রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-৫

0
400

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মাৌমিতা
৫.

“ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিও না!”

কক্ষে জিন্নাতের উপস্থিতিতে আতরের খুশবু ছড়িয়ে পড়লো চারোধারে। রাজকন্যা শয্যায় শুয়ে তখন বিশ্রাম করছিলো। আকস্মিক এই খুশবু আর জিন্নাতের কন্ঠ পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো।

“এলে তুমি?”

অভিমানী কন্ঠে জানতে চাইলো রাজকন্যা। জিন্নাত ওর সজ্জিত শয্যায় বসলো নিরিবিলি। এখন রজনির প্রথম প্রহর। আকােশে উঠেছে পূর্নিমার মস্ত বড় চাঁদ। জিন্নাত সেদিকেই দৃষ্টি রাখলো। জবাব দিলো না।

“এখনও রাগ করে আছো?”

“বাহিরে তোমার বিবাহের আয়োজন হচ্ছে। দেখেই এলাম।”

“আমার কথার জবাব দাও।”

“দিয়েছি!”

“কোন বেলা দিলে?”

“ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিওনা।”

জিন্নাত কথাটা আবারও আওড়ালো। রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শয্যা ত্যাগ করে উঠে এলো অলিন্দে। চারপাশে তাজা ফুলের গন্ধে মোঁ মোঁ করছে। রাজকন্যা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। অতঃপর বলল,

“তুমি চলে গেলে, আর দেখো আমার জীবনের কত রঙ বদলে গেলো।”

“আমি সারাজীবন থাকবো না কি তোমার সঙ্গে?”

“থাকবে না বুঝি?”

“তোমার বিবাহের পর রাজকুমারই হয়তো তোমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হবে রাজকন্যে। হয়তো কি বলছি, এটাই যে সত্যি!”

“তুমি আমাকে এখনি পর করে দিচ্ছো তো?”

রাজকন্যের কন্ঠে কেমন অসহায় টান। জিন্নাত হাওয়ায় ভেসে ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। অমনি রাজন্যার নাকে এসে বারি খেলো আতরের খুশবু। রাজকন্যা পাশ ফিরে তাকালো জিন্নাতের দিকে। কিছু বললো না। পূনরায় দৃষ্টি বাহিরে স্থির করলো।

“রাজকুমারের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়েছিলুম। কোনো খারাপ দিক তো খুঁজে পাইনি। তবে..”

রাজকন্যার বুক কাঁপল।

“তবে?”

“তবে একটু বদরাগী এই যা।”

রাজকন্যা দম ছাড়লো। বলল,

“ওটা পুরুষের থাকেই।”

“রাজা মশাই খুবই ভালো এবং আন্তরিক মানুষ ছিলেন। উনার মৃত্যুর পর কাল নেমেছিলো উনার রাজ্যে। রাজকুমার যা একটু ফিরিয়েছিলো.. কিন্তু এখন আবারও সেই করুন অবস্থায় ফিরে গেছে। মানুষ রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছে। না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে। তাই রাজকুমার সিরাজদি রাজ্যে চলে এসেছে। নিজের করুন অবস্থা ফেরাতে আর তার আব্বাজানের কথা রাখতে।”

“সবই শুনেছি।”

“তোমার এই বিবাহে আমার কোনো আপত্তি নেই রাজকন্যে।”

রাজকন্যার চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো খুশিতে। চমৎকার হেসে জড়িয়ে ধরলো জিন্নাতকে। আনন্দিত গলায় বলল,

“সত্যি বলছো তুমি? আমি এই বিবাহ করে ভুল করছি না তো?”

জড়িয়ে ধরলো জিন্নাতও। সব অভিমান,অভিযোগ পাশে ঠেলে বলল,

“না। ভুল করছো না। তবে মনে রেখো, কখনও অন্যের উপর অন্ধবিশ্বাস করবে না। রাজকুমার, চাচাজান, চাচীজান যতই তোমার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিক না কেন, কখনও নিজেকে ছাড়া অন্যকে বিশ্বাস করবে না। তুমি একাই এই রাজ্য সামলাতে পারো,তাই তোমার অন্যের জ্ঞানের প্রয়োজন নেই।”

“আচ্ছা। জানো জিন্নাত, আম্মাজানের বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করছে! তার আসল মুখটা সামনে আনা এতো সহজ হবেনা। সে বড় চালাকি করে কবিরাজ মশাইকে ফাঁসিয়েছেন! আর উনি বেচারা এই বিষয়ে মুখ খুলতেই ভয় পাচ্ছেন। আমার মনে হয় উনাকে হয়তো ভয় দেখিয়ে চুপ রাখা হয়েছে।”

“তোমার কি কাউকে সন্দেহ হচ্ছেনা?”

“কাকে?”

“চাচাজান কে!”

“আবার শুরু করলে তুমি? আচ্ছা চাচাজান তোমার কি এমন ক্ষতিটা করলো শুনি?”

“উনাকে আমার কোনো কালেই পছন্দ নয়।”

“কাউকে পছন্দ না করাটা অন্যায়ের কিছু নয়। তাই বলে তাকে এভাবে দোষারোপ করাটাও কাজের কথা নয় জিন্নাত!”

“রাজকুমারকে তুমি ছোটো বেলা দেখেছো রাজকন্যে?”

“দেখেছি হয়তো। মনে নেই।”

“রাজকুমার তোমায় খুব নিখুঁত ভাবে চেনে। উনার চোখে তেমার প্রতি গভীর প্রেম!”

“যাহ্..”

“লজ্জা পেলে?”

জিন্নাত মুচকি হাসলো। রাজকন্যা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। বলল,

“তুমি উনাকে কখন দেখলে?”

“আসার পথেই দেখলাম।”

“কোথায়?”

উনার কক্ষে। আগামী দিনের জন্য পোশাক নির্ধারণ করছিলেন। সঙ্গে এক যুবকও ছিলেন। আদিম,অনিন্দ,তীর্থ সহ আরও অনেকে। সবার সঙ্গেই বেশ সখ্যতাপূর্ন আচরণ।

রাজকন্যার মন জুড়ালো। যাক, সারাজীবন যার সঙ্গে থাকবে বলে ভাবলো সে অন্তত মুখ চোরা নয়। কিংবা ঘরকুনোও নয়। সবার সাথে সখ্যতা গড়তে পারে অতি সহজে।

“গতরাতেই আমার রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।”

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কথাটা বলল রাজকন্যা। জিন্নাত চিন্তিত স্বরে বলল,

“কখন? আর কেমন করে?”

“আমি সুফিকে নিয়ে রোজকারের ন্যায় আব্বাজানের সন্ধানে বেরিয়ে ছিলাম। জঙ্গল পেরোতে বড় মাঠে কদম রাখতেই দেখতে পাই একটু অদূরেই একফালা অগ্নিকুণ্ড জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। হাতের তলোয়ার শক্ত রেখে এগিয়ে গেলাম ওদিকটায়। প্রথমে ভেবেছিলাম গুপ্তচর! অতঃপর দেখি পথচারী। হয়তো পথ হারিয়েছে তাই তাবু টানিয়ে রাত পার করছে। বারকয়েক ডাকলাম। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পায়নি। হঠাৎ মনে ভয় জাগলো! কোনো বন্যপ্রাণী আক্রমণ করলো না তো? ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে খচমচ করে শব্দ করছিলো। তখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম এ বন্যপ্রাণী ছাড়া আর কিছুই নয়। মানবের প্রাণহানি ঘটেছে নিশ্চিত। তাই আন্দাজেই তলোয়ার চালাই। প্রায় অনেক্ষন ধস্তাধস্তি হওয়ার পর প্রকট হয় তার মুখখানা।”

“রাজকুমার তোমার মুখ দেখেছিলো?”

চিন্তার মাত্রা একধাপ বেড়ে গেলো জিন্নাতের। রাজকন্যা মাথা নাড়লো। অর্থাৎ না। জিন্নাত হাফ ছাড়লো। বলল,

“জানতে দেওয়াটা উচিৎ হবে না!”

“হু। তাই নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিলাম। উনি বারবার জানতে চেয়েছিলেন। উদগ্রীব হয়ে পড়ছিলেন।”

বলে মুখে হাত চেপে হাসলো রাজকন্যা। জিন্নাতও হাসলো। জিন্নাত উপলব্ধি করতে পারলো এই হাসির মানে। সে বুঝে নিলো। এটা অন্তরের অন্তস্তল থেকে প্রগলিত।

_______________

রাজকন্যা তার ফুপুআম্মা, চাচীআম্মা আর জিন্নাতকে নিয়ে তার আম্মাজানের কক্ষে প্রবেশ করলো। জিন্নাত অবশ্য অদৃশ্য। তার উপস্থিতি রাজকন্যা ছাড়া আর কারোর বুঝতে পারার ক্ষমতা নেই। রানীমা শয্যায় আছেন। বরাবের মতোই আনমনে,চিন্তাহীন মনে শুয়ে আছেন তিনি। মুখে কোনো কথা নেই,কোনো হাসি নেই,কান্না নেই। তিনি বাহ্যিক কোনো কথা,আলোচনা শুনতে পান কি না সেটা নিয়েও ব্যপক সন্দেহ আছে। রাজকন্যা বসলো তার পায়ের কাছে। ডাকল কোমল গলায়। কাল তার বিবাহ্, অথচ এখনও তার আম্মাজান নির্বিকার! এই ঘটনা তাকে বড আঘাত করছে। তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। এমন তো ঘটার কথা ছিলো না কোনোদিন। তার জীবনটা তো অন্যরকম হওয়ার কথা ছিলো। অন্য রঙে,অন্যভাবে সাজ্জিত হওয়ার কথা ছিলো। এমন তো কথা ছিলো না।

“আম্মাজান। আম্মাজান? আপনি কি শুনতে পান আমাকে?”

কোনো জবাব দেন না রানিমা। এক মনে তাকিয়ে থাকেন শূন্যে। রাজকন্যার চোখ জোড়া টলমল করে। বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার। বুক ফেটে কান্না আসছে। কিন্তু কাঁদতেও যে পারছেনা। সে কখনও কারোর সামনে কাঁদেনি। আর কাঁদবেও না। চোখের টসটসে জলখানি হাতের উল্টোপিঠে মুছে ফেললো। উঠে দাঁড়ালো আম্মাজানের কাছ থেকে। তার বসার স্থানে চাচীজান বসলেন। পাশেই বসলেন ফুপুআম্মাও। তারা নানান কথা জুড়লেন তার সঙ্গে। দাসীরা তাকে ধরে উঠে বসালো। শরীরে সরে যাওয়া কাপড় ঠিকঠাক করে দিলো। অতঃপর রাজকুমারকে নিয়ে প্রবেশ করলো আদিম আর এক অচেনা যুবক। যুবককে রাজকন্যা আগে দেখেনি। জিন্নাত কি এই যুবকের কথা বলেছিলো?

রানীমার সামনে দাঁড়িয়ে নতশির করে সালাম দিলো রাজকুমার। অতঃপর কদমবুসি করলো। ফুপুআম্মা রানীমাকে ডেকে রাজকুমারের পরিচয় দিয়ে বললেন, “এই তোমার জামাতা রাজকুমার সাদ্দাত। রাজামশাইয়ের কাছের বন্ধু রাজা রাজত আকবরের একমাত্র পুত্র। দেখো তাকিয়ে। সেই ছোট্ট পুত্র বিবাহ যোগ্য হয়ে গেছে। তোমার কন্যাকে নিতে এসেছে। বিবাহের পর নিয়ে যেতে চাইলে কি বলবো? আটকাবো নাকি পাঠিয়ে দেবো গো?”

অনেক কথা বলে ফেললেন ফুপুআম্মা। তবুও কোনো হেলদোল নেই তার। রাজকন্যা আর টিকতে পারলো না এই দমবন্ধ অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে। কারোর দিকে আর না তাকিয়েই চলে এলো সে। এলো জিন্নাতও। পিছু পিছু ছুটে এলে রাজকন্যা বারন করে।

“আমাকে একটু একান্ত সময় দাও জিন্নাত! আমি একা থাকতে চাই।”

“কাল তোমার বিবাহ রাজকন্যে! এমন সুখের দিনে কি কেউ কাঁদে?”

“আমার ভাগ্যটা যে পোড়া!”

বলেই কক্ষে প্রবেশ করে দাসীদের হুকুম করলো তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে। দাসীরা মাথা নেড়ে হুকুম শিরোধার্য করলো। রাজকন্যা ভেতরে ঢুকে সোজা অলিন্দে গিয়ে দাঁড়ালো। নেত্রকোন থেকে অঝোড়ে ঝর্না বয়ে চলেছে। রাজকন্যা হাঁটু ভাজ করে বসে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে কিছুক্ষন ঐ দূর আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাখলো। অতঃপর ফোপাঁতে ফোপাঁতে মুখ ঢাকলো হাঁটুতে। আব্বাজান আজ এখানে থাকলে এতো কষ্ট তাকে কখনই পেতে হতো না। একমাত্র আব্বাজানের নিখোঁজ হওয়ার জন্যই তার জীবনের সব সুখ,সাচ্ছন্দ্য, আনন্দ ভেসে গেছে। একমাত্র যেটা সঙ্গে থেকেছে তা হলো নিঃস্বঙ্গতা,একাকিত্বতা,বুক ভরা আর্তনাদ, একরাশ অপুর্ন চাহিদা,একরাশ যন্ত্রনা আর আব্বাজানের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার তীব্র আক্ষেপ!

“রাজকন্যা কাঁদেও বুঝি?”

ঠিক সম্মুখে কারোর প্রগাঢ় উপস্থিতি আর পুরুষালি কন্ঠ পেয়ে চমকে উঠলো রাজকন্যা। তৎক্ষনাৎ মুখ উঁচিয়ে তাকাতেই সামনে দৃশ্যমান হয় রাজকুমারের শ্যামবর্ণ স্নিগ্ধ কোমল মুখ খানা। হঠাৎ রাজকন্যার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতির নদী বহমিত হয়ে যায়। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায় এই স্নিগ্ধ মুখ খানা দেখার আনন্দে। তারপর আবার হঠাৎ নিভে পড়ে। মনটা একরাশ দুঃখে আবার কাঁতরে ওঠে। তার থুঁতনি কেঁপে ওঠে। প্রশ্রয় চায় মানুষটার কাছে। খুব প্রশ্রয় চায়।

রাজকুমার রাজকন্যার মনের কথা ঠিক পড়ে ফেলে। চট করে হাত বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় রাজকন্যার সিক্ত মুখবিবর। মুছে দেয় অক্ষিপটের অঝোর ধারা। রাজকন্যা হঠাৎ চমকে ওঠে। কি মনে হতে দূরে ছিটকে পড়ে। কাঠকাঠ গলায় বলে,

“এ কি আপনি! আপনি আমার কক্ষে কি চান? কেন এসেছেন?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here