#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব১০
-Farhina Jannat
১০.
লোকটা একদম সিদ্রার মুখের কাছে এসে বোঝার চেষ্টা করল, ও আসলেই ঘুমাচ্ছে কিনা। তারপর খালার শিওরে বসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরখ করল। তারপর আস্তে করে ডাকল খালাকে।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসল খালা। হাত নাড়িয়ে কথা বলতে লাগল ইশারায়, সব বুঝতে পারলনা সিদ্রা, তবে মাঝেমাঝে ওর দিকে ইশারা করল। লোকটা যেন পুরো হতভম্ব হয়ে গেছে।
“আপনি জানেননা ও কিভাবে বেরিয়েছে?”
“চোখ খুলে দেখলেন ও আপনার মাথায় জল পট্টি দিচ্ছে?”
“আপনাকে খাইয়েও দিয়েছে?”
প্রতিটা প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল মহিলা। লোকটা সিদ্রার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ। “আনবিলিভেবল! এই মেয়ের মধ্যে দয়ামায়া বলে কিছু আছে!! কিন্তু তালা লাগানো ঘর থেকে ও বের হল কিভাবে এটাই তো বুঝতে পারছিনা, যাদু জানে নাকি?” চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল লোকটা।
“যাকগে, সেবা যখন করেছে তখন ঘুমাক, ডাকবনা এখন। তুমিও রেস্ট নাও। আমি একটু দেখি, কোন খাবার আছে নাকি। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে”
এইরে, আমিও তো কিছু খাইনি রাতে, মনে পড়ল সিদ্রার, এখন তো না খেয়েই থাকতে হবে। খালা অবশ্য লোকটাকে উঠতে দিলনা, নিজেই উঠে গেল। একটু পরেই থালায় করে সকালের ভাত তরকারি নিয়ে এসে দিল।
“ভাত? আমি না তোমাকে বলেছি ওকে ভাল খাবারদাবার না দিতে!”
খালা উত্তরে মনে হয় সিদ্রার ডায়রিয়া হওয়ার খবর দিল।
“তাহলে ভালই করেছো, সামান্য ডায়রিয়াতে টুস করে মরে গেলে আমার জ্বালা মিটতোনা। প্রতিশোধ কমপ্লিট হতনা। আমি ওকে তিলেতিলে মারব। আমাকে দেয়া কষ্টগুলো শতশত গুণ করে আমি ওকে ফিরিয়ে দিব”
আরো কিছু বলুক, কোন কষ্ট কিসের কষ্ট, সব খুলে বলুক লোকটা, মনেপ্রাণে চাইছে সিদ্রা। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আর কিছু বললনা লোকটা।
খাওয়া শেষে বলল, “খালা, আমি পাহারায় থাকছি, তুমি আজ রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমাও।” এই বলে আলমারি থেকে কয়েকটা জিনিস নিয়ে বের হয়ে গেল লোকটা।
খালা থালাবাটি এসব পরিষ্কার করে বাতিটা নিভিয়ে দিল। সিদ্রার গায়ের ওপর কিছু একটা চাপিয়ে দিল। হাত বুলিয়ে দেখল কাঁথা, মুচকি হাসি ফুটে উঠল সিদ্রার ঠোঁটে। খালার মন ওর প্রতি নরম হয়েছে, বুঝল সিদ্রা। আলহামদুলিল্লাহ্, পালাতে না পারলেও অনেক বড় উপকার হয়েছে আমার। শব্দে বুঝল, বিছানায় শুয়ে পড়ল খালা। পেটে ক্ষুধা নিয়েও বন্দী জীবনে প্রথমবারের মত মনে প্রশান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সিদ্রা।
***
একটা পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সিদ্রা। চারিদিকে অন্ধকার। সামনেই পূবাকাশে ভোরের আভাস দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ফর্সা হয়ে উঠছে চারপাশ। এত সুন্দর দৃশ্য কোনদিন দেখেনি সিদ্রা। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়, সারবেঁধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝ দিয়ে রূপালী ফিতার মত একটা নদী বইছে। ও যেটাতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাই যেন সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভোরের সূর্যোদয়ের দম আটকানো সৌন্দর্য উপভোগ করছে সিদ্রা। সারা পৃথিবী যেন সূর্যের আলোয় আস্তে আস্তে প্লাবিত হচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করল, ও একদম পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আর নিচে অতল খাদ মুখ ব্যাদান করে আছে। আচমকা কে যেন ধাক্কা মারল। পড়তে শুরু করল ও, চিৎকার করে উঠলো সজোরে, কিন্তু নিজে নিজের চিৎকার শুনতে পাচ্ছেনা। স্লো মোশানে নিচে পড়ছে তো পড়ছেই, তল পাচ্ছেনা কোন, এ অবস্থাতেই কেউ একজন ওর হাত ধরল। এসময় ঘুমটা ভেঙে গেল।
আতঙ্কিত হয়ে সোফায় সোজা হয়ে বসল সিদ্রা। পুরো শরীর ঘামে চপচপ করছে। অস্বাভাবিক ভাবে ঘুমানোর জন্য ঘাড় সোজা করতে পারছেনা। কোনমতে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হল সিদ্রা। বুঝলো, তাহাজ্জুদের সময় হয়ে গেছে বলেই ঘুম ভেঙেছে। বাথরুমে যাবার জন্য দরজা খুলতেই দেখল, দরজার বাইরেই লোকটা ওর ওই খাটে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। এমনভাবে যে, খাট না সরিয়ে ওইপাশে যাবার উপায় নেই।
কি করবে বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। লোকটার ঘুম ভেঙে গেলে হয়তো নামাজ পড়াই বাদ হয়ে যাবে। অন্যদিনের মত খাওয়ার পানি দিয়েই বরং অজু করে ফেলি। আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে নিঃশব্দে অজু নামাজ সেরে নিল সিদ্রা। আজকে আর বোকামি করলনা, মোনাজাতও আস্তে আস্তেই করল। তারপর সোফায় বসে জানালার ঠাণ্ডা বাতাসে চোখ বুজল। কি অদ্ভুত জায়গা, ভাবছিল সিদ্রা, যেন দুনিয়ার বাইরে কোথাও। পাখিদের কিচিরমিচির ছাড়া কোন শব্দও শুনতে পাইনা। আজানও শোনা যায়না, লোকালয় মনে হয় অনেক দূরে। জানালা দিয়ে ভোরের আলো প্রবেশ করতেই স্বপ্নের কথা স্মরণ হল সিদ্রার।
ভোরের আলো, তবে কি শিগগিরই মুক্তি পাব আমি! কিন্তু তারপরে তো আবার কে যেন ফেলে দিল খাদের ভেতরে। তাহলে কি আরো বড় বিপদে পড়ব? আবার কেউ একটা হাতও ধরল। কিন্তু পড়তে পড়তে হাত ধরলেই বা কি, বাঁচাতে তো পারবেনা। আদৌ কি কোন তাবীর আছে এ স্বপনের, নাকি পুরোটাই আমার কল্পনা, কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলনা সিদ্রা।
দরজা খুলে লোকটা ঘরে ঢুকতেই স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে এল সিদ্রা, তাকাল উনার দিকে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা চেহারা, মাথার চুল পুরো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে, একটু হাস্যকর আর বোকাবোকা দেখাচ্ছে লোকটাকে। সিদ্রাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে যেন একটু বিব্রত হল লোকটা। কিছু না বলেই বের হয়ে দরজা লাগিয়ে দিল বাইরে থেকে। এসবে এখন অভ্যস্ত সিদ্রা, আর কিছুই মনে হয়না। আর কালকের পর কেন যেন মনের বিশ্বাস বেড়েছে, পালাতে পারবে ও।
***
চুলায় ভাতের পাতিল বসিয়ে তরকারি কাটছে সিদ্রা। লোকটা হুকুম দিয়েছে, আজকে রান্নাবান্না সব কাজ সিদ্রা করবে। খালা অবশ্য আপত্তি করছিল, বুঝতে পেরেছে সিদ্রা, কিন্তু লোকটা মানেনি। সকালের নাস্তায় সবাই চা মুড়ি খেয়েছে, অবশ্যই চা টা সিদ্রাকেই বানাতে হয়েছে।
রান্না না করলেও মাঝে মাঝে আম্মুকে হেল্প করতো সিদ্রা। তরকারি কাটতে জানি, রান্নাও হয়ত করতে পারব। কিন্তু আমি এসব করছি কেন? আলু কাটতে কাটতে ভাবল ও। একজন অসুস্থ মানুষের জন্য রান্না করছি, নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিল সিদ্রা।
আজকে চুলা জ্বালাতে আগের দিনের মত কষ্ট হয়নি। লোকটা সেই আগের দিনের মত চেয়ারে আয়েশ করে বসে পা দুটো টেবিলে তুলে দিয়েছে। তবে পার্থক্য হল, আজকে সারাক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে না থেকে মোবাইল টিপছে আর মাঝেমাঝে তাকাচ্ছে। মোবাইলটা কোনভাবে হাত করে বাসায় ফোন দিতে হবে, ভাবছে সিদ্রা। কিন্তু আমি কোথায় সেটাই তো জানিনা, কি বলব আমি? অবশ্য আমি কোথা থেকে ফোন করেছি, সেটা হয়ত পুলিশ বের করতে পারবে। কিন্তু মোবাইলটা হাতে পেলে তো!
লোকটা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, ও কিভাবে বের হয়েছে ঘর থেকে। ও কোন উত্তর দেয়নি। বলে দিলেই যে জানালাটা আর থাকবেনা সেটা ও ভালই বুঝতে পারছে। লোকটা আর জোরাজোরি করেনি তখন, কিন্তু পরে আবার জানতে চাইবে বলে মনে হয়েছে সিদ্রার।
“মহারাণী, চুলা তো নিভে গেল” লোকটার কথায় বাস্তবে ফিরে আসল সিদ্রা।
Tabir mane ki?