শাপলা ও সেতুর গল্প পর্ব-৫

0
285

#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-৫]

সময়ের অক্লান্ত যাত্রা এখন বিকেলের অতিথিশালায় অবস্থান করছে। সূর্যের তেজে ভাটা পড়েছে।
কিন্তু রূপের শোভা বেড়েছে কয়েকগুন। কিংবা বলা যায় সারাদিনের পরিশ্রমের পর প্রকৃতিতে দৃষ্টি মেলার অবকাশ মিলেছে বলেই বিকেলের সৌন্দর্য বেশি মনে হয়। নীল আকাশে সিদুররাঙা মেঘের আনাগোনা। লিখি হুটখোলা রিক্সায় বসে আকাশে দৃষ্টি মেলে তার অপার, অশেষ রূপ অবলোকন করতে করতে বাসায় ফিরলো। ওর কাধ ছাড়ানো খোলা চুল এলোমেলো হয়ে আছে। ঘর্মাক্ত মুখটা ওড়নার একাংশ দিয়ে মুছে বিছানায় বসতেই লিখির মা রেবেকা এসে দরজায় দাঁড়ালেন। আদুরে স্বরে বললেন,

“তুই ফিরেছিস?”

“দেখছোই তো ফিরেছি।” লিখি বিরক্ত হলো।

“হ্যাঁ তাইতো। যা গোসল সেড়ে আয় জলদি। বেশি সময় নিয়ে করবি না। দিন পরে এসেছে, ঠান্ডা লেগে যাবে। খাবার গরম করে টেবিলে দিচ্ছি।”

লিখি ভ্রু কুচকালো। রেবেকা হাওয়ায় উড়ে যেন চলে গেলেন। লিখি গোসল সেড়ে টেবিলে আসতেই দেখলো আজ ওর প্রিয় খাবারগুলোই টেবিলে। আলুভর্তা, লতি দিয়ে চিংড়ির তরকারি, মুগ ডাল, ঝাল করে মুরগির মাংস। তবে সবার আগে আলুভর্তাটাই লিখির নজর কাড়লো। কেননা তাদের বাড়িতে আলুভর্তা নিয়ে দুইটি দল রয়েছে। লিখির বাবা-মা কাঁচা তেল ও কাঁচা পেয়াজের ভর্তা পছন্দ করেন। লিখি আর রিথী পছন্দ করে তেলে ভাজা ভর্তা। এই নিয়ে দ্বন্দ্বও কম হয় না। তবে আজ তেলে ভাজা ভর্তা করেছেন রেবেকা। ওনার মেজাজও আজ বেশ ভালো। লিখির কপালের ভাজ আরেকটু গাঢ় হলো। তবুও সে চুপ রইলো। তার মা কোনোকিছু বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারেন না। তাই কোনো বিশেষ কারণ থাকলে অবশ্যই বলবে। লিখির খাওয়ার সময় রেবেকা বিশেষ কিছু বললেন না। তবে নিজেই সব এগিয়ে দিলেন। অন্যসময় সব সামনে দিয়ে রাখলেও এগিয়ে দেন না। খাওয়া শেষে লিখি মাথার চুল ঝেড়ে বারান্দায় দাঁড়ালো। ওদের এলাকা শহরের অদূরে মফস্বলে বলা যায়। লিখিদের বাড়িটা ঘিরে গাছপালার সমাবেশ। বাইরে তাকালেই মন ভালো হয়ে যায়।

রেবেকা এককাপ চা করে আনলেন মেয়ের জন্য। লিখি চায়ে লম্বা চুমুক দিলো। চায়ে চিনির মাত্রা খুবই কম। চিমসানো মুখে বললো,
“চিনি আরেকটু বাড়িয়ে দেওয়া যায় না? তৃপ্তি না পেলে খাওয়ার মানে হয়?”

“চিনি একদম খাবি না। মেদ হবে। মেদ হলে মুখে বয়সের ছাপ পড়বে। লাবন্য কমে যাবে।”

“এত ভেবে খেলে তো স্বাদই ত্যাগ করতে হবে।”

“এখনই সচেতন থাকার সময়। তোর ফুপুর মেয়ে মুনিয়াকে দেখেছিস? বয়স হচ্ছে, ওজনও বেড়েছে। তাইতো এখন ভালো পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না।”

লিখি উত্তর দিলো না। রেবেকা আবার বললেন,
“প্রতিদিন এত খাটুনি করে অফিস করার কি কোনো দরকার আছে?”

“আছে। কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি কি ঘরে বসে থাকতে?”

“প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে কোনো লাভ আছে? সরকারি চাকরি হলেও একটা নাম থাকতো।”

“এখন আবার প্রতিযোগিতায় নামতে বলো না, মা। জীবনে কম প্রতিযোগিতা তো করলাম না। এখন আবার চাকরির পিছনে ছুটতে নতুন করে পড়াশোনা করতে পারবো না। প্রাইভেট কোম্পানিতে যা ইনকাম, তাতে আমার ভালোই চলে যাবে।”

“ক্ষেপছিস কেনো? আমি তো চাকরি করতে বলছি না। বয়স হয়েছে, বিয়ে করে সংসার করবি। শুধু শুধু এত খাটুনির কি দরকার?”

“ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে ঝেড়ে কাশো।”

রেবেকা আরেকটু পাশ ঘেঁষে মেয়ের ভেজা চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে বললেন,
“তোর মামা কল দিয়েছিলো।”

“তাই তো বলি, এত খাতির করছো কেনো?”

“আহা, শুনবি তো।”

“বলো।”

“একটা ভালো পাত্র আছে হাতে।”

“তারপর?”

“বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। প্রবাসে আছে। টাকাপয়সার কোনো অভাব নেই। তারা একটি শিক্ষিত, ভদ্র মেয়ে খুঁজছে। তোর মামা তোর কথা বলেছে। ছবিও দেখিয়েছে। ওদের পছন্দ হয়েছে। তুই চাইলে!”

“চাইলে?”

“তাদের বাড়িতে ডাকতাম।”

“বাবা কি বলে?”

“তুই রাজি হলে তোর বাবাকে জানাবো।”

“প্রবাসী বিয়ে করে ইমো অ্যাপে সংসার করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, মা।”

“আর মানুষ কি করে না? তাছাড়া ছেলে নিজেকে গুছিয়ে বউকেও বিদেশে নিয়ে যাবে।”

“আমার ইচ্ছে নেই, মানা করে দাও। হুটহাট রাগ করে যদি বাপের বাড়িই না আসতে পারি তাহলে কি বাঙালি সংসারের ফিল পাবো নাকি?”

“এটা কোনো কারণ হলো? আর মানুষ কি বিদেশে সংসার করে না?”

লিখি কোনো কথা বললো না। ওর নির্লিপ্ত ভাব দেখে বোঝা গেলো সে আগ্রহী নয়। অবশ্য বাবা বললে লিখি ফেরাতে পারতো না। কিন্তু বাবাও এই নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাবেন না যদি লিখির মত না থাকে। রেবেকার বাপের বাড়ির সঙ্গে জাহিদুল ইসলামের সামান্য মনমালিন্য আছে। তাই রেবেকা আগে মেয়েকে মানাতে এসেছিলেন। রেবেকার গলা কর্কশ হতে শুরু করলো,
“তুই কি সত্যিই মানা করছিস? তোর মামা অনেক বড় মুখ করে পাত্রপক্ষকে তোর কথা বলেছেন। একবার দেখতে এলে তো ক্ষতি নেই।”

“দেখতে এলেই বিয়ে হয় না, এই ফাঁদে আমি পা দিচ্ছি না। একটু আগেই মামী আমাকে ছেলের ছবি পাঠিয়েছেন। তাকে আমার পছন্দ হয়নি। বয়স বেশি মনে হয়।”

রেবেকা দূরে সরে গেলেন। রাগি গলায় বললেন,
“তোরা সব মর্ডান হয়েছিস? বিয়ে করবি না। এদিকে নিজের যে বয়স হচ্ছে, সে খেয়াল আছে?”

“বিয়ে করবো না কখন বললাম। এই লোকটাকে বিয়ে করবো না বলেছি। আর এমনভাবে বলছো যেনো ত্রিশ পেরিয়ে গেছি। আমার আর কোনো গতি নেই।”

“বাঙালি মেয়েদের পঁচিশও কম না। মুনিয়ার বিয়ে হচ্ছে না বয়সের জন্য। ওকে দেখেও কি শিক্ষা হয় না তোদের?”

লিখির ভীষণ রাগ হলো। মুনিয়া আপুকে সে খুবই পছন্দ করে। মেয়েটার মলিন গায়ের রঙ এবং বাড়তি ওজনের ফলে সঙ্গী নির্ধারণে ভাগ্য বড়ই নিষ্ঠুর আচরণ করছে। আর মা বারবার তাকেই টেনে উদাহরণ দিচ্ছেন। সে তাচ্ছিল্য করে বললো,
“এখন যদি আমার চাকরিটা না থাকতো, তুমি অনায়াসেই বলতে যে ঘাড়ে বসে খাচ্ছি।”

রেবেকা কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ফোঁসফোঁস করে বললেন,
“এরপর যখন ভালো পাত্র পাবে না তখন এই মাকেই মনে পড়বে।”

“ভাইয়ের কাছে মুখ ছোট হবে বলে মেয়ের মতামতকে অপছন্দ করছো? তুমি আসলে মা বেশি নাকি ভাইয়ের বোন বেশি?”

“না, আমি হলাম দাসী। তোর বাপ আমাকে রেখেছে তোদের দাসী হিসেবে।”

রেবেকা চলে গেলেন। লিখি জানে এখন তার মা ঘরে দরজা আঁটকে দেবেন। রাতের খাবারও খাবেন না। একটি রাত না পার হওয়া অবধি ওনার রাগ কমবে না।

রিথী উঁকি দিলো বারান্দায়। লিখি ওকে দেখে বললো,
“কি ব্যাপার রে? আজ আমি অফিস শেষে আসলাম অথচ তোকে দেখলাম মাত্র। কোথায় ছিলি?”

“মাকে আজ খুশি খুশি দেখলাম। আর খুশি থাকলেই মায়ের স্মৃতিশক্তি তুখোড় হয়ে যায়। তখন কবে ক্লাস টেস্ট হয়েছে, কি নম্বর পেয়েছি, কোন সাব্জেক্টে খারাপ করেছি, সব নিয়ে তদারকি করতে বসবে। তাই ছাদে কাপড় তুলতে যাওয়ার নাম করে ঘাপটি মেরে ছিলাম। জানতাম তুমি এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

লিখি হেসে ফেললো। বোনের চুল টেনে বললো,
“বাদর হচ্ছিস। মা আর ওসব দেখবে না। আজ আর কথাও বলবে না।”

“রেগে গেছে না?”

“হুম।”

“রাগুক। তুমি বিয়ে করবে না। প্রবাসী তো নয়ই। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতেই পারবো না।”

“তোকে যৌতুক হিসাবে প্যাকেট করে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবো।”

____________

মাঝরাতে হুট করে রুনির ঘুম ভেঙে গেলো। সে তড়িঘড়ি করে উঠে আধারে হাতড়ে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে স্বামীর ফোনে কল দিলো। রিসিভ হতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে বললো,
“বাবুর আব্বু, তুমি কি আরেকটা বিয়ে করবে? আম্মা কি তোমার জন্য মেয়ে দেখছে?”

নওশাদ ঘুম জড়ানো কন্ঠে খুব শান্তভাবেই বললো,
“তুমি কি একা ঘুমিয়েছো রুনি?”

“হ্যাঁ, তুমি কি করে জানলে?”

“তুমি ঘর থেকে বেরিয়ে রাসিফের কাছে যাও। ওকে ফোনটা দাও।”

“কেনো? তুমি কি আমাকে সত্যিটা বলতে সংকোচ করছো? তুমি কি আসলেই বিয়ে করবে? তুমিও আম্মার মতো আমাকে বোকা ভাবো? বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।” কান্নায় রুনির কন্ঠ বুজে এলো।

“জানি তো। আমি কোনো বিয়ে-ফিয়ে করছি না। এবার ভাই অথবা মায়ের কাছে যাও।”

রুনি বাধ্য মেয়ের মতো ঘর ছেড়ে বের হলো। ওর কান্না থেমেছে। কিন্তু চোখ টলমল করছে। রাসিফকে দুইবার ডাকতেই সে ঘর ছেড়ে বের হলো। চোখ কচলে বললো,
“একি! কাঁদছো কেনো আপা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছো? অসুস্থ লাগে?”

রুনি মাথা নেড়ে না করলো। রাসিফ পুনরায় বললো,
“কিছু খাবা?”

“তোর দুলাভাই কথা বলবে।”

রাসিফ ফোন কানে নিলো। সালাম বিনিময় করে নওশাদ বললো,
“তোমার আপাকে একা ঘুমাতে দিয়ো না রাসিফ। এই সময় ও খুব বেশি খারাপ স্বপ্ন দেখে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে কাঁদে। ওকে মায়ের সঙ্গে ঘুমাতে পাঠাও। জেদ করলেও আলাদা ঘুমাতে দেবে না। আমি কালই আসবো।”

“চিন্তা করবেন না দুলাভাই। আমি আছি।”

“সেটাই ভরসা।”

রাসিফ রুনিকে মায়ের ঘরে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে রইলো। রুনি মিনমিন করে বললো,
“তোর দুলাভাই সত্যিই বিয়ে করবে না তো?”

“করবে না। এবার ঘুমাও তো।”

রুনি চোখ বোজে। রাসিফ আপার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি সরল তার মুখশ্রী। সারাদিন সব আজগুবি কথা দিয়ে বিরক্ত করে। অথচ এই বোকা আপা আর মাকে ঘিরেই তার জীবন।

চলবে…

(আজ গল্প দেবো না ভেবেছিলাম। লেখার মানসিকতাই ছিলো না। আমার কতগুলো পোষা পাখি আছে। যাদের দলের নাম সঙ্গীত সভা। সেখানে সব উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গীত শিল্পীরা বসবাস করেন। তাদের গানে মাঝে মাঝে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। ওদের সঙ্গে হৃদয়ের অদ্ভুত, নামহীন এক সম্পর্ক হয়ে গেছে। ওরা সামান্য ব্যাথা পেলেও বুকে লাগে। কিছুদিন আগেই সঙ্গীত সভার একজন সদস্য মা’রা গেছে, আরেকজন হারিয়ে গেছে। আজ সকাল থেকে আরেকজন অসুস্থ। ফলে মন ভালো নেই। দোয়া করবেন, যেন আর কাউকে না হারাতে হয়।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here