রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-৬

0
374

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৬.

বিবাহের আয়োজন হচ্ছে সুনিপুণ ভাবে। রাজকন্যাকে বিবাহের জন্য প্রস্তুত করতে দূর দূর থেকে বেশ কয়েক জন কন্যা নিয়ে আসা হয়েছে। অন্য দিকে রাজকুমারের জন্যও সব এলাহি আয়োজন। কেমন করে সাজাবে, কি পড়াবে তা নিয়ে মহা হৈচৈ। জিন্নাত বারবার এ কামরায় ঘুরছে তো ও কামরায় ঘুরছে। তার ব্যস্ততা যে সবার উর্ধ্বে। বারেবারে দৃশ্যমান হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মহানন্দে। আবার বারেবারে অদৃশ্য হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। রাজকুমারের সঙ্গে থাকা যুবকটি এই ব্যাপারটা খুব ভালো করে খবরদারি করলো। ‘একটা জ্বিন রাজপ্রাসাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে আতরের খুশবু পেয়েছে। অস্তিত্ব ধরতে পারেনি। তবে আন্দাজ করেছে। কালো একটা ছায়ায় দেখেছে বেশ কয়েকবার। খবরটা রাজকুমারের কানে এনে তুলল। সে গম্ভীর হয়ে চিন্তা করলো একবার। অতঃপর ভুলে গেলো। যুবকটি রাজকুমারের বন্ধু আরহাম। তার প্রাসাদের মহামন্ত্রীর পু্ত্র। যুদ্ধের সময় রাজামশাইয়ের সঙ্গে সেও নিজের জীবন উৎসর্গ করে তাদের প্রাসাদকে দোষমুক্ত করেছিলো। সেদিন থেকেই রাজকুমারের প্রানপ্রিয় বন্ধু হয়েছিলো আরহাম। তাদের বড় হওয়া, শিক্ষা ব্যবস্থা সবই একত্রে ছিলো।

“রাজকন্যে.. ওরা তোমাকে আমার মনের মতো সজ্জিত করিতে পারিবেনা। ওঁদের বলো তুমি নিজ হাতেই সাজবে। কারোর সাহায্য চাইনে!”

ফিসফিসিয়ে রাজকন্যা কানের কাছে এসে কথাগুলো বলল জিন্নাত। রাজকন্যা তখন অর্ধ-সজ্জিত। গায়ে তার সোনালি পাথরের কাজ করা ভারী রাজকীয় পোশাক। হাতে স্বর্নের মোটা মোটা বালা। গলায় ভারি ভারি স্বর্নের গহনা। কান তখন খালি। একজন হাতে কানের দুল নিয়ে পড়াতে নিলে তখনই জিন্নাতের গলা পায় সে। শুনে মিটমিট করে হাসে। জবাব দেয়না। কানে দুল পড়ানো হয়ে গেলে রাজকন্যা আবারও শুনতে পায়,

“হাসছো যে? ওঁদের বলো না!”

“কি বলবো জিন্নাত?”

“এটাই যে,তুমি একাই সাজতে পারবে।”

“পেছনে দেখো, চাচীজান আর ফুপুআম্মা বসে আছেন। ওনাদের কি বলি?”

জিন্নাত হঠাৎ দৃশ্যমান হয়। আরশিতে তার প্রতিচ্ছবি ভাসে। সে রাজকন্যার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রাজকন্যা হাসলো। ভ্রু উঁচিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“তুমি সাজবে না?”

“না।”

“সে কি! কেন?”

“আমার বিবাহে আমিও সাজবো।”

রাজকন্যা ফিক করে হেঁসে দিলো।

“তা সে সুদিন কবে আসবে?”

“আসবে।”

“হু। পছন্দ করলে কাউকে?”

“মনুষ্য জাতি কে?”

“হু?”

“খামোশ! এই অধম মনুষ্য জাতিকে আমি কেন বিবাহ করিবো?”

“অধম বলছো কেন?”

“অধমই তো!”

“রাজকুমারও কি অধম?”

“বটেই।”

“ছি ছি.. এ কথা কেন?”

“মনুষ্য কুলের পুরুষ জাতি সত্যিই অধম। কখনও বুঝবে।”

“তবে কি এই বিবাহ আমার জন্য অনুচিত?”

“না।”

“তুমি যে বললে?”

“ভালোবাসা, মহব্বত তারা অধিক করিতে পারে। কিন্তু দিনশেষে সবাই অধম।”

“তবে তো আমার তোমার জাতিকেই বিবাহ করা উচিৎ হইতো।”

“বটেই তো।”

“ঘোড়ার ডিম!”

জিন্নাত মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। এতক্ষণ রাজকন্যা খেয়াল করলো তাকে সাজাতে ব্যস্ত থাকা মহিলাগুলো তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। একজন তো বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে বলেই বসলো,

“ক্ষমা করবেন রাজকন্যা! আপনি কি কারোর সঙ্গে কথা বলছেন?”

রাজকন্যার হুঁশ ফিরলো। সে নড়েচড়ে উঠলো। বলল,

“না তো। তোমরা তোমাদের কাজ করো।”

সবাই আবারও হুকুম পালনে লেগে পড়লো। রাজকন্যার সাজসজ্জা সম্পূর্ণ হলো। কি চমৎকার রূপ তার। কেউই যে নজর ফেরাতে পারছেনা। মনোহরণী স্নিগ্ধ কোমল আবেশ তার। আগুনের ন্যায় দৃষ্টি। যে পুরুষ একবার এই রূপ দেখবে সে নির্ঘাত প্রান উৎসর্গ করিবে।

রাজকন্যাকে নিয়ে যাওয়া হলো বিবাহের আসরে। রাজকুমার পূর্বেই সেখানে উপস্থিত ছিলো। রাজকন্যার আগমনে সোরগোল পড়ে গেলো চারপাশে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রজারা উপস্থিত হয়েছে এই বিবাহের সাক্ষী হতে। এদের মাঝে এমনও অনেক প্রজারা আছেন যারা রাজকন্যাকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য বহুবার ছুটে এসেছেন। রাজা সিরাজ উদ্দীন যবে থেকে এই প্রাসাদ ত্যাগ করেছেন তবে থেকেই তারা মুখিয়ে ছিলো রাজকন্যাকে এই রাজ্য শাসন করতে দেখার জন্য। তবে ছোট রাজামশাই মানে চাচাজান সাফ সাফ ঘোষনা দিয়েছিলেন,” যতদিন অব্দি রাজকন্যার বিবাহ না হইবে ততদিন সে এই রাজ সিংহাসনে বসিবে না।” এবার বুঝি তাদের অপেক্ষার প্রহর কাটবে। তাদের ইচ্ছে পূরন হবে।

“বিবাহ আরম্ভ করুন।”

চাচাজানের হুকুমে কাজী যত্রতত্র বিবাহ পড়ানো শুরু করলো। রাজকুমার সেই তখন থেকেই অপলক চেয়ে আছে রাজকন্যার প্রতি। এমন ভয়ংকর রূপ সে তার ইহজীবনে কোনোদিন দেখেনি। রাজকন্যা হূরিয়া। নামের ন্যায় তাহার রূপ। চোখ চকচক করছে তার। মাথা ঘুরছে। অস্থির অস্থির হচ্ছে বুকের ভেতরে। চিনচিনে এক ব্যাথার আবির্ভাব ঘটেছে সেই প্রথম পলকেই। এই মানুষটা তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ হতে যাচ্ছে ভাবতেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে যায়। বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করে। অবিশ্বাস্য লাগে এই ঘটনা। এই পৃথিবী,এই বর্তমান। মনে হয় যে সবটাই তার দুঃস্বপ্ন। সে ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভাঙ্গলেই সবটা এক নিমিষে শেষ হয়ে যাবে।

বিবাহের কার্য সম্পন্ন হলো। সবার মোনাজাত শেষ হলেও রাজকুমার প্রায় অনেক্ষন মোনাজাত ধরে বসে রইলো। সে তার প্রভুর কাছে একান্তে কিছু চাইলো। যা সে ছাড়া আর কেউ জানলো না।

জিন্নাত হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছে। তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। রাজকন্যা একজন ভালো আর সৎ মানুষকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে পেলো। এই তো অনেক। তার জীবনের সব দুঃখ যেন এই প্রহরেই বরাবরের মতো শেষ হয়। হে প্রভু! দেখো তুমি।

ক্ষপ করে কেউ তার হাতটা চেপে ধরলো। আতংকে ছোট হয়ে গেলো সে। ভীত নয়নে সামনের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সেই যুবককে। অর্থাৎ রাজকুমারের বন্ধুুকে। কাঁপতে লাগে সে। যুবকটি কি তাকে চিনে ফেললো?

“হে রব! এ এ আমি কি দেখছি।”

আরহামের কম্পিত স্বরে কথাটা শুনতে ভ্রুকুটি করে জিন্নাত। চোখ জোড়া গোলাকার করে। আরহামের হাতের মধ্যে থেকে মোচড়াতে মোচড়াতে বলে,

“কি দেখছেন?”

“ত্ তুমি.. ত্ তুমি..”

“আমি কি?”

“পরী!”

“জি।”

“প্রাসাদে ঘুরছো কেন? মতলব কি?”

“মতলব! আমার?”

“জি। তোমার?”

“আপনারও যা আমার তা।”

“মানে?”

“হাত ছাড়ুন.. ব্যাথা পাই!”

জিন্নাতের কাতর গলায় দৃষ্টি নামায় আরহাম। জিন্নাতের নরম তুলতুলে হাতের দিকে তাকায়। যা তার হাতের জোরে রক্তবর্ণ ধারন করেছে। তবুও ছাড়লো না ওর হাত। ওর হাত টেনে কাছে নিয়ে এলো। জিন্নাত হকচকালো। আরহামের চোখের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল,

“একি! কি করছেন?”

“তুমি জ্বীন!”

“হ্ হ্যাঁ!”

“কাঁপছ যে?”

“আমাকে যেতে দিন। নয়তো আমি আপনার অনেক বড় ক্ষতি করে দিবো।”

“আচ্ছা? করো তবে!”

এই বলে আরেকটু কাছে টেনে নিলো তাকে। জিন্নাত এবার ভয় পেতে লাগলো। আজ অব্দি সে কোনো পুরুষের স্পর্শ পায়নি। যেটা আজ তার গোটা জীবনে এই প্রথমবার পেলো।

“আ্ আমি অনেক কিছু করতে পারি!”

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো জিন্নাত। আরহাম হেসে পড়লো। বলল,

“জানি তো।”

“জানেন না আপনি! জানলে আমাকে এভাবে ধরে রাখার সাহস করতেন না।”

“জানি বলেই তো ধরেছি। তুমি এতো সুন্দর কেন?”

“কারন তার মন সুন্দর!”

“কার?”

প্রশ্ন করলো আরহাম।

“যে আমাকে এই রূপ দিয়েছে।”

“কে দিয়েছে তোমায় এই মনহরণী রূপ?”

“যার কাছে আছে।”

“কো সে?”

“ছাড়ুন..”

“ছাড়বো না। আগে বলো কে দিলো তোমায় এই রূপ।”

জিন্নাত রাজকন্যার নামটা মুখে এনেও গিলে ফেললো। না, বলবে না সে। এই পুরুষের দ্বারা যদি রাজকন্যার কোনো বিপদ হয়?

“বলো?”

“ছাড়ুন আমায়!”

আরহাম জিন্নাতের হাত ছেড়ে দিলো। তার থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে বলল,

“তুমি চাইলেই অদৃশ্য হতে পারতে। তোমাকে বেঁধে রাখার ক্ষমতা আমার ছিলো না। কিন্তু তুমি অদৃশ্য হলে না। কেন বলো তো? তবে কি আমার মতো তুমিও মোহিত হয়ে পড়েছিলো?”

শেষোক্ত কথাটা বলতে বলতে শয়তানি হাসলো আরহাম। জিন্নাত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। আরহাম ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলল,

“ভষ্ম করবে নাকি?”

জিন্নাত জবাব না দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলো। আরহাম দাঁড়িয়ে থেকেই হাসলো। সত্যি ভীষণ মায়াবী রূপ জিন্নাতের। কে দিলো তাকে এই রূপ?

জিন্নাত রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে রাজকন্যার কাছে গিয়ে হাজির হলো। রাজকন্যাকে আসর থেকে নিয়ে আসা হলো তার কক্ষে। এতক্ষণ দাসীরা তার সঙ্গেই ছিলো। মাত্রই বিদায় করলো তাঁদের। জিন্নাতকে হঠাৎ এমতবস্থায় দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো। ভারী পোশাক তুলে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো তার নিকটে। বাহুতে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরালো। চিন্তিত স্বরে জানতে চাইলো,

“কি হলো তোমার? এতো ক্ষুব্ধ কেন?”

ফোঁস করে উঠলো জিন্নাত। বড় ক্রোধের সহিত নাম নিলো আরহামের। বলল,

“ঐ যুবকের এতো দুঃসাহস যে আমার পথ রোধ করে!”

অবাক হলো রাজকন্যা। কিছু একটা ভেবে বলল,

“কি হয়েছে খুলে বলো আমায়?”

“ঐ যুবক..”

“কোন যুবক?”

“রাজকুমারের বন্ধু!”

“রাজকুমারের বন্ধু? উনি.. উনি তোমায় দেখলেন কেমন করে?”

রাগে ফেটে পড়ছে জিন্নাত। তবুও খুব নিখুঁত ভাবে সবটা খুলে বলল রাজকন্যাকে। রাজকন্যা তার কথা শুনে কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বলল,

“আহা বেচারা। তোমার রূপে সে আহত হয়েছে বড়।”

“রাজকন্যে তুমি হাসছো?”

“ও জিন্নাত… আমি তো আমার হাসি থামাতেই পারছিনা। আমি বড় খুশি হয়েছি।”

“কেন? এখানে কিসের খুশি?”

“এটাই যে আমার পরেও কেউ তোমার বিমোহিত রূপের প্রশংসা করেছে। এমনকি পুরো উন্মাদের মতো আচরন করেছে। সে তোমার রূপে ধরা পড়েছে জিন্নাত।”

জিন্নাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আর কোনো জবাব না দিয়ে হুড়মুড় করে প্রস্থান করলো। এদিকে মুখ টিপে হাসলো লাগলো রাজকন্যা। এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলো রাজকুমার। ডাকলো রাজকন্যাকে,

“রাজকন্যা?”

চমকে উঠলো রাজকন্যা। পেছন মুড়ে তাকালো রাজকুমারের দিকে। তার বুকের ভেতর ধুকপুক করে উঠলো। হাসি থেমে গেলো। মুহুর্তেই এক জড়তা এসে ভর করলো তার মনে। মাথা নীচু করে একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here