#অপরিণত_ভালোবাসার_পরিণতি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ৭
__________
পালিয়ে বিয়ে অহরহ ঘটনা। তেমনই এক কাণ্ড সচরাচর ঘটল কবিরদের বাড়িতে। তবে গ্রামাঞ্চলে এমন ঘটনাকে নিছক ছোটো চোখে না রসিয়ে-কষিয়ে বড়ো চোখেই দেখা হয়। সমালোচনা করা যেখানে মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
কবিতা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। বিয়ের বাকি পাঁচদিন। কবির সেটা শুনে দ্রুত টিকেট কেটে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। বাড়ির অবস্থা শোচনীয়, অবশ্য এই শোচনীয় অবস্থা বেশিরভাগ গ্রামবাসীরা করে রেখেছে। যেন কোন মরা বাড়ি। এত মানুষের ঢল! আনিসুর মিয়ার মাথায় পানি ঢালছে তমা। রেবেকা শুয়ে আছে বিছানায় মরার মতো পড়ে। বোধশক্তি কাজ করছে না তাঁর। মেয়েটা কী করল!
_______
সময়ের পরিক্রমা শেষে নিভে আসে দীপ। অর্থাৎ সুখের দিন শেষে দুঃখের হাওয়া লাগা শুরু হয়। ভালোবেসে বেলা শেষে যার হাত ধরে আপন নীড় ছেড়ে অচেনা শহরে পাড়ি দেয়, একটু ভরসার আশ্রয়স্থল যদি তখন মিথ্যে হয়; স্রেফ নির্বাক, নিথর, চাহনি মেলে সেথায়।
যেদিন অন্ধকারে হারিকেন নিয়ে উঠানে পা রেখে দেখেছিল, অচেনা যুবা পুরুষের নির্নিমেষ ভালোলাগার চাহনিতে কবিতা সেদিন ঘায়েল হয়েছিল। এমন না যে স্কুলে কারো পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠেনি সে। তবে সে-ই আগায়নি। কিন্তু সেদিনকার নিরবের দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল, যা তাকে লজ্জাবরণে ঢেকে দিয়েছিল। সেই থেকে নিরবের প্রতি ভালোলাগার শুরু। স্বল্প সময়ের ও অপরিণত ভালোবাসা ধরা দেয় ফোনে কথা বলতে বলতে। দু’জন দু’জনকে কাছে পাওয়ার আকুলতার মাঝে বাঁধা আসায় অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয় কবিতার। কিন্তু সেটা কি আদৌও সঠিক ছিল?
পালিয়ে আসার পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল। কিন্তু কবিতা জানত না সে কোথায় উঠছে। তবে এতটুকুই জানত যে, কবিরের সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকে নিরব। কবিরের বিয়ের সময় নিরব না আসাতে বেজায় রেগেছিল সে। পরে নিরব বুঝিয়ে বলেছিল, দু’জন তখন একসাথে দেখা হলে পরিবারের চোখে পড়তে পারে। সমস্যা বাড়বে তখন তাঁরা যদি একটুও তাদের সম্পর্কের বিষয়ে আঁচ করতে পারে। সেজন্যই সে বিয়েতে আসেনি। এক ফ্ল্যাটে থাকে বিধায় কবিতাকে নিয়ে তো আর সেখানে উঠতে পারবে না তাই সে আলাদা ফ্ল্যাট নিবে বলে জানিয়েছিল। কাজের বিষয়ে বলেছিল কবিরের মতো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ম্যানেজার সে। অথচ সময় গড়ালে দেখল সবই মিথ্যা কাচের আবরণে ঢাকা। ফ্ল্যাট তো দূরে থাক, তাদের এখন থাকতে হচ্ছে লম্বা সারি সারি একচালার বসতিস্থলে। যৌথ রান্নাঘর, টয়লেট ও গোসলখানা। এসব দেখে এতোটাই হতভম্ব বনে গিয়েছিল কবিতা যে, গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করার বিষয়টাই মাথায় আসেনি। বিলাসিতার এমন দৃশ্য দেখে জীবনের চরম সবক পেয়েছিল। ফিরে যাওয়ার পথ খোলা ছিল না। কারণ সেই মুখই কবিতা রাখেনি।
কবিতা যে রেগে তা বেশ বুঝতে সক্ষম নিরব। তবুও নিরব শান্ত, চুপচাপ থেকে নীরবতা পালন করছে। এখন একটু উচ্চবাক্য ব্যাপারটা বিগড়াতে সময় নিবে না। রয়েসয়ে যা বলার বলতে হবে। হ্যাঁ, একটু মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে তাতে কী হয়েছে? ভালোবাসাকে পেতে, কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে নিয়ে কে না চায় ঘর বাঁধতে। সে-ও করেছে, তাই বলে অমন গুমোট ভাব ধরে রইবে। মেয়েটাও তো তাকে ভালোবাসে। এমন না যে ভালোবাসে না জোর করে তুলে নিয়ে আনা হয়েছে তাকে। থাকুক কিছুক্ষণ ওভাবে পড়ে। এসব ভেবে বাইরে বেরিয়ে যায় রাতের খাবার আনতে।
অচেনা ও ভিন্ন শহরে একা কী করবে কবিতা? রাগ করে কথা না বলে বসে থাকলেও তো চলবে না। যেহেতু ভালোবেসেছে সেহেতু মানুষটা তার যেমনই হোক না তাকে মেনে নিয়েই সংসার করতে হবে এছাড়া কোনো উপায় নেই। রাতে খাবার নিয়ে এলে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করে কবিতা। নিরবও মেয়েটার চেষ্টার বিষয়টা বুঝতে পারে। তাই সে-ও পরিবেশ স্বাভাবিক রাখে কোনো প্রকার কষ্টান্বিত কথা তুলে না। ঘরটাতে কেবল বিছানা পাতা চৌকি ও নতুন কেনা বুঝায়ই যায় হাঁড়ি পাতিল, প্লেট ও গ্লাস। হৃদয় নিংড়ানো আটকে থাকা হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুয়ে পড়ে বিছানাতে। দু’প্রান্তে দু’জন মানুষ জেগে, অথচ একসময় একে-অপরকে কতোই না ভালোবাসত। ভালোবাসত? আদৌও তা ভালোবাসা ছিল তো? নাকি খানিকের মোহ কাজ করেছে সেখানে?
স্বাভাবিকের চেষ্টায় সফলতার আজ মাসেক তিন পড়েছে। রান্না করার জন্য সাপ্লাই গ্যাস থাকলেও পাওয়া যায় না সময় মতো, যেই না লম্বা লাইন! তাই মাটির চুলো তৈরি করে নিয়েছে কবিতা। সেটাতেই রান্না করছে নিজের ঘরের দোরগোড়ায়। নিরব বাসায় নেই, কাজ খোঁজছে পনের-বিশ দিন যাবৎ অথচ কোনো কাজই তার মন মতো গছে না। এতে দু’দিন পরপর ঝগড়া বাঁধে কবিতার সাথে। যেদিন শুনেছে কোনো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি নয় অটো চালানোর কাজ করে নিরব, সেদিন মেয়েটা চুপ থাকতে পারেনি। চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল, বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল ধৈর্যের। সেই তুলকালামে নিরব হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে হাত উঠায় সেই প্রথম। কবিতা বিমূঢ় বনে গিয়েছিল। চোখের পানি শূন্য হয়ে রক্তজবায় পরিণত এক মূর্তি যেন। শুধু জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে একটুকু বলেছিল,
“বাবা-মা’কে ধোঁকা দিয়ে দু’দিনের ভালোবাসার জন্য এত বছরের ভালোবাসা ফেলে আসার পরিণাম পাচ্ছি।”
______
চলবে…