#ভালবেসে_অবশেষেপর্ব: ১৫
#নুশরাত_জেরিন
আজ মিলির জন্মদিন, যদিও সে জন্মদিন পালন করা খুব একটা পছন্দ করে না। তবুও দিনটা তার অন্যান্য দিনগুলোর তুলনায় বেশ ভালো কাটে।
আজকের দিনের শুরুটাও খুব ভালভাবে হলো।
সিয়াম প্রতিদিনকার মত আজও তাকে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরে ছিলো। মিলি জোর করে হাত ছাড়িয়ে তারপর বিছানা ছেড়েছে।
নীরা আজ পায়েস রান্না করেছে, উইশও করেছে। রেনু বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেছেন। মিলি মনটা ফুরফুরে করে সিয়ামকে বলল,
“আজও অফিস যাবে?”
সিয়াম মাত্র গোছল সেরে, অফিসের ড্রেস পড়েছে। চুল তার এখনও ভেজা। ওয়ালেট, ঘড়ি কোনোটাই খুঁজে পাচ্ছে না। এই হয়েছে মহা জ্বালা, দরকারের সময় কিচ্ছু হাতের কাছে পাওয়া যায় না।
সে বলল,
“ঘড়ি কোথায়? ওয়ালেট কোথায়?”
কন্ঠে তার বিরক্তি। মিলি ঘড়ি, ওয়ালেট খুঁজে সিয়ামের হাতে তুলে দিলো। লোকটাও হয়েছে, চোখের সামনে থাকা জিনিসগুলো খুঁজতে গিয়ে পুরো ঘর লন্ডভন্ড করে ফেলে।
আবার চুলটাও ঠিকমতো মুছতে পারে না, টপটপ করে পানি যে ঝরছে সেদিকে খেয়াল নেই। সে এগিয়ে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে দিলো।
সিয়াম মাথাটা হালকা নোয়ালো। বলল,
“নীরার ডেলিভারি ডেট কবে দিয়েছে? ”
“আরও দশদিন পর।”
“সময় কত দ্রুত চলে গেলো তাই না? এই তো কদিন আগে মনে হয় তুমি এ বাড়ি এলে….”
মিলি মৃদু হাসলো। সত্যি তো সময়ের গতি কতটা দ্রুত…বলল,
“অফিস যাবে কীনা বললে না?”
“অফিস ড্রেস পড়ে অফিস না গিয়ে কোথায় যাবো?”
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল,
“কেনো? তুমি আজ যেতে নিষেধ করছো? কোনো দরকার?”
মিলি অভিমানে মুখ ফোলালো। তার জন্মদিনের কথাটা লোকটা বেমালুম ভুলে গেলো? একবার উইশ করতে কী হতো! সে বলল,
“উহু, এমনি বললাম।”
“তবে গাল ফুললো কেনো?”
মিলি সিয়ামের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে রুম ছেড়ে বেরুতে চাইলো। সিয়াম একহাতে তাকে আটকালো। কাছে টেনে কোমড় চেপে কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
“না বললে আমি বুঝবো কী করে?”
“কী বলবো?”
মিলির অভিমানী কন্ঠ শুনে সিয়াম একচোট হাসলো। স্পর্শ আরেকটু গভীর করতে দরজায় কড়া পড়লো। নীরা ডাকছে,
“মিলি!”
মিলি চটজলদি সরে দাড়িয়ে বলল,
“উল্টো পাল্টা কাজ না করে অফিস যাও।”
সিয়াম হেসে রুম ছেড়ে বেরুলো। যাবার আগে মিলির কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়াতে ভুললো না।
….
মিলি শপিং সেড়ে বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যার একটু আগে। নীরার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে ইচ্ছে হয়েছিলো তাছাড়া নতুন সদস্যটার জন্য খেলনাও কেনা হয়নি। যদিও তার আসতে দিন কয়েক দেরি হবে তবুও আগেভাগে কিনতে ইচ্ছে হলো।
বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে, টিপটিপ বৃষ্টির ফোটা পড়ছে।
মিলি চটজলদি মাথা মুছলো, মাথা ব্যথা করছে। বৃষ্টির ফোটা মাথায় পড়েছে বোধহয়, বৃষ্টি তার সহ্য হয় না। এর আগে সিয়ামের সাথে সেচ্ছায় বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তার। আজও সেরকম হবে হয়তো!
শপিং শেষে বেড়োনোর পথে মাধ্যমিকে পড়াকালীন এক বান্ধুবির সাথে দেখা হয়েছিল, সেই টেনেটুনে কাছের এক রেস্টুরেন্টে নিলো। মিলিও আর বারণ করতে পারেনি, অনেক পুরোনো বন্ধু তার। একসময় একসাথে কত দুষ্টুমি করেছে। কাঠের বেন্ঞ্চে চুইংগাম লাগানো থেকে শুরু করে স্যারের পিছে কাগজের প্লেন ছুড়ে মারা, কী করেনি তারা।
মিলি একহাত মাথায় চেপে ধরলো। নীরা কাছেই ছিলো। মিলিকে জাপটে ধরে বলল,
“কী হয়েছে বোন, পরে যাচ্ছিলি তো!”
“শরীরটা খুব খারাপ লাগছে আপা।”
তার কন্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে, শরীরও টলছে। হাত ভর্তি শপিংয়ের ব্যাগ ততক্ষণে নিচে পড়ে গেছে।
আওয়াজ শুনে রেনু বেগম ছুটে এলেন।
তার কন্ঠে উৎকন্ঠা,
“কী হয়েছে নীরা?”
নীরা কথা বলতে পারলো না। তার একটা মাত্র বোন। হঠাৎ কী হলো তার! ভালো মতো হেসে খেলে শপিং করতে গেলো।
….
সিয়ামের আজ মন মেজাজ দুটোই খারাপ। অফিসে ঝামেলা হয়েছে। যার সাথে শেয়ারে কোম্পানিটা চালু করেছিলো সেই লোকটা মহা ত্যাদড়। কথায় কথায় নিজের হুকুম চালায়, অন্যান্য কর্মচারীদের জ্বালিয়ে মারে৷ এমন লোকের সাথে হাত মেলানোটাই কাল হয়েছে সিয়ামের। তারচেয়ে তার বন্ধু রায়হান হাজার গুনে ভালো ছিলো। কেনো যে তখন কথাটা মাথায় আসেনি।
তারউপর অফিস থেকে বেড়িয়ে হলো আরেক ঝামেলা। মাঝ রাস্তায় আরিয়া এসে এক প্রকার জাপটে ধরলো। মেয়েটাও হয়েছে নির্লজ্জ। এমন ব্যবহার দেখে সিয়াম মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি। ইচ্ছে মতো ধমকেছে৷ যদিও আরিয়ার কান্না এবং আকুতি শুনে তার কথা শুনতে রেস্টুরেন্টেও বসেছিলো।
তবে এতটুকুই। আরিয়ার আর কোনো কথা রাখা সম্ভব নয় তার পক্ষে। কী করেই বা রাখবে? মেয়েটা আবার ফিরে আসতে চায়, সুযোগ চায়। চাইলেই কী সম্ভব? যে মেয়ে স্বামীকে ধোকা দিয়ে তারই কাছের বন্ধুর কাছে চলে গিয়েছিল তাকে ফিরিয়ে নেওয়া যায়? ভাবাও তো যায় না। তাছাড়া এখন সিয়ামের জীবনে মিলি আছে।
আরিয়া তার জীবনটা এলোমেলো করেছিলো, মিলি গুছিয়েছে। মিলি তার জিবনে না এলেও সে কখনই আরিয়াকে ফিরিয়ে নিতো না।
বিশ্বাসঘাতকদের আবারও বিশ্বাস করা যায় না!
আরিয়া হয়ত জানতো না সিয়ামের পুনরায় বিয়ে করার কথা। শুনতেই সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো। মোহে পড়ে সে যে ভুল করেছে তা শোধরাবার সুযোগ নেই। ইশতিয়াক বিদেশে থেকেছে বহুবছর। এক মেয়েকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে ধরা তার কাছে কোনো ব্যপার না। আসলে একটু আবেগী হয়েই আরিয়ার প্রতি ঝুকেছিল সে, তবে সে আবেগ সময়ের সাথে সাথে ফুরিয়েও গেছে। সেইজন্য আরিয়াকে ছুড়ে ফেলতে দিত্বীয় বার ভাবেনি।
সিয়াম বাড়ি ফিরে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলো। আরিয়াকে একসময় ভালোবেসেছিল সে, তার এমন পরিণতি মনে মনে প্রার্থনা করলেও এখন মানতে কষ্ট হচ্ছে। আর ইশতিয়াক? প্রকৃতি তাকেও বুঝি কর্মের ফল ঠিক ফিরিয়ে দেবে… আজ নাহয় কাল…
মিলির দেখা না পেয়ে সিয়াম একবার ডেকে উঠলো। তবুও মিলির কোনো খোজ নেই।
সিয়াম রুম থেকে বাইরে বের হয়ে মায়ের রুমে উঁকি দিলো। রেনু বেগম মাত্র নামাজ সেরে উঠেছেন। মুখটা তার থমথমে।
সিয়াম ডাকলো,
“মা!”
“কি?”
রেনু বেগমের গম্ভীর কন্ঠ শুনে সিয়াম একটু ভড়কালো। বাড়িতে কী কিছু হয়েছে? এমন চুপচাপ কেনো চারিপাশ? নীরার কিছু হলো নাতো, মেয়েটার কয়েকটাদিন বাদেই তো ডেলিভারি ডেট।
সে বলল,
“নীরা কোথায় মা? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“সে ঘরে শুয়ে আছে!”
“আর মিলি?”
রেনু বেগম ছেলের মুখের দিকে ফিরলেন। ছেলেটার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ।
তিনি বললেন,
“তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? অফিস ছুটি হয়েছো তো অনেক আগে!”
সিয়াম চমকে তাকালো। হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছে কেনো? তবে কী আরিয়ার সাথে কথা বলার বিষয়টা মিলি জেনে গেছে, এজন্য রেগে সামনে আসছে না?
সে বলল,
“মিলি কোথায় মা?”
“বাড়িতে।”
“কোথায়? আমি তো কোথাও খুঁজে পেলাম না।”
“তার নিজের বাড়িতে।”
সিয়ামের বুকটা ধক করে উঠলো। তার আশঙ্কাই কী তবে সত্যি হলো! মিলি তার আসার অপেক্ষা পর্যন্ত করলো না? এতটা অবিশ্বাস? তবে যে সে বলেছিল, সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে, বিশ্বাস, সম্মান, ভালবাসা!
এত সহজে ভিত্তিটাকে নড়বড়ে করে দিতে পারলো সে! সিয়ামের কন্ঠ আটকে আসতে চাইলল। তবু কোনো মতে কাপাঁ গলায় বলল,
“কেনো গেছে হঠাৎ? ”
“নিজ দায়িত্বে জেনে নাও।”
সিয়াম ধীরপায়ে নিজ ঘরে এসে দরজা আটকালো। যাবে না সে মিলির কাছে, আর কখনই যাবে না। যে তাকে বিন্দু মাত্র বিশ্বাস করে না তার কাছে কেনো যাবে?
,
চলবে….