#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_১৩
দরজার লক ভেঙ্গেই সিমিকে ওয়াসরুম থেকে বের করে আনা হলো।
অনেকটা সময় পার হয়ে গেলেও সিমি বের হচ্ছে না দেখে পরশ ডাকাডাকি শুরু করেছিল। কোন সাড়া শব্দ নেই দেখে বাসার অন্যদের জানালো। সবাই জড়ো হয়ে গেলো ওয়াসরুমের সামনে।এর পর পরশের বাবা নাঈম আর পরশ ধাক্কা দিতে দিতে লক ছুটে এলো।
সিমিকে ফ্লোরে পরে থাকতে দেখে সবার চোখ কপালে উঠে গেলো।চোখে মুখে পানি দেয়ার পর সিমি চোখ খুলে তাকালো।
হঠাৎ এই অবস্থা দেখে সবাই মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেলো।একটু সন্দেহ উঁকি দিলো মনে,এটা সিমির নতুন কোন চাল নয় তো?
একটু ঠিক হয়ে আসার পর সিমিও বলতে পারলো না কেন হঠাৎ করে ওর এমন হলো। তবে সে জানালো কয়েকদিন থেকেই মাথাটা কেমন ঘোরে,খেতেও মন চায় না।আগে তো কখনো এমন হয়নি।পরশের মা রোকেয়া মানা করলেন আজ ভার্সিটিতে যেতে।এমনটা হওয়া তো ভালো না।কি কারনে হলো,কারণটা তো বের করতে হবে।তাই রোকেয়া বললেন,বিকেলে একজন মেডিসিন স্পেশালিস্টকে দেখিয়ে আনবেন।সিমি ভালো করে নাস্তা ও করলো না।পরশের দাদু কাছে এসে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সিমিকে ভালো করে খেয়াল করলেন,একটা সন্দেহ তার মনে উঁকি দিলো। সবাই যার যার কাজে চলে গেলে সিমিকে জিজ্ঞেস করলেন। কথাটা শুনে সিমি আকাশ থেকে পড়লো যেন।এটা কিভাবে সম্ভব,একেবারে ছিটকে উঠলো।এই অবস্থা দেখে দাদি বললেন-
—তোমার তাইলে বাচ্চা হইতে পারে না?
সিমি মনে মনে যেন একটু দমে গেলো দাদির কথার দৃঢ়তা দেখে।
—যদি সন্দেহ থাকে ,বাসায় কত ভাবে না পরীক্ষা করা যায় ? পরীক্ষা কর।পরশের লগে কথা বল।
দাদির সন্দেহই ঠিক হলো।আগের দিনের অভিজ্ঞ চোখ বলে কথা। সমস্যা হলো,সিমি কিছুতেই এই বাচ্চা রাখবে না।সে এখনই বাচ্চার মা হতে চায় না।এই অপ্রত্যাশিত খুশির খবরে প্রথমে সবাই ভেবে পাচ্ছিল না খুশি হওয়া উচিত কিনা। কিন্তু কি করা খুশি তো খুশিই সেটা প্রত্যাশিত হোক বা অপ্রত্যাশিত।
পরশের বিশ্বাস করতে যেন কষ্ট হচ্ছে ব্যপারটা কি ঘটতে যাচ্ছে,হজম করতে কিছুটা কষ্ট হলো। তার জীবনের সব কিছুই যেন টুপ করে এসে হয়ে যাচ্ছে।এখন তাদের সাথে সাথে তাদের বাচ্চার দায়িত্ব ও নিতে হবে তার বাবা-মাকে।পরশ এটাও বুঝতে পারছে না তার কি আসলেই খুশি হওয়া উচিত?সিমি যে পাগলামি শুরু করেছে তাতে কখন কি করে বসে ঠিক নেই।আর এখন মাত্র শুরু এর মধ্যেই অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে অবস্থা কাহিল কিভাবে কি হবে তার মাথায় আসছে না।এত সতর্ক থাকার পরেও যে পৃথিবীতে আসবে কোন না কোন ভাবে চলে আসেই।এই জন্য সিমি সম্পূর্ণ দোষারোপ করছে পরশকে,পরশ বার বার বুঝিয়ে বলার পরেও বুঝতে পারছে না।পরশ ভাবনায় পড়ে গেল স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোন বন্ডিংই নেই এর মাঝে একটা প্রাণকে পৃথিবীতে এনে আবার কোন ঝামেলায় পড়তে হয়!এই সব চিন্তায় পরশের মাথাই এলোমেলো হয়ে গেলো।দাদি পরশের মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন ওর মনের অবস্থা কি।
দাদির সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করার পরে এখন অনেকটা হালকা লাগছে নিজেকে।
দাদি বললেন-
—এমনও হইতে পারে বাচ্চা হওয়ার পরে সিমি ঠিক হইয়া যাইতে পারে।যা হয় আল্লার তরফ থাইকাই হয় ভালোর জন্য হয়।
সবাই মিলে বুঝিয়েও লাভ হচ্ছে না।
সিমির মা-বাবা খবর শুনে এলেন।সিমির মা পারু কথা বলার পর সিমি ধমকে উঠলো।
শফিক তেড়ে এলেন-
—মায়ের সাথে এইভাবে কথা বলে?
—তোমার কাছেই তো শিখেছি।জীবনে কোনদিন তো মায়ের সাথে তোমাকে ভালো করে কথা বলতে দেখিনি।
—আমার মধ্যে ভালো কিছু নেই?আমি তো আমার মাকে সম্মান করেছি তাঁর কথার অবাধ্য কখনো হইনি।সেই সব দেখিস নি।ভালোটা কখনো চোখে পরেনি।মানছি তোর মায়ের সাথে আমি খারাপ ব্যবহার করেছি।তোর অন্য ভাইবোনরা ও দেখেছে ওরা তো এমন হয়নি।
—সবাই এক রকম হবে এমন তো কথা না।
—নিজের ইচ্ছায় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিয়ে করেছিস। সবকিছু কিছুটা ঠিক হয়ে এসেছে এখন আবার ঝামেলা করবি না।
—আমি কোন ঝামেলা করছি না।আমি এখন বাচ্চা পালতে পারবো না।এই বাচ্চা রাখবো না।
—সব কিছু তোর কাছে ছেলে খেলা?একটা প্রাণকে মেরে ফেলতে চাইছিস?যদি সত্যিই এই সন্তান না জন্ম দিতে চাস,তাহলে এর সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব তোর।আর উনাদের সাথেও কথা হয়েছে। এই পাপের সাথে তারাও নেই।তোর স্বামীই তো তোর সাথে নেই।একা একা কিভাবে কি করবি? অনেক জ্বালাতন করেছিস, অনেক সহ্য করেছি।এবার তোর ব্যপারে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
—কি সিদ্ধান্ত নিতে চাও?মেরে ফেলতে চাও?আমি বাচ্চা পালতে পারবো না।
এবার পারু বললেন-
—ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করতে পেরেছিস এখন এই অবস্থার সৃষ্টি করে ঢংয়ের কথা বলবি না।আমি আর তোর শাশুড়ি মিলে তোর বাচ্চা পালবো।
পম্পি আর নওমিকে রেডি হতে দেখে রজনী বলল-
—পম্পি তোমার শরীরটা এখনো দূর্বল।পরে যাও।
—আপনাকে এত অপমান করি তবুও কেন কথা বলতে আসেন?
—তুমি তা বল,সেটা অপমান না। তোমার মনের ক্ষোভ।হয়তো তোমার বাবার প্রতি কিংবা তোমার মায়ের প্রতি।
—মায়ের প্রতি?
—হু,হতে পারে।তুমি ভাবো কেন তিনি তোমাকে একা করে চলে গেলেন?কেন মৃত্যু আরো পরে আসলো না।সব দূঃখ আর ক্ষোভ আমি সামনে থাকি বলে আমার উপর প্রকাশ পায়।আমি দূঃখ পাই কিন্তু কিছু মনে রাখি না।
—আপনি কিসের তৈরি?
—তৈরি হয়তো একই মেটেরিয়াল দিয়ে। কিন্তু জীবনে এত অপমান আর দূঃখ সহ্য করতে হয়েছে যে এই সব কিছু মনে হয় না।এই সব বাদ দাও।কয়েকটা দিন থেকে যাও।
—নওমি ও আছে।আমি থেকে গেলে ও আবার একা হয়ে যাবে।
—নওমিও থাকবে সমস্যা কি?
রজনী এই কথা বললেও গত রাতে পম্পির বাবা অন্য কথা বলেছে।’পম্পি কাদের সাথে মিশে। আবার সাথে করে বাসায় নিয়ে আসে।এই সব মানা করবে।’রজনী বলেছিল-‘আপনার মেয়ে আপনি বলে দেবেন।আর একসাথে পড়াশোনা করলে কত ছেলেমেয়ের সাথে মিশতে হয়।নওমি মেয়েটা তো ভালোই মনে হচ্ছে। আপনি কি জানেন আপনার মেয়ে কোথায় থাকে?তাকে বাসায় এনে রাখতে পারেন না এখন এই সব কথা বলছেন।এত দিন পরে মেয়েটা এসেছে যা বলার আপনিই বলবেন আমি কিছু বলতে পারবো না।’
পম্পির বাবা এর পর আর কিছু বলেননি। রজনী চাচ্ছে আরো কিছু সময় , কিছুদিন বা সবসময় পম্পি এখানে থাকুক।মিলেমিশে না হোক,আত্নার সম্পর্ক না গড়ে উঠুক তবুও তো একজন থাকবে।এই এত বড় বাড়িকে ভুতুড়ে বাড়ি মনে হয়।
পম্পি একটু নরম হয়ে বলল-
—কয়েক দিন পরে এসে থাকবো।আমি বলি কি আপনি এখানে পরে আছেন কেন?
—কোথায় যাবো?কার কাছে যাবো?
—পড়াশোনা করেছেন, চাকরি করে একটা সম্মানের জীবন যাপন করতে পারেন।
—তোমার তাই ধারণা?যখন সাহস ছিল নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি তখন তোমার বাবার নজরে পরে যাই আর এখন তো শক্তি,সাহস কিছুই নেই। ডানা কাটা পাখির মতো,চাইলেও উড়তে পারবো না।
রজনীর মুখের দিকে তাকিয়ে পম্পির খুব খারাপ লাগছিলো। তার খুব কান্না করতে ইচ্ছে করলো রজনীকে জরিয়ে ধরে। কিন্তু তার পা একটুও এগোলো না।রজনী কি সেটা বুঝতে পারলো?সে এগিয়ে এসে পম্পিকে জরিয়ে ধরলো।
পম্পিও জরিয়ে ধরলো রজনী কে।
—আমি কি তোমাকে খালামনি বলতে পারি। তুমি অনেক ছোট আমার মা হিসেবে তোমাকে বিশ্বাস হয় না।
—অবশ্যই ডাকতে পার।
—এবার তাহলে আসি।
—খুব তাড়াতাড়ি তোমার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
নওমি এতক্ষণ নিরব দর্শক হয়ে ওদের কথোপকথন শুনেছে। রজনী ওকে জড়িয়ে ধরে আবার আসতে বলল।
নওমির ভালো লাগছে , অবশেষে পম্পি ওর বাসায় চলে আসবে। রজনীর সঙ্গে ভাব হয়ে গেলো। সবার জীবনে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে শুধু তার জীবন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই থাকবে।
নওমির মায়ের মুখটা সব সময় সামনে আসে একটা দুঃখে জড়ানো হাসিহীন একটা গম্ভীর মুখ।একটা ছবি মামার কাছে দেখেছিল তার মায়ের।সেখানে দুই বেনী করা একটা উচ্ছ্বল কিশোরীর ছবি। সাদাকালো সেই ছবিটা অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু