন্ধুর হবু বউয়ের জন্য সুন্দর শাড়ি চয়েজ না করে থাকতে পারি। মা শা আল্লাহ একদম পরীর মতো লাগছে।
খালামণি শাড়িটা নিয়ে দোকানদারকে বললো,
— এটা প্যাক করে দিন ভাই।
আমি স্তব্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। আমার মাথা কাজ করছে না। কি থেকে কি হচ্ছে তা আমি নীরব দর্শকের মতো সব দেখে যাচ্ছি। আমি যে তার প্রতিবাদ করবো সেই শক্তিটুকু আমার মাঝে নেই। বিয়েটা আজই হয়ে যেতো। কিন্তু তায়াং ভাইয়ার এক ফুপু আজ আসতে পারবে না। তাই আগামীকাল শুক্রবার দেওয়া হয়েছে।
বড় মামা, মামী আজ বিকেলে আসবে।নূর আপি আসবে না। তার অবস্থা বোধহয় এনাজের মতোই।আমার হাতে আরেক দিন সময় বেরেছে।কিন্তু কিভাবে কি করবো তাই বুঝতে পারছি না। এনাজ শাড়ি পছন্দ করেই দোকান থেকে বের হয়ে গেছে। আমি খালামণির দিকে না তাকিয়ে বললাম,
— খালামণি বিয়ের শাড়ি যেন পাঁচ হাজারের বেশি না হয়। পারলে এর কম নিয়ো। একদিনের জন্য এত দাম দিয়ে শাড়ি কেনার দরকার নেই।
— সে কি কথারে নোভা! কি বলিস তুই? বিয়ে তো মানুষের একবারই হয়। হোক একদিন পরবি।তাই বলে আমার একমাত্র ছেলের বউকে কি আমি এত কম দামের শাড়ি দিতে পারি?
— শো অফ করার কোন দরকার নেই খালামণি। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের। আমাদের এতো বিলাসিতা চলে না। অল্পতে তুষ্ট হতে হয়।
— তুই টাকা নিয়ে কোন চিন্তা করিস না তো।তোর খালু বিয়ের জন্য পুরো টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে।
— খালু প্রবাসে কষ্ট করে টাকা কামাই করে খালামণি। টাকাটা যদি তায়াং ভাইয়ার হতো তাহলে অন্য কথা ছিলো। কিন্তু টাকাটা খালুর। তাই আমাকে ভাবতে হচ্ছে।
দাদী খুশিমনে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— দেখলে তানভীরের মা। আমি কি ওকে শুধু শুধু তানভীরের জন্য পছন্দ করেছি? বিয়ের আগেই শ্বশুরের কষ্টের কথা চিন্তা করছে। এমন মেয়ে কি হাতছাড়া করা যায় তুমিই বলো? একদম সোনার টুকরো মেয়ে। দেখবে তোমার সংসার সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখবে। তোমার কিছু করতেই হবে না।
খালামণি আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
— তুই যেভাবে বলবি সেভাবেই হবে। বিয়ের পর তোর হাতে পুরো সংসার তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই।
আমি মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বড় করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। বাবা-মা যদি জানতো তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তাদের সন্তান নিজের ভালোবাসাটাকে কিভাবে বিসর্জন দেয়। তাহলে হয়তো এই শহরে এতো ভাঙা মনের মানুষ থাকতো না। তারা কেন বুঝে না তাদের পছন্দের মানুষটাকে বিয়ে করলে তাদের সন্তান ভালো নাও থাকতে পারে?
💖💖💖
অনেকখন ধরে তায়াং ভাইয়া ও এনাজের কোন দেখা নেই। কোথাও গেছে তাও জানি না। দুজনকেই কল দিলাম কিন্তু কারো রেসপন্স নেই। এনাজকে পোকামাকড়ের ঔষধের দোকানে দেখে আমার পিলে চমকে উঠলো। দ্রুত সেদিকে গেলাম।
— ভাই, ইদুর মারার হাই পাওয়ারের বিষ পাওয়া যাবে?
এনাজের কথা শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হওয়া শুরু করলো। ইঁদুর মারার বিষ দিয়ে কি করবে ও? নিজের ক্ষতি করার চিন্তা করছে না তো?আমি দ্রুত ওর হাত ধরে অন্য দিকে টেনে এনে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি ইঁদুর মারার বিষ দিয়ে কি করবেন?
— খাবো।
— মানে?
— তোমার, তায়াং-এর বিয়ে হবে একদিক দিয়ে আরেক দিক দিয়ে আমি বিষ খাবো।
— কি পাগলামি শুরু করছেন?
— পাগলামির দেখছো কি তুমি?
— এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আপনার মতো বুদ্ধিমান ছেলেকে দিয়ে এমনটা আশা করি না আমি।
— বিয়েটা একবার হোক তারপর দেখো আমি কি করি। যাও গিয়ে বিয়ের শপিং করো।
— এনাজ আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।আর কিন্তু সহ্য হচ্ছে না।
— তোমাকে না পেলে আরো বেশি করবো। আমার মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। আমার শুধু তোমাকেই চাই। তুমি আমার জীবনে থাকলে সব ঠিক থাকবে তুমি না থাকলে আমিও নাই।
— মাথা কি পুরো গেছে আপনার?
— হ্যাঁ, অনেকটা তাই। এই মাথা আমার ঠিক হবে না।
— আপনি শান্ত হোন। একদম উল্টো পাল্টা চিন্তা করবেন না। আমি কি মরে গেছি? এমন পাগলামি কেন করছেন? বুঝদার মানুষ হয়েও অবুঝের মতো কাজ করছেন।
উনি অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— তোমাকে আমি কারো সাথে ভাগ করতে পারবো না টিডি পোকা।
— একটু ঠান্ডা হোন। আমি দেখছি কি করতে পারি।
— আজকের দিন পেরুলে কাল তোমার বিয়ে। আর আমি ঠান্ডা হবো? এমনটা তুমি ভাবলে কি করে?
আমি তার কথার উত্তর দেওয়ার আগে পেছন থেকে তায়াং ভাইয়া বললো,
—এনাজ একটু শোন?
এনাজ মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে কঠিন গলায় বললো,
— আমি কারো কথা শুনতে ইচ্ছুক নই।
কথা শেষ হতেই এনাজ চলে গেলো। তায়াং ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— এই সবকিছুর মূলে তুই। আমাদের এতবছরে বন্ধুত্বে ফাটল ধরিয়ে দিলি। তোকে আমি ছাড়বো না।
তায়াং ভাইয়াও চলে গেল। আমি শুকনো মুখে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। ধীর পায়ে খালামণিদের কাছে যেতেই সে তায়াং ভাইয়াকে ডেকে আনতো বললো। আমি তাই আবারো ওকে খুঁজতে বের হলাম।শপিং মলের পেছনের দিকে এসে হঠাৎ দেখতে পেলাম তায়াং ভাইয়া চেচিয়ে কারো সাথে কথা বলছে। মনে হলো নূর আপির সাথেই বোধহয়। অপরপাশ থেকে কল কেটে যাওয়ায় তায়াং ভাইয়া রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। ওর সামনে যেতেও ভয় করছে। খালামণি ওদের ডাকছে। না গেলেও ভেজাল। মৃদুস্বরে দূর থেকে ডাকলাম,
— ভাইয়া!
— চোখের সামনে থেকে সর। নয়তো তোকে আমি খুন করে ফেলবো।
— খালামণি ডাকছে।
— তোকে আমার সহ্য হচ্ছে না নোভা। ভালো চাইলে আমার সামনে থেকে চলে যা।
— সবাই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমার দিকটা কেউ বিবেচনা করছিস না?
— তোকে কেউ ভুল বুঝছে না। তুই যা করছিস তাই বুঝছে।
— নিজেদের দিকটা ভাবলি তোরা? একবার চিন্তা করলি না আমি কি অবস্থায় আছি। দাদীকে বিয়ের কথা বলেছি বলে এখন সব দোষ আমার? আমার মনের ভেতর কি চলছে তোরা কি তা জানিস? তোদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি এই বিয়েতে অনেক খুশি।জেনেশুনে তাই এসব করছি। আমি কি অবস্থায় আছি তা আমিই জানি ভাইয়া। আমি শুধু পারছি না চিৎকার করে কাঁদতে। তোরা তো আমাকে দোষারোপ করে নিজেরা পার পেয়ে যাচ্ছিস। কিন্তু আমি, আমি তো পারছি না বিয়ে ভাঙতে আবার পারছি না বিয়ে করতে। সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছিস। আমাকে একটু হেল্পও করছিস না। আমি একা কি করবো তাই বুঝতে পারছি না। তোরা আমার সাথে থাকলে বিষয়টা কি এতদূর গড়ায় বল?হ্যাঁ, আমি মানছি আমার দোষ। আমি দাদীকে বিয়ের কথা বলছি। কিন্তু তোরা আমার ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিস কেন? শুধু এতটুকু চিন্তা করিস ভাইয়া, তোদের মতো আমিও ভালো নেই। আমিও এনাজকে ভালোবাসি। আমার ওপর সব চাপিয়ে দিস না। তাহলে আমার মৃত্যু অনিবার্য।
কথাগুলো বলে এক মিনিটও দাঁড়ালাম না। কাঁদতে কাঁদতে অন্য দিকে চলে এলাম। দেয়ালের আড়ালে গিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে মুখ চেপে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু চিৎকারের শব্দটা বাইরে বেরুতে দিলাম না। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ মুছে হাসি মুখে পেছনে ঘুরলাম। এনাজকে দেখতে পেয়ে আমার কান্নার বাঁধ ভেঙে গেলো। ওর বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।উনি আমার মাথাটা পেছন দিকে ধরে শক্ত করে তার বুকে চেপে ধরেছে। আজ আমার কোন লজ্জা, সংকোচ কাজ করছি না। কিছু সময় পর কান্নার বেগ কমতেই সে বললো,
— তায়াং-এর সাথে তোমার সব কথা আমি শুনেছি।আমায় মাফ করে দিও। আমিও শুধু আমার দিকটাই দেখেছি। তোমার মনের অবস্থাও চিন্তা করা উচিত ছিলো আমার।
আমি চোখ মুছে তাকে ছেড়ে দাঁড়ালাম। তার চোখ দিয়েও টপটপ করে পানি পরছে। আমি এগিয়ে গিয়ে তার দুই চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম,
— প্লিজ আপনি কান্না করবেন না। আপনার চোখের পানি আমার সহ্য হয় না। অনেক কষ্ট হয়।
উনি এক হাত দিয়ে বুকের বা পাশটা ধরে বললো,
— তার থেকে বেশি কষ্ট আমার এইখানে হচ্ছে।
— আমি সব ঠিক করে ফেলবো। প্লিজ আপনি ভেঙে পরেন না।
হাত বাড়িয়ে উনার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে গেলেই উনি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বললো,
— লাগবে না।
— কেন?
— তায়াং-এর চুল ঠিক করে দিও।
— আচ্ছা তাহলে যাই।
এনাজ আমার এক হাত ধরে আটকে বললো,
— একদম না। আমারটা ঠিক করে দিবে তুমি। আর কারোটা নয়।
আমি তার চুল ঠিক করে দিয়ে গাল দুটো টেনে বললাম,
— ভালোবাসি!
— এটাও লাগবে না। ভালবাসলে বিয়েটা ভেঙে দিতে।
— আমার ভালোবাসাও লাগবে না?
এনাজ অভিমানী সুরে বললো,
— না লাগবে না।
— তাহলে সব জমা করে রাখি। তায়াং ভাইয়ার সাথে যদি বিয়ে হয় তাহলে ওকেই দিবোনি।
— একদম না। তুমি পুরোটাই আমার। তাই তোমার সবকিছু আমার। আমি কারো সাথে তোমাকে ভাগ করতে পারবো না।
— একটু ধৈর্য্য ধরুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
— তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে বড্ড বেশি জেঁকে ধরেছে। শেষ পর্যন্ত তোমাকে পাবো তো আমি?
আমি চুপ হয়ে গেলাম। এই কথার উত্তর আমার কাছে নেই। দুদিন ধরে আমারও ভীষণ ভয় করছে। যদি আমি কিছু করতে না পারি?ভাইয়ার সাথে সত্যি যদি বিয়েটা হয়ে যায়! তাহলে কি করবো আমি? এনাজের বা কি হবে? ও যা পাগলামি শুরু করছে তাতে যেকোনো সময় নিজের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। আমাকে চুপ থাকতে দেখে এনাজ আবার জিজ্ঞেস করলো,
— বলো না শেষ অব্দি আমি তোমাকে পাবো তো? নয়তো সত্যি তোমাকে আমার মরা মুখ দেখতে হবে।
তার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে আমার মাথায় রাগ চেপে উঠলো। রাগী গলায় বললাম,
— এক থাপ্পড় মেরে মরার ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবো।দুই দিন ধরে শুধু মরার কথা শুনছি মুখে। আরেকবার বললে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে এনাজ।
— সত্যি কথা বলছি তো বিশ্বাস করছো না। তোমার বিয়েটা যদি হয় তাহলে আমার কথা মিলিয়ে নিও।
— আবার😡!
— তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না তো। আমার শুধু তোমাকেই লাগবে। শুনতে পেয়েছো আমি কি বলছি? আমার শুধু তোমাকেই লাগবে। এখন আমাকে বাঁচাতে চাইলে বিয়ে ভেঙে দাও। আর যদি মারতে চাও তাহলে বিয়ে করে নিও। আমাকে বাঁচাবে নাকি মারবে তা শুধুমাত্র তোমার হাতে।
গম্ভীর মুখে কথা শেষ করে এনাজ চলে গেল। আমি শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। আদোও কি সব ঠিক করতে পারবো আমি? নাকি চারটা জীবন নষ্ট হয়ে যাবে? কিচ্ছু জানি না।
#চলবে
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Special_Part
#Writer_NOVA
— ঐ ছেমড়ি জলদী দৌড় দে।
তায়াং ভাইয়া তাড়া পেয়ে শাড়ির কুঁচি ধরে দিলাম ভো দৌড়। প্রথমে শাড়ি তার ওপর বোরখা পরে কি দৌড়ানো যায়? এই সহজ কথাটাই আমি পাঠারে বোঝাতে পারছি না। আমি থেমে কিছুটা রাগ দেখিয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললাম,
— কি ধরনের কথাবার্তা এগুলা তায়াং ভাইয়া?
— বেশি কথা না বলে শাড়ি উচাইয়া দৌড় মার আগে।
— মান-সম্মান আর কিছু রাখলি না তুই পাঠা।
— কেউ দেখলে ধরে-বেধে বিয়ে দিয়ে দিবে বোইন। তোর পায়ে পরি জলদী দৌড় মার।
— শাড়ির ওপর বোরখা পরছি। এক কদমও দিতে পারছি না। তুই দৌড়াতে বলছিস বলে কোনরকম চেষ্টা চালাচ্ছি। এর পর যদি বেশি কথা বলিস তাহলে তোকে শাড়ি,বোরখা পরিয়ে দৌড়াতে দিবো।
— এই গলির থেকে যেতে পারলেই নিরাপদ।
— আরেকটু দেরী হলে এতখনে সর্বনাশ হয়ে যেতো। ঐ পাঠা দাঁড়া। আমার জুতা বাঁকিয়ে গেছে।
আমি কিছুটা পেছনে পরে গেলাম। তায়াং ভাইয়া দৌড় থামিয়ে পেছনের দিকে চলে এলো। রেগে বললো,
— বিয়ের জুতা জোড়ায় পরে আসতে হইছে? তোর কি আর জুতা নাই রে শাঁকচুন্নি?
— দেখ, অনেক কষ্ট করে তিন ঘন্টা পার্লারে বসে থেকে বউ সাজছি। লাল বেনারসির সাথে যদি বিয়ের জুতা না পরি তাহলে কি আমায় বুটুফুল(বিউটিফুল) লাগবে বল?
— তোর বিউটিফুলের গুল্লি মারি।তোকে ইচ্ছা করছে কোলে তুলে আছাড় মারতে।জুতা খুলে হাতে নে। তারপর দে দৌড়।
— কেন জুতা খুলমু কেন? এগুলা সব আমার। একটা জিনিসের দাবী রাখবি না। শেষ অব্দি বিয়েটা ভেঙে দিলাম। এখন পালাচ্ছি। এই শাড়ি, গহনা, জুতা সব আমার। তুই তোর বউকে নতুন কিনে দিস।
— চুপচাপ সবকিছু দিয়ে দিবি। এগুলোর ওপর আমার নূরের অধিকার।
— এত ছেঁচড়া কবে হলি তুই? তোর বউকে কি নতুন কিনে দিতে পারবি না? এগুলো আমার খালুর টাকার। বিয়েতে যেহেতু আমায় দিয়েছে তাহলে সব আমার।গহনার একটা পুঁতিও আমি ফেরত দিবো না।
— যা তোরে ভিক্ষা দিয়ে দিবোনি।
— ঐ ভিক্ষা দিবি কেন? এগুলো আমার জন্য খালামণি কিনছে। তাই এগুলো সব আমার।
— জ্বি না ময়না। এগুলা আমার বউয়ের জন্য কিনছে। তুই যদি আমার বউ হতি তাহলে এগুলো সব তোর হতো। কিন্তু এখন আমার বউ হবে নূর তাই এগুলো সব ওর।
— আমি একদিন পরে ফেলছি। তুই তোর বউকে পুরাতনটা দিবি ভাইয়া?
— হুম দিবো। একদিন পরলে কিছু হয় না।
— কিপ্টা! এগুলো আমাকে না দিলে আমি ফিরে গেলাম বাসায়। তুই থাক। গিয়ে বলবো আমি তোকে বিয়ে করতে রাজী আছি। এমনিও তুই জামাই হিসেবে খারাপ না। তাহলে তো এতো গহনা, শাড়ি, জুতা সব আমার হয়ে যাবে।
— সিরিয়াসলি, তুই এসবের জন্য আমাকে বিয়ে করতে চাইছিস? দাঁড়া এনাজকে বলছি। পরে মজা বুঝবি।
— বল তোর ঐ বন্ধুকে। আমি কি ভয় পাই নাকি?
— আচ্ছা একটু ওয়েট কর।
— বিয়ের যাবতীয় জিনিসপত্র খালুর টাকায় কেনা হয়েছে। তাই এসবে কোন দাবী করতে পারিস না।
— আমি দাবী করবোই।
— কেন তোর টাকা দিয়ে কিনছিস?
— আমার বাপের টাকা দিয়ে কিনছি।
— ইস আসছে। যা ভাগ।
— তোর কি ইচ্ছে আছে বিয়েটা করার?
— না তো। তাহলে কি পালাতাম নাকি?
— তাহলে এখানে দাঁড়ায় আছিস কেন?
— ওহ সত্যি তো। আমি তো ভুলেই গেছিলাম আমরা যে বিয়ের আসর থেকে পালাইছি।
— এখন তো মনে পরছে। দয়া কইরা বোইন এবার দৌড় দে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। তায়াং ভাইয়ার হাত ধরে দিলাম দৌড়। এতখনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমরা কেন দৌড়াচ্ছি? বাসা থেকে পালিয়েছি আমরা দুজনেই। আরেকটু দেরী হলে কাজী আমাদের বিয়ে পরিয়ে ফেলতো। তিন ঘন্টার বেশি সময় ধরে পার্লারে সেজেছি। পার্লার থেকে সন্ধ্যার পর ফিরে এসেছি। আগের থেকে সব প্ল্যান করে রেখেছিলাম। সুযোগ বুঝে ইফাত,সিফাতকে দিয়ে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিয়েছে। সেই ফাঁকে শাড়ির ওপর কোনরকম বোরখাটা পরে হিজাব পেঁচাতে পেঁচাতে আমি ও তায়াং ভাইয়া ছুট।আমাদের পালাতে তন্বী,ইভা,ইফাত,সিফাত প্রচুর সাহায্য করেছে। তন্বী সবার চোখের আড়ালে আমাদেরকে বের করতে হেল্প করেছে। ইভা সবকিছু পাহারা দিয়েছে।বাসা ভর্তি মানুষকে ফাঁকি দিয়ে পালানো তো চারটি খানি কথা নয়।গহনা খোলার সময়ও পাইনি। এখন শাড়ি,বোরখা, গহনার ভারে আমার অস্বস্তি লাগছে। দৌড়াতেও পারছি না। শাড়ির কুঁচি পেচিয়ে যাচ্ছে। তায়াং ভাইয়াকে থামিয়ে চেচিয়ে বললাম,
— ঐ তোর বাইক কোথায়? বাইক থাকলে কি এতো দৌড়াতে হয়?
— মেইন রোডে ইমরান বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
— বাসার নিচে থাকলে কি সমস্যা হতো? পাঠা কি তোকে সাধে বলি আমি? মাথার মধ্যে ঘিলু নামক কোন বস্তুই নেই। আমি আর দৌড়াইতে পারছি না। একটু দাঁড়া ভাই। বোরখার সাথে শাড়ির কুঁচি পেচিয়ে যাচ্ছে।
— বেশি দাঁড়ানো যাবে না। ধরা পরে গেলে আমরা শেষ।
— শাড়ি পরে কি দৌড়ানো যায়? তার ওপর বোরখা! আমি হাঁপিয়ে উঠছি। এর জন্য এই ব্যাঙের শাড়ি আমার পরতে ইচ্ছে করে না। কুচি পায়ের সাথে বেজে যায়। বিয়েতে লেহেঙ্গা দিলে কি হইতো? তাহলে আমি অনায়াসে লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে দৌড়াতে পারতাম।
— আম্মুকে বলোস নাই কেন? শপিং তো তোকে নিয়ে করতে গিয়েছিল।
— তখন কি জানতাম নাকি বাসা থেকে এভাবে পালাতে হবে। শোন ভাই, নূর আপিকে বিয়ের দিন লেহেঙ্গা দিবি।
— কেন ও কি তোর মতো পালাবে নাকি?
— আরে না তার জন্য নয়। শাড়ি সামলাতে অনেক কষ্ট। শাড়ি সামলানোর মতো ঝামেলা ২য়টা নেই।
— দ্রুত পা চালা তুই। বকরবকর করতে করতে মাথা ধরিয়ে ফেলছিস।
— কোথায় যাবো আমরা?
— দেখি কোথায় যাওয়া যায়।
হাঁটতে হাঁটতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে চলে এলাম। সেই আলোতে তায়াং ভাইয়াকে দেখে আমি হাসতে হাসতে পেট ধরে বসে আছি। তাড়াহুড়োয় তায়াং ভাইয়া যে ড্রেসআপ পরছে তাতে হাসি আসারি কথা। এতখন অন্ধকার থাকায় খেয়াল করিনি।ও বিয়ের শেরওয়ানি পায়জামার সাথে ওপরে টি-শার্ট পরে চলে আসছে। ওকে যা লাগছে না 🤣। টি-শার্টটাও শর্ট। দুই/তিন বছর আগের হবে। ভালো করে দাঁড়ালে পেট বের হয়ে যায়।আমি হাসতে হাসতে বললাম,
— ঐ তুই এগুলা কি পরছিস?
— কেন দেখোস না?
— ভালো করে নিজের দিকে তাকা ভাই।
তায়াং ভাইয়াও খেয়াল করিনি কিসের মধ্যে কি পরেছে। নিজের দিকে তাকিয়ে কপালে জোরে একটা চাপর মেরে বললো,
— দেখ তো এগুলো কোন কথা? আম্মু গতকাল চেয়ারের মধ্যে দুই বছর আগের টি-শার্টগুলো ভাজ করে রাখছিলো। ঘর মুছবে তার জন্য। আমি তাড়াহুড়ো করে পাঞ্জাবী বদলে ঐ জায়গা থেকে একটা পরে দিছি দৌড়।
— তোকে যা লাগছে না ভাইয়া। একদম ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতো। তুই একটু হাত দুটো উঁচু কর।
— কেন?
— তাহলে তার টি-শার্ট ব্লাউজে রূপান্তরিত হবে😂।
— ভেটকাইস না। এখন রাত হয়ে গেছে। কেউ আমায় খেয়াল করবে না। এটা পাল্টে আসতে গিয়ে কি বিপদে পরবো নাকি?
— থাক, সমস্যা নেই। ব্লাউজ আর পায়জামায় তোকে খারাপ লাগছে না।
—মজা নিচ্ছিস?
— হো🤭।
ভাইয়া আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো। আমি মুখ টিপে হেসে ওর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে শাড়িতে বেজে দুইবার উষ্ঠা খেতে খেতে বেঁচে গেলাম।
💖💖💖
মেইন রোড গিয়ে ইমরান ভাইয়ার থেকে বাইক নিয়ে আমরা রওনা দিলাম উত্তরের রাস্তায়।সময় এখন রাত আটটা।আমার কাছে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরটা আজ অন্য রকমভাবে সেজেছে। মাথা থেকে বড় একটা প্যারা তো নেমে গিয়েছে। এখন প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারবো।মাথাটাও পাতলা লাগছে। তায়াং ভাইয়াকে খোচা মেরে বললাম,
— এই ভাইয়া শোন।
— খোচাচ্ছিস কেন?
— আমার কথাটা শোন।
— বল শুনছি। কিন্তু খোঁচা মারিস না।
— আমাকে ট্রিট দিস।
— কেন?
— ও মা একা একা সব প্ল্যান করলাম। বিয়েটা ভেঙে দিলাম। তুই কিছু করিস নি।
— তো?
— তো মানে কি? সব আমি একা সামলিয়েছি। অদক্ষ হাতে পুরোটা কমপ্লিট করলাম।
— যেহেতু তুই ভেজাল লাগিয়েছিস সেহেতু তুই সব করবি। আমরা করবো কেন?
— এর জন্য আমাকে ট্রিট দিবি না?
— প্রশ্নই উঠে না।
— যদি ট্রিট দিস সাথে বিয়ের যাবতীয় জিনিসপত্র আমাকে দিয়ে দিস,তাহলে দুই দিনের মধ্যে তোর আর নূর আপির বিয়ে কনফার্ম করে দিবো।
ভাইয়া খুশি হয়ে বললো,
— সত্যি?
— হ্যাঁ তিন সত্যি।
—আচ্ছা আগে সব ঠিক করে দে। তাহলে তোকে আমি ট্রিট তো দিবোই সাথে এই জিনিসপত্রও।
—ওকে তুই শুধু দেখতে থাক কি করি আমি।
— কিন্তু কালকে বাসায় গেলে আমাদের ঢুকতে দিবে তো?
— কালকেরটা কালকে দেখা যাবে। আজকে চিন্তা করে মাথায় চাপ নিস না তো।
— প্লিজ বল না আগামীকাল কি করবো?
— কি আর করবো বল? তুই দাদী আর খালামণির পা জড়িয়ে ধরে বসে থাকবি। আমি আম্মু-আব্বুর পা জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। যতক্ষন পর্যন্ত তারা না মানবে ততক্ষণ পা ধরে বসেই থাকবো। না মেনে কোথায় যায় তাও আমি দেখবো।
— আইডিয়া পছন্দ হয়েছে।
— দেখতে হবে তো কে দিয়েছে।
কিছু সময়ের জন্য আবার নীরব হয়ে গেলাম। হঠাৎ ভাইয়া চেচিয়ে বললো,
— ঐ ছেমড়ি দূরে সর। আমার সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করতাছিস কেন?
— ঐ কি বলিস এগুলা? আমি ঘেঁষাঘেঁষি কখন করলাম? আমি ভালো করে বসতে পারতাছি না। বোরখাটা পিছলিয়ে যাচ্ছে। বসে শান্তি পাচ্ছি না। তুই আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে বস না ভাই।
— কত জায়গা লাগে তোর মুটি? নে সামনে এগুয়েছি। এবার বস ভালো করে।
দুজন ঝগড়া করতে করতে গন্তব্যে চলে এলাম। পাঁচ তলা এক দালানের সামনে তায়াং ভাইয়া বাইক থামালো। আমি বাইক থেকে নেমে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
— এটা কাদের বাসা ভাইয়া?
— দুইতালায় এনাজ থাকে।
— আজকের রাতটা আমরা এনাজের কাছে থাকবো?
— হুম।
— ওকে, আমার কোন সমস্যা নেই। তোর মোবাইলটা দে।
— কেন?
— এতো কেন কেন করিস কেন তুই?
— মোবাইল বন্ধ করে রাখছি। খুললে বিপদে পরতে হবে।
— আমরটা তো বাসায় রেখে আসছি।
— মোবাইল দিয়ে কি করবি তুই?
— কয়েকটা ছবি তুললাম। তিন ঘন্টা বসে থেকে কি সুন্দর বউ সাজলাম। পালানোর ধান্দায় একটা ছবিও তুলতে পারিনি। ফিলিং দুক্কু 🥺।
— আহারে! থাক মন খারাপ করিস না। এনাজের সাথে তুলুস।
— আচ্ছা।
আমি ও ভাইয়া বাইকসহ গেইট দিয়ে ঢুকলাম। ভাইয়া ভেতরে ঢুকে বাইক তালা মেরে পাশে রেখে আমাকে বললো,
— উপরে চল।
— দাঁড়া এক মিনিট।
— কি হয়েছে?
— তোর পায়জামা উপরের দিকে উঠা। পেট বের হয়ে আছে🌚।
— শাঁকচুন্নি।
— এক কাজ কর ভাইয়া, তুই পায়জামাটাকে আরেকটু উঠিয়ে টি-শার্টটাকে ইন করে পর। তাহলে পেটও দেখা যাবে না। তোকেও খারাপ লাগবে না।
ভাইয়া আমার মজা করা বুঝতে পেরে দুই হাত কোমড়ে রেখে রাগী চোখে আমার দিকে তাকালো।আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। ওর দিকে তাকালেই আমার হাসি পায়। শর্ট টি-শার্ট আর পায়জামায় ওকে দেখে আমার হাসি আটকে রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। এখন যদি ওর সাথে একটু ছবি তুলতে পারতাম। তাহলে ওর এই সুন্দর ড্রেসআপটা দেখিয়ে পরে ব্লাকমেইল করতে পারতাম।ভাইয়া রেগে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। আমিও হাসতে হাসতে ওর পিছু নিলাম।
♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪
তুই ছাড়া একেকটা দিন কি যে যন্ত্রণা,
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা।
দু-চোখ পুড়ে কি দহনে তুই তো দেখিস না।
তুই ছাড়া একেকটা দিন কি যে যন্ত্রণা,
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা।
চোখের ভেতর বৃষ্টি ঝরে, হৃদয়টা হয় যেন নদী
তোর না থাকার একেকটা খন ছুয়ে দেখতি যদি
আমায় ছেড়ে কখনো দূরে যেতি না
তুই ছাড়া একেকটা দিন কি যে যন্ত্রণা,
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা।
♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪
ফ্ল্যাটের দরজার সামনে কান পেতে রেখেছি। ভেতর থেকে ইমরানের “তুই তো দেখিস না” গানটা বাজছে। আমি দরজার থেকে কান সরিয়ে একবার মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে আফসোসোর সুরে বললাম,
— আহারে বেচারা কষ্টের গান শুনছে। তার কষ্টে আমি সত্যি কষ্টিত।
— নোভা,তুই কিন্তু এবার বেশি করছিস।
—একটুও না। তোর বন্ধু এগুলো কি গান শুনে? শুনবে তো জোরে সাউন্ড দিয়ে অপরাধী গান।
ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। আমি মেকি হাসি দিয়ে জোরে চেচিয়ে হেড়ে গলায় গান গাওয়া শুরু করলাম,
“ও মাইয়া, ও মাইয়ারে তুই অপরাধীরে
আমার স্বপ্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরাইয়া দে
আমার অনুভূতির সাথে খেলার অধিকার দিলো কে
মাইয়া তুই বড় অপরাধী তোর ক্ষমা নাই রে।”
— চুপ কর।
— তোর বন্ধু এই গান শুনবো। আসল ছেঁকা খাওয়া গান তো এইগুলা।তা না করে আমার ফেভারিট সিঙ্গারের গান শুনে কেন?
— কথা কম বল তুই। আমরা যে ওর বাসায় আসবো তা ও জানে না। ওকে সারপ্রাইজ দিতে এখানে চলে আসছি। কিন্তু তুই যা শুরু করছিস।
আমি মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কেটে বললাম,
— এত সুন্দর করে গান গাইলাম। কোথায় বাহবা দিবে। তা না করে ইনসাল্টিং করছে। আজকাল আর্টিস্টদের কেউ সম্মান করে না। মনে রাখিস একসময় আমার নাম সুপার সিঙ্গারদের তালিকায় থাকবে। তখন আমার অটোগ্রাফ নিতে তোকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
— হইছে চাপা কম মার। চাপা না মেরে দরজা ঠেলা মার। কথা বলতে বলতে আমার কানের পর্দা ফাটায় ফেলানোর চিন্তায় আছিস।
আমি চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকালাম।ও সেদিকে নজর না দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। দরজা বাইরে থেকে আটকানো ছিলো। ভেতরে ঢুকে আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। সবকিছু এলোমেলো। কোন কিছু গুছানো নেই। তায়াং ভাইয়া বসার রুম ক্রস করে আমাকে নিয়ে একটা রুমে চলে এলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কড়া সিগারেটের গন্ধ নাকে এলো। ভাইয়া লাইট জ্বালিয়ে দিতেই দেখলাম এনাজ উপুর হয়ে শুয়ে আছে। তায়াং ভাইয়া মৃদুস্বরে এনাজকে ডাকলো,
— এনাজ!
কিন্তু অপরপাশ থেকে এনাজের কোন রেসপন্স এলো না। তায়াং ভাইয়া সামনে গিয়ে ওকে ঠেলা মেরে আবারো ডাকলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভাইয়া ভীত কন্ঠে বললো,
— এনাজের শরীর তো ঠান্ডা নোভা। ওর কোন সাড়াশব্দও নেই। ও কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলেনি তো?
ভাইয়ার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। সত্যিই এনাজ বিষ খেয়ে নেইনি তো? আমার হাত-পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেলো। আমরা কি আসতে দেরী করে ফেললাম? আমাদের জন্য কি আরেকটু অপেক্ষা করা যেতো না?
#চলবে