#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩১
-Farhina Jannat
৩১.
রাইয়্যান কাছে আসতেই পিছু হটলো সিদ্রা, কিন্তু ভুলে গেল যে বাথরুমের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। তার ফলে যা হবার তাই হলো, চৌকাঠে পা লেগে উলটে গেল পেছন দিকে, আ…… করে চিৎকার করে উঠলো সিদ্রা। ঠিক সময়ে ওর একটা হাত ধরে ফেলল রাইয়্যান, বাঁচিয়ে দিল আছাড় খাওয়ার হাত থেকে। পরমুহূর্তেই হ্যাঁচকা টান দিয়ে সোজা করলো ওকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় মোটামুটি হা হয়ে গেছিলো সিদ্রা। সেই হা করা মুখে থার্মোমিটার ঢুকিয়ে দিয়ে হাসতে লাগলো রাইয়্যান। সিদ্রার ভীত চোখমুখ দেখে মজা করে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিল ও, কিন্তু সেটা যে এতখানি কাজে দিবে ভাবতেও পারেনি।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থার্মোমিটার মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সিদ্রা। ভীষণ লজ্জা পেল ও, উনি আমার জ্বর মাপতে আসছিলেন আর আমি এমন উদ্ভট চিন্তা করছিলাম! ছি!! ছি!!!
এক মিনিট পর রাইয়্যান নিজেই ওর মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করে নিলে সম্বিৎ ফিরল ওর।
“যাক, নরমাল” স্বস্তির সুর রাইয়্যানের কন্ঠে। বিড়বিড় করে আলহামদুলিল্লাহ্ বলল সিদ্রা।
“আচ্ছা, তুই বাসায় একা থাকতে পারবি, আমি তাহলে খালাকে দেখে আসতাম”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন সিদ্রা, “হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন পারবোনা?”
“ঠিক আছে, আমি বেরোচ্ছি তাহলে”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল সিদ্রা, রাইয়্যান দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আবার।
“বুবুর বাসা থেকে খাবার আনিয়েছি, নিচে টেবিলে ঢাকা দেয়া আছে, খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবি”
“আপনি খেয়েছেন?” বলেই জিভে কামড় দিল সিদ্রা। উনি খেলেন কি খেলেন না, তাতে আমার কি? নিজের ওপর বিরক্ত হল ও।
“হুঁ” মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল রাইয়্যান।
***
বুবুকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে খালার কাছে রয়েছে রাইয়্যান। খালার জ্বর অবশেষে ছেড়েছে, এখন ঘুমাচ্ছে। টেস্ট রিপোর্ট এসে গেছে, নিউমোনিয়া হয়েছে খালার। কয়েকদিন এখানে ভর্তি থাকতে হবে খালাকে। সেটা শুনে চিন্তায় পড়ে গেছে রাইয়্যান। সিদ্রা মুখে কিছু না বললেও একা বাসায় ওর সাথে থাকতে সিদ্রা অস্বস্তি বোধ করবে এটা ভালই বুঝতে পারছে ও। বুবুর বাসার কাজের মেয়েটাকে বাসায় এনে রাখা যায়, কিন্তু ওর আর সিদ্রার আলাদা থাকার বিষয়টা চোখে পড়ে যাবে ওর। কাজের উসিলা দিয়ে ঢাকায় চলে যাব? নাহ! খালা আর সিদ্রা দুজনেই অসুস্থ, এই অবস্থায় কোথাও যাওয়া খারাপ তো দেখাবেই, আমারও মন মানবেনা। কি করি আমি এখন?
খালার ঘুম ভাঙল এসময়। আপাতত এসব চিন্তা বাদ দিয়ে নার্স কে ডাক দিল রাইয়্যান। নার্স এসে খাবার আর ঔষধ খাইয়ে যাবার পর খালা ওকে সিদ্রার কথা জিজ্ঞেস করল। সত্যি কথাই বলল ও। শুনে চিন্তিত হয়ে গেল খালা, ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলল।
“কেন খালা?” অবাক হল রাইয়্যান।
খালা জানাল, সিদ্রার দিনের বেলায় জ্বর ছেড়ে যায় আর রাতের বেলা আসে, আগেরবার খেয়াল করেছেন উনি। এবার রাইয়্যানও টেনশনে পড়ে গেল। এসময় ঝড়ের বেগে কেবিনে ঢুকল বুবু, পেছনে ঢুকল বুবুর বাসার কাজের মেয়েটা।
“এই তুই সিদ্রাকে বাসায় আটকে রেখে এসেছিস কেন?” ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল রাইয়্যানের, বুবু কিভাবে বুঝল!
“কি বলছো বুবু? আটকে রেখেছি মানে?” এমনভাবে তাকাল যেন আকাশ থেকে পড়েছে।
“আমি ওকে দেখতে গেলাম, মেয়েটা দরজা খুলতে পারলনা, বলল তুই নাকি চাবি নিয়ে গেছিস!”
“ও এই ব্যাপার! আসলে ও তো রেস্ট নিচ্ছিল, দরজা লাগাতে গেলে শুধুশুধু সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে হবে তাই আমি বাইরে থেকে লাগিয়ে এসেছি” সাবধানে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল রাইয়্যান।
“আচ্ছা, তা তুই ওকে ফোন কিনে দিসনি?” বুবুর কন্ঠে জেরার সুর।
“দিতে চেয়েছিলাম তো, ও নিজেই নিতে চায়নি। মোবাইল হাতে পেলেই নাকি ওর মন মানবেনা, বাসায় ফোন দিতে ইচ্ছে করবে, আর ওর আব্বু আম্মু ওকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাবে। কি অদ্ভুত মেয়ে, বুঝো”
“হুম, কিন্তু আমি খেয়াল করেছি, ও তোর সাথেও কেমন গুটিয়ে থাকে, ভালোবেসে বিয়ে করলে এমন তো হওয়ার কথা না। সত্যি করে বল, তুই আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস নাতো?”
“ছি ছি বুবু, তুমি আমাকে আবার সন্দেহ করছো! আরে, একবার ভেবে দেখো, ওর মত মেয়ের কি এমন কাজ করা সাজে? ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছে। এখন বেচারি অনেক গিল্টি ফিল করছে, কিছুতেই সহজ হতে পারছেনা। আর এর খানিকটা দোষ তো আমারও, সেজন্য আমাকেও শাস্তি দিচ্ছে”
“আহারে, এত ভাল মেয়েটা। ওর ফ্যামিলি যে কেন মানলনা তোকে। যাকগে, তুই কষ্ট পাসনা। ওর দিকটা একটু বুঝার চেষ্টা কর। তোকে ভালবাসে বলেইতো এতকিছু ত্যাগ করেছে। ওকে যেন কোনদিন পস্তাতে না হয়। তুই অন্তত ওকে কোনদিন কষ্ট দিসনা” অবশেষে বুবুর কন্ঠ থেকে সন্দেহের সুর দূর হতে দেখে হাঁফ ছাড়ল রাইয়্যান।
“না না, কোনদিন দিবনা, দেখো তুমি” বুবুকে পটানোর মত একটা হাসি উপহার দিল ও।
“দিবিনা তো, এখন কি করছিস? ওকে একা বাসায় রেখে এখানে বসে আছিস কেন?” ধমকে উঠল বুবু, হাসি বন্ধ হয়ে গেল রাইয়্যানের।
“ওর জ্বর তো ভাল হয়ে গেছে, ও-ই তো জোর করে পাঠাল আমাকে”
“গাধা! ও পাঠাল আর তুই ড্যাঙড্যাঙ করে চলে এলি। আমি মুক্তাকে নিয়ে এসেছি সাথে করে, ও খালার কাছে থাকবে। তুই চল আমার সাথে। অসুস্থ মেয়েটাকে একা রেখে এতক্ষণ এখানে বসে আছে! ইরেস্পন্সিবল ইডিয়েট একটা!” মাথায় জোরে একটা ঠোকনা মারল বুবু।
ড্রাইভ বুবুই করছিল, রাইয়্যানের বাংলো আগে পড়ে, ওকে নামিয়ে দিয়ে বুবু চলে গেল নিজের বাংলোর দিকে। অসুস্থ সিদ্রাকে দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল বুবুর। কিন্তু রাইয়্যানের সাথে কথা বলার পর বুবুর মনে হয়েছে, ওদের একটু স্পেস দেওয়া দরকার। বাসায় কেউ নেই, ওরা বরং নিজেদের মত একটু সময় কাটাক। আমার ভাইটা একটা আস্ত গাধা! প্রেম করেছে, কিন্তু রোমান্স বুঝেনা। নতুন বউকে নিয়ে হানিমুন তো দূরের কথা, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার নাম পর্যন্ত নিচ্ছেনা। এবার মেয়েটা সুস্থ হলে আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। গাড়ি পার্ক করতে করতে এসবই ভাবছিল বুবু।
***
হাত উঁচিয়ে বুবুকে বিদায় দিয়ে বাসায় ঢুকল রাইয়্যান, পুরো বাড়ি অন্ধকার। মাত্র তো রাত নটা বাজে, সত্যি সত্যি আবার জ্বর আসলনা তো? সিদ্রার ঘরে ঢুকে দেখল, শুয়ে পড়েছে ও। আলো জ্বালাতেই চোখ মেলল সিদ্রা, উঠে বসল বিছানায়। বিছানার কাছে এসে কপালে হাত দেয়ার আগেই কথা বলে উঠল সিদ্রা।
“জ্বর আসেনি আর”
“কখন মেপেছিস?” জিজ্ঞেস করলো রাইয়্যান।
“আমার কথা বাদ দেন, খালা কেমন আছে সেটা আগে বলেন”
রাইয়্যান ওর কথার উত্তর না দিয়ে ঔষধের পাতাটা হাতে নিল, একটা কম। যাক, ঔষধ খেয়ে নিয়েছে তাহলে, স্বস্তি পেল ও।
“উত্তর দিচ্ছেন না কেন?” অস্থির কন্ঠে বলল সিদ্রা।
“বলছি বলছি” বিছানার পাশের সোফাটাতে বসল রাইয়্যান, “খালার নিউমোনিয়া হয়েছে”
“আল্লাহ্! আমি কি করলাম এটা!” দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল সিদ্রা।
“আরে, আবার কাঁদে। এটা এত ভয়ংকর কিছু না, বয়স্ক মানুষদের ঠাণ্ডা লেগে হয়েই থাকে। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে”
“সত্যি বলছেন?” মুখ তুলল সিদ্রা।
“শুধু শুধু মিথ্যা কেন বলব? রাতের খাবার খেয়েছিস?”
“হুঁ”
“বেশ, তাহলে আর কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়। অন্তত একজন সুস্থ হয়ে আমাকে ধন্য কর” সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রাইয়্যান।
সিদ্রা কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুমানোর জন্য নয়। লোকটা যাওয়ার পর থেকে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে ও, শুধু দুইবার নামাজের জন্য উঠেছে। ও আন্দাজ করতে পারছিল, খালা হাসপাতালে থাকলে এই গোটা বাড়িতে ওই লোকটার সাথে একা রাত পার করতে হবে ওকে। তাই রাতে কিছুতেই ঘুমানো যাবেনা, জেগে থাকতে হবে। সেজন্য মাগরিবের পর কড়া করে এক মগ কফি বানিয়ে খেয়েছে আর বাগান থেকে একটা লাঠিও কুড়িয়ে এনে রেখেছে কম্বলের নিচে। এখন এই ভয়ংকর রাত ভালোয় ভালোয় কাটলে হয়!
লোকটা লাইট অফ করে দরজা টেনে চলে যাওয়ার পর কতক্ষণ পার হয়েছে জানেনা সিদ্রা, হঠাৎ দেখল দরজাটা খুলে যাচ্ছে। লোকটা লাইট না জ্বালিয়েই এগিয়ে আসছে কেন? কম্বলের নিচে লাঠিটা শক্ত করে ধরল সিদ্রা, কোন তেড়িবেড়ি দেখলে সোজা বসিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত। লোকটা বিছানার কাছে আসতেই ঘুমের ভান করে চোখ বুজল সিদ্রা।
কপালে হাত দিল লোকটা, ভয়ে সিদ্রার গোটা শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই হাতটা সরে গেল। হালকা করে চোখ ফাঁক করে সিদ্রা দেখল লোকটা চলে যাচ্ছে। ও, শুধু জ্বর দেখতে এসেছিলো! আলহামদুলিল্লাহ্! এতক্ষণ আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা সাবধানে ছেড়ে দিল সিদ্রা।
***
প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় গিয়ে রাইয়্যান দেখে আসছে সিদ্রাকে, আর তার ফাঁকে ল্যাপটপে কাজ করছে। সারাদিনে ধকল তো আর কম যায়নি, বারোটার দিকে হাই তোলা শুরু করল ও। আর কিছুক্ষণের মধ্যে কাউচে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েও পড়ল। ঘুম ভাঙল একেবারে চারটার সময়, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল রাইয়্যান। ততক্ষণে মনে পড়ে গেছে সিদ্রার জ্বরের কথা, তড়িঘড়ি করে উঠে ছুটল ও সিদ্রার ঘরের দিকে।
ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে এসে কম্বল সরিয়ে আরেকদফা চমকে গেল রাইয়্যান, বিছানা ফাঁকা। বাথরুমে গিয়েছে মনে হয়, নাহ! বাথরুমের দরজা খোলা। বারান্দা, সেখানেও নেই।
ড্রয়িংরুম, বাগান, রান্নাঘর, লাইব্রেরি সব জায়গা খুঁজে ফেলল রাইয়্যান, সিদ্রা কোথাও নেই। মাথার চুল খামচে ধরল দুহাত দিয়ে, মেয়েটা গেল কোথায়!?