#রাজকন্যা_হূরিয়া
লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৩০;
অম্বরের বক্ষজুড়ে নিশাকান্তের দম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেখা হলো না রাজকন্যার। তার দৃষ্টি শূন্যে কোথাও ভাসছে। এক ঝাঁক মন খারাপ নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সে। তার সাজানো উদ্যান তখন বেলীফুলের সতেজ সুবাসে মুখরিত। রাজকন্যার হাতে লাগানো নতুন গাছ। ফুল এসেছে সবে সবে। মিষ্টি সুঘ্রাণ। নির্মল বাতাসে ভেসে চলেছে সর্বত্র। এমন সময় একজোড়া উষ্ণ হাতের সংস্পর্শে নিজেকে আকস্মিক জড়িয়ে পড়তে দেখে চমকে উঠলো রাজকন্যা। হাতজোড়া ততক্ষণে তাকে সম্পূর্ণ নিজের দখলে করে নিয়েছে। আগন্তুকের শরীরের মিষ্টি গন্ধ পরিচিত রাজকন্যার। তাই পেছন মুড়ে তাকে না দেখেও বুঝে নিলো তার প্রিয় মানুষটা ব্যতীত অন্যকেউ নয়।
“আমার মনোহরিণীর মনটা এত্তো খারাপ কেন? এই অধম পূণরায় কি করলো?”
রাজকন্যার বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের আনাগোনা মিলল। আয়াস ততক্ষণে রাজকন্যার কাঁধের উপর থুঁতনি রেখে আরেকটু কাছে টেনে নিলো রাজকন্যাকে। রাজকন্যা প্রায় অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। ফের জবাব দিলো,
“আপনাকে যেতে হবে যে!”
“খুব শীঘ্রই ফিরবো যে। তারপর ঠিক এই ভাবেই পার করে ফেলবো জনম জনম।”
“আপনি খুশি হতো রাজকুমার?”
“না চাইতেও আপনি আমায় এই ধরণীর সমস্ত সুখ একত্র করে দিয়েছেন মনোহরিণী। এরপরও আমি খুশি হবোনা?”
“ওস্তাদজী আপনার কোনো ক্ষতি করে দেবেন নাতো?”
“ম/রে যেতে ভয় নেই। কিন্তু মরবার পূর্বে এই মিষ্টি মুখ খানা দেখবার আবদার নিশ্চিয় করবো! তারা নিশ্চয়ই আমার শেষ ইচ্ছে অপূর্ণ রাখবে না!”
রাজকন্যা ক্রোধে ফেটে পড়লো। একই সঙ্গে একঝাঁক মন খারাপ হানা দিলো মনে। এক ঝাটকায় নিজের থেকে সরিয়ে দিলো আয়াসকে। রাগে কিঞ্চিৎ কম্পন হলো তার ওষ্ঠযুগলে। তা নাড়িয়েই রাগান্বিত হয়ে বলল,
“আপনি কখনও শুধরাবেন না তাই না!”
রাজকন্যার রাগ দেখলেও মনেমনে ঠিকই বুঝে নিলো তার অপ্রকাশিত মন খারাপের ভাব। অমনি হুট করে তার মনটাও খারাপ হয়ে গেলো। ভেতরে মুচড়ে উঠলো মন খারাপ। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো রাজকন্যার সম্মুখে। দু্ই কানে হাত দিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
“ক্ষমা করবেন রাজকন্যা! আ- আমি আপনাকে আঘাত করতে চায়নি!”
আয়াসের কার্যকলাপে আকস্মিক রাজকন্যার মনের সব রাগ,মন খারাপ একই সঙ্গে পালালো। তাছাড়া ভীষণ মায়াও হলো আয়াসকে এমন করে কান ধরতে দেখে। না চাইতেও মনে মনে ভীষণ হাসলো রাজকন্যা। মুখে কিছু না বলে চুপটি করে বসলো আয়াসের সম্মুখে। ঠিক তার মতোই হাঁটু মুড়ে। হাত বাড়িয়ে আয়াসের ধরে রাখা কান থেকে হাত ছাড়িয়ে দিলো। কিঞ্চিৎ বকার সুরে বলল,
“আপনি সত্যি শোধরাবার নয়। ভীষণ নাটুকেও হয়েছেন বটে।”
আয়াস কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো রাজকন্যার পানে। যেন সে ভীষণ অবাক হয়েছে। রাজকন্যাও তাকিয়ে রইলো আয়াসের পানে। তারপর হঠাৎই দু’জন হেঁসে উঠলো একত্রে। আয়াস হাসি থামিয়ে বলল,
“আমি শুধরাতে চাইনা। এমনই নির্লজ্জ, ঠোঁট কাটা পুরুষ থাকতে চাই। যাতে আপনাকে যখন তখন লজ্জায় ফেলে বুকে জড়িয়ে রাখতে পারি৷”
“উফফ!”
“সত্যি!”
“আমি মোটেও আপনার ওসব কথায় লজ্জা পাইনা।”
“তাই?”
“একদম।”
“চেষ্টা করবো একবার?”
“রাজকন্যাকে ভয় দেখাচ্ছেন? বন্দী করবো কারাগারে।”
“আমি তো সেই কবে থেকেই বন্দী। আপনার মনের কারাগারে।”
“ধ্যাৎ!”
“এখনই লজ্জা পেয়েছেন।”
“এখন যেতে হবে। উঠুন।”
“ইচ্ছে হচ্ছে না এখন। আরেকটু থাকিনা।”
আকুল কন্ঠে আবেদন জানালো আয়াস। কথাটা বলতে বলতে রাজকন্যার হাত দুটো শক্ত করে ধরলো। রাজকন্যা স্মিত হাসলো। একহাত বাড়িয়ে আয়াসের মুখবিবর ছুঁয়ে দিয়ে ক্ষনকাল ঠিক এমনই পলকহীন চেয়ে রইলো। অতঃপর বলল,
“আর মোটে ক’টা দিন। তারপরই তো আমরা আবারও একত্রে হতে পারবো। তখন আর কোনো দুঃখ থাকবেনা। সত্যি।”
আয়াসও হাসলো। মলিন হাসি। হাত উঠিয়ে রাজকন্যার নরম হাতটা চেপে ধরলো নিজের গালে। চোখ বুঁজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিলো। ফের আনমনেই বলে উঠলো,
“আমাদের আর কখনও দেখা হবে তো মনোহরিণী? নাকি এটাই আমাদের শেষ দেখা..”
রাজকন্যা আঁতকে উঠে মুখ চাপলো আয়াসের।
“উফফ! কেন এসব কথা বলেন?”
অভিযোগের সুরে বলে রাজকন্যা। আয়াস নেত্র মেলে তাকায়। ততক্ষণে রাজকন্যার ন্যায় তার নেত্রকোনও ভিজে উঠেছে। কাঁপা কাঁপা হস্তে নিজের মুখ থেকে রাজকন্যার হাত টা নামিয়ে এনে ঢিপঢিপ করে আওয়াজ করে যাওয়া বক্ষস্থলে চেপে ধরলো। অসহায় কন্ঠে আওড়ালো,
“আমি পারবো না ঐ মানুষটাকে আঘাত করতে! শতহোক তাকে আমি নিজের প্রিয় আব্বাজানের পবিত্র স্থানে বসিয়ে ছিলাম।”
“আপনাকে পারতেই হবে। আমার জন্য..”
“আমাকে কি ক্ষমা করবেন আপনি? যদি আমি হেরেই ফিরে আসি! কিংবা না আসি?”
রাজকন্যা ক্লান্ত দৃষ্টিতে দেখে আয়াসকে। আয়াস ভেতর থেকে ভেঙে যাচ্ছে। তার সাধারণ জ্ঞান শক্তি যেন ক্রমশ লোপ পাচ্ছে! সত্যিই তো কি করে
ত/লোয়ার চালাবে ঐ মানুষটার উপর? যাই হোক না কেন, তাকে তো সে আব্বাজান ডেকেছে!
রাজকন্যা জবাব দিলো না। আর কিছু না বলে আয়াসের বুকে মাথা রাখলো। কতক্ষণ ঠিক এমন সময় পেরোলো জানেনা সে। এক পর্যায়ে আহত কন্ঠে আওড়ালো,
“আমার আব্বাজানকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন রাজকুমার। দয়াকরে;’
আয়াস থমকালো। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগলো হঠাৎ। এক যুগ! এক যুগ এই মানুষ টা তার আব্বাজানের স্নেহ থেকে বঞ্চিত! কেবল তার আব্বাজানের জন্য! না। সে ভুল। ঐ মানুষটাকে তার আব্বাজান নয়। একজন ডাকাত। যে কিনা দিনের পর দিন কেবল তার পাপের চূড়া উঁচু করে গেছে। কখনও কারোর ভালো চায়নি এমনকি ভালো করেওনি! কোনোদিনও না। তাকে মারতে কিসের আপত্তি? কোনো আপত্তি নেই। একজন বাবাকে তার সন্তান এবং স্ত্রীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া তার কর্তব্য। একজন রাজকুমার হিসেবে,একজন সন্তান হিসেবে আর সবশেষে একজন মানুষ হিসেবে। হ্যাঁ। সে পারবে।
ভাবতে ভাবতে আয়াস দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো রাজকন্যাকে। রাজকন্যার ললাটে অধর ছুঁয়ে ভালোবাসার পরশ একে কোমল স্বরে বলল,
” চিন্তা করবেন না। রাজামশাই অতি শীঘ্রই ফিরে আসবেন তার আদরের রাজকন্যার কাছে। এবং তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে। পরিশেষে তার গোটা সাম্রাজ্যের কাছে। ফিরে আসবেন। আমি কথা দিচ্ছি।”
আয়াসের কথাগুলোয় আনন্দে নেত্রকোন গলিয়ে টসটসে কয়েকোটা জলে অক্ষিকাচ ভিজে উঠলো রাজকন্যার। সে আর কিছু বলতে পারলো না। আয়াসে বক্ষস্থলে পরম স্নেহে মাথা রেখে নিশ্চুপ রইলো।
–“আম্মাজাননননন!(বিকট শব্দে)”
আকস্মিক রাজপ্রাসাদের অন্দরমহল থেকে কারোর কন্ঠে এমন বিকট আওয়াজ ভেসে আসতেই চমকে উঠলো তারা দু’জনেই। রাজকন্যা এবং আয়াস দু’জনেই আতংকিত দৃষ্টিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
“আবার কোন বিপদ হলো?”
আতংকিত কন্ঠে প্রশ্ন করে রাজকন্যা। আয়াস অন্দরমহলে দৃষ্টি রেখে বলে,
“জানিনা। চলুন দেখতে হবে।”
রাজকন্যাকে হাত ধরে উঠালো আয়াস। অতঃপর দু’জনেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো।
___
কাউকে কোত্থাও না পেয়ে রাজকন্যা এবং আয়াস ছুট্টে গেলো নিজেদের কক্ষে। শোরগোলের আওয়াজটা ওখান থেকেই ভেসে আসছে। নিজেদের কক্ষের সামনে এসে অবাক হলো দু’জনেই। কি হয়েছে তাদের কক্ষে?
“কি হয়েছে এখানে?”
রাজকন্যার গলা ভেসে আসতেই সবাই পাশে সরে গেলো। তাদের ভেতরে যাওয়ার পথ করে দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়ালো সব প্রহরী এবং দাসীরা। রাজকন্যা তাদের থেকে উত্তরের আশায় বসে রইলো না। দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। আলিয়া কাঁদছে! আদিমকেও দেখা যাচ্ছে। সে কখন ফিরে এলো? দেখা করলো না যে! আরহাম রেদোয়ান দু’জনেই আছে। চাচীজানও আছেন যে। ফুপুআম্মা, নাজিমউদ্দীন, রাজকুমার সাদ্দাত সবাই উপস্থিত। রাজকন্যা নিজের বিস্ময় চেপে রাখতে পারলোনা। এগিয়ে গেলো আলিয়ার কাছে। আলিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে তার মুখবিবর ধরে নিজের দিকে ফেরালো। স্নেহ মিশ্রিত গলায় আওড়ালো,
“কি হয়েছে আলিয়া? কাঁদছো কেন?”
আলিয়া রাজকন্যাকে দেখতেই ঝাপটে ধরলো। আর ওমনি তার কান্নার বেগ দিগুন হলো। রাজকন্যা ভড়কে গেলো। ইতিহাসে এই প্রথম ঘটলো, তার বোন তাকে পেয়ে এমন করে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে!
“আলিয়া.. আলিয়া?”
আলিয়া কাঁদতে কাঁদতে জবার আওড়াতে পারলোনা। রাজকন্যা আবারও ডাকলো। এবারও কেবল কেঁদেই গেলো আলিয়া। রাজকন্যা ওকে আর কোনো প্রশ্ন না করে চাচীজানকে প্রশ্ন করলো,
“চাচীজান.. কি হয়েছে ওর? কাঁদছে কেন এমন করে?”
চাচীজান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিন্তিত গলায় বললেন,
“আমি জানিনা রাজকন্যা। ও যে কিছুই বলছেনা।”
রাজকন্যা এক এক করে বাকিদেরও জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু সবার জবাবের ভান্ডারই শূন্য। রাজকন্যা না পেরে রাজকুমার সাদ্দাতকে প্রশ্ন করলো,
“আপনি কি কিছু জানেন রাজকুমার?”
রাজকুমার সাদ্দাত নিশ্চুপ! সে না কিংবা হ্যাঁ কোনো জবাবই দিলো না। রাজকন্যা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাজকুমার সাদ্দাতের পানে। যেন এর মাঝেই কোনো ঘাপলা আছে। হঠাৎই রেদোয়ান কিছু বলতে চাইলো,
“আমি হয়তো বুঝতে পারছি এখানে কি ঘটেছে!”
সবাই উৎসুক নয়নে তাকালো রেদোয়ানের পানে। রাজকন্যা হুকুম করলো,
“বলো?”
রাজকুমার সাদ্দাত কেমন অস্বস্তিতে পড়লো। যেন তার পর্দা ফাঁস হতে যাচ্ছে। সে যাওয়ার তাগাদায় বলে উঠলো,
“আমার একটু কাজ আছে!”
রাজকন্যা পাশ ফিরে তাকালো রাজকুমার সাদ্দাতের পানে। রাজকন্যার সন্দেহ যেন ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। রাজকুমার সাদ্দাত রাজকন্যার পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই রাজকন্যা কঠোর গলায় বলে উঠলো,
“দাঁড়ান!”
রাজকুমার সাদ্দাত থমকে দাঁড়ায়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায়। রাজকন্যা আলিয়াকে সোজা করে দাঁড় করায়। পূর্বের ন্যায় কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আলিয়া, কি হয়েছে?”
আলিয়া ফুঁপিয়ে ওঠে। ঘৃণিত দৃষ্টিতে একবার তাকায় রাজকুমার সাদ্দাতের পানে। অতঃপর আকস্মিক ক্ষেপে যায়। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
“আপা, রাজকুমার সাদ্দাত আমায় জোর করে.. আ- আমায় কলঙ্ক.. কলঙ্কিত করতে চেয়েছে!”
আলিয়ার মুখে এমন কথা শুনে স্থবির হয়ে যায় রাজকন্যা। একই সঙ্গে উপস্থিত সকলে। রাজকন্যা বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় রাজকুমার সাদ্দাতের পানে। আলিয়া আবারও বলে ওঠে,
“তোমার কক্ষে উনি এই বাজে মতলব নিয়েই আসে আপা। উনি আমায় নয় তোমায় কলঙ্কিত করতে চেয়েছে! আমি উনাকে লক্ষ করেছি সেই প্রভাত থেকে। উনি কেবল একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সুযোগ পেলেই উনি তোমার সঙ্গে এমন বাজে আচরণ করবেন। কিন্তু উনার এই কাজে আমি বাঁধা দিতে যাওয়ায় উনি আমার সঙ্গে..”
“প্রহরী!”
বজ্রকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো রাজকন্যা। রাজকুমার সাদ্দাত চমকে উঠলো। এবার বুঝি তারও কারাবাস ঘটার পালা!
#চলবে
[ গতকাল গল্প দিতে না পারায় অনেক গুলো দুঃখিত! অনেক ব্যস্ততা আর অসুস্থতা মিলিয়ে হয়ে ওঠেনি। আজও অসুস্থ আছি অনেক। তবুও লিখে ফেললাম। দোয়া করবেন। আর গঠন মূলক মন্তব্য করবেন]