#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ১২
-Farhina Jannat
১২.
লোকটা গাছে হেলান দিয়ে বসে মোবাইল টিপছে আর একটু পর পর সিদ্রার দিকে তাকাচ্ছে।
মেয়েটাকে যত দেখছে, আস্তে আস্তে অবাক হচ্ছে লোকটা। একদম চুপ করে মাথা নিচু করে গলা পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। সদ্যস্নাত চেহারাটা বড্ড নিষ্পাপ লাগছে। কিন্তু সে খুব ভাল করেই জানে, এই নিস্পাপ চেহারাটা একটা মুখোশ। ও একটা শয়তান মেয়ে। ওকে দেখলে কে বলবে, ওর ভেতরটা এত কুৎসিত! ওই নিষ্পাপ চেহারায় মায়ায় সে ফাঁসবে না। কিন্তু তার জানার সাথে মিলছেনা কেন মেয়েটার কোন কাজ। মানুষ কি এতখানি অভিনয় করতে পারে? কি জানি, এমন মেয়েরা হয়ত পারে।
যেমন, কালকে ও খালার জন্য যেভাবে সেবা করেছে, সেটা একেবারেই অকল্পনীয়। ওর মত একটা মেয়ে, যার কাছে মানুষের আবেগ-অনুভূতি খেলার জিনিস, সে ওই কাজটা কেন করল। প্রতিদিনের নামাজ-কালাম আর বেশী বেশী পর্দা করা যে ঢং, সেটা তো আমি আগেই বুঝেছি। কিন্তু কালকে ও যখন বের হতে পারল, তখন পালিয়েই তো যেতে পারতো। সেটা না করে খালার সেবা কেন করতে গেল, এখনো বুঝতে পারছিনা। এটাও কি আমার কাছে নিজেকে ভাল প্রমাণ করার চেষ্টা? হুম, সেটাই হবে, সিদ্ধান্তে পৌঁছল লোকটা।
পলপল করে বয়ে যাচ্ছে সময়, সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে, খেয়াল করল সিদ্রা। লোকটা বুঝতে চাইছেনা কেন, অবশ্য লোকটার যে ধারণা ওর সম্পর্কে তাতে ওকে বিশ্বাস না করাই স্বাভাবিক। কিন্তু লোকটার এসব ধারণার উৎস আর আমার এই দুর্ভোগের কারণ কি আমি কোনদিন জানতে পারব? ভাবছিল সিদ্রা। লোকটা না নিজে কিছু খুলে বলছে, না আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে। হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করলে সিদ্রা সাহস করে বলে উঠলো,
“আপনি এমন করছেন কেন? নামাজ কাযা হয়ে যাচ্ছে তো! আপনি না হয় নিজে নামাজ পড়েননা, তাই বলে কি অন্যকেও পড়তে দিবেননা?”
“এত জ্ঞান দিসনা তো, খুব নামাজের প্রতি মোহাব্বত দেখাচ্ছে, নটংকী কোথাকার। তোর মত মেয়ের মুখে এসব ধর্মের জ্ঞান শুনলে আরো রাগ উঠে আমার। তোকে কি আমি উঠতে না করেছি, নিজেই তো উঠছিসনা।“
“ধুর! সবসময় এক কথা” মনে মনে বলল সিদ্রা।
আস্তে আস্তে আলো কমে আসছে, দেখল সিদ্রা। তাকিয়ে দেখল লোকটাও অধৈর্য হয়ে উঠছে, উসখুস করছে। ফোনের কি চার্জ শেষ নাকি? এই অবস্থাতেও হাসি পেল ওর কথাটা চিন্তা করে।
“তুই কি সত্যিই উঠবিনা?” অবশেষে নিরবতা ভাঙল লোকটা।
“না” দৃঢ় স্বরে বলল সিদ্রা। ওর স্বরে কি যেন একটা ছিল, লোকটা উঠে দাঁড়ালো। “ঠিক আছে, আমি তোর কথা মানব, কিন্তু একটা শর্ত আছে”
“কি শর্ত?”
“আমাকে সত্যি সত্যি বলতে হবে তুই কাল ঘর থেকে কিভাবে বের হয়েছিস। যদি মিথ্যে বলিস, আমি তোকে সারারাত এই পানিতেই চুবিয়ে রাখবো।“
হা হয়ে গেল সিদ্রা, বলে কি লোকটা!
“আর আমি যে চাইলেই সেটা করতে পারি, তাতে আশা করি তোর কোন সন্দেহ নাই। সো, জলদি জলদি সত্যি কথাটা বলে দে”
ঢোক গিলল সিদ্রা, কি করবে বুঝতে পারছেনা।
“জলদি!” তাড়া দিল লোকটা।
ঠিক আছে, সত্যি বলে দেয়াই ঠিক মনে করল সিদ্রা। “আমি জানালা দিয়ে বের হয়েছি”
এবার লোকটার হা হওয়ার পালা। “তুই ওইটুকু একটা জানালা গলে বের হয়ে এলি! মাই গড!! তুই যে এত চিকনাচাকনা, তোকে দেখে তো বোঝা যায়না” কিছু বললনা সিদ্রা।
“আচ্ছা, তোর কথা আপাতত আমি বিশ্বাস করলাম, যাচ্ছি আমি খালাকে ডাকতে, তুই উঠে আয়” অনেকক্ষণ তো হল, যেই পোষাকে ও আমার সামনে উঠে আসছেনা, সেই পোষাকে ও পালাতে যাবেনা। আর সন্ধ্যে হয়ে আসছে, রাতের বেলা অচেনা জংগলে পালানোর সাহস হওয়ার কথা না। আরও বেশিক্ষণ থাকলে শেষে জ্বর বাঁধাবে, এসব ভেবে হাঁটা দিল লোকটা।
লোকটা গাছের আড়াল হতেই ভয় লাগতে লাগল সিদ্রার। বনে জঙ্গলে সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। আলো ফুরিয়ে আসছে। উনি যাওয়ার পর খালা আসতে আসতে তো রাত হয়ে যাবে, আর ততক্ষণ এখানে একা থাকলে আমি ভয়েই মরে যাবে। এত ঝোপঝাড়, সাপ-খোপ থাকা বিচিত্র নয়। তাড়াতাড়ি করে পাড়ে উঠলো সিদ্রা।
গায়ে সেঁটে থাকা বোরকাটা আলগা করার ব্যার্থ চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। না পেরে নিচের দিকটা একটু চিপে, ঝেড়ে নিল। ওড়নাটাও খুলে দ্রুত হাতে চিপে নিল, তারপর ঝেড়ে আবার গায়ে পেঁচাল এমনভাবে, যাতে যথাসম্ভব কম শরীর বোঝা যায়। এরপর বালতি নিয়ে নিচে নেমে পানি ভরলো। কিন্তু ভরা বালতি নিয়ে তো আর পাড়ে আর উঠতে পারেনা। খালি পানি পড়ে যায়। একবার তো পা পিছলে ধপাস করে পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথা পেল। কোনমতে ব্যথা সামলে উঠে ভাবল, লোকটা থাকলে হয়ত বালতিটা ধরতো। কি করবে এখন! এই পানি দিয়েই রাত পার করতে হবে ওর। আরও কয়েকবার চেষ্টার পর আধ বালতি পানি নিয়ে পাড়ে উঠতে সক্ষম হল। এবার কোমরের ব্যথাকে যথাসম্ভব অগ্রাহ্য করে দ্রুত পথ চলতে শুরু করল সিদ্রা। সন্ধ্যা হয়ে গেলে আর রাস্তা দেখতে পাবোনা, এই ভেবে হাঁটার গতি আরো দ্রুত করল। কিন্তু শীত করছে কেন এত? ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল সিদ্রা। শরীরটাও দুর্বল লাগছে, কিন্তু হাঁটা থামালনা। মাথাও ঘুরতে লাগল একটু পর। বুঝতেও পারলনা ও, রাস্তা ছেড়ে ঢুকে যাচ্ছে বনের মধ্যে।
***
গাছের আড়াল হলেও চলে যায়নি লোকটা। তার ধারণা ছিল মেয়েটা পালাবে, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল সিদ্রা কি করে। তাড়াহুড়ো করে পাড়ে ওঠা আর বালতি নিয়ে ওর নাজেহাল অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হাসছিল। আছাড় খাওয়া দেখে তো আরেকটু হলেই জোরেই হেসে ফেলেছিল, কোনমতে মুখে হাত দিয়ে আটকিয়েছে।
সিদ্রা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলে লোকটা পিছু নিল ওর। তারপর যখন ও রাস্তা ছেড়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল, রাগতে শুরু করল লোকটা। আচ্ছা, তাহলে ঠিকই ভেবেছি! দেখছি, তুই পালিয়ে কতদূর যাস!
কিন্তু একটু পর যখন হাত থেকে বালতি পড়ে গেল আর এদিক ওদিক আঁকাবাঁকা করে পা ফেলতে লাগল, তখন বুঝল লোকটা, মেয়েটা স্বাভাবিক নেই। দৌড়ে ওর কাছে যেতে না যেতেই আহ! করে একটা চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল সিদ্রা। লোকটা এসে দেখল একটা মোটা ডালে মাথা ঠুকে জ্ঞান হারিয়েছে ও। আর পায়ে একটা শুকনা কাঁটাওয়ালা ডাল বিধে আছে।
সিদ্রার গায়ে হাত দিতেই দেখল প্রচণ্ড তাপ বেরোচ্ছে গা দিয়ে। যা ভয় করেছিলাম, তাই! এতো ভারী জ্বালা হল। এজন্যই বলেছিলাম উঠে আসতে। আস্ত ত্যাঁদড় মেয়ে, সেই তো আমি দেখলামই ওর ভেজা জামাকাপড়। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়ানো।
প্রথমে টান দিয়ে কাঁটা ছুটাল লোকটা, রক্ত বের হল খানিকটা। তারপর বালতি থেকে হাতের চোলে পানি নিয়ে মুখে ছিটাল। ঘোরলাগা দৃষ্টি নিয়ে চোখ খুলল সিদ্রা। লোকটা ওর কথা বলার অপেক্ষা না করে আগের দিনের মত বাম কাঁধে সিদ্রাকে তুলে নিল। বুঝতে পারল, আগের দিনের থেকে কত হালকা হয়ে গেছে মেয়েটা। আজ আর বাধা দিলনা সিদ্রা, অবশ্য সেই হুঁশ থাকলে না দিবে।
ডান হাতে বালতিটা নিয়ে হাঁটা শুরু করল লোকটা। আরিব্বাস! গায়ের তাপে দেখি জামাকাপড় শুকিয়ে যাচ্ছে। একদিনেই মরে গেলে তো সব প্ল্যান মাটি হয়ে যাবে, জোরে পা চালাল লোকটা।