#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৯

1
681

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৯
-Farhina Jannat

৯.
এদিকে পরপর দুইবার স্যালাইন খেয়ে খুব জোর বাথরুম পেয়েছে সিদ্রার। ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে খালা খালা বলে, কোন সাড়াশব্দ নেই। ব্যাপার কি! বাথরুমও আর চেপে রাখা যাচ্ছেনা। এবার ডাকের সাথে নানারকম আল্টিমেটাম দেয়াও শুরু করল সিদ্রা।

“খালা, দরজা না খুললে কিন্তু ঘরে টয়লেট হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি খুলেন” এসব বলার পরেও যখন খালার দেখা পাওয়া গেলনা, তখন অসাধ্য সাধন করে ফেলল সিদ্রা। খাটটাকে টেনে জানালার কাছে আনল। তারপর বহু কসরৎ করে শরীরটা মোচড়ামুচড়ি করে জানালা দিয়ে বের করে আনল। মোটামুটি জান বের হয়ে গেল এতটুকু জানালা দিয়ে বের হতে গিয়ে। আর ওইপাশে তো কিছু ছিলনা, পায়ে একটু ব্যাথাও পেল। ভাগ্য ভাল যে ভাঙেনি কি মচকায়নি।

এর আগেও একবার এই চেষ্টা করেছিল ও, একদম প্রথমদিন সকালে। কিন্তু সেদিন কিছুতেই বের হতে পারেনি। আজকে প্রয়োজনের তাগিদেই হোক, আর না খেয়ে শুকিয়ে যাওয়ার কারণেই হোক, সফল হল সিদ্রা। পায়ে ব্যাথা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতেই সোজা বাথরুমে দৌড় দিল।

আহ! শান্তি!! বাথরুম করেও যে এত শান্তি পাওয়া যায়, আজকে জীবনের প্রথম উপলব্ধি করলাম, ভাবল সিদ্রা। গোপাল ভাঁড়ের গল্পটা কি আর এমনি এমনি হয়েছে!!!

এবার মাথায় এল আসল চিন্তা। লোকটাও নেই আর মহিলাটাও নেই। এটাই তো সুযোগ পালানোর। বোরকাটা পরে আসি জলদি। যেই ভাবা সেই কাজ, দৌড়ে বারান্দায় আসল সিদ্রা। তালা কি করে খুলব, এই চিন্তা করতেই দেখে দরজার সাইডেই একটা হুঁকে চাবি ঝোলান। আলহামদুলিল্লাহ্‌! বলে তালা খুলে ফেলল সিদ্রা। তাড়াতাড়ি করে বোরকাটা পরে ওই শাড়িছেড়া ওড়নাটা দিয়ে ভালভাবে নেকাব পরে ফেলল। বারান্দা থেকে নামার সময় একটু কৌতূহল হল, চলেই তো যাচ্ছি, পাশের ঘরটা কেমন ছিল একটু উঁকি মেরে যাই। এবং ভুলটা করল এখানেই।

আস্তে করে হেঁটে উঁকি মারতেই দেখে, খালা মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। দৌড়ে গেল সিদ্রা উনার কাছে। ডাক দিল, সাড়া নেই। গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা, হাত রাখা যাচ্ছেনা। জ্বরের প্রকোপেই অজ্ঞান হয়ে গেছে, বুঝল ও। দোটানায় পড়ে গেল সিদ্রা। কি করব আমি? পালাবো নাকি উনার জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করব? পালানোর এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলব? কিন্তু একজন অজ্ঞান মানুষকে ফেলে যাই কি করে, এতটা অমানবিক কি করে হব?

একটু পরেই দেখা গেল সিদ্রা ওকে পরতে দেয়া শাড়িটার একপাশ ছিড়ে সেটা দিয়ে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। আর শরীর ভেজা গামছা দিয়ে মুছে জ্বর কমানোর চেষ্টা করছে। পালিয়ে ও যেতেই পারতো, কিন্তু বিবেক সায় দিলনা। ওরা অমানুষ বলে কি ওকেও অমানুষ হতে হবে নাকি!

একেতো ওর জন্য বৃষ্টিতে ভিজে খালার এই দশা। আবার এত তাপ গায়ে, তার মানে জ্বর অনেক আগেই এসেছে, সকালে হয়ত জ্বর গায়েই ওর জন্য রান্না করেছে। আর লোকটারো দুদিন ধরে পাত্তা নেই, কখন আসবে সেটাও তো বোঝা যাচ্ছেনা। ততক্ষণে মহিলার বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে যেতে পারে। এছাড়া এই ঘন জংগল থেকে যে ও নিজে আসলেই পালাতে পারবে, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই, কিছুই চিনেনা ও। বরং একটা মানুষের প্রাণ বাঁচানোই আগে দরকার, নাহলে পালিয়ে বাঁচলেও নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারতোনা সিদ্রা।

ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতেই নড়ে উঠল মহিলা। মুখ ফাঁক করল, যেন কিছু বলতে চাইছে। সিদ্রা কি করবে বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি করে চামচ দিয়ে পানি দিল ঠোঁটের ফাঁকে, খেয়ে নিল মহিলা। এভাবে বেশ খানিকটা পানি খাওয়ানোর পর মনে হল ওষুধ খাওয়াতে হবে। কিন্তু তার আগে তো কিছু খাওয়ানো দরকার।

রান্নাঘরে পাতিলে ভাত তরকারি সবই পেল সিদ্রা। জ্ঞান এসেছে ঠিকই, কিন্তু হুঁশ এখনো ফেরেনি মহিলার। গলার ভেতর থেকে গোঁ গোঁ একটা আওয়াজ আসছে, কথা বলতে পারলে হয়তো প্রলাপ বকত এতক্ষণ। অনেক চেষ্টা করেও কয়েক লোকমার বেশী খাওয়াতে পারলনা। এবার ওষুধ খোঁজার পালা।

এতক্ষণে ঘরটার দিকে ভাল করে নজর দেয়ার সুযোগ পেল সিদ্রা। ও যেটাতে ছিল, তার থেকে বেশ বড় ঘরটা। আর অনেক সুন্দর করে সাজানো গুছানো, যেন আধুনিক হোটেল রুম কিংবা কোন ভ্যাকেশন হোম। ঘরের মাঝখানে মশারি টানানোর স্ট্যান্ডসহ মাঝারি সাইজের সুন্দর একটা খাট, স্ট্যান্ডগুলোর সাথে সুন্দর করে মশারি বেঁধে রাখা। খাটের দুপাশে বেডসাইড টেবিল, একপাশে দারুণ একটা কাঠের আলমারি, ম্যাচিং ড্রেসিং টেবিল, জানালার পাশে একটা কফি টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি দুটো আরামদায়ক সোফা।

বাব্বাহ! এখানে এসে নিশ্চয় কেউ সময় কাটায়, ভাবল সিদ্রা। ওই মহিলার নিজের ঘর এটা হতেই পারেনা।

আলমারি, বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার কোথাও কোন ওষুধ পেলনা সিদ্রা। লাস্ট বাকি আছে শুধু ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার। “আল্লাহ্‌! এখানেই যেন পাই, তুমি দেখো” বলে ড্রয়ার খুলল সিদ্রা।

“আলহামদুলিল্লাহ্‌”, প্যারাসিটামল সহ ইমার্জেন্সিতে প্রয়োজন এমন সব ওষুধই আছে ড্রয়ারে। তাড়াতাড়ি করে একটা প্যারাসিটামল গুলে খাইয়ে দিল খালাকে।

বিকালের দিকে জ্বর কমে আসল। এর মধ্যে সিদ্রা খালি দুইবার নামাজ পড়ার জন্য উঠেছে, এছাড়া এক মুহূর্তের জন্যও জলপট্টি দেয়া থামায়নি। যতবার চোখ খুলেছে মহিলা ততবার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছে ওর দিকে। হয়ত ভাবতে পারছেনা সিদ্রা এখানে কিভাবে এল অথবা সিদ্রা উনার সেবা করছে সেটা বিশ্বাস করতে পারছেনা কিংবা দুটোই।

মাথায় পানি ঢাললে হয়ত আরো তাড়াতাড়ি জ্বর নামতো, কিন্তু সমস্যা হল মহিলা এত ভারী যে, সিদ্রা চেষ্টা করেও উনাকে খাটের উপরে তুলতে পারেনি, সেজন্য মাথায় পানি ঢালা সম্ভব হয়নি।
আলমারি থেকে চাদর বের করে মেঝেতে বিছিয়ে উনাকে গড়িয়ে ওইটার ওপর এনেছে। তারপর গায়ে কাঁথা দিয়ে দিয়েছে।

যাই হোক, মাগরিবের আগে আগে পুরোপুরি জ্বর ছেড়ে গেল। মহিলা তখন ঘুমাচ্ছে। সিদ্রা ভাবছিল, এখন পালাবে কিনা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রাত হয়ে যাবে। অচেনা জংগলে যেখানে দিনে কিভাবে পালাবে সেটা বুঝতে পারছিলনা, সেখানে এখন তো আরো অসম্ভব। তার ওপর ওইদিন গাছে আটকে থাকার সময় রাত হয়ে যাওয়ার পর যে ভয় পেয়েছিল, সেটা ভেবেও বুক কেঁপে উঠলো ওর। তাই, আপাতত বাদ দিল পালানোর চিন্তা। আল্লাহ্‌ যদি আমার কপালে মুক্তি লিখে রাখেন, তাহলে সুযোগ আবার আসবে, ইন শা আল্লাহ্‌, ভাবল সিদ্রা।

রাতের বেলা ফিরে এল লোকটা।

এশার নামাজ শেষ করে সোফার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে নামাজের পরের তসবিগুলো গুনছিল সিদ্রা। বুদ্ধি করে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে এসেছে, যাতে লোকটা এসে দরজা খুলতে গেলে ও শব্দ শুনে বুঝতে পারে। আর এ ঘরের দরজাও ভেজিয়ে রেখেছে।

একটু তন্দ্রা এসে গেছিল সিদ্রার, সে সময়ই শুনল ওর ঘরের দরজা খোলার শব্দ। তন্দ্রা ছুটে গেলেও ঘুমের ভান করে পড়ে রইল সিদ্রা। মুখটা এমনভাবে হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে যাতে চোখ বন্ধ দেখে বুঝা যায় যে ও ঘুমাচ্ছে।

“খালা, খালা, মেয়েটা কোথায়?” বলতে বলতে ঘরে ঢুকল লোকটা। ঢুকেই থমকে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল, যেন পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। জল পট্টি দেয়ার বাটি আর কাপড় খালার পাশেই পড়ে আছে, যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে। হালকা করে খুলে চোখের কোণ দিয়ে দেখার চেষ্টা করল সিদ্রা। তেলের বাতির আলো-আঁধারি ওর অভিনয় আরো সহজ করে দিল। লোকটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে, যেন ঘুম ভাঙাতে চাইছেনা। ওর দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে চোখ বুজে ফেলল সিদ্রা।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here