#অপরিণত_ভালোবাসার_পরিণতি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ৫
__________
সময় হয়েছে কর্মে ফিরে যাওয়ার। পাঁচদিন বিয়ে উপলক্ষে থেকে গেলেও আজ ঢাকা ফিরে যেতে হবে। বিদায় মূহুর্তের সময়টা উপলব্ধি করতেই নিরবের বুকটা হাঁসফাঁস করতে লাগল। নিজের অনুভূতিগুলো স্বীয় মানুষটার কাছে ব্যক্ত করার সুযোগ বা সময় কোনটিই হয়ে উঠল না। একমাত্র মেয়েটার জন্যই তার নিজের স্বকীয় সত্তার পরিবর্তন হয়েছে এখানে। চুপচাপ, শান্ত থাকা ধীরস্থির নিরবের মাঝে সঞ্চার হয়েছে উচ্ছ্বাসতা, স্ফুরিত হয়েছে উল্লাসতা। অথচ সবকিছুই এখন আগের অবস্থানে ফিরে যাবে। মন! মনটা তো পড়ে রইবে এখানে। সেটা তো আর সাথে যাবে না।
______
শূন্য ঘর, শূন্য মন তারউপর কষ্টকর জীবন।
উদাসীন ভঙ্গি নিয়ে তাকিয়ে ঢাকা শহরের যান চলাচল, মানুষের ভিড় দেখছে নিরব। চারদিন হলো কবিরের গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছে। কাজের জোগাড় এখনো হয়ে উঠেনি। খোঁজ চলছে। কবিরটাও গ্রাম থেকে আসার পর কেমন জানি পাল্টে গেছে হয়তো ভালোবাসা নামক শব্দটা তাকে পালটে দিতে বাধ্য করেছে। ঠিক যেমন করে নিরবকে পালটে দিয়েছে। রাতের অনেক গভীর পর্যন্ত ছেলেটাকে ফোনে কথা বলতে দেখতে পায় নিরব। আর সে রাত জাগানিয়া নিশাচর হয়ে কল্পনাতে ডুব দেয়। মধ্যকার উচ্ছ্বাসতা, দীপ্ততা সেসব যেন অবাস্তবতা ছিল, ছিল কাল্পনিক। রোজ রাতে গুমরে মরে। তবে হাতে থাকা বাটন ফোনে কবিতার হলুদ সন্ধ্যেয় জ্বলজ্বল করা একটা ছবি অগোচরে তুলে নিয়ে এসেছিল। সেটা দিয়েই আপাতত তৃষ্ণা মিটায় সে।
গ্রাম থেকে আসার মাসের মাঝামাঝি সময়টাতে ফোন আসে অচেনা নম্বর থেকে। তখন নিরব কাজে ব্যস্ত। ভাড়ায় অটো চালায়। চলন্ত গাড়িতে তো রিসিভ করা সম্ভব না। তাই প্যাসেন্জার নামিয়ে ফোন হাতে নিয়েই দেখতে পায় অচেনা নম্বর। ভাবে, একবার মাত্র কল দিয়েছে। হয়তো ভুল নম্বরে তাই দ্বিতীয়বার আর দেয়নি। সেজন্যে নিরব-ও কে ব্যাক করল না। এখন হিসেব করে চলতে হয় তাকে খুব। আগে কাজ ছিল না তখন ছিল সে বেহিসাবি আর এখন কাজের সময় হিসেবনিকেশ করে চলে পুরোদস্তুর মিতব্যয়ী বনে গেছে। তবে মাঝে মাঝে মনের খোরাক মিটানোর তাগিদে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে, জ্বলন্ত হৃদয়কে আরো জ্বালাতে সিগারেটের ছাই ওড়ায়৷
আগের বসতিতেই ফিরল রাত দশটায়। হোটেলে খাওয়াদাওয়া করেই আসে প্রতিদিন। এই দিকটাতে অবশ্য খরচা করতে হয়। নাহলে অসুস্থতায় পড়লে আবার এ-কুলও তার ও-কুলও যাবে। তথাপি বলা বাহুল্য যে, তার এই মিতব্যয়ীতার পেছনের কারণ ছোটো বোনের বিয়ে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে পার করার যে গুরু দায়িত্ব তার কাঁধে। বোনের বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন আছে অল্পস্বল্প। মায়ের জন্যও মন কাঁদে তার। একটু চোখের দেখার আশায় আরো ভালোভাবে কাজ করার চেষ্টায়রত হয় ছেলেটা। কিন্তু তখনও সে বেখবর, অজানা কিছু ক্ষেত্রে ভালোটা নিয়তির উপরও বরাদ্দ থাকে।
রাত বারোটা দশ মিনিটের কাটায় আবারও ফোনকল আসে। বালিশের নিচে থাকায় ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে। সারাদিনের কর্মের ধকলে রাত হলে সকলে একটু শান্তির ঘুম চায় বিধায় ফোন সে সাইলেন্ট করে রাখে। ইদানীং তার-ও ক্লান্ত দেহে একটু ঘুমের আশা করে বলে রাত জাগানিয়া নিশাচর আর হয়ে উঠে না তার।
______
তপ্ত প্রখর রোদের তাড়নায় চিবুক ছুঁয়ে ঘামের ফোঁটার আনাগোনা। পানির বোতল ভরে সাথেই রাখে সবসময় সে। তবে সেটাও এখন খালি। আশেপাশে দেখে অটো থামালো নিরব। আপাতত খালি অটো প্যাসেন্জার নামিয়ে দিয়েছে, মোড় থেকে আবারও যাত্রী উঠাতে হবে। যারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অটোর জন্য। পানি ভর্তি বোতল মুখ ঠেকিয়ে খাওয়ার সময় আবারো শার্টের পকেটে ফোনটা নিজ শব্দে জানান দিলো কারো কল আসার। হাতে নিয়ে রিসিভ করে কানে দিয়ে বলল,
“হ্যালো!”
ওপাশের নিরবতা ছাড়া কোনো শব্দই কানে এলো না এমনকি নিশ্বাসের শব্দও। ফের বলে উঠল,
“হ্যালো, কে বলতাছেন?”
এবার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল ওপাশ থেকে। তবুও বুঝতে না পারার কারণে তপ্ত রৌদ্রের প্রভাবে উত্তপ্ত মেজাজে গমগম আওয়াজে বলল,
“বা* ফোন দেওন মারাস কতা কছ না ক্যা? ফোন দিয়া তয় ডিস্টার্ব করোন মারাইতাছোস ক্যান? ট্যাকা বেশি হইয়া গেছে গা?”
বস্তুত রিকশাচালক জাতিদের সংস্পর্শে এসে মুখের ভাষার অবনতি ঘটেছে তার। এমনিও ছিমছাম ছিল তবে অপ্রকাশ্যে। তবে ফোনের ওপাশের ব্যক্তি এবার মুখ খুলল বিস্ময়াহত তার কণ্ঠ,
“আপনার মুখের ভাষা ছিঃ!”
নিরব যেন সাংঘাতিক বিষম খেলো। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তির কিন্নরকণ্ঠ চিনতে অসুবিধা হলো না।
“কবিতা!”
বেশ কিছুক্ষণ কোনো শব্দ এলো না ফোনের ওপাশ থেকে। অবাকতা কাটালে নিরব কান থেকে ফোন নামিয়ে একবার দেখে নিলো। লাইনে তো এখনও আছে। কথা বলছে না কেন তাহলে? কবিতাই তো ছিল, কণ্ঠ তার অতি চেনা। মেয়েটা চুপটি সেধে গেল কেন?
“কবিতা, কবিতা না তুমি? কথা বলছ না কেন?”
“হু।”
এই একটু স্বীকারোক্তি নিরবের মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিলো। কানে কেবল মেয়েটার মধুর কণ্ঠে বলা স্বর গুঞ্জন করছিল। আশেপাশের জাগতিক অস্তিত্ব ছিল না। কেবল ছিল সে এবং তার ভালোবাসার মানুষটার সুকণ্ঠ।
______
মৃত্যুর আগে নাকি সৃষ্টিকর্তা মানুষের অনেক আকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছা পূরণ করেন। নিরবের কাছে ব্যাপারটা তেমনই মনে হচ্ছে। এই যে সে দিন-রাত এক করে যাকে মনেপ্রাণে প্রার্থনায় চেয়েছিল আজ তার দেখা না পেলেও কথা বলার সুযোগ হলো, সেটাই বা কম কীসে। তবে এতকিছু ছাপিয়ে একটা বিষয় কুটকুট করছিল মাথায়। মেয়েটা তার নম্বর কোথায় পেল? কল কেন দিলো? আশ্চর্যান্বিত ছিল সে তখনকার সময়টাতে।
রিং হচ্ছে ওপাশে। কল ধরবে ক্ষণকালে কেটে দিয়েছে মেয়েটা। হয়তো কেউ সামনে পড়ে গেছে কিংবা কাজে ব্যস্ত ভেবে নিরব আর কল দিলো না। যখন কবিতা ফোন দিবে তখন নাহয় কেটে সে আবার কল করবে। সময়টা দেখে নিলো দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। এমন সময় কবির এসে হাজির হলো তার সামনে কাজ থেকে ফিরেছে ঘেমে-নেয়ে একাকার। তবে মুখে চমৎকার হাসি। হাসবেই বা না কেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে মালিককে হাত করে নিয়েছে। বলা যায় ডান হাত। প্রোমোশন পেয়ে টাকাপয়সার বিষয়টাও দেখছে ম্যানেজার হয়ে। কপাল বড়ো। আর তার…
“কী খবর রে?”
“এই তো চলতাছে।”
“তোরে তো পাওয়াই যায় না। কথাও হয় না।”
নিরব শুধু হাসলো কবিরের এই কথায়। তবে মনের ভেতর স্বগোতক্তি করল, ‘আমাকে পাওয়া যায় না হাহ্! নিজেরই সময় হয় না। সামাজিক স্তর পরিবর্তন হয়েছে কি না।”
এমন সময় কবিরের ফোন আসায় একটু সাইডে গিয়ে কথা সেড়ে ফিরে এলো। নিরব তখন সিগারেট খাওয়ায় ব্যস্ত।
“বুঝলি দোস্ত, এত চাপাচাপির মধ্যে থাকা যায় না। আবার তো ফ্যাক্টরি থেকে দূর হয়ে যায়। ভাবতাছি, কাছাকাছি কোথাও রুম নিমু। তয় আবার সমস্যা একা ব্যাচেলর দেখে কেউ দিব না।”
কবিরের বক্তব্য শুনেও চুপটি সেধে রইল নিরব। তার ভাবনার কিংবা সমস্যার সলাপরামর্শ করার জন্য কথাগুলো বলা হয়নি নিরবকে। প্রশ্ন ছিল না, ছিল কেবল কথার কথা বলায় হয় না যেমন ঠিক তেমনই, একই ছাদের নিচে একই রুমে থাকায় বলা আরকী। উপরন্তু এখানে যে কবির থাকবে না সেটার একটু আগাম বাতাস দিয়ে গেল তাকে।
চলবে…