#যে_গল্পের_নাম_ছিলনাবোনাস পর্ব-২ঃ
-Farhina Jannat
বোনাস পর্ব-২ঃ
আমিও না গাধা! এতোদিন পরে দেখা হয়েছে আর উনি সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিবেন নাকি!? উনি কি করে জানবেন, আমি গাধার মতো বিয়েতে হ্যাঁ করে দিয়েছি! ফোনটা বের করে কল লগে নাম্বারটার ওপর আঙুল বোলাল সিদ্রা। বাসায় ঢুকার একটু পরেই কল দিয়েছিল রাইয়্যান, ও ঠিকঠাক পৌঁছেছে কিনা জানতে। এবার আর জিজ্ঞেস করেনি সিদ্রা, ওর নাম্বার উনি কি করে পেলেন। যে মানুষ ওর সব খবর রাখে, তার পক্ষে একটা নাম্বার যোগাড় করা আর কি এমন কঠিন কাজ! কিন্তু প্রব্লেম টা হচ্ছে, নাম্বারটা ও সেভ করতে পারছেনা। কারণ, আজকেও উনার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি!
বারবার পড়তে পড়তে অবশ্য নাম্বারটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছে, সেভ না করলেও চলবে। কিন্তু যদি উনার কাছে ওর নাম্বার থেকেই থাকে, তাহলে এতদিন উনি কল করেন নি কেন? আর এতদিন ধরে যোগাযোগই বা কেন করেননি? এর মধ্যে আমার যদি বিয়ে হয়ে যেতো!
যদিও তিনমাসের জন্য নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একটা মেয়ের বিয়ে হওয়া যে কত কঠিন, তা হাড়ে হাড়ে বুঝে গিয়েছে সিদ্রা। কত ভালো ভালো প্রস্তাবই তো এসেছে, মানুষ ঠিক দায়িত্ব নিয়ে বিয়েগুলো ভেঙে দিয়েছে। যত নেককার দ্বীনদার মানুষই হোক, এমন একটা অতীতযুক্ত মেয়েকে বিয়ে করার সাহস কেউ করতে পারেনি। তবে কেউই রাজি হয়নি বললে অবশ্য ভুল হবে। বিপত্নীক, বয়স অনেক বেশি, বা আগের দু একটা বউ আছে, মানে নিজের কোন দুর্বলতা আছে, এমন কেউ কেউ রাজি হয়েছে, কিন্তু নিজাম সাহেব এসব প্রস্তাব এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন। আর এসব প্রস্তাবগুলোর খবর আনতো ওরই নিকটাত্মীয়রা। বলেনা, যার বিয়ে তার খবর নেই পাড়াপড়শির ঘুম নেই, ওর হয়েছে সেই অবস্থা। ওর বিয়ের টেনশনে কেউ যেন ঘুমাতে পারছেনা।
আব্বু আম্মু বা মুনিরা, কেউই এসব কথা ওর সামনে বলতো না। কিন্তু যাদের আনা প্রস্তাব আব্বু রিজেক্ট করেছেন, তারাই ওকে ফোন করে নিজেদের ঝাল মেটাত। এতো ভালো প্রস্তাব কোথায় পাবে, ছেলের বয়স বেশি তো কি হয়েছে, আগের বিয়ে ছিল তো কি হয়েছে, একটা বাচ্চা থাকলে কি সমস্যা, এতো বাছবিচার করার ইচ্ছা তো পালিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিলি কেন, এখন আবার সিনিয়র ডাক্তার পটানোর তাল করছিস নাকি, এমন আরও কত কি! নেহাত ভদ্র মেয়ে বলে মুখের ওপর ফোন রেখে দিতে পারতো না। কিন্তু এসবের জন্য দিনের পর দিন কতগুলো আইটেম যে পেন্ডিং হয়েছে, কতরাত যে শুধু চোখের পানি ফেলে পার করেছে, তার সাক্ষী শুধু ওই হোস্টেলের বালিশ আর কাঁথা।
মাঝে মাঝে জাহানারা বেগম অবশ্য দুর্বল হয়ে পড়তেন, মানুষের কথা শুনে শুনে মন বিষিয়ে উঠা অস্বাভাবিক কিছু তো না, রাগ করে এমন কারো সাথেই বিয়ে দিয়ে দিতে চাইতেন, কিন্তু নিজাম সাহেব সবসময় শক্ত কণ্ঠে থামিয়ে দিয়েছেন উনাকে।
কিন্তু যার সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম, সে কে? আমি তো কিছুই শুনলাম না। আর সেইবা কি, আমাকে না দেখেই রাজী হয়ে গেলো!? অবশ্য আব্বু আম্মুর কাছ থেকে ছবি দেখে থাকবে হয়ত। কিন্তু আব্বুরও পছন্দ হয়েছে, আর ছেলেটা সব জেনেশুনে বিয়ে করছে, কেমন যেন লাগছে ব্যাপারটা। আব্বু আম্মু কিছু লুকায়নি তো উনার থেকে? কিন্তু উনার ব্যাপারে সত্যিটা জানার পর আমি অন্য জায়গায় কিভাবে বিয়ে করবো? ধুর! কি যে ব্লান্ডার করলাম! রাগে ক্ষোভে বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠুকতে লাগল সিদ্রা।
***
ধানমন্ডির একটা কফি শপে বসে আছে সিদ্রা, অপেক্ষা করছে ওর হবু বরের জন্য। ফাইনালি বিয়েটা করছে ও, ডেটও ফিক্স হয়ে গেছে। কারণ এতো আশার আলো জাগিয়ে শেষ মুহূর্তে ফু দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়েছে লোকটা। সেদিনের পর আর যোগাযোগ তো করেইনি, উলটা মুনিরার কথামতো ও যখন নিজে ফোন করে জানাল যে, বাসা থেকে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করেছে, লোকটা কি করল? কতক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, “কংগ্রাচুলেশনস! তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল” কাওয়ার্ড একটা! আমাকে রাখতে এসে তো খুব আব্বু আম্মুর কাছে ক্ষমা চাইতে আসতে যাচ্ছিল, আর এখন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সাহস নেই! তাহলে আমি আর কি করতে পারি? বেহায়ার মতো তো আর বলতে পারিনা, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই!
চোখ মুছল সিদ্রা। ওর হবু বর লোকটা যে কেমন হবে! প্রথমে তো বলেছিল, দেখার দরকার নেই, এমনিই বিয়ে করবে, এখন আবার কি মনে করে দেখা করতে চাইল কে জানে। বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইতে পারে, কিন্তু তার জন্য দেখা করার কি দরকার!? নাকি আমার অতীত সম্পর্কে ক্লিয়ার হয়ে নিতে চায়!? যদি সেটা হয়, আমাকে যদি বিশ্বাস না করে, তাহলে তো বিয়ের প্রশ্নই উঠে না। ধুর! এতো ভেবে কি হবে। বিয়ে না হলে কি আমি মরে যাবো? মুনিরাটাও পুরো ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে, বাসায় গিয়ে ওকে মজা দেখাব আমি।
সিদ্রার সাথে থাকার কথা ওর, অথচ কফিশপে ঢুকার আগমুহূর্তে বলে কিনা, কোন টেইলার্সে নাকি ভুল মাপ দিয়ে ফেলেছে, না গেলে হবেইনা, বিয়ের পোষাক বানাতে নাকি ভুল করে ফেলবে। সিদ্রা বেশ বুঝতে পারছে, এসব ওর চালাকি, ও চাইছে আমি লোকটার সাথে একা মিট করি, কমফোর্টেবল ফিল করি। কিন্তু আমি যে ওর সাথে থাকলেই বেশি কম্ফোর্টেবল ফিল করতাম, সেটা যদি গাধীটা বুঝতো!
“আসসালামু আলাইকুম” পরিচিত কণ্ঠে চমকে দাঁড়িয়ে গেল সিদ্রা, উনি এখানে কি করছে!
“আপনি এখানে?” প্রশ্ন করল সিদ্রা।
“উম্ম, আমার ফিয়ন্সের সাথে মিট করতে এসেছি” ফোনের দিকে তাকাতে তাকাতে উত্তর দিল রাইয়্যান।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল সিদ্রার, এজন্যই আপনি আমার বিয়ের সংবাদ এতো ক্যাজুয়ালি নিয়েছেন! ফাইনালি নিজেও বিয়ে করছেন বলে! চোখে পানি চলে আসল ওর।
এসময় ওর ফোন বেজে উঠতেই তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ খুলল সিদ্রা, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে জ্বলজ্বল করছে “My Fiancée” নামটা। কফিশপে ঢুকার আগে মুনিরা সেভ করে দিয়েছে নাম্বারটা। এদিকওদিক তাকাল সিদ্রা কলদাতার খোঁজে।
“এই যে হ্যালো, আমি সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আপনি কোনদিকে তাকাচ্ছেন?” নিজের ফোনটা সিদ্রার চোখের সামনে ধরল রাইয়্যান। দুচোখ বিস্ফোরিত করে সিদ্রা দেখল, ডায়াল স্ক্রিনে ওর নাম্বার, উপরে লেখা “My Philosopher’s Stone”
কি হচ্ছে এসব!? সিদ্রা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল নিজের ফোনের স্ক্রিনে, আগে খেয়াল করেনি, নামের নিচে উঠে আছে কয়দিন আগে পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলা সেই নাম্বার। ওর হবু বরের জায়গায় উনার নাম্বার সেভ করা কেন? রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে দেখল, নিঃশব্দ হাসিতে ভরা লোকটার মুখ, দারুণভাবে উপভোগ করছে সিদ্রার হতভম্ব অবস্থা।
হঠাৎ সবটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল, না দেখতে চেয়ে সবকিছু জেনে বিয়ে করতে চাওয়া, মুনিরার কয়দিন ধরে মিটিমিটি হাসি, লোকটার সামনে না এসে পালিয়ে যাওয়া, সবটা। বাকহারা হয়ে চেয়ারে বসে পড়ে মাথা নিচু করল সিদ্রা, কারণ চোখ বেয়ে নেমে যাচ্ছে আনন্দাশ্রু। পরিস্থিতির এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে খুশিতে আত্মহারা হবে, নাকি সবটা ওর থেকে লুকিয়ে এ কয়দিন ওকে এতোটা কষ্ট দেয়ার জন্য রাগ হবে, ঠিক করতে পারছেনা ও। তার মানে আব্বু আম্মু উনাকে মেনে নিয়েছে, এটা কিভাবে সম্ভব!?
“আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা, আমাকে এবার একটু বুঝিয়ে বলবেন, প্লিজ?” নিজেকে সামলে বলল সিদ্রা।
“প্রথমেই তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, এ কটা দিন অন্ধকারে রাখার জন্য। সত্যি বলতে প্ল্যানটা মুনিরার ছিল। আংকেল এর থেকে শুনেছি, ও চেয়েছিল তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে। বিয়ের পর আমাকে বর হিসেবে দেখে নাকি তুমি দারুণ সারপ্রাইজড হতে”
মুনিরা ফাজিলটা! এভাবে ঠকালি আমাকে! তবে এটা সত্যি, সেটা আমার জীবনের সবথেকে বড় সারপ্রাইজ হতো, কিন্তু আজ যা পেলাম তাই বা কম কি!
“আমিও প্রথমে তেমনটাই ভেবেছিলাম, তোমাকে বিয়ের পর চমকে দিবো। কিন্তু পরে মনে হল, সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে কোন ভুল না হয়ে যায়!”
“মানে?” নিচু কণ্ঠে চোখ না উঠিয়েই বলল সিদ্রা।
“মানে, আমরা ভাবছি, তুমি আমাকে বর হিসেবে দেখে খুশি হবে, কিন্তু সেটা তো নাও হতে পারে। তোমার মতামতটা পরিষ্কার ভাবে জানা উচিত বলে আমার মনে হল”
“হুম, ঠিকই বলেছেন আপনি, কথা বলার দরকার আছে বৈকি। তবে স্যরি, আমাকে একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে” উঠে পড়ল ও।
“অর্ডারটা দিয়ে গেলে মনে হয় ভালো হত” বলল রাইয়্যান।
“আপনি যা ইচ্ছা দিয়ে দিন” হাঁটা দিল সিদ্রা ওয়াশরুমের দিকে।
ওয়াশরুমে ঢুকে এতক্ষণের চেপে রাখা খুশি প্রকাশ করতে ছোটখাটো একটা চিৎকার দিয়ে ফেলল সিদ্রা, লাফ দিতেও ইচ্ছে করছে, কিন্তু বিয়ের আগে আর পা ভাঙার রিস্ক নিলনা। কতবার যে আলহামদুলিল্লাহ্ পড়ল, তার ইয়ত্তা নেই। ফাইনালি নিজেকে শান্ত করে বেসিনে ভাল করে মুখ ধুয়ে মুছে কান্নার চিহ্ন দূর করল। নেকাব যে কত অপ্রস্তুত অবস্থা থেকে বাঁচায়, যারা পরে শুধু তারাই জানে, হাসল ও।
“স্যরি” ফিরে এসে বলল সিদ্রা। খেয়াল করে দেখল লোকটার মুখ এর মধ্যেই টেনশনে ছোট হয়ে গেছে, মুচকি হাসল ও। আমাকে এতো কষ্ট যখন দিয়েছেন, আমিও এতো সহজে ছেড়ে দিচ্ছিনা আপনাকে, দেখেন আপনি শুধু, মনে মনে বলল ও।
“ইট’স ওকে। কোল্ড কফি চলবে তো? নাকি এখনো ঠাণ্ডা লেগে আছে?” বলল রাইয়্যান।
“না, নো প্রবলেম। তাহলে কথা শুরু করা যাক” বলল সিদ্রা।
“শিওর! বলো, কি জানতে চাও”
“আমি যা যা জানিনা সেগুলো জানতে চাই” সিরিয়াস কণ্ঠ সিদ্রার।
“যেমন?”
“আপনার সাথে আমার বিয়ে কিভাবে ঠিক হল? আব্বু আম্মু রাজি হল কিভাবে?”
হাসল রাইয়্যান “সেটা আমার কাছেও একটা রহস্য! তুমি বরং বাসায় গিয়ে মুনিরার থেকে জেনে নিও, ও ভালো বলতে পারবে”
“আচ্ছা, কিন্তু ওর সাথে আমি বাসায় গিয়ে কথা বলব কিনা সেটা আগে ভাবতে হবে। ছাড়েন, আমি আম্মুর থেকে জেনে নিব। আপনি বরং বলেন, হঠাৎ আমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছে হল কেন আপনার?”
“হঠাৎ!?” বেদনাময় একটা হাসি দিল রাইয়্যান, “তুমি বোধহয় ভুলে গেছো, আমি সেই আট বছর আগেই তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তুমি এক্সেপ্ট করোনি”
“হুম, কারণ আপনি শুধু নিজের অপরাধবোধ থেকে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, আমি আপনার জীবনটা নষ্ট করতে চাইনি” তখন আপনার মনের কথা জানলেও কি একই কাজ করতাম আমি? কি জানি, হয়ত করতাম! মনে মনে বলল সিদ্রা।
“না সিদ্রা, অপরাধবোধ থেকে নয়। আমি সত্যিই তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম বলে প্রস্তাব দিয়েছিলাম”
“তাহলে এতো বছর পর কেন? আপনি তো আরও আগেই আসতে পারতেন”
“কারণ, আমি নিজেকে কখনও তোমার যোগ্য মনে করতে পারিনি……… সত্যি বলতে এখনও করিনা। তোমার মতো একজন হাফেজা দ্বীনদার মেয়ে আমার থেকে অনেক ভালো ছেলে ডিজার্ভ করে। শুধু আমার একটা ভুলে আমি তোমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছি”
“তাহলে প্রস্তাব দিলেন যে!?” সিদ্রার কাটা কাটা কথায় বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে রাইয়্যানের। তবে কি ও আমাকে পছন্দ করেনা!? আমি তো ভেবেছিলাম, তানজিয়াকে আমার ওয়াইফ ভেবে রাগ করে ও বিয়েতে রাজি হয়েছে, সেজন্যই তো মুনিরার প্ল্যানে রাজি হয়েছিলাম! তবে কি সেটা ভুল ছিল? আমাকে দেখে, আমার বিয়ে হয়নি শুনে আনন্দে ওর চোখ নেচে ওঠা, সেগুলো কি তবে আমি ভুল দেখেছিলাম!? বিয়েটা ভেঙে যাবে নাতো? বুকটা মোচড় দিল রাইয়্যানের।
“কারণ, আমি এতোগুলো বছর অপেক্ষা করেছি তোমার বিয়ে হওয়ার জন্য” উত্তর দিল রাইয়্যান।
“কি?” আকাশ থেকে পড়ল সিদ্রা, উনি আমার জন্য সারাজীবন অবিবাহিত থাকতে চেয়ে আমারই বিয়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন!
“হুম! স্টুডেন্ট অবস্থায় বিয়ে করলেনা, ভাবলাম চাকরি পাওয়ার পর করবে। তারপরেও ছয়মাস কেটে গেল, বিয়ে করলেনা। তবে আমি যতদূর জানি, করোনি না, বিয়েগুলো হয়নি। আর তার পেছনে আমিই দায়ী! তারপরেও কোন মুখে আংকেল আন্টির সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম! ফাইনালি যখন তোমার পোস্টিং শ্রীমঙ্গলে হল, তখন আমি আশার আলো দেখতে পেলাম। মনে হল যেন এটা আল্লাহ্র ইশারা। আমি এস্তেখারা করলাম, সেখানে পজিটিভ রেজাল্ট পেয়েই আমি সাহস করে প্রস্তাব নিয়ে আসি”
“পজিটিভ রেজাল্ট কিভাবে বুঝলেন?”
“সেটা আমি এখন তোমাকে বলবোনা। বিয়ের পর বলব, ইন শা আল্লাহ্”
“আমি কিন্তু এখনও সম্মতি দেইনি” শক্ত কণ্ঠে বলল সিদ্রা।
আবার বুকটা কেঁপে উঠল রাইয়্যানের, এমন করছে কেন ও?
“হুম, সেজন্যই তো ইন শা আল্লাহ্ বললাম” মুখ কাল করে বলল রাইয়্যান। সিদ্রা দারুণ মজা পাচ্ছে লোকটার এই নাজেহাল অবস্থা দেখে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার কথা শুরু করল রাইয়্যান,
“সিদ্রা, আমি হাফেজ আলেম নই, যেমনটা তুমি আশা করো তোমার হাজবেন্ড হিসেবে। তবে তুমি চলে আসার পর, তোমাকে দেয়া কথা অনুযায়ী নিজেকে সাধ্যমতো বদলানোর চেষ্টা করেছি, একজন সত্যিকার মুসলিম এর মতো দিন যাপন করার চেষ্টা করেছি। তোমার জন্য কেনা রিয়াদুস সালেহীন যে আমার কতটা হেল্প করেছে, তুমি জানোনা। আমি এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে না পারলেও জামাতে পড়ার চেষ্টা করি। অফিসে টাইমলি জামাতে নামাজ পড়ার নিয়ম চালু করেছি। নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করি, হাদীস পড়ার চেষ্টা করি। আমি তোমার যোগ্য কোন দিক থেকেই নই, তবু অনেক আশা নিয়ে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। হযরত আলী (রা) যখন মা ফাতিমা (রা) কে বিয়ের প্রস্তাব দেন, সাধারণ দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন কপর্দকশূন্য। একটা বর্ম ছাড়া উনার কাছে কিছুই ছিলনা। তবু তিনি সাহস করে নবীনন্দিনীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার ক্ষেত্রে অবস্থা পুরো উল্টো। দুনিয়াবি সম্পদের আমার অভাব নেই, দুনিয়ায় এমন কিছু নেই, যা আমি তোমাকে চাইলে এনে দিতে পারবনা। কিন্তু আখিরাতে হয়ত আমার হাত কপর্দকশূন্য থাকবে। এ কয় বছরে আমি আখিরাতের জন্য তেমন কিছুই উপার্জন করতে পারিনি। নাহয় হাশরের ময়দানে তোমার স্বামী হওয়ার উসিলায় আল্লাহ্র কাছে নাজাত চাইব। কিন্তু…….”
“চুপ করুন আপনি” কান্নামাখা কণ্ঠে বলল সিদ্রা, “আমাকে এতো উপরে তুলবেননা প্লিজ, আমি এতো মহান কেউ নই। আমি আপনার যোগ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলিনি, নিজেকে এতো ছোট কেন ভাবছেন আপনি!? আমারই ভুল, আপনাকে শুধু শুধু অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেললাম, স্যরি” চোখ উপরে তুলে রাইয়্যানের দিকে তাকাল সিদ্রা।
সিদ্রার কান্নাভেজা চোখ দেখে আর এমন ব্যথিত কণ্ঠ শুনে রাইয়্যানের বুকটা যেন ভেঙে গেল।
“তুমি কেন স্যরি বলছো, অপরাধী তো আমি। ওই তিনমাস তোমাকে এতো কাঁদিয়েছি যে, নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলে আমার জন্য তোমার চোখে জল আসতে দিব না। কিন্তু সেই তোমাকে কাঁদিয়েই ফেললাম। আমার আসলেই তোমাকে পাবার কোন অধিকার নেই। আমি আজকেই আংকেলের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসব, আর কোনদিন তোমার সামনে আসার দুঃসাহস করবনা”
“একদম না! যদি এমন কিছু করেছেন না, বিয়ের পর আপনার খবর করে ছাড়ব আমি!” মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে গেল সিদ্রার।
“আচ্ছা ঠিক আছে…………এক মিনিট! কি বললা তুমি!” প্রথমে রাইয়্যান বুঝেনি সিদ্রা কি বলেছে, পরক্ষণেই বুঝতে পেরে চোখে পানি চলে আসল ওর “ইয়েস, আলহামদুলিল্লাহ্! আলহামদুলিল্লাহ্! আলহামদুলিল্লাহ্!” খুশির চোটে দুমদুম করে টেবিলে কয়েকটা কিল মেরে বসল রাইয়্যান।
আশেপাশের টেবিল থেকে মানুষজন চমকে তাকাতেই সিদ্রা লজ্জায় মাথা নিচু করে প্রথমবারের মত কোল্ড কফিতে চুমুক দিল। এতক্ষণ খাবার কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। কোল্ড কফি আর কোল্ড নেই, পানি হয়ে গেছে।
“ওয়েট, কফিটা মনে হয় আর খাওয়ার মত নেই, নতুন আরেকটা দিতে বলি?” আনন্দ যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে রাইয়্যানের চোখমুখ থেকে, কণ্ঠস্বরেও তার ছোঁয়া পাওয়া গেল।
“জ্বী না। জানেননা, খাবার নষ্ট করতে নেই, আজকে এই পানি কফিই খেতে হবে। শুধু শুধু একটা ঘণ্টা নষ্ট করার শাস্তি দুজনের!”
“মানে?”
“আপনার আর মানে বুঝে কাজ নেই, চুপচাপ খেয়ে নিন। মাগরিবের আজান দিল বলে”
“হুম, ঠিক বলেছো” কফিতে চুমুক দিল রাইয়্যানও। চোখের হলটা কি, খালি পানি চলে আসছে, ট্রের উপর থেকে টিস্যুটা টেনে নিল ও।
***
সিদ্রাদের বাসার সামনে গাড়ি থামাল রাইয়্যান। সালাম দিয়ে গাড়ি থেকে নামল সিদ্রা। তারপরেই আবার পেছনে ঘুরল,
“ওইদিন বাসায় আসতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু আজকে আসতে বলছি, রাতে খেয়ে যান”
“ওরে বাবা! বিয়ের আগে আর ঢুকছিনা! বিয়ের পর একবারে জামাই আদর খাব”
“আচ্ছা, আপনি যা ভালো বুঝেন!” আবার গালদুটো লাল হয়ে গেছে সিদ্রার। ভদ্রতার খাতিরে আসতে বললেও মনে মনে চাইছিল যেন লোকটা না আসে। আব্বু আম্মুর সামনে লজ্জায় মাথা তুলতে পারতো না নাহলে। হঠাৎ জরুরী কথাটা মনে পড়ল ওর, “এক মিনিট! আপনার নামটা বলবেন প্লিজ!” লাজুক কণ্ঠে বলল ও।
“হোয়াট! তুমি তোমার হবু বরের নাম জানো না! লজ্জা লজ্জা!”
“বলবেন, না বলবেন না?” কপট রাগ দেখাল সিদ্রা।
“বলব না, এতো দিন যখন জানতে ইচ্ছে হয়নি, তখন একেবারে বিয়ের আসরেই শুনে নিয়ো। আল্লাহ্ হাফেজ” গাড়ি স্টার্ট দিল রাইয়্যান।
“আরে, শুনেন শুনেন!” কে শুনে কার কথা, গাড়ি ততক্ষণে এগিয়ে গেছে, জানালা দিয়ে বের করে নাড়তে থাকা হাতটা শুধু দেখা গেল গলির শেষ মাথা পর্যন্ত।
“ধুর! ফাউল লোক!” বিরক্ত মুখে গেইট ঠেলে ভেতরে ঢুকল সিদ্রা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মোবাইল বের করল ও, মাগরিব এর সময় কতটা যে পেরিয়েছে, আল্লাহ্ মালুম। বাসার ওয়াইফাই কানেক্ট হয়ে ফেসবুকের নোটিফিকেশন আসা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। দেখল, নতুন নোটিফিকেশন আসল মাত্র, “Mu’tasim Billah Raiyan sent you a friend request” আর পরক্ষণেই “Mu’tasim Billah Raiyan sent you a message request”
একটা বিট মিস করল সিদ্রার হার্ট, বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলনা, এটাই সেই কাঙ্ক্ষিত নাম, যা গত আট বছর ধরে না জানার জন্য আফসোস করেছে। তবু শিওর হওয়ার জন্য ওপেন করল মেসেজটা। “রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে রাখলাম, বিয়ের পর এক্সেপ্ট করলেও চলবে” নিচে একটা চোখ টিপ দেয়া ইমোজি, মুখটা হাসিতে ভরে উঠল ওর। “রাইয়্যান” অস্ফুট স্বরে নামটা উচ্চারণ করে দুচোখ বুজে ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে কলিংবেল চাপল সিদ্রা।
***
নামাজটা পড়েই আম্মুর থেকে সবটা শুনল সিদ্রা। ও সিলেট চলে যাওয়ার পরদিন রাইয়্যান এখানে আসে। নিজের পরিচয় দেয়ার পর নিজাম সাহেব চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছিলেন ওকে, তখন মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে দুহাত জোড় করে ক্ষমা চায় ও। তারপর এতোদিন পর আসার কারণ জানতে চাইলে, সবটা খুলে বলে রাইয়্যান। কিভাবে সিদ্রা চলে আসার পর নিজেকে পরিবর্তন করেছে, আর কেন এতোদিন পর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, সবটা। কিন্তু যেই ছেলের জন্য মেয়ের জীবনের এই দুর্দশা, তার কাছে থেকেই বিয়ের প্রস্তাব শুনে আর নিজেকে থামাতে পারেনি ওর আব্বু, সোজা মেরে বসেন রাইয়্যানকে। এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি খেয়েও টলেনি রাইয়্যান, সবকিছু বিবেচনা করে দেখার জন্য অনুরোধ করে সেদিনের মতো চলে যায়।
রাইয়্যানের ভাগ্য ভালো, মুনিরা সিদ্রাকে বিদায় জানানোর জন্য শশুরবাড়ি থেকে এসে তখনও ফিরে যায়নি। ঘটনা শুনে আনন্দের চোটে সিজদায় পড়ে যায় ও। ব্যাপার দেখে অবাক হয়ে যায় নিজাম সাহেব আর জাহানার বেগম। তখন মুনিরা তাদের কাছে সিদ্রার মনের কথা খুলে বলে, বলে যে সিদ্রাও উনার অপেক্ষায় বসে আছে। কিন্তু মুনিরা একবার সিদ্রার সাথে যা করেছে, তারপর আর অন্ধভাবে ওকে বিশ্বাস করতে পারেননি তারা। সেজন্যই সিদ্রাকে সবটা জানানোর সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু সিদ্রা তো কিছু না শুনেই রাজি হয়ে গেল, যেটা তারা ভাবতেও পারেননি। মুনিরার কথার সাথে ব্যাপারটা মিলছিল না। কিন্তু রাইয়্যানের ব্যাপারে সব খোঁজখবর নিয়ে ততদিনে মন প্রসন্ন হয়েছে নিজাম সাহেবের। আর জাহানারা বেগম তো প্রথম থেকেই রাজি, এই মেয়ের বিয়ে কোনভাবে দিতে পারলেই উনার শান্তি।
তাই যেভাবেই হোক, সিদ্রা রাজি হয়েছে বিয়েতে, এতেই তারা খুশি হয়ে যান, আর রাইয়্যানকে ফোন করে নিজেদের সম্মতি জানান। ফোনটা করেছিলেন সেসময়, যখন রাইয়্যান সিদ্রার সাথে রেস্টুরেন্টে ছিল। উনি এটাও জানান যে, সিদ্রা ওর সম্পর্কে না জেনেই বিয়েতে রাজি হয়েছে। রাইয়্যান সাথে সাথে বুঝে যায়, সিদ্রা কেন বিয়েতে রাজি হয়েছে, আর সেটা নিজাম সাহেবকেও খুলে বলে। ব্যস! সিদ্রা যে রাইয়্যানের বিয়ে হওয়ার জেলাসিতেই নিজের বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে, এতে আর কোন সন্দেহ থাকেনা। তাই তারাও মুনিরার পরামর্শ মতো সিদ্রাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য সবটা চেপে যান। কিন্তু বিয়ের আয়োজনে মেয়েকে মনমরা দেখতে ভালো লাগছিল না নিজাম সাহেবের। নিজের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে হবে, অথচ মেয়েটা বিয়ের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেনা, এটা মানতে পারলেননা তিনি। তাই ওদের দেখা করানোর সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর আর মুনিরার ওপর কি করে রাগ করে থাকবে সিদ্রা, ও না বললে বিয়েটাই তো হতনা! তারপরেও ওকে শিক্ষা দেয়ার জন্য কৃত্রিম রাগ করে কথা বলছিলনা সিদ্রা ওর সাথে। কিন্তু মুনিরা যখন এসে বলল, “একবার তোকে লুকিয়ে তোর জীবন নষ্ট করেছিলাম, তাই আবার তোকে লুকিয়ে তোর জীবনটা ঠিক করে দিতে চেয়েছিলাম রে, তুই এতো কষ্ট পাবি জানলে করতামনা” তখন আর রাগ করে থাকতে পারল না। বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সিদ্রা, “তুই এবার কোন ভুল করিসনি। একদম ঠিক করেছিস। বাসর রাতে উনাকে দেখার পর যে আমার কি হত, আমি ভাবতে পারছিনা”
“থালামুনি তোমলা কাঁদতো কেন? তোমাদেল কি কেউ বকেতে?” পাশ থেকে বলে উঠল মুনিরার দুই বছরের মেয়ে মানহা। হো হো করে হেসে উঠল দুই বোন।
***
ঘাসের উপর উল্টো হয়ে শুয়ে আছে সিদ্রা, সমস্ত মনযোগ সামনে খোলা বইয়ের পাতায়। পাশে বসে ওর দুপাশে এলিয়ে পড়া খোলা চুলগুলো নিয়ে খেলা করছে রাইয়্যান।
“উফ! কি করছো! এতো ইন্টারেস্টিং একটা জায়গা পড়ছি, ডিস্টার্ব করছো কেন?” বিরক্ত কণ্ঠে বলল সিদ্রা। ফারহানের কবর জিয়ারতের সাথে সাথে ঝর্ণার ধারে পিকনিক করতে এসেছে দুজনে। কবর জিয়ারতের পর নাস্তা করেছে, আর তারপরেই সিদ্রা ব্যাগ থেকে কি একটা বই বের করে পড়তে বসে গেছে।
“ধুর! এখানে কি তোমাকে আমি বই পড়তে এনেছি!” আরও বেশি বিরক্ত কণ্ঠে বলল রাইয়্যান।
“তা কি জন্যে এনেছো শুনি? আমার তখন কত ইচ্ছে করতো জানো, এই ঝর্ণার ধারে বসে, ঝর্ণার মিষ্টি আওয়াজ শুনতে শুনতে বই পড়ব! তখন তো আর সাথে বই ছিলনা। সেজন্যই তো আজ ইচ্ছে পূরণ করছিলাম” মুখ ভার করে উঠে বসে বই বন্ধ করল সিদ্রা।
“আপনার ইচ্ছেপূরণ করার জন্য না সারাজীবন পড়ে আছে ডাক্তার সাহেবা! খালার সাথে এসে এসে আপনি ইচ্ছেপূরণ কইরেন, কেমন? এখন এদিকে আসেন” হাত ধরে টেনে তুলল সিদ্রাকে রাইয়্যান।
জলাশয়ের একদম কিনারে নিয়ে এল ওকে, তারপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। সিদ্রাও বসল পাশে, রাইয়্যানের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল। “গান শুনবে?” নরম কণ্ঠে বলল রাইয়্যান।
“উঁহু! কুরআন তেলাওয়াত শুনব” রাইয়্যানের দিকে তাকাল সিদ্রা, “সেদিন তোমার গান শুনে আমার সবার প্রথম কি মনে হয়েছিল জানো? আহ! এতো সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত! কতইনা মধুর শোনাবে। তাই, তুমি আমাকে এখন কুরআন তেলাওয়াত শুনাবে”
“হায় আল্লাহ! বলে কি?” জিভে কামড় দিল রাইয়্যান, “আমি তো মাত্র কুরআন তেলাওয়াত শিখেছি, ভালো করে পারিনা, সুন্দর করে শিখে নিয়ে শুনাব, ওকে? আজ বরং তুমি শোনাও। তোমার তেলাওয়াত শুনেই তো আমি প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলাম!”
“কি! আমার তেলাওয়াত শুনে! কবে?” অবাক হয়ে তাকাল সিদ্রা।
“হুম, ওই যে টিলাটার উপর দাঁড়িয়ে” আঙুল তুলল রাইয়্যান “চোখ বন্ধ করে কুরআন তেলাওয়াত করছিলা! সূর্যের প্রথম রশ্মি এসে পড়েছিল তোমার উপর। কমলা রঙের ওই অতি সস্তা একটা জামাতেও কি অপূর্ব লাগছিল তোমায়! যেন ঝলমল করছিলে! আমি চোখ বন্ধ করলেই তোমার সেদিনের ওই স্নিগ্ধ পবিত্র রূপটা দেখতে পাই জানো?”
নিজের এমন প্রশংসা শুনে গাল দুটো যথারীতি লাল হয়ে গেল সিদ্রার। রাইয়্যান মুচকি হেসে ওর গালে টোকা দিল, “আর লজ্জা পেতে হবেনা, এবার শুরু করো”
“না, না, আমি না, তুমি” রাইয়্যানের হাত ধরে ঝুঁকাতে লাগল সিদ্রা, “প্লি……জ”
“আচ্ছা, কিন্তু আগে প্রমিস করো, হাসবানা শুনে?”
“আজব তো! হাসব কেন!?”
“ওকে” সোজা হয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসল রাইয়্যান, “আরে, ওইভাবে তাকিয়ে থাকলে কিভাবে পড়বো!? এমনিতেই তোমার সামনে জান ধকধক করছে!”
“আচ্ছা, আচ্ছা, তাকাচ্ছি না! তুমি তেলাওয়াত করো” দুষ্টুমি হাসি দিয়ে ঝর্ণার দিকে তাকাল সিদ্রা। কিন্তু রাইয়্যান তেলাওয়াত শুরু করতেই আর অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলনা ও। রাইয়্যান যে সূরা নাজম তেলাওয়াত করছে, যেখানে “সিদ্রাতুল মুনতাহা”র কথা উল্লেখিত আছে। চোখ বন্ধ করে পুরো সূরাটা তেলাওয়াত করে থামল রাইয়্যান। চোখ খুলে দেখল সিদ্রা হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হাত দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিল রাইয়্যান, “মশা ঢুকে যাবে তো!”
“মা…শা…আল্লাহ্! আনবিলিভেবল! তুমি তো আমার কল্পনার থেকেও সুন্দর তেলাওয়াত করেছো! তাও আবার তিন পৃষ্ঠার এতোবড় একটা সূরা মুখস্থ!”
“আমার সবথেকে প্রিয় মানুষটার নাম যে আছে এই সূরায়, বুঝতে হবে!” গর্বিত ভঙ্গিতে বলল রাইয়্যান।
“আচ্ছা, তাই বুঝি! সূরা ইয়াসিন মুখস্থ করেছো?” ভ্রু নাচাল সিদ্রা।
“ইয়ে মানে, ওইটা তো অনেক বড়!”
“আ হা হা! আমার নাম আছে বলে এই সূরাটা মুখস্থ করে ফেলেছেন উনি। আর যেই সূরাকে পুরো কুরআনের হার্ট বলা হয়, যে সূরার ফযিলত সবথেকে বেশি, উনি সেটা মুখস্থ করেননি”
“এভাবে বলছো কেন? তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা টা তো দেখো” ব্যথিত কণ্ঠ রাইয়্যানের।
“আ হা হা! ভালোবাসা দেখাচ্ছেন উনি! আল্লাহ্কে, আল্লাহ্র রাসূলকে আগে ভালবেসে তারপর আমাকে ভালবাসতে হবে”
“কি করবো বলো? তোমাকে ভালবেসেই তো আল্লাহ্ আর আল্লাহ্র রাসূলকে ভালবাসার সুযোগ পেয়েছি। আর তাছাড়া নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসা গুনাহ না, হুহ!”
“এহ! যখন এটা মুখস্থ করেছো, তখন আমি তোমার স্ত্রী ছিলামনা”
“কিন্তু তখন তো আমার ইসলাম সম্পর্কে এতো জ্ঞানও ছিলনা। আচ্ছা, এখন কি তুমি আমাকে শুধু বকাঝকাই করবে”
“আরে ধুর! তোমাকে একটু জালালাম। আমি সত্যিই ভাবতে পারছিনা, শুধু আমার নাম আছে বলে তুমি এতো বড় সূরাটা পুরোটা মুখস্থ করে ফেলেছো, তাও আবার এতো সুন্দর করে! আমি সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী। পৃথিবীতে আর কোন স্বামী তার স্ত্রীকে এমন উপহার দিয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তুমি আমাকে বিয়ের পর থেকে এ কয়দিনে অনেক কিছু দিয়েছো। বাট বিলিভ মি, ইট ওয়াজ দা বেস্ট! তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই আমার কাছে” চোখে পানি চলে এসেছে সিদ্রার, সেটা আলতো করে মুছে আবার কাঁধে মাথা রাখল ও, “কিন্তু তুমি আমাকে এখনও বলনি, তুমি কিভাবে এস্তেখারা পজিটিভ বুঝলে?”
“আমি স্বপ্নে দেখলাম, এখানে এইভাবে আমরা দুজন বসে আছি, আর আমি তোমাকে কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাচ্ছি। এজন্যই তো আজকে এখানে আনলাম তোমায়।”
“সত্যি?” অবাক চোখে তাকাল সিদ্রা।
“জ্বী ডাক্তার সাহেবা, সত্যি” কিছুক্ষণ রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে থাকার পর আবার জিজ্ঞেস করলো সিদ্রা, “আচ্ছা, সত্যি করে বলতো, তুমি কি আল্লাহ্র কাছে আমাকে পাওয়ার জন্য দোয়া করতে?”
“উঁহু! বললাম না তোমায়, নিজেকে তোমার যোগ্য ভাবতে পারিনি, তাই আল্লাহ্র কাছে চাইতেও সাহস হয়নি। তবে এটা বলতাম যে, ও যাকে পাবে, সে যেন আমার থেকেও ওকে বেশি ভালোবাসে। আমার তো বিয়ে করার ইচ্ছেই ছিলনা, কিন্তু যখন থেকে জানলাম যে, বিয়ে করা রাসূলের সুন্নত, বিয়ে করলে অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ হয় আর উত্তম জীবনসঙ্গী লাভের দোয়াটাও পেলাম, তখন থেকে মোনাজাতে দোয়াটা পড়তাম, আর ভাবতাম যে, কপালে থাকলে হবে। ততদিনে জেনে গেছি যে, কাউকে নির্দিষ্ট করে চাইতে নেই। কিন্তু আমি তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম, তোমার থেকে উত্তম জীবনসঙ্গী আর কেউ হতেই পারেনা। তাই মুখে ওই দোয়া পড়লেও মনে মনে ঠিকই তোমাকে চাইতাম। আর আল্লাহ্ তো অন্তর্যামী, তাইনা?” সিদ্রার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপতে গেল রাইয়্যান, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল, ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
“এমা, তুমি কাঁদছো কেন?” দুহাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরল রাইয়্যান।
“আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা, আল্লাহ্ আমার কপালে এতো ভালোবাসা লিখেছিলেন! অথচ এক সময় কত নিরাশ হয়েছি, ভেবেছি সারাজীবন মিছেই পার হয়ে যাবে, কোন সুখ আহ্লাদ ভালোবাসা ছাড়াই। এতো ভালোবাসা পাবার কি আদৌ যোগ্যতা রাখি আমি!?” দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়েই যাচ্ছে সিদ্রার।
দুহাত দিয়ে পানিগুলো মুছে দিল রাইয়্যান। “আরে বোকা, এটা বুঝতে পারছোনা, তুমি তোমার অমন বিপদের সময়ও আল্লাহর উপর বিশ্বাস হারাওনি, প্রতি মুহূর্তে ভরসা করেছো, সেজন্যই তো আল্লাহ্ খুশি হয়ে তোমাকে দুনিয়াতেই একটা আস্ত মানুষ পুরস্কার হিসেবে দিয়ে দিয়েছেন”
রাইয়্যানের কথার স্টাইলে হেসে ফেলল সিদ্রা।
“কিন্তু আমি বুঝে পাইনা, সারাজীবন অবহেলায় কাটিয়ে এতো বড় পাপ করার পরেও আমি তোমাকে কিভাবে পেলাম! এতোবড় ভাগ্য আমার হল কি করে!?” বলল রাইয়্যান।
“কারণ, তুমি অনুতপ্ত হয়েছো এবং তাওবা করেছো। আর আল্লাহ্ তাওবাকারীকে অনেক ভালোবাসেন, বুঝলেন মশাই” রাইয়্যানের কপালে গুঁতো দিলো সিদ্রা।
“বুঝলাম, মাই ফিলোসফার স্টোন! কিন্তু……. তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি!”
“কোন প্রশ্ন?”
“তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা?”
“ও, দিইনি না…..” চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল সিদ্রা। তারপর আচমকা উঠে দৌড় দিল, “আর দিবোওনা” একটু দূরে গিয়ে হাসতে হাসতে বলল ও।
“দিবানা মানে? না দিয়ে যাবা কোথায়!?” পেছনে পেছনে ছুটল রাইয়্যানও। এভাবে ছুটাছুটি করতে করতে ঝর্ণার একদম কাছে চলে গেল সিদ্রা, পেছনে তাকিয়ে ছিল বলে বুঝতে না পেরে হড়কে গেল পা, ধপাস করে পড়ে গেল জলাশয়ের পানিতে। রাইয়্যানও কিনারে এসে হাসতে লাগল,
“কেমন? আমাকে মজা দেখাতে গিয়ে নিজে গোসল করে ফেললে তো?” কিন্তু সিদ্রা মাথা তুলছেনা দেখে হাসি বন্ধ হয়ে গেল ওর।
“মজা করছো, না? ভাবছো, নিজের সাথে আমাকেও গোসল করাবে, সেটি হচ্ছেনা, তাড়াতাড়ি উঠে আসো বলছি…….সিদ্রা, এই সিদ্রা!” পানি তো এতো গভীর না, প্রথমদিন ও পড়ে যাওয়ার পরে এজন্যই তো গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু ও উঠছেনা কেন? ও তো সাঁতার জানেনা বলেছিল! আর কিছু না ভেবে ঝাঁপ দিল রাইয়্যান। প্রায় সাথে সাথে বেশ খানিকটা দূরে ঝর্ণার কাছাকাছি মাথা তুলল সিদ্রা। খিলখিল করে হাসছে ও, “কি, কেমন দিলাম?”
“তুমি!? ওইখানে গেলা কিভাবে!? তুমি না সাঁতার জানোনা!?”
“জানতামনা! পাস্ট টেন্স! খালার কাছে ওই এক মাসে সবরকম সাঁতার শিখে নিয়েছি। তা আমার ডুব সাঁতারের স্কিল কেমন লাগল?” চোখ নাচাল সিদ্রা।
“ইউ! দাঁড়াও, তোমাকে মজা দেখাচ্ছি আমি!” সাঁতরে রাইয়্যান এগোল সিদ্রার দিকে।
“ধরতে পারলে ধরো” সিদ্রাও হাসতে হাসতে সাঁতরানো শুরু করল। রাইয়্যান কাছাকাছি আসতেই আবার ডুব দিল পানির মধ্যে। রাইয়্যান ডুব দিতে গিয়েও থেমে গেল, কোনদিকে যায় আগে দেখি, তারপর ধরব। খানিকটা দূরে মাথা তুলল সিদ্রা, রাইয়্যান ওর দিকে এগোতেই আবার ডুব দিল। রাইয়্যান যতক্ষণে ওখানে গিয়ে পৌঁছল, সিদ্রা ততক্ষণে চলে গেছে আরেকদিকে, সেখান থেকে মাথা উঠিয়ে হাসতে লাগল। রাইয়্যান আবার এগোতেই আবার ডুব দিল ও। এভাবেই চলতে লাগল ওদের পানির মধ্যে লুকোচুরি খেলা।
পাখির কলকাকলি আর ঝর্ণার ঝিরিঝিরি শব্দের সাথে কিছুক্ষণ পরপর শোনা যাচ্ছিল ওদের প্রাণখোলা হাসির আওয়াজ, পাহাড়ের গায়ে প্রতিদ্ধনিত হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছিল গোটা বনে।
(সমাপ্ত)
মার্জিত মন্তব্য এবং সমালোচনার আশাবাদী 😊ো