প্রেমানুরাগ পর্ব-১৮
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
নিরবতা ভেঙে প্রেমার বাবা মিস্টার পলক হাসান গম্ভীর স্বরে বলেন,
–তুমি যা বলছো ভেবে বলছো?
অনুরাগ মাথা নিচু থেকে হালকা উঠিয়ে প্রেমার বাবার দিকে তাকিয়ে নম্র ভাবে বলে,
–জ্বী আঙ্কেল।
প্রেমার বাবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে,
–হুজুগে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছো কি? আমার মেয়ের সারাজীবনের ব্যাপার এটা। তোমার কেনো মনে হয় আমি রাজী হবো? যেখানে সবটা অনিশ্চিত!
অনুরাগ মলিন চোখে তাকায়। সে চাইলে ডাইরেক্টলি বলে দিতে পারে যে,
“আমার বউ এখন আমি নিয়ে যাবো।”
কিন্তু এতে এক বাবার মনে কস্ট দেওয়া হবে। এমনিতে প্রেমার বাবা যদি রাজী হয় এরপরেও আরেকটা ঝড় বাকি থাকবে। একটা সম্পর্কে হাজারটা বাঁধা। এখন কারো অসন্তোষ নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলে সবটা ঘোলাটে থেকে যাবে। অনুরাগ নিজের ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলে,
–আমি জানি আঙ্কেল আপনার দুশ্চিন্তা আপনার মেয়ের ফিউচার নিয়ে। আমার মতো সেলিব্রেটিদেরকে কোনো কনজারভেটিভ ফ্যামেলি মেয়ে জামাই হিসেবে মানতে চাইবে না। আপনি তো পত্রিকাও পড়েন। সেখানে নিশ্চয়ই আমার নামে রটানো অনেক কিছু দেখেছেন যা খানিকটাও সত্য নয়। আর সবচেয়ে বড় কারন আমার বাবাকে নিয়ে। তার রিলেশন ও পারসোনাল লাইফ নিয়ে অনেকটা চর্চা হতো আগে। আপনি নিশ্চয়ই সবটাই জানেন। আমার বাবা রটানো কোনো কিছু মিডিয়াতে কখনো ক্লিয়ার করতো না তার পাবলিসিটির জন্য। কখনো যদি তার কো-একট্রেস খোলসা করত তখনই সব ক্লিয়ার হতো। এরজন্য আমার মা অনেক অসুখী ছিলেন। সবটাই আমি দেখেছি। মায়ের কস্ট আমাকেও ছুঁয়ে যেতো। এজন্যই আমি এব্রোড চলে গেছিলাম যাতে মিডিয়ার জগতে আসতে না হয় কিন্তু মৃত্যু শয্যায় মাকে দেয়া ওয়াদার কারনে বাবার কথা মানতে হয়েছে। এজন্য আজ আমি সুপারস্টার।
অণুরাগ থামে। মলিন মুখ নিচু করে রেখেছে সে। প্রেমার বাবা অনুরাগকে বলে,
–এখন যদি তোমার বাবার কথাতে কোনো সময় আমার মেয়েকে ছেড়ে দেও? তোমার কথার প্রেক্ষিতে ও আমার জানামতে সাহিল খান হয়তো এরকমটা করবে একসময়।
অনুরাগ ধীরতার সাথে বলে,
–আমার মা আমাকে এমনটাও বলেনি যে বাবার সব অন্যায় আবদার মানতে! উনি বলেছিলেন, আমি যেনো আমার বাবার সব কথা মানি তবে অন্যায়ের সাথে আপোষ না করি। আমার বাবা আমাকে মিডিয়া জগতে আসতে বলেছেন সাথে মায়ের কাছে করা ওয়াদা মনে করিয়ে তাই আমি বাধ্য হয়েছি। এখন আমার জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উনি হস্তক্ষেপ করতে পারবে না কারন সেই ওয়াদাও আমি বাবার থেকে নিয়ে রেখেছি। এখন উনি যদি কখনো আমাকে প্রেমাকে ছেড়ে দিতে বলে সেটা আমার ভাষ্যমতে অনাধিকারচর্চা হবে।
প্রেমার বাবার কিছুটা সন্তুষ্টি হলো তবে এবার তিনি অনুরাগকে পরোখ করতে বললেন,
–যদি তোমার কখনো মনে হয় আমার মেয়ে তোমার যোগ্য না তবে? তখন তো তুমি ওকে মাঝপথে ছেড়ে দিবে। আফটারঅল সেলিব্রেটিদের সংসার ভাঙার রেকর্ড অনেক। তুমি একজন সুপারস্টার কিন্তু আমার মেয়ে একজন সাধারন মেয়ে। তখন সেই পরিস্থিতিতে সব দোষ আমার মেয়েকে বহন করতে হবে। আমি কেনো আমার মেয়ের জীবন নিয়ে রিস্ক নিবো!
অনুরাগ বাদে ঘরের প্রতিটা মানুষের মনে এই শঙ্কা তো আছে। সচরাচর তো এটাই হয়। তাও সানাফ তার চাচাকে ইশারা করে কিছু বলতে কিন্তু সানাফের চাচা মিস্টার পল্লব হাসান নির্বিকার। তিনি তার ভাইয়ের পক্ষে সেটাই সানাফ ও প্রিয়মকে চোখের ইশারাতে বুঝিয়ে দেন।
হবে নাই বা কেনো? প্রতিটা দায়িত্বশীল বাবা নিজের মেয়েকে সুপাত্রে পাত্রস্থ করতে চান। সব দিক বিবেচনা করতে চান।
অনুরাগ মুচকি হেসে নম্র স্বরে বলে,
–আপনার কথা ও চিন্তা পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত। তবে একটা কথা, মানুষের মন কখন পরিবর্তন হয় সেটা কেউ বলতে পারে না। আপনি যদি একজন ভদ্র ও ভালো ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলেকেও নিজের মেয়ে জামাই করেন তার সব খোঁজখবর নিয়ে। তারপরেও আপনি কতটা নিশ্চিত সে সবসময় আপনার মেয়েকে আগলে রাখবে? কখনো ছেড়ে যাবে না? যার মন পরিবর্তন হবার হয় সেটা বলে কয়ে হয় না। হুট করেই হয়। সেই ছেলেও তো আপনার মেয়েকে ছেড়ে দিতে পারে যদি আপনার মেয়ের কপালে বিচ্ছেদ লিখা থাকে। আবার কারো হায়াতের বিশ্বাস নাই। এমনও হতে পারে এই মুহূর্তে আমার মৃত্যু আমার সন্নিকটে উপস্থিত! সবটা বিধাতার লিখন। আপনি আমি খন্ডাতে পারবো না। তবে তাও সচ্চরিত্রের ছেলের সাথে বাবারা মেয়ে বিয়ে দেয় সবদিক বিবেচনা করে। যা করা প্রতিটা বাবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু কোনো দুশ্চরিত্রের মানুষ যদি নিজের বাহিরের সুন্দর আবরন দ্বারা আপনাকে আকৃষ্ট করে ভিতরের কুৎসিত মনকে ঢেকে রাখে তাতে কেউ কিন্তু তার ভিতরটার সন্ধান জানতে পারবে না। ছেলেটার পরিবার ভালো কিন্তু ছেলেটা সবার থেকে নিজের খারাপ গুন লুকিয়েও রাখতে পারে বা ফ্যামিলি তাদের ছেলের সত্য প্রকাশ করলো না! সবকিছু হতে পারে। এবার ডিসিশন আপনার হাতে।
অনুরাগ থামে। প্রেমার বাবার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির ঝিলিক ফোটে। তিনি অনুরাগের কথাতে সন্তুষ্ট। মানুষের বর্তমান ও অতীত কর্ম মানুষের ভাগ্য বদল করতে পারে। অনুরাগ তার অতীত ক্লিয়ার করেছে এবং তার বর্তমান সবার সামনে। এখন ভবিষ্যতে কি হবে সেটা কেউ জানে না। অনুরাগের উত্তরে ঘরে অবস্থানরত সবাই খুশি।
প্রেমার বাবা গলা ঝেড়ে বলে,
–আমার মেয়ে যেহেতু রাজী তাই আমার কোনো আপত্তি নেই।
প্রেমার বাবার কথায় সবাই অবাক প্লাস খুশিতে একদম হা করে তাকিয়ে আছে। প্রেমার বাবা সেটা দেখে বলে,
–এতো অবাক হবার কিছু নেই। আমি কোনো দজ্জাল বাবা নই যে মেয়ের খুশিটা বুঝবো না।
প্রিয়া ও ইশা একত্রে চিৎকার করে উঠে খুশিতে। প্রেমার বাবার ও প্রিয়ার বাবা দুই মেয়ের হঠাৎ চিৎকারে কানে হাত দিয়ে ফেলে। ইশা ও প্রিয়া দৌড়ে গিয়ে অনুরাগের দুই পাশে বসে পরে। প্রিয়ার বাবা তার মেয়ের বাচ্চামো দেখে মেয়ের মাথায় হাসতে হাসতে টোকা মারে। প্রিয়া মাথা চুলকে দাঁত কেলাচ্ছে।
প্রেমার মা, চাচি, সিয়া সবাই অনেক খুশি। প্রেমার মা আঁচলে চোখ মুছে। সিয়া দৌড়ে সানাফকে জড়িয়ে ধরেছে শ্বশুর-শাশুড়িদের সামনে। সিয়ার কান্ডে ওর শ্বাশুড়িরা হেসে ফেলে। সানাফ প্রথমে লজ্জা পেলেও পরে নিজেও সিয়াকে এক হাত দিয়ে আগলে নেয়। প্রিয়ম ইশা যেখানে বসে আছে তার পেছোনে গিয়ে ইশার অপরপাশ দিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
–প্রেমময়ী! একদিন এভাবেই তোমার বাবাকে রাজী করাবো।
ইশা লজ্জায় সেখান থেকে উঠে প্রেমার ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। প্রেমাকে ডাকবে এখন। প্রেমার চাচি রান্নাঘর থেকে মিষ্টির প্লেট সাঁজিয়ে নিয়ে আসে। প্রেমার বাবা আগে অনুরাগকে মিষ্টি মুখ করিয়ে জড়িয়ে ধরে আলগোছে। এরপর একে একে প্রেমার মা, চাচা, চাচি, ভাই, ভাবি, বোন সবাই অনুরাগকে মিষ্টি মুখ করায়। বেচারা অনুরাগ মিষ্টি খেয়ে কাহিল। এমনিতে সে ডায়েটের কারনে সুগার খুব একটা খায় না। অসহায় চোখে সবার দিকে তাকিয়ে আছে সে। সবাই ওর চাহনি দেখে হেসে ফেলে।
_________
“অনিশ্চয়তার কালোমেঘ হটে নবলোক পরিচ্ছন্ন হয়,
তখন মুক্ত বিহঙ্গরা সুবিশাল অম্বরে ডানা মেলে।”
প্রেমাকে ইশা যখন দরজার বাহির থেকে জোরে ভালো খবর দেয় তখন যেনো এক লহমায় প্রেমার কাছে সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো। এক সুন্দর স্বপ্ন। যা ভেঙে যাবার ভয় তার প্রচুর। প্রেমা স্তব্ধ হয়ে জায়নামাজে বসে আছে। যখন সবটা তার কর্ণকুহর পেরিয়ে মস্তিষ্কের নিউরনে বারংবার ধাক্কা দেয় তখন সে খুশিতে কেঁদে ফেলে। তৎক্ষণাৎ আল্লাহর কাছে দুই রাকাআত শুকরিয়া নামাজ পড়ে ফেলে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।
সব ঠিক করে দিছি। 😁