#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ চৌদ্দ
#মম_সাহা
টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ যেন ছন্দ তুলছে। রাতের আকাশে মেঘ জমলে রাত ততটা নিকোষ, কালো লাগে না। বরং অন্যান্য দিনের তুলনায় রাতটা স্বচ্ছ হয়। ঘরের মানুষ বেশিরভাগই উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। নিধি তার ছেলেকে উঠোন থেকে তুলে লাগিয়ে দিলো এক চড়। কানটা মলে দিয়ে বললো,
“পাঁ’জি শয়’তান ছেলে। বৃষ্টি দেখলেই ওর ভিজতে হবে সবসময়। নিশ্চয় এখন লুকিয়ে ভিজার জন্য এসেছিলো অন্ধকারের মাঝে তাই পড়েছে। বে’য়া’দব ছেলে হয়েছে একটা।”
দৃষ্টান্ত একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। দর্শিনী রান্নাঘর থেকে ছুটে উঠোনে নামতে নিলেই ধমকে উঠে দৃষ্টান্ত,
“এই,এই তুই উঠোনে নামছিস কেনো? দেখছিস না উঠোন কত পিচ্ছিল হয়ে আছে? পড়ে যাবি তো নাকি? সাবধান হবি কবে? অদ্ভুত!”
দৃষ্টান্তের ধমকে দর্শিনীর পা আবার আগের জায়গায় স্থির হলো। দৃষ্টান্ত কেনো সবাধান করেছে, তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। নিধিও স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ প্রিয়,তুই আর ভিজিস না অন্তত। দেখ এখানে সবাই কত ভিজে গেছে। যা তাড়াতাড়ি সবার জন্য গামছা আর জামা-কাপড় বের কর। এই ছেলেটার জন্য সবার কী নাজেহাল অবস্থা। দৃষ্টান্ত দাদা প্রথমে ছুটে এসেছে এই আঁধারে। আমরা তো ভেবেছিলাম তুই কোনো অঘটন ঘটিয়েছিস। যাক ঈশ্বর বাঁচিয়েছে।”
দর্শিনী মাথা নাড়িয়ে ঘরে চলে গেলো। সবার জন্য জামা-কাপড় বের করা শুরু করলো। একে একে সবাই ঘরে প্রবেশ করলো।
মৃত্যুঞ্জয় এতক্ষণ সবটা নিরবে পর্যবেক্ষণ করলো। ভ্রু কুঁচকে এলো তার আপনা-আপনি। দৃষ্টান্তের শাসন নামক ব্যাপারটা তার ঠিক সহ্য হচ্ছে না। দৃষ্টান্ত একটু বেশিই ভাবছে আজকাল দর্শিনীকে নিয়ে!
একে একে যখন সবাই ঘরে ঢুকতে ব্যস্ত মৃত্যুঞ্জয় তখন ধীর কণ্ঠে দৃষ্টান্তের পিছু ডেকে উঠলো,
“দৃষ্টান্ত,শোন।”
দৃষ্টান্ত ঘরে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেলো। তখনও অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে পৃথিবীর বুকে। ভিজিয়ে দিচ্ছে উত্তপ্ত পরিবেশকে। দৃষ্টান্ত পিছু ফিরলো, ভ্রু কুঁচকে বললো,
“হ্যাঁ বল?”
মৃত্যুঞ্জয় মুখের কাঠিন্য ভাবটা সরিয়ে সামান্য হাসলো। একটু খোঁচা দিয়ে বললো,
“আজকাল দেখি প্রিয়দর্শিনীর ভালোই খেয়াল রাখছিস! শাসনও করছিস! বাহ্। কী ব্যাপার, বন্ধু?”
দৃষ্টান্ত মৃত্যুঞ্জয়ের কথা শুনে কতক্ষণ থম মেরে রইলো। পরক্ষণেই উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো। যেন সে মজার কিছু শুনে ফেলেছে। সেই হাসি ঠোঁটের কোণে বজায় রেখেই ফিচলে কণ্ঠে বললো,
“আজকাল দেখি আমার শাসন দেখে কারো হৃদয় পুড়ে,প্রতিহিংসারা জ্বলে উঠে উদ্যমে হৃদয় আঙিনায়। বাহ্। কী ব্যাপার, বন্ধু?”
মৃত্যুঞ্জয় যেন এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। খানিকটা থতমত খেয়ে যায় সে। নিজের বিব্রত পরিস্থিতি আড়াল করতেই বলে উঠলো,
“কী বলছিস এসব!”
“তুমি যা বুজেছো, ভাই।”
দৃষ্টান্তের দুষ্টুমি মাখা কণ্ঠে হেসে ফেলে মৃত্যুঞ্জয়ও। যাক,তার বন্ধু যেহেতু তার মনের পরিস্থিতি বুঝে গেছে তবে আর ভয় নেই। আর দ্বিধা নেই। প্রকৃতির সাথে শীতল হলো মানবের বক্ষ পিঞ্জিরা। যাক,এবার অন্তত মানবী তার।
দৃষ্টান্ত কতক্ষণ পর হাসি থামলো। কিছু একটা ভেবে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“মেয়েটাকে আগলে রাখবি তো সবসময়?”
“আমার উপর তোর ভরসা নেই?”
“তোর উপর ভরসা আছে। কিন্তু দর্শিনীর ভাগ্যের উপর আমার ভরসা নেই।”
দৃষ্টান্তের কণ্ঠে,কথায় কিছু একটা ছিলো যা নাড়িয়ে দিলো মৃত্যুঞ্জয়কে। সে ভেবে ভেবে অবাক হলো,দৃষ্টান্ত এতটা গভীর কথা কেনো বললো?
ততক্ষণে ভিতর থেকে তাদের ডাক এলো। দু’জন নিজেদের ভাবনা বাদ দিয়ে ছুটে গেলো ঘরের দিকে। তারা হয়তো দক্ষিণ দিকের জানালার দিকে তাকালে দেখতে পেতো কেউ একজন তাদের কথা শুনেছে অতি গোপনে,নিরবে।
_
নিপা ধৃষ্টের মাথাটা ভালো করে মুছে দিচ্ছে। সবার সাথে তেমন ভাব ভালোবাসা না থাকলেও ধৃষ্টকে নিপা অনেক বেশিই আদর করে। কারণ একটাই, বিয়ের এত গুলো বছর পরও তার কোল খালি। একটু “মা” ডাক শোনার হাহাকার তার হৃদয়ে জ্বলছে অনবরত। তাই সে ধৃষ্টকে নিজের সন্তানের মতনই আদর করে।
তন্মধ্যেই সকলের খাবার শেষ হলো। এখন কেবল নিধি আর দর্শিনী বাকি আছে। নিধি রান্নাঘর থেকে নিজেদের খাবারটা এনে সাজিয়ে রাখলো। নিজের ছেলের পানে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বলল,
“ওকে এত সোহাগ করার দরকার নেই, নিপা। আদরে আদরে বাঁ’দর তৈরী হচ্ছে।”
মায়ের ধমকে ধৃষ্ট নিপার গলা জড়িয়ে ধরলো। নিপা আহ্লাদী স্বরে বললো,
“আহা দিদি,বাচ্চা মানুষ একটু তো দুষ্টুমি করবেই। তার জন্য তুমি ওকে এত বকবে না তো। আমার ভালো লাগে না।”
“এই তুই ই আহ্লাদ দিয়ে ওকে এমন বানাচ্ছিস। একদম আহ্লাদ দিবি না। একটু তো শাসন করিস।”
“যার কোল খালি তার শিশুদের প্রতি আহ্লাদ ছাড়া আর কিছু আসবে না দিদি। তুমি তো “মা” ডাক শুনতে পেরেছো কিন্তু আমি পাই নি। আমি জানি কতটা তৃষ্ণা আমার হৃদয়ে। কতটা হাহাকার। তোমরা অনেক ভালো তাই হয়তো দর্শিনীর মতন আমার দশা হয় নি। নাহয় আমার ভাগ্যও তো সেই একই পথে। সে আমি যতই দর্শিনীকে কথা শুনাই।”
পুরো ঘরময় পিনপতন নীরবতা। নিপার মতন শক্ত মেয়ের চোখে অশ্রুকণা টলমল করছে। প্রতাপ সাহা নিজের আরামকেদারা থেকে উঠে আসলেন, পুত্রবধূর মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে বললেন,
“মা,আফসোস রেখো না জীবনের প্রতি। সে তোমাকে যা দিয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকো। আর রইলো সন্তানের কথা, অনেক দম্পতি সন্তান জন্ম না দিয়েও সন্তান পায়। তোমরা দত্তক নিতো পারো। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তোমাদের খুশিতেও আমরা খুশি। এতে একটা অনাথ বাচ্চা বাবা-মা পাবে আর তোমরা সন্তান।”
“হ্যাঁ ছোট বউ,তোমরা চাইলেই সন্তান দত্তক নিতে পারো। অনাথ আশ্রমে কত অসহায় শিশুরা আছে। তাদের মাঝে একজনের ছাদ হও তোমরা।”
শ্বশুর শাশুড়ির এমন নিবিড় কথায় নিপার ঠোঁট তিরতির করে কেঁপে উঠে। দু’ফোটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে নিরবে। এতক্ষণ সবটা দর্শিনী চুপ করে শুনছিলো। ইশ,তাদের বাবা-মায়ের মতন যদি তার শ্বশুর বাড়ি হতো তাহলে বোধহয় তার সংসারটা এভাবে ধূলিসাৎ হতো না।
নিপার স্বামী সুমন নিপাকে ধমকিয়ে উঠলো,
“এই, এমন কান্না করছো কেনো? তোমাকে কী আমরা কোনো কিছুর অভাবে রেখেছি? তোমার বাবা-মায়ের সামনে কান্না করছো,তাদের কেমন লাগছে বুঝতে পারছো না? আর ধৃষ্ট আছে না? ও আমাদের সন্তানই তো।”
দেবরের কথাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিধিও বললো,
“হ্যাঁ রে নিপা,ধৃষ্ট কী তোদের সন্তান না? এমন করে বলছিস কেনো? কান্না বন্ধ কর। সবার খারাপ লাগছে।”
দর্শিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। ছোট বৌদির কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। হাঁটু গেড়ে বসলো ছোট বৌদির পায়ের কাছে। ছোট বৌদির চোখ দুটো খুব আদরের সাথে মুছে দিয়ে নিবিড় কণ্ঠে বললো,
“ছোট বৌদি,তুমি কেঁদো না। ঈশ্বর যখন সব শখ পূরণ করেছে, তখন তোমার এ শখও অপূর্ণ থাকবে না। দেখেছো,তোমার শ্বশুর বাড়ির মানুষ তোমার চোখের জল ঝড়তে দিচ্ছে না। তোমার কত ভাগ্য! এমন ভাগ্যের উপর না পাওয়ার কলঙ্ক আর লেপন করো না। তোমাকেও “মা” ডাকার মতন কেউ নিশ্চয় আসবে।”
নিপা থামলো। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো,
“এত বছরেও যার কোলো কেউ এলো না, তার কোলে কী আর কেউ আসবে?”
দর্শিনী মুচকি হাসলো,আশ্বাসের স্বরে বললো,
“এই যে আমি কথা দিলাম, তুমিও একদিন কাউকে কোলে পিঠে করে মানুষ করবে। দেখে নিও।”
নিপা চুপ হলো। সাথে চুপ হলো নিরব পরিবেশ। টিপ টিপ বৃষ্টির ফোঁটা গুলো কেবল ছন্দ তুলে যাচ্ছে। দর্শিনীও ভেতরে খুব গভীর ভাবনা ভাবছে। আজকাল তার মন কু ডাকছে। তার সন্তানের তো বাবা নেই, যদি জন্ম দিতে গিয়ে সেও চলে যায় বহুদূর! তবে,বাচ্চা টা এখন আর অনাথ হবে না। এই তো, সে তার বাচ্চার জন্য নতুন বাবা-মা খুঁজে এনেছে।
#চলবে
[এ পর্বটির আরেকটু অংশ আছে। লিখা হয় নি তাই এতটুকুই দিলাম। রাতে বর্ধিতাংশ দিবো। তবে,দেরি হতে পারে।]