সুখপাখি পর্ব-১১

0
309

সুখপাখি

১১.
সকালে আবিরকে আরবি পড়াতে বসেছে শিমু। ঘুমে ঝিমুনি আসছে বারবার। আবিরকে পড়তে দিয়ে একটু হেলান দিতেই চোখ লেগে এলো। আবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো আবির নেই। কায়দা খোলা। শিমু আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে চোখ যেতেই শিমুর চোখ চড়াক গাছ। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। আবির টুপি এক আঙুলে ঝুলিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোমড় দুলাচ্ছে। শিমু উঠে গিয়ে বেতের বারি দিতেই আবির শিমুর দিকে ফিরে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শিমু বললো,
— “বুড়া দামড়া একটা ছেলে পড়া ফেলে নাচতেছেন। আজব তোহ!”

আবির নিজের দিকে আঙুল তাক করে বললো,
— “আমি বুড়া দামড়া? আমার এখনো চুলও পাকেনি। তুমি আমাকে দামড়া বললে? কিভাবে বললে?”

— “নাটক রাখুন। এসব ফাইজলামি কেন করতেছেন? আপনি প্রতিদিন আরবি পড়তে বসলে এমন করেন। কেন?”

আবির ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
— “তোমাকে জ্বালাতে খুব ভালো লাগে আমার।”

শিমু ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে কায়দাটা গুছিয়ে রেখে বললো,
— “বাজারে যান। আজকে আর পড়তে হবে না।”

আবির তাই করলো। বাজার করে এনে দিলো। নাস্তা করে রেডি হয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো। সন্ধ্যায় আবির ফিরে এলে দুজনে নামাজ পড়ে নাস্তা খেয়ে নেয়। শিমু নিজের বই নিয়ে পড়তে বসে। পাশের চেয়ারে আবির হাদিসের বই নিয়ে বসেছে।

——————————
রাত সাড়ে দশটা,
কলিংবেল বেজে উঠতেই শিমু আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “এখন কে এলো?”

— “দেখে আসি কে এসেছে।”

আবির এসে দরজা খুলে দেখলো মাহিন। হাতে কিছু খাবারের জিনিসপত্র। আবির ইতস্তত করছে বাসায় ঢুকতে দেবে কি দেবে না কারণ শিমুর শর্ত ছিলো মাহিনের থেকে দূরে থাকার। তাও সোফায় বসালো। আবির ভেতরে গেলে শিমু জিজ্ঞেস করলো,
— “কে এসেছে?”

— “মাহিন।”

শিমু অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
— “কেনো এসেছে? ওরে বলেন চলে যেতে।”

— “এভাবে কিভাবে তাড়িয়ে দি তুমি বলো?”

শিমু রাগ করলো। গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। আবির শিমুকে কাছে টেনে এনে বললো,
— “মেহমান আল্লাহর রহমত। মেহমানকে কষ্ট দেয়া নিষেধ তুমিতো জানোই। তাহলে ওকে পাঠিয়ে দিলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। রাগ করো না প্লিজ।”

— “আপনি ওর সাথে দেখা করে আসুন। আমি যাবো না।”

— “ঠিকাছে।”

আবির ড্রয়িংরুমে গেলো। শিমু পড়ার টেবিলে বসে আছে। বইয়ের দিকে চোখ অথচ পড়ায় মন নেই। এভাবে অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলো। একটু পর গোঙানির শব্দ কানে এলো শিমুর। বুকটা ধক করে উঠে। তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে এসে দেখলো আবির নিচে পরে একহাতে বুক চেপে ধরে চোখ মুখ খিচে গোঙাচ্ছে। শিমু এসে আবিরকে ধরে বললো,
— “কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেনো?”

শিমু কেঁদে দিলো। মাহিন অট্টহাসিতে ফেটে পরে। শিমুর চুলের মুঠি টেনে ধরে বললো,
— “ওর জুসে ড্রাগ মিশিয়ে দিয়েছি তাই বেচারার এই অবস্থা।”

— “কেনো করছো তুমি এমন? ছাড়ো আমাকে।”

শিমুর চুলের মুঠি টেনে দাড় করালো। ব্যাথায় চোখ খিচে নেয় শিমু। মাহিন বললো,
— “তোকে নিয়ে যেতে এসেছি। সোজাসাপটা ভাবে নিয়ে যেতে পারবো না। তাই বাকা পথ ধরলাম।”

— “আমি কেন যাবো তোমার সাথে? আমি যাবো না। আমি আমার স্বামীকে রেখে যাবো না। ছাড়ো। আমি ব্যাথা পাচ্ছি ছাড়ো।”

— “নতুন একটা ক্লাইন্ট আছে। দ্বিগুণ টাকা দিবে। তাই তোকে দরকার। তোর মতো সুন্দরীকে, রূপবতীকে চড়া দামে কিনে নিবে।”

শিমু ভয়ে কেঁপে উঠে। আবিরের দিকে তাকালো। আবির দুইহাতে মাথা চেপে ধরে পরে আছে মেঝেতে। শিমু মাহিনকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ফুলদানি তুলে নেয়। মাহিন হেসে বললো,
— “এটা দিয়ে কি করবি?”

— “আমার কাছে আসলে মাথা ফাটিয়ে দিবো তোর।”

মাহিন আবারো বিশ্রী করে হাসছে। শিমুর কাছে আসলে শিমু ফুলদানি দিয়ে আঘাত করার আগেই শিমুর হাত মোচড়ে ধরে। ফুলদানি হাত থেকে পরে যায়। ব্যাথায় অপর হাত দিয়ে মাহিনকে কিল ঘুসি দিচ্ছে। শিমুর দুইবাহু চেপে ধরে বললো,
— “বেশি বাড় বেড়েছিস। কি যাদু করেছে এই আবির তোকে? সে যাই হোক, এতোটা বেড়েছিস তাই তোকে এখন একটা শিক্ষা আমিই দিবো। তারপর ক্লাইন্টের কাছে চড়া দামে বিক্রিত হবি তুই।”

— “না। ছাড় আমাকে।”

মাহিনের কাধে কামড় দিয়ে দৌড়ে পালাতে চাইলেই মাহিন শিমুর চুলের মুঠি ধরে টেনে ধাক্কা দেয়। শিমু দেয়ালের সাথে চরম ভাবে ধাক্কা খায়। মাথায় আঘাত লাগে সাথে কোমড়েও। এক হাতে মাথার পেছনে দিয়ে চেপে ধরে। অন্যহাতে কোমড় চেপে ধরে। ব্যাথায় চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। মাহিন শিমুর ওড়না টেনে নিয়ে ফেলে দেয়। একহাত চেপে ধরে গলায় মুখ গুজে অপর হাতে খামছে ধরে কোমড়। শিমু ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেয়েও পারেনা। চোখ বন্ধ করে ফেলে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ খুলে দেখলো আবিরের হাতে মাহিন। আবির মাহিনের ঘাড় চেপে ধরেছে। আবিরের মধ্যে হিংস্রতা। চোখ লাল হয়ে আছে। কপালের রোগ ফুলে উঠেছে। রাগে হাত মুঠ করায় হাতের প্রতিটা রগ স্পষ্ট। শিমু তাড়াতাড়ি করে ওড়না নিয়ে নিজেকে ঢেকে দেয়। আবির মাহিনকে নিজের দিকে ফিরিয়ে গলা চেপে ধরে ভয়ংকর আওয়াজে বললো,
— “তুই জানিস না কোনো ড্রাগস এবং ড্রিংকসে আমার নেশা চড়ে না। ভুলে গেছিস এই ড্রাগস নিলে আমার ভেতরে হিংস্রতা জেগে উঠে। আগের থেকে শক্তি বেড়ে যায়। ভুলে গেছিস?”

আবির একহাতে মাহিনের গলা চেপে ধরেছে। মাহিন নড়াচড়া করতেই পারছে না। শিমু ভয়ে জড়সড় হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আবিরকে দেখে আরো ভয় লাগছে তার। আবির তার সাথে আগে যেমন হিংস্র আচরণ করতো আজ তার চেয়ে বেশি হিংস্র লাগছে। মাহিনের নাক বরাবর তিন চারটা ঘুসি দেয় যার ফলে মাহিন ধীরেধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। আবির মাহিনকে দরজার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
— “ভুলে গেছিস আমার জিনিসে হাত দেয়ার পরিনাম? সেইদিনের ঘটনা ভুলে গেছিস? শিমুকে টিজ করায় আমার প্রাণের বন্ধুকেও ছাড়িনি। তুই কি জিনিস তো?”

লাথি মেরে গেটের বাহিরে ফেলে আসলো। ঘরে এসে শিমুর সামনে দাড়ালো আবির। শিমু এখনো ভয় পাচ্ছে। আবির শান্ত কণ্ঠে শিমুকে বললো,
— “তোমাকে অন্য জায়গায় চড়া দামে বিক্রি করবে সেই ভয়ে নিজেকে বাঁচাতে তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছো?”

শিমু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আবির আবার বললো,
— “যদি তাই হয় তাহলে তোমাকে আমি মুক্ত করে দিবো। আমি চাইনা কেউ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার কাছে থাকুক। তোমাকে মুক্ত করে দিয়ে তোমার সিকিউরিটির সব ব্যাবস্থা আমি করে দিবো।”

কথাগুলো বলে আবির চুপচাপ দাঁড়ায়। শিমুর চোখের পানি আপনা আপনি গড়িয়ে পরছে। আবির তাকে এসব বলবে সে ভাবতেও পারেনি। শিমুর কোনো উত্তর না পেয়ে আবির চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছনে শার্টে টান পরে। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো শিমু আবিরের শার্টের এক অংশ টেনে ধরেছে। শিমু কান্না থামিয়ে বললো,
— “আপনি আমাকে এতোটা স্বার্থপর ভাবেন কোনদিন থেকে? আপনি আমাকে এভাবে কেন বললেন বলুন? কি কারণে এসব কথা শুনিয়েছেন আমাকে জবাব দিন?”

আবিরের কলার ধরে বললো,
— “আমার সেফটির জন্য আমি এখানে আপনার সাথে থাকি না। আপনাকে ভালোবাসি বলেই এখানে থাকি। আপনার এতোটা মারধর অত্যাচারের পরেও এখানে আছি কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি। বুঝেছেন আপনি? শুনেছেন? আপনাকে আমি ভালোবাসি।”

আবিরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে শিমু হু হু করে কেঁদে উঠে। আবির দুইহাতে শিমুকে আগলে ধরে মিনমিনে স্বরে বললো,
— “সরি।”

শিমু ক্ষেপে গেলো। আবিরকে কিল ঘুসি মেরে বললো,
— “আপনি স্বার্থপর। হ্যাঁ আপনি একটা স্বার্থপর। নিজের জন্য আমাকে রেখেছেন। আমাকে বিয়ে করেছেন। এখন বলছেন মুক্ত করে দিবেন? আমাকে ভালোলাগে না? হুম? অন্য কাউকে ভালো লাগে? আপনি এমন কেন? আপনি বুঝেন না কেন আমাকে? আমাকে ভালোবাসেন না কেন? আমাকে ভালোবাসলে কি হয়? অন্য যে মেয়েকে ভালোবাসেন তাকে না বেসে আমাকে ভালোবাসলে কি হয়? আমি যোগ্য না? আপনার সাথে দাড়ানোর যোগ্য না? নাকি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না? কোনটা? হ্যাঁ বলেন কোনটা?”

শিমুকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে আবির। শিমু কেঁদেই যাচ্ছে। আবির বললো,
— “আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি না। আমি তোমাকেই ভালোবাসি পাগলি। তুমিই তো আমার সুখপাখি। আমার এই সুখপাখিকে ছেড়ে আমি কিভাবে আরেকজনকে ভালোবাসবো বলো?”

শিমুর কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গেছে। তাও কান্না জড়ানো গলায় বললো,
— “আপনি পচা। আমাকে শুধু কষ্ট দেন। আপনি অনেক পচা। আমি মরে গেলে তখন বুঝবেন। তখন দেখবো কিভাবে থাকেন।”

আবির রেগে গেলো। শিমুর গাল চেপে ধরে বললো,
— “মরার কথা বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। আর কোনো কথা না। ওই হারামি তোমাকে স্পর্শ করেছে চলো গোসল করবে তুমি। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে শিমু। প্লিজ আর কেঁদো না। তোমার কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না।”

আবির শিমুকে নিয়ে ওয়াশরুমের শাওয়ারের নিচে দাঁড়ায়। আবির দুইহাতে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আবিরের দুইহাতের মাঝে শিমু। শিমুর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ এভাবে ভেজার পর দুজনে বেরিয়ে আসে। আবির ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরে। শিমু এসে আবিরের পাশে বসলো। আবির বললো,
— “আমার মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে শিমু। হাত পা অবশ হয়ে আসছে।”

— “ডাক্তারের কাছে চলুন। এভাবে বসে থাকলে সেদিনের মতো হবে আবার।”

— “না যেতে হবে না। তুমি সেদিন আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে যেভাবে সূরা পড়েছিলে এখন সেভাবে একটু সূরা শুনাও।”

— “ঠিক আছে।”

শিমু বেডে বসে আবিরকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে সূরা পড়তে শুরু করে। আজ একটা ঝড় গেছে তাদের দুজনের উপর। আবির এভাবেই ঘুমিয়ে যায়। আবিরকে বালিশে শুইয়ে বাতি নিভিয়ে এসে আবিরের বুকে মাথা রেখে শিমুও ঘুমিয়ে যায়।

——————————
আজ অফিস থেকে বারোটায় ফিরে এসেছে আবির। শিমু রান্নাঘরে কাজ করছে। আবির দেখলো শিমুকে অনেকটা ক্লান্ত লাগছে। আবির ডাকলো,
— “শিমু।”

— “আসছি।”

শিমু এসে আবিরের সামনে দাড়ালো। আবির শিমুর দুইহাত ধরে বললো,
— “তোমার সব কাজ আজ আমি করে দিবো। তবে একটা শর্তে।”

— “কাজ করবেন তাও শর্ত দিচ্ছেন। দরকার নেই। হুহ।”

— “আহা শুনো না।”

— “বলুন।”

— “আমি কাজ করবো তুমি শুধু আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখবে। রাজি?”

শিমু হেসে বললো,
— “ঠিকাছে।”

আবির রান্নাঘরে কাজ করছে। শিমু পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। বেসিনের ধোয়াপালা কাজ শেষ করে পেছন ফিরলেই শিমু পরে যায়। ধরে ফেলে শিমুকে। আবির হাসলো। মনে মনে বললো,
— “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায় আজ প্রথম দেখলাম।”

শিমুকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে আবির রান্না শুরু করে। মোবাইলে ইউটিউব দেখে দুইটা আইটেম রান্না করে ফেলে। ঘর ঝাড়ু দিয়েছে। ঘর মুছেছে। শিমুর পড়ার টেবিলের বই খাতা গুছিয়ে রেখেছে। নিজেদের বেডরুমটা গুছিয়েছে। কাবার্ডের সব কাপড় গুছিয়ে রেখে আবির শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো শিমু দাঁড়িয়ে আছে। শিমুর মুখের সামনে মাথা এনে ভেজা চুল হাত দিয়ে ঝাড়ি দিলো। পানির ছিটকা শিমুর মুখে পরলে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় শিমু। আবির হেসে বললো,
— “ঘুম ভেঙেছে?”

— “কষ্ট করে এতো কাজ কে করতে বলেছে আপনাকে? আমাকে ডাক দেননি কেন?”

— “কে বললো কষ্ট করেছি। আমিতো সুন্নাহ পালন করেছি। রাসূল (সাঃ) যখন ঘরে থাকতেন ঘরের কাজ করতেন। আমিও তাই করেছি।”

শিমুর নাক টেনে দিয়ে বললো,
— “যাও ফ্রেস হয়ে এসে অজু করে নামাজ পড়ে নাও।”

শিমু নাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আবির আগেই নামাজ পড়ে নেয়। শিমু নামাজ পড়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দেখলো আবির খাবার সার্ভ করে টেবিলে রেখেছে। একটা চেয়ারে বসে শিমুর জন্য অপেক্ষা করছে। শিমু চেয়ারে বসতেই আবির বললো,
— “ইউটিউব দেখে রান্না করেছি। খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে। খারাপ হলে কিন্তু বকবে না আমি আজ প্রথম রেধেছি।”

শিমু হেসে বললো,
— “ঠিক আছে।”

শিমু খেয়ে বলল,
— “প্রথমবার হিসেবে দারুণ হয়েছে।”

খাওয়া দাওয়া শেষে দুজন গল্প করতে বসে। শিমু জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনাদের এতোবড় মেনসনটা কি সবসময়ই এমন নিরব ছিলো?”

— “আরে না। দাদি দাদার কাছ থেকে যা শুনেছিলো সেগুলোই আমাকে বলছে। দাদার বাবারা আট ভাই এবং চার বোন ছিলেন। তারা তখন অনেকটা জমিদারের মতোই ছিলো। বারোজন ছেলেমেয়ে আবার তারা স্বামী স্ত্রী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি সবাই মিলে থাকতো এই মেনসনে। এছাড়াও তাদের চাকর বাকরের অভাব ছিলো না। সেই সুবাধে এতোবড় মেনসন তৈরি করেছিলো। দাদিরা যখন ছিলো তখনও এই বাড়ির পরিবেশ জমজমাট ছিলো। আমার আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে বাড়িটা সুনশান হয়ে গেছে। এরপর আমার মেয়েরা মিলে বাড়িটা আবার জমজমাট করে তুলবে।”

শিমু হাসলো। আবির শিমুর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। পরেরদিন আবির বললো,

— “রেডি হও। আজ আমি তোমাকে কলেজে দিয়ে আসবো।”

— “ঠিকাছে।”

শিমু কলেজের সাদা ড্রেস পরে বেরিয়ে এলো। আবির শিমুকে ক্রসবেল পরিয়ে দিয়ে নিজে রেডি হয়ে নিলো। শিমু ব্যাগ গোছানো শুরু করে। আবির চিরুনি নিয়ে শিমুর পেছনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়ে খোপা করে দেয়। দুইজনে নাস্তা খেয়ে নেয়। আবির তাগাদা দিয়ে বললো,
— “এই শিমু তাড়াতাড়ি বোরকা পরো।”

শিমু বোরকা, হিজাব পরে বেরিয়ে আসে। শিমুর ব্যাগটা আবির কাধে নিয়ে দুজন হাটতে থাকে। শিমু বললো,
— ” আজ হেটে যাই।”

দুইজনে রাস্তায় পাশাপাশি হাটছে। শিমুকে বামপাশে রেখে ডানহাতের কবজি ধরে রেখেছে আবির। কলেজে দিয়ে আবির অফিসে চলে আসে। এভাবেই দুইমাস কেটে গেলো। একদিন আবির চারটার সময় ফিরে এসে জোরে জোরে শিমুকে ডাকতে শুরু করে। শিমু তাড়াতাড়ি ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো একজন বৃদ্ধ মহিলাকে নিয়ে এসেছে আবির। আবির শিমুকে বললো,
— “শিমু ইনি হচ্ছেন আমার মা। কত খুজেছি পাইনি। দেখো আজ পেয়ে গেছি। তাই নিয়ে এলাম সাথে করে।”

শিমু আবিরের মাকে সালাম দিলো। আবির তার মাকে বললো,
— “মা ও হচ্ছে শিমু। আমার পিচ্চি বউ।”

শিমু মুচকি হাসলো। আবিরের মা সেখানে দুজনকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। বললো,
— “তোকে বোঝা ভেবে ফেলে চলে গেছিলাম। যেই সন্তানকে আপন করে নিয়েছিলাম আজ তারা আমায় বোঝা ভেবে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে চলে গেছে। বাবা আমাকে মাফ করে দিস।”

আবিরও আবেগাপ্লুত হয়ে গেলো। সেও তার মাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বললো,
— “মাফ চেয়ো না। তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি মা। তোমাকে এতোবছর পর খুজে পেয়েছি তাতেই আমি খুশি। পুরানো দিনের সব কিছু বাদ।”

আবিরের মা ফিরোজা বেগম শিমুকে কাছে ডাকলেন। শিমু ফিরোজা বেগমের সামনে হাটু গেড়ে বসলো। শিমুর গাল দুইহাতে ধরে কপালে চুমু দিলেন ফিরোজা। আবির বললো,
— “মা জানো আমি তোমাকে কত ভুল বুঝেছি আগে।কিন্তু এই যে এই পিচ্চিটাকে দেখছো, এই পিচ্চিটা আমার সব ভুল ভাঙিয়ে আবার তোমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে।”

ফিরোজা অবাক চোখে তাকালো শিমুর দিকে। ফিরোজা বললো,
— “আমিতো চিনতেই পারিনি আবিরকে। সেই ছোট্ট থাকতে ফেলে চলে গেছিলাম। বৃদ্ধাশ্রমের গেটের কাছে দাড়িয়ে ছিলাম আজ। সেখানে আবির আমাকে দেখে চিনতে পেরে পরিচয় দিয়ে বললো সে আমার ছেলে আবির। কত অপরাধ জেগেছে আজ। তবে খুশিও লাগছে। তুই অনেক ভালো মা।”

শিমুর কপালে আবার চুমু দিলো। শিমু ফিরোজাকে ধরে ওয়াশরুমে এনে ভালোমতো গোসল করিয়ে দিয়ে ভালো থেকে একটা সূতির শাড়ি পরিয়ে দিলো। তারপর ভাত দিলো খেতে। তিনজনে হেসে খেলে দিন পার করে এখন।

চলবে,,,
® নাহার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here